মহাবিশ্বের কবে হয়েছিল শুরু! কবে মানুষ এসেছিল পৃথিবীতে!
কবে মানুষ কথা বলতে শিখেছিল!!
অনন্তকাল ধরে জ্ঞানীদের অন্বেষণে… এই প্রশ্নগুলো।
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর অনুসন্ধান করতে গিয়ে সভ্যতার আরেকরকম বিকাশ।
জন্মের পর শিশুর যখন বোধ জন্মায়, প্রথম প্রশ্নটিই থাকে তার “এলাম আমি কোথা থেকে”।
তার আরও প্রশ্ন থাকে— আমার নাম এটা কেন? আমার চারপাশে যারা তারা কেন?
এটা এরকম না হয়ে অন্যরকম হলে মন্দ কী হত!!
এই প্রশ্নগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাগতিক আরও প্রশ্নাদির চাপে ক্রমশঃ মিইয়ে যায়।
আমরা যে কথা বলি— সেগুলো কি আদিতে এমনই ছিল?
মানুষ কী ভাবে কথা বলতে শিখল?
প্রকৃতিতে থাকা বিভিন্ন সত্তার নিজস্ব প্রকাশভঙ্গী রয়েছে, সেটা তার কথা, তার ভাষা।
জলের বয়ে যাওয়ার শব্দ আছে, বাতাস বয়ে যাওয়ার শব্দ আছে,
মেঘের শব্দ আছে— এই শব্দগুলি তাদের উপস্থিতি জানান দেয়, আমরা বুঝতে পারি শব্দের মাধ্যমে এগুলোর উপস্থিতি যখন শব্দগুলো শুনতে পাই।
মানুষ আদিতে কথা বলতে পারত না।
সে দেখল প্রকৃতিতে শব্দ সৃষ্টি হয়, বিভিন্ন প্রাণী শব্দ করে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে।
মানুষ তা অনুকরণ করতে লাগল।
মানুষের কিছু অস্ফুট ধ্বনি আছে, যা আসলে ব্যক্ত ও অব্যক্ত এর মাঝামাঝি।
এগুলো নির্দিষ্ট কোনও অর্থ প্রকাশ করে না, শরীরের অঙ্গভঙ্গি দিয়ে সেই ধ্বনি ব্যক্ত করতে হয়।
মানুষ অঙ্গভঙ্গি করে নিজের সেই অর্দ্ধব্যক্ত ধ্বনিকে, পাশাপাশি প্রকৃতি থেকে শোনা বিভিন্ন শব্দ, ধ্বনিকে প্রকাশ করতে শিখল।
প্রকৃতির ধ্বনিগুলো সুরেলা,
বিভিন্ন জীব থেকে উৎসারিত ধ্বনিগুলিও সুরেলা-ই।
তাই একটা সময় যখন মানুষ ধীরে ধীরে কথা বলতে শিখল, সেও সুর করে করে কথা বলাই শিখল।
আরও অনেক অনেক পরে সুর করে বলা কথাগুলো সে ছন্দাকারেই বলত।
কাজেই ভাষা সৃষ্টির সঙ্গে সুর আর ছন্দের ওতোপ্রোত সম্পর্ক আছে।
মানুষের বিকাশের ইতিহাসের সাথে সঙ্গীতের স্বর বা সুর সপ্তকের রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক।
সাতটি সুরে বাঁধা স্বরসপ্তকে রয়েছে মানুষের তৎকালীন জীবনের ইতিহাস।
যা আমাদের খুঁজে নিতে হবে।
আমাদের আজকের লেখার প্রতিপাদ্য সঙ্গীতের সেই সাতটি স্বর বা সুর— সা রে গা মা পা ধা নি।
জেনে নিই এগুলোর ইতিহাস।
সা—
সুর বলি আর স্বর বলি মোট হচ্ছে সাতটা, যা নিয়ে হয় সুরসপ্তক বা স্বরসপ্তক।
শুদ্ধ সাতটি স্বর নিয়েই হয় এই সপ্তক।
সঙ্গীতশাস্ত্রে যা নিম্নরূপে পরিচিত
সা— ষড়জ
রে— ঋষভ
গা— গান্ধার
মা— মধ্যম
পা— পঞ্চম
ধা— ধৈবত
নি— নিষাদ।
কল্কিপুরাণ অনুযায়ী ধর্ম্মের সাতটি অশ্ব আছে যেগুলোর নাম সুর বা স্বরসপ্তক অনুযায়ী
ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত, নিষাদ।
এই যে ধর্ম্মের কথা বলা হয়েছে— তা হল সামাজিক নিয়মকানুনের ধর্ম্ম, আইনশৃঙ্খলার ধর্ম্ম।
আইন এর একটি অর্থ কানুন যা ফারসী শব্দ, যার একটি অর্থ বীণা-জাতীয় সুরযন্ত্র।
সুর বা স্বর সপ্তকে সা থেকে নি পর্যন্ত যেতে তিনটি স্তর পেরোতে হয়, এগুলি হল ‘উদারা, মুদারা, তারা’।
উদারা-তে সুর বা স্বরের প্রক্ষেপণ নীচু থাকে এবং নি-তে সুরের প্রক্ষেপণ উঁচু বা চড়া থাকে।
সুর আমাদের এমন সন্ধান দেয় যেখানে আমরা সাতটি বিভিন্ন সত্তার সমন্বয়ে তৈরি প্রাচীন সমাজব্যাবস্থার একটি ধারণা পাই।
যেই সমাজ ব্যাবস্থা ষড়জ— থেকে শুরু হয়।
সা— ছয়ের শুরু যে করে, ছয়ের সৃষ্টিকর্তা, যা থেকে সৃষ্টির শুরু।
সা— ষড়জ, যার সাথে সংশ্লিষ্ট সত্তাটির নাম ময়ুর, সামাজিক ভাবে এই সত্তাটি সুসজ্জিত সেনাবাহিনীরূপে পরিচিত।
ষড়জ—
ষড় (ছয়) + জ
হিন্দীতে খড়জ্, খরজ, ষ = খ
ষ
ষড়জ— বিশেষ্য।
কণ্ঠ, তালু, জিহ্বা, দন্ত, নাসা এবং উরঃস্থল এই ছয় হতে জন্মে বলিয়া এই নাম। প্রয়োগ “ষড়্জং রৌতি ময়ূরঃ”
কণ্ঠস্বরবিশেষ। ইহা ময়ূরকণ্ঠধ্বনি সদৃশ সঙ্গীতের আদ্যস্বর; ইহার সঙ্কেত “সা”
তাহলে সা হল ময়ূর
ময়ূর— মী (হিংসা) + ঊর
ময়ূর গতিশীল সীমায়িতকে নিষেধ করে বা ধনবানদের ভক্ষণ করে যে, সর্পকে হিংসা করে যে।
প্রাচীন ভারতে প্রথম যে ভাড়াটে সেনাবাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল তার বাহন ছিল ময়ূর।
যৌথসমাজে যারাই প্রচুর ধনসম্পদ সম্পদের পাহাড় গড়েছিল, এই সেনাবাহিনী তাদের ধ্বংস করেছিল।
কিন্তু তাদের অনেক সময় কাজ থাকত না, নিতান্তই ফুলবাবুর মত ঘুরেও বেড়াত, তখন তাদের কাঁচা-কার্ত্তিক বলা হত।
এই বাহিনী যেহেতু ভাড়াটে ছিল, তাই তাদের কাজ ছিল নির্দ্দেশিত। কাজেই তাদের গলার স্বর ছিল নীচু। তাই সা-এর সুর-ও নীচু বা উদারা থেকে শুরু হয়।
রে—
রে— ঋষভ। সুর বা স্বর সপ্তকের দ্বিতীয় সুর বা স্বর। বৃষ, ষাঁড়।
ঋষভ— √ঋষ + অভ, ঋষ্ এর ভরণ বা ভক্ষণ করে যে।
ঋ কে দিশাগ্রস্ত করা হয় যাহাতে— ঋষ।
ষাঁড় দু’রকমের। যে ষাঁড় শক্তিধর, মালিকহীন, ঘুরে বেড়ায় সে হল এক প্রকার, তাকে বলে ঋষভ।
যে ষাঁড় প্রায় বলদ এবং চাষীর গোয়ালে বাঁধা থাকে সে হল আরেকপ্রকার ষাঁড়— বলতে গেলে তার তেমন কোন কাজ থাকে না, এই প্রকার ষাঁড় হল বৃষভ।
ষাঁড় বলতে যেগুলো চরে বেড়ায়, শক্তিধর সেগুলো হল একপ্রকার ঋষভ। আরেক প্রকার ষাঁড় যা ছিল সামাজিক ষাঁড় বা ঋষভ।
প্রাচীন ভারতে সামাজিক ঋষভেরা উৎপাদনের মূল শক্তি ছিলেন।
তারা সমাজে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বিষয়ে নতুন নতুন কর্ম্মকৌশল, প্রযুক্তির খবর দিতেন।
তারা ছিলেন আবিষ্কারক, উদ্ভাবক, সৃজনশীল সত্তা।
যেহেতু তারা ঘুরে ঘুরে জ্ঞান বিতরণের কাজটি ভাল করতেন, তারা সৃজনশীল হলেও নিজেরা অলসতাহেতু কিছু করতেন না।
মালিকানাহীন ষাঁড় যেমন ঘুরে বেড়ায় তারাও তেমনি ছিলেন কাজেই পরবর্ত্তীতে সামাজিক ঋষভেরা কেবল বল দানকারী বলদে বা বৃষভে পরিণত হন।
গা—
গান্ধার: গান ধারণ রীতি যাহার
দেশবিশেষ, কান্ধার, গান্ধারবাসী, সিন্দুর, স্বরগ্রামের তৃতীয় স্বর (ইহা ছাগরব তুল্য)
গন্ধ নাসিকা ও কর্ণ চালিত করিয়া নির্গত হয়, সেইজন্য গান্ধার বলা হয়। (ব.শ)
গান্ধারদেশটি ছিল সিন্ধুনদের পশ্চিম তীর হতে আফগানিস্তানের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে, বর্ত্তমানে কান্দাহার।
গান্ধার এর বাংলা অর্থ—
gāndhāra বি. ১ কান্দাহারের প্রাচীন নাম; ২ (সংগীতে) স্বরগ্রামের তৃতীয় স্বর, গা; ৩ সংগীতের রাগবিশেষ।
বিণ. গান্ধারদেশীয়; গান্ধারদেশবাসী।
গান্ধারী বি. (স্ত্রী.) গান্ধার রাজকন্যা, দুর্য্যোধনের জননী। — সূত্র: ইন্টারনেট
স্বরসপ্তকের তৃতীয় স্বর। সামগানে এর নাম ছিল দ্বিতীয়।
লৌকিক নাম গান্ধার। ছাগল-এর তুল্য ধ্বনি থেকে এই স্বরের নাম গ্রহণ করা হয়েছিল। এই স্বরটির অবস্থান তিনটি শ্রুতিতে।
প্রাচীন ভারতীয় সঙ্গীতশাস্ত্র মতে গান্ধার দুই শ্রুতিতে অধিষ্ঠিত। এই দুইটি শ্রুতি হল রৌদ্রী ও ক্রোধা।
যখন মধ্যমের দুই শ্রুতি গ্রহণ করে গান্ধার চার শ্রুতিযুক্ত হয়।
তখন এই চারটি শ্রুতি হয় রৌদ্রী, ক্রোধা, বজ্রিকা ও প্রাসরিণী। এই অবস্থায় প্রসারিণীতে গান্ধার অবস্থান করে এবং সঙ্গীতরত্নকারের মতে তখন তাকে অন্তরগান্ধার বলা হয়।
এর ফলে মধ্যম দুই শ্রুতির অধিকার পায়।
বর্ত্তমানে অন্তরগান্ধার-কেই শুদ্ধ গান্ধার বলা হয়। — সূত্র: উইকিপিডিয়া
অন্তত চারটি লোকে গান্ধারকে চিহ্নিত করেছিলেন আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা।
— ভৌগলিক : গান্ধার— সিন্দুর অববাহিকা অঞ্চল যা বর্ত্তমানে কান্দাহার।
— বিশেষ রকমের দানকারী জ্ঞানধারা ও পণ্যধারা : উভয় ধারাই একসময় দানকারী থেকে বিনিময়ের পরিবর্ত্তে দানকারী হয়ে গান্ধার হয়ে যায়।
— সুর/স্বর সপ্তকের তৃতীয় স্তর যা কিনা ছাগরবতুল্য। যে ছাগ দক্ষতার ধারক বাহক।
— পণ্যের যে প্রকাশ যা নাক ও দো-কান ব্যবহার করে করতে হয়।
গান্ধার ছাগরব তুল্য কারণ পণ্য উৎপাদনকারী যে দক্ষ তার সৃজনশীলতা নাই, জনন নাই। সে কেবল পূর্ব্বে অর্জ্জিত জ্ঞানের পুনরুৎপাদন করতে পারে, নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না।
ছাগ— আচ্ছাদিত গমন যাহার।
যে ছাগ দৃশ্য তা বনে চরে খায় বা মানুষ পালন করে।
আর অদৃশ্য ছাগ হল বিশেষ জ্ঞানী যে তার অর্জ্জিত বিশেষ বিদ্যাটি ব্যবহার করে রুজি-রোজগার করে জীবন চালায়। দক্ষতার আচ্ছাদনে তার জীবন চলে। এই ছাগ হল অধঃপতিত শিব।
মা—
সপ্তস্বর/সপ্তসুরের পঞ্চম স্বর/সুরটি হল মা যাকে মধ্যম নামে অভিহিত করা হয়।
মধ্যম = মধ্য সীমায়িত থাকে যাহাতে।
যাহা গুণে বা জাতিধর্ম্মে উৎকৃষ্ট-অপকৃষ্টের মধ্যবর্ত্তী। (ব.শ)
মধ্য = মধ থাকে যাহাতে।
মধ্য— অন্তরস্থ, হারযষ্টিমধ্যগ্রথিত, অপক্ষপাত, উদাসীন, ন্যায্য, উৎকর্ষ-অপকর্ষহীন, নাতিহ্রস্ব-নাতিদীর্ঘ, পূর্ব্বাপরের অন্তরাল, কেন্দ্রস্থল, অন্তর, দেহমধ্যভাগ, অভ্যন্তর, ভিতর ইত্যাদি।
মধ— সীমায়িতের ধারক।
যে কোনও বিষয়ের কেন্দ্র হল তার মধ্য, কারণ সেখানে বিষয়টির সার বা সর্ব্বোচ্চ সীমায়িত রূপ (ম) ধরা/ধারক (ধ) থাকে বা থাকতে পারে।
সেই কারণেই মধ থাকে যাহাতে তাই মধ্য।
মধ এর আধাররূপ হল মধ্যম।
মধ্য শব্দের উত্তরাধিকার রয়েছে ইংরেজি medium, middle শব্দে।
মা বা মধ্যম স্বরটির প্রচলিত অর্থ বকের ডাক। সংশ্লিষ্ট সত্তা— ক্রৌঞ্চ।
এই সত্তা কর্ম্মফল চয়ন করে। যাকে ধনলোভী জ্ঞানী/ব্রাহ্মণ বা বকধার্ম্মিক নামেও অভিহিত করা হয়।
ক্রৌঞ্চ = কর্ম্মফল (উৎপাদনের অভিজ্ঞতা/উৎপন্নের মূল্য) চয়ন করে যে সে হল ক্রুঞ্চ, ক্রুঞ্চ হইতে জাত ক্রৌঞ্চ।
ক্রৌঞ্চপর্ব্বত হল হিমালয় পর্ব্বতের পুত্র বা পৌত্র, সেখানে ক্রুঞ্চ পক্ষীরা থাকত।
বৈদিক সমাজব্যবস্থায় ক্রৌঞ্চ সমাজ ব্যবস্থা নামে একটি ব্যবস্থার জন্ম হয় যেখানে বকধার্ম্মিকেরা থাকত।
তারা মাঝামাঝি অবস্থানে বা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকত এবং উৎপাদনের অভিজ্ঞতা ও উৎপন্নের মূল্য চয়ন করত।
মধ্যে অবস্থান করে সব সুবিধা ভোগ করত বলে প্রাচীন শব্দজ্ঞানীরা সপ্তস্বরে এই ক্রৌঞ্চ সমাজ ব্যবস্থার এই শ্রেণিটির অবস্থান মধ্যে রেখেছিলেন।
পা—
সপ্তস্বর/সুর-এর পঞ্চম স্বর/সুর হল পা বা পঞ্চম।
পঞ্চম হল কোকিলের ডাক। কোকিল খুব মিষ্ট স্বরে গায়। সপ্তস্বরের পঞ্চম স্বরটিও মিষ্টি।
পঞ্চম এর প্রচলিত অর্থ কোকিলের ডাক।
কোকিলের আরেক নাম পিক।
যে সত্তা সৃষ্টি করে কিন্তু পূর্ণতা দান করে না সেই সত্তাটিই হল পিক।
সে ডিম পারে কিন্তু বাচ্চা ফুটায় না।
পিক-এর বৈশিষ্ট্য কাঁচামাল প্রস্তুতকারীর মত।
কাঁচামাল যারা জোগান দেয় তারা অভিষ্ট বস্তুটি তৈরি করতে পারে না।
কাজেই তার পূর্ণাঙ্গতা নেই।
পিক = পি (পান-করি, পান-করি) করে যে।
পিক— কোকিল, পানের রস।
ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যবস্থার ফল যখন ফলে পিক তখন তার গৌরব গায়।
পিক সৃষ্টির পূর্ণাঙ্গতা দেয় না, তার কিছু অংশ পানের পিক-এর মতই ফেলে দেয়।
আমাদের প্রাচীন শব্দজ্ঞানীরা সমাজে থাকা পিক-দের বৈশিষ্ট্য সপ্তস্বরের পঞ্চম স্বরে স্থান দিয়েছেন।
ধা—
সপ্তস্বর/সুর এর ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে ধা যার স্বরূপ হল ‘ধৈবত’।
প্রচলিত অর্থে ঘোড়ার ডাক ধৈবত। ধৈবত যে সত্তার অধিকারী তা হল অশ্ব।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জ্ঞানসার যারা বহন করেন তারাই হলেন অশ্ব।
সমাজের নানাবিধ বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ এবং কূটনৈতিকগণ এই সত্তার গুণসম্পন্ন।
অশ্ব = অশ্ বহন করে যে। ঘোটক।
এই অশ্ হল ‘অস্তিত্বের শক্তিবিচ্ছুরণ’ বা ব্যাপ্তকরণ শক্তি।
অশ্ হল ash বা ছাই। সর্ব্বজ্ঞানকর্ম্মফলের সার যা শিব মাখেন।
অশ্বেরা এ ছাই মাখে না, বহন করে।
সমাজে যারা বিশেষজ্ঞ তারা সকলেই অশ্ব।
আবার সর্ব্ব প্রকারের ঘটনা ঘটাতে পারেন বলে তারা ঘোটক পদবাচ্য।
এ’কালের ভাষায় সেকালের অশ্ব হলেন এক্সিকিউটিভ।
শব্দজ্ঞানীগণ এভাবেই সপ্তস্বরের ষষ্ঠ স্বর ধা-কে সপ্তকের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।
নি—
সপ্তস্বর/সুরের সপ্তম স্বর/সুর হল নি যার স্বরূপ প্রাচীন শব্দজ্ঞানীরা হাতির ডাকে দেখতে পেয়েছিলেন।
নিষাদ সত্তা হল হস্তী। হস্তীর থাকে বিশাল ও নিপুণ হাত, যার দ্বারা সে সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। সমাজের বিভিন্ন গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গ তাদের হস্ত দ্বারা নিয়ন্ত্রণের কাজটি করেন এবং এটিই তাদের বৈশিষ্ট্য।
নিষাদ— নিঃসারিত সদ (পণ্য) দেয় যে।
নিষাদ— পাপের আধার যে (ব.শ)।
ব্যাধ, কিরাত, চৌর্য্যবৃত্তি-দস্যুবৃত্তিসূচক কটুভাষী মৎস্যলোভী ব্রাহ্মণ।
অনার্য্য জাতি।
প্রাচীন ভারতে যৌথসমাজে বেণিয়ার আদিপুরুষ বেণ— এর সান্নিধ্যে এই নিষাদ এর জন্ম হয়,
এরা হল আদি ফেরিওয়ালা।
সেকালে অধিক উৎপন্ন হয়ে গেলে সেই উৎপন্নকে পাপ বলা হত,
সেজন্য আদি দোকানদারকে বলা হত পাপের আধার।
এই দোকানদারেরা বিভিন্ন ভাবে (হস্তের সাহায্যে) সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করত,
তাদের সেই নিয়ন্ত্রণের যে আওয়াজটা ছিল তাকে শব্দজ্ঞানীরা হাতির ডাকের সাথে তুলনা করে সপ্তস্বর/সুর-এর সপ্তম স্থানে জায়গা দিয়েছিলেন।
শেষের গীতিকা—
এই বিশ্বজগতের যাবতীয় বস্তুর প্রকাশেচ্ছা আছে, সবার কথা আছে, সেই কথা প্রকাশে আছে নানা ছল।
গাছের যে কথা আছে তা পাতার নড়া দেখে বুঝতে পারা যায়,
কারও দ্বারা প্রভাবিত হলে কথার জন্ম হয়। বাতাসে গাছের পাতাদের কথার জন্ম দেয়,
সেই কথা ঝড়ো হাওয়ায় একরকম, শান্ত হাওয়ায় আরেকরকম। এই কথার সুর আছে, প্রকৃতির প্রতিটি প্রকাশে থাকে সুর।…
আদিম মানুষ সেই সুর ধরতে পেরেছিল, সেই সুরের ধারা ক্রমশঃ বিকশিত হয়েছে।
আমরা দেখি স্বজন বিয়োগে গ্রামের মহিলারা সুর করে কাঁদে,
দৈহিক পরিশ্রমের কাজে লোকজন সুর করে গান করে, নয়তো ছন্দের তালে ছড়া কাটে।
শিশুদের মায়েরা ঘুমপাড়ানি গান শোনান,
ছাত্ররা সুর করে পড়ে,
ঝগড়া লাগলে গ্রামের লোকজন সুরে কথা বলে সাথে হাত পা নেড়ে
নৃত্যের তালে তালে দেহভঙ্গী কারে— সুরের রাজ্যে অবচেতন ভাবেই বিচরণ মানুষের।
আদিম মানুষেরা যে ধ্বনিগুলো শুনতে পেত, তা উচ্চারণ করতে পারত না, তবু সে ধ্বনিগুলোই অনুকরণ করে অঙ্গভঙ্গী সহ যতটুকু সম্ভব সুর দিয়ে মনের আনন্দ, দুঃখ, রাগ, গোপনীয় বার্ত্তা প্রকাশ করত।
মন্দ্র (নীচু), মধ্য (মধ্য) ও তার (উচ্চ) ধ্বনির সাহায্যে তাদের এই প্রকাশ ছিল।
তারা তাদের জীবিকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করত,
সেই পরিশ্রম লাঘব করার চেষ্টা করত নৃত্যগীতের মাধ্যমে, যদিও তার বেশিটাই অব্যক্ত ছিল। তাদের সঙ্গীতে নান্দনিকতার চেয়ে জৈবিক প্রয়োজনটাই বেশি ছিল।
তাদের মাথা গুজার ঠাঁই ছিল না বটে, সুরের কাছে বাঁধা পড়েছিল;
প্রকৃতিগতভাবেই মানুষের মনের অনেক ভাব স্বয়ংক্রিয় ধ্বনির মাধ্যমেই অজান্তে নির্গত হয়।
ভারতীয় সঙ্গীতের ইতিহাসে প্রাচীন যুগ হল খ্রিষ্টপূর্ব্ব ৬০০০-এর পূর্ব্ব থেকে ১২০০ সাল।
মধ্যযুগ ১২০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৭৫৭ সাল। আধুনিক যুগ ১৭৫৭ থেকে বর্ত্তমান পর্য্যন্ত। বৈদিক যুগে বৈদিক মন্ত্রগুলিই গান বোঝাত। ব্রাহ্মণ পুরোহিতরা সুরে মন্ত্র পাঠ করত।
গ্রামগেয়, অরণ্যগেয়, ঊহ ও উহ্য— এই চার প্রকার গান নিয়ে সামবেদের গানগুলো রচিত।
সাম বলতে বৈদিক মন্ত্র বা ঋকগুলিকেই বোঝানো হত।
আদিম মানুষ জৈবিক প্রয়োজনে যে গান করত, সামাজিক বিবর্ত্তনের মাধ্যমে শ্রমবিভাজন,
গোষ্ঠীভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার, উৎপাদন ও বন্টন ব্যবস্থা সবকিছুই সেই গানে প্রভাব ফেলে এবং মানুষের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে গানগুলোও বিবর্ত্তিত হতে থাকে।
নারদ বলেছেন, সাতস্বর ষড়জ— মধ্য— গান্ধার তিন গ্রাম, একুশ মুর্চ্ছনা, একান্ন তান প্রভৃতি স্বরমণ্ডলের ব্যবহার বৈদিকোত্তর যুগে দেখা যায়।
বৈদিক যুগের শেষভাগে গান যেন সাধারণের জীবনে কিছুটা সংক্রামিত হল।
সামগানের সাথে লৌকিক গানের সংমিশ্রণ ঘটল।
গান্ধার দেশের গান্ধর্বরা যে গান করতেন তা হল গান্ধর্ব গান। তবে এই গানগুলো মন্দিরেই গাওয়া হত।
গৌতমবুদ্ধের সময় বৌদ্ধ রাজাদের কল্যাণে দেশী রাগ বিকশিত হতে শুরু করে।
“সৎচিত্ত সাধারণের চিত্ত বা মন রঞ্জিত করা যায়
যে স্বর ও বর্ণের বিশিষ্ট প্রয়োগে— তাই রাগ” — বিশেষজ্ঞদের মতে।
মানুষ ধ্বনির সাথে সুরের জগতে প্রবেশ করেছিল।
মানুষের, মানুষের ভাষার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে সেই সুরেরও ক্রমবিকাশ ঘটেছিল।
মূলতঃ সুরের ইতিহাস, ভাষার ইতিহাস, মানুষের ইতিহাস রূপকাশ্রয়ী গল্পের আকারে আমাদের কাছেই আছে, প্রাচীন ভারতীয় শব্দজ্ঞানীরা সে ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ভাষাই কেবল পারে সেই ইতিহাসটুকু সঠিক ভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরতে।
সহায়ক : বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, শব্দের ভিতর ও বাহিরে, ঠিকানা- প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া।