শরীর
কেবলই শরীর না, ইহা শরীর শরীফ! …
শরীর শরীফ বিহীন হয় না প্রেম,
মজে না মজমা!
মন হল,
শারীরিক রসায়নের নূর-এ কেবলা, আশেকান! …
অতএব
নত হও ইবাদতে,
আচমন করো শরীরসমগ্র/জলজ প্রপাত! …
মুরশিদ,
বাহো তরী, বাহো গো ত্বরী-কা,
লবণের অপার রহস্য খুঁজে পাবে শরীরসমুদ্রে! …
— শরীর শরীফ // আরণ্যক টিটো
কোন কোন মাজার ভক্ত সাধারণ মুসলমান মনে করেন, জগতে মাত্র পাঁচটি শব্দের সাথেই বিশেষণ হিসাবে শরীফ শব্দটি ব্যবহার করা যায়। যেমন মক্কা শরীফ, মদিনা শরীফ, মাজার শরীফ, কোরান শরীফ, হাদিস শরীফ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এরকম পবিত্র অর্থে মুসলমানরা আরও অনেক শব্দের সাথে শরীফ শব্দের ব্যবহার করে থাকেন। যেমন— রওজা শরীফ, ওরশ শরীফ, ফাতেহা শরীফ, দরুদ শরীফ ইত্যাদি। আবার সম্ভ্রান্ত কিংবা অভিজাত অর্থেও শরীফ শব্দের নানা রকম ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। মক্কা শরীফ বা মদিনা শরীফের মত অন্যান্য শব্দের সাথে শরীফ শব্দের ব্যবহারে মুসলিম সমাজে তেমন কোন আপত্তি দেখা যায় না। কিন্তু কেউ যদি শরীর শব্দের সাথেই যোগ করে দেয় শরীফ শব্দটি, যেমনটি করা হয়েছে “শরীর শরীফ” শিরোনামের কবিতায়, তবে কি ব্যাপারটি আপত্তিকর হবে? আমাদের মনে হয়, হতেও পারে আবার নাও হতে পারে! কেননা চিকিৎসাবিজ্ঞান, ইসলাম এবং ভারতীয় বিভিন্ন ধর্ম্মতত্ত্বেও মানবশরীরের গুরুত্ব রয়েছে।…
চিকিৎসাবিজ্ঞানে সুস্বাস্থ্যের কথা আসলেই প্রথমে আসে সুস্থ দেহের কথা। বলা হয় যে, সুস্থ মানুষ ও সুস্থ চিন্তার জন্য সুস্থ দেহ প্রয়োজন। চিকিৎসা বিজ্ঞান থেকে ধর্ম্মতত্ত্বে শরীরের গুরুত্ব অনেকটা আলাদা এবং তা কোথাও অধিক আবার কোথাও কম। যেমন সাধারণ ধর্ম্ম অপেক্ষা দেহবাদী দর্শনে দেহের গুরুত্ব অধিক। ইসলাম ধর্ম্মে লৌকিক জগৎ অপেক্ষা যেমন পরকালকে অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে তেমনি শরীর অপেক্ষা অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে আত্মাকে! আত্নাকে নিষ্কলুষ রাখার কথা যেমন বলা হয়েছে তেমনি শরীরকে পবিত্র রাখার বিধানও প্রদান করা হয়েছে। সাধারণ মুসলিমরা নফস্ বলতে আত্মার ওপর প্রভাব বিস্তারকারী এক প্রকার বিমূর্ত্ত শক্তিকে বুঝে থাকেন। কিন্তু সুফী-দরবেশ ও মারেফতপন্থী ফকিররা দেহের ভেতরে আবিষ্কার করে নফসের বস্তুগত সত্ত্বা। যে নিজেকে চিনেছে সে আল্লাকে চিনেছে, তাদের হাত আল্লার হাত হয়ে যায়, তাদের মুখ আল্লার মুখ হয়ে যায়— এমন অনেক বয়ানের ওপর ভিত্তি করে সুফীরা দেহের মধ্যেই নির্ণয় করে আরশ, কাবা, লওহে মাহফুজ প্রভৃতি স্থান! এভাবে সুফী দরবেশ ও ফকিররা ‘যাহা আছে ভাণ্ডে তাহা আছে ব্রহ্মাণ্ডে’র মত দেহবাদী ধারণা গড়ে তোলে এবং তারা যোগতন্ত্রের মাধ্যমে দেহসাধনা কিংবা দেহকেই একমাত্র সাধন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করে। এমনও দেখা যায় যে, কোন কোন ফকির সম্প্রদায় দেহ ব্যতীত আত্মার মতো কোন দ্বিতীয় সত্ত্বা স্বীকার করতে নারাজ। এক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা একাত্ম হয়ে যায় চার্ব্বাক অভিজ্ঞতার সাথে।… বেদে কোন একক ঈশ্বরের ধারণা ব্যক্ত করা হয়নি। বিভিন্ন দেবতার তুষ্টির জন্য বেদে কর্ম্মের কথাই বলা হয়েছে। আর এই কর্ম্ম বলতে যাগযজ্ঞকেই বুঝানো হয়েছে। বেদের সংহিতা এবং ব্রাহ্মণে কর্ম্মবাদই প্রাধান্য পেয়েছে এবং কর্ম্মবাদে অবশ্যই দেহের প্রাধান্য রয়েছে। অন্যদিকে আরণ্যক ও উপনিষদে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে জ্ঞান ও ভক্তিবাদকে। জ্ঞানবাদ এবং ভক্তিবাদেও মানবদেহকে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যাহা আছে ভাণ্ডে, তাহা আছে ব্রহ্মাণ্ডে— সর্ব্বভূতে ঈশ্বর বিদ্যমান— এরূপ ধারণা প্রচারের সাথে বৈদান্তিক যুগে ধর্ম্ম-দর্শনে দেহের গুরুত্ব অধিক পরিমাণে বেড়ে যায়। নির্গুণ ব্রহ্ম ধারণা থেকে উদ্ভূত একমাত্র মায়াবাদ ব্যতীত দ্বৈতবাদী-অদ্বৈতবাদী সকল বৈদান্তিক ধর্ম্মীয় মতবাদগুলোতে দেহের মর্য্যাদা রয়েছে। তান্ত্রিক যোগের গুরুত্ব বেড়ে যাওয়ায় শৈব শাক্ত বৈষ্ণবসহ নানা মতবাদগুলোতে দেহের গুরুত্ব ক্রমান্বয়ে আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে।…
চরম অহিংসবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত জৈনধর্ম্মে ভোগ বিমূখতার কারণে দেহের মর্য্যাদা অনেক কম। অপর দিকে অহিংসার কথা থাকলেও নিরিশ্বরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম্মে দেহের গুরুত্ব অনেক। পার্থিবতাবাদী এ ধর্ম্মে ভোগ বিমূখতা নেই। কিন্তু ভোগ স্পৃহার প্রতি বিমূখতা আছে। ব্যাপারটি অনেকটা নিষ্কাম কর্ম্ম ধারণার কাছাকাছি— ভোগ করবে কিন্তু ভোগের প্রতি অসক্ত হওয়া যাবে না। বৌদ্ধ ধর্ম্ম নানা যানে/খণ্ডে বিভক্ত হওয়ার পর সহজিয়া, বামাচারী, নাথ প্রভৃতি চরম দেহবাদী মতবাদগুলোর উদ্ভব হয় এরূপ ধারণার ওপর ভিত্তি করেই। এসব দেহবাদী মতবাদগুলো তান্ত্রিক যোগনির্ভর হওয়ায় তাদের ধর্ম্মসাধনা একান্ত দেহকেন্দ্রীক এবং পার্থিব। তাই তাদের কাছে দেহ সাধনই ধর্ম্মসাধন।…
নানা পন্থা এবং বিভিন্ন শ্রেণীর বাউল মতবাদেও দেহ সাধনাই আসল ধর্ম্ম! সন্ন্যাসী হোক কিংবা গৃহী হোক— দেহস্থিত কুলকুণ্ডলীনী শক্তিকে ঊর্ধ্বে স্থাপন করে প্রকৃতি এবং নিজের একাকার রূপ দর্শনই তাদের লক্ষ্য। তারা ভোগ করে কিন্তু ভোগের প্রতি নিরাসক্ত। যা এভাবে বলা যায়— পঞ্চস্বামীর মন যুগাইয়া তবু মাইয়া সতী রয়!…
কবিতার প্রথম চরণে বলা হচ্ছে— শরীর কেবল শরীর নয়, ইহা শরীর শরীফ।
শিরোনামে ‘শরীফ’ শব্দের পবিত্রতা অর্থে নিশ্চিত হয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, শুধু পবিত্রতা নয়, শরীর শব্দের আরও কোন বিশেষত্ব রয়েছে। অর্থাৎ শরীরের নানামুখী মর্য্যাদার একটা ইঙ্গিত মিলছে এখানে।…
পরের চরণে বলা হচ্ছে, শরীর শরীফ বিহীন হয় না প্রেম, মজে না মজমা।…
প্রেম সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা এই যে, প্রেম এক প্রকার ঐশ্বরিক শক্তি; শরীরের সাথে প্রকৃত প্রেমের কোন সম্পর্ক নাই— আত্মাই প্রকৃত প্রেমের উৎস। কিন্তু বিজ্ঞানমনস্ক মাত্রই জানেন, প্রেম যদিও বিমূর্ত্ত বিষয়, প্রেমের মূল উৎস হচ্ছে দৈহিক বা জৈবিক প্রবৃত্তি। আমাদের এই ধারণার সাথে মিলে যেতে পারে সুফীদরবেশবাউলফকিরদের প্রেম সম্পর্কিত ধারণা। সুফীরা মনে করেন, কয়েক প্রকার নফসের মধ্যে যে নফসের স্বভাব কাম, সাধনার মাধ্যমে তাকে প্রেম স্বভাবে পরিণত করতে হয়। কামনার বিনাশ নয়, কামনাকেই প্রেমে রূপান্তরিত করতে হয়। বাউলরা গান করেন— কাম থেকে হয় প্রেমের উদয়, কাম গেলে প্রেম থাকে না।… তাহলে এখন মানতে হবে, প্রেমের জন্য কাম দরকার আর কামের জন্য দেহ দরকার। শরীর ছাড়া কাম অসম্ভব, শরীর শরীফ ছাড়া প্রেম অসম্ভব, মগ্নতাও সম্ভব নয়!…
এবার একদম দরবারী ধাঁচের উচ্চারণ— মন হল শারীরিক রসায়নের নূর-এ কেবলা, আশেকান! …
উচ্চারণটা দরবারী ধাঁচের হলেও, দরবারীদের এ ব্যাপারে কঠোর আপত্তি থাকতে পারে। কেননা এখানে দেহকে শুধু মনের আধার নয়, উৎসও বলা হচ্ছে। অর্থাৎ মন দেহ থেকে আলাদা কোন সত্ত্বা নয়, বরং দেহেরই অংশ। এ মত্ বিজ্ঞান অনায়াসে স্বীকার করে! প্রাচীন ভারতের চার্ব্বাক দর্শনও দেহ এবং আত্মা সম্পর্কে এমন ধারণা পোষণ করে। কিন্তু সাধারণ ধর্ম্মবিশ্বাসী লোকের কাছে এ মত্ এত সহজে গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়। কারণ ধর্ম্মতত্ত্বে সাধারণত দেহ ও আত্মাকে দুটি পৃথক সত্তা হিসাবে দেখা হয়। ভারতীয় অনেক ধর্ম্ম দর্শনে আত্মা ও মনকে পৃথক জিনিস বলে মনে করা হয়। কিন্তু ইসলামে আত্মা আর মনে তেমন পার্থক্য করা হয় না। আবার ভারতীয় অধিকাংশ দেহবাদী মতবাদই চার্ব্বাক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত এবং তাতে মন কিংবা আত্মাকে দেহের নানান উপাদানের সমন্বিত রূপের এক প্রকার বিমূর্ত্ত শক্তি বলে ধারণা করা হয়। সুফিবাদেও নফসের মূর্ত্ত সত্ত্বার মত মনেরও মূর্ত্ত সত্ত্বার ইঙ্গিত মিলে।… সাধারণ ধর্ম্মতত্ত্ব মতে, আত্মা কিংবা মন দেহ থেকে পৃথক সত্ত্বা। দেহের মৃত্যু হলেও আত্মা কিংবা মনের মৃত্যু অসম্ভব। কিন্তু দেহবাদী দর্শন মতে, আত্মা বা মন বিমূর্ত্ত জিনিস হলেও তা জৈবিক সত্তারই এক প্রকার শক্তি। জৈবিক উপাদান পৃথক হওয়ার সাথে সাথে তার চিৎ-শক্তিও পৃথক হতে বাধ্য। এরপর ইবাদতে নত হয়ে শরীর সমগ্র কিংবা জলজ প্রপাত আচমন করতে বলা হচ্ছে।… দেহ শুদ্ধিই এখানে ইবাদত বলে স্বীকৃত। আর শরীর সমগ্র ও জলজ প্রপাত শব্দের মাঝখানে বিকল্প চিহ্ন (/) শরীর সমগ্র ও জলজ প্রপাতের অভিন্ন অর্থ নির্দ্দেশ করছে। ‘শরীর সমগ্র’ শব্দের কি কোন ভিন্ন তাৎপর্য্য আছে? শরীর শব্দ কি দেহের সম্পূর্ণতা প্রকাশ করতে অক্ষম? যাই হোক, সমগ্র শব্দটি এখানে শরীর শব্দকে আরও জোরালো করতে সক্ষম। এখানে জলজ প্রপাত ও শরীর সমগ্র শব্দের কি অভিন্নতা বজায় রাখা সম্ভব? অর্থাৎ জলজ প্রপাতের সাথে শরীরের কি মিল পাওয়া যাবে?…
বিজ্ঞান বলছে, মানবদেহের সত্তর ভাগ জল। এ-ও বলছে যে, প্রাণ ও প্রাণীর মূল উৎস এ্যামিনো এসিড যা তরল। তাহলে দেহও তো এক প্রকার জলধারা যা এ্যামিবা রূপে বিবর্ত্তন ধারায় গড়িয়েছিলো।…
দেহবাদী তান্ত্রিকযোগে সমগ্রদেহ হয়ত জলজ প্রপাত নয়, কিন্তু দেহাভ্যন্তরে নদী কিংবা জলজ প্রপাতের অবস্থান স্পষ্ট। দেহের তিনটি নাড়ী তিনটি ঝর্ণা আর এ তিন নাড়ী দিয়ে স্বত্ব, রজঃ, তম, এই তিন প্রকার জল-ধারা প্রবাহিত। এ তিনটি ধারাকে ঊর্ধ্বমুখী করাই দেহ আচমন/দেহ শুদ্ধি। এখন দেহবাদে যদি দেহ শুদ্ধিই ইবাদত হয়, চিকিৎসা বিজ্ঞানে তাহলে দেহ সুস্থ রাখাই হবে ইবাদত!…
শেষের চরণটিতে মুর্শিদকে আহ্বান করা হচ্ছে তরী কিংবা ত্বরী-কা বেয়ে যাওয়ার জন্য। আর জানানো হচ্ছে, শরীর সমুদ্রেই লবণের অপার রহস্যের সন্ধান মিলবে।
আমরা জানি, বাউল কিংবা মারেফতি গানে দেহকেই তরী হিসাবে কল্পনা করা হয়। কিন্তু এখানে ত্বরী-কা বা সাধনরীতিকেই তরী হিসাবে কল্পনা করা হচ্ছে। ত্বরী-কা শব্দের “ত্বরী” এবং “কা” পৃথক করে লেখার মাধ্যমে উপমান উপমেয়’র মধ্যে নিখুঁত সাদৃশ্য গড়ে উঠেছে। তরী এবং ত্বরী-কা ভাবগত এবং আক্ষরিক উভয় দিকে একাকার হয়ে গেছে। তরী/ত্বরী-কায় সওয়ার হয়ে দেহসাধনের পন্থা অবলম্বন করে লবণের অপার রহস্য খোঁজার জন্য নামতে হবে শরীর সমুদ্রে।… লবণ এখানে আত্মার রূপক। তাহলে আত্মার রহস্য খুঁজতে হবে শরীরে। অর্থাৎ শরীরই আত্মার উৎস।… এখানে মুরিদকে আহ্বান করা হয়নি, বরং মুর্শিদকেই আহ্বান করা হয়েছে। এ কি শিষ্য গোরক্ষ নাথ কর্ত্তৃক গুরু মৎসেন্দ্র নাথকে মার্গ প্রদর্শন, নাকি বিজ্ঞান এবং দেহবাদী ঐতিহ্যের আলোকে প্রচলিত ধর্ম্মকে পরিশোধনের আহ্বান?!…
দ্বীপ দিদার
জন্ম: ০৭ ডিসেম্বর ১৯৯১, মাতারবাড়ী, মহেশখালী, কক্সবাজার। প্রকাশিত গ্রন্থ: সহপাঠ গুপি গাইন, বাঘা বাইন…