পুরুষ ও প্রকৃতি : প্রত্যয় ও প্রকৃতি || সম্পাদকীয়

0

“প্রতি দুর্জয় নির্ভীক মনে, দৃঢ় প্রত্যয় প্রতিটি কদমে”।
একটি দেশাত্মবোধক গানের সঞ্চারী।
দুর্জ্জয় মনোভাব নিয়ে এগিয়ে চলার জন্য প্রত্যয় থাকতে হয়, এই প্রত্যয় হল শপথ, বিশ্বাস।
বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে আমরা চলি, প্রতিটি জীবের ক্ষেত্রেই তাই।
যখন কোনও একজন কাজে বের হয়, সে এই বিশ্বাস নিয়ে ঘর থেকে বের হয় যে, কাজশেষে ঠিকমত সে বাড়ি ফিরে আসবে।
জীবন চলার পথে বিশ্বাসটুকু না থাকলে মানুষের অগ্রযাত্রা থেমে যেত, বিশ্বাসই মানুষকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে।
এই বিশ্বাসের আরেক নাম প্রত্যয়।
আমরা মূল আলোচনায় যাচ্ছি।
প্রত্যয় = প্রতি + √ ই + অ (অচ্)-কর্ম্মবাচ্যে। (ব.শ)।
প্রতি যায় যাহাতে।
প্রতীত, বিশ্বাস, নিশ্চয়, অনুভব, অব্যাভিচাবিজ্ঞান, শপথ, প্রতিতত্ব, আচার, অধীন, সহকারী কারণ, সহকারী, প্রমাণ, হেতু, ইত্যাদি।
প্রত্যয়ন দ্বারা প্রত্যায়িত হয়, যিনি প্রত্যয়ন করেন তিনি প্রত্যয়ী।
প্রত্যয় ও প্রত্যয়ী শব্দদুটি যথাক্রমে belief ও confident অর্থে প্রচলিত।
প্রকৃতি-প্রত্যয় ব্যকরণের পারিভাষিক শব্দরূপে প্রচলিত।
প্রতিটি বস্তু বা বিষয় কীভাবে চলে বা যায় তৎসংক্রান্ত বোধ হচ্ছে প্রত্যয়।
যার ভেতরে স্ব-ভাব বা প্রকৃত প্রতিষ্ঠিত আছে, সেরকম প্রকৃতি মাত্রেরই প্রত্যয় লাগে। নতুবা প্রকৃতি পথের দিশা হারাবে।
প্রকৃতির পথপ্রদর্শক বলেই প্রত্যয় হল পুরুষ।
আমাদের পূর্ব্বপুরুষগণ বহু সাধনায় পুরুষ-প্রকৃতি বোধ অর্জ্জন করেছিলেন।
এই বিশ্বজগৎ পুরুষ ও প্রকৃতি রূপে বিভাজিত, কামসূত্রে একত্রে গ্রথিত হয়ে আছে। পরস্পরকে কামনা করে চলতে হয়, পরিপূর্ণ হতে হয় বলে পুরুষ ছাড়া প্রকৃতির চলে না, প্রকৃতি ছাড়া পুরুষের চলে না।
পুরুষ ছাড়া প্রকৃতি অন্ধ, প্রকৃতি ছাড়া পুরুষ খঞ্জ।
পুরুষ ও প্রকৃতি দ্বৈতাদ্বৈত অভেদ রূপ হচ্ছে সর্ব্বশ্রেষ্ঠ রূপ। ক্রমে তারা বিভাজিত হয় পরিচালক পরিচালিত রূপে, শাসক শাসিত রূপে, নিপীড়ক নিপীড়িত রূপে।
বাক্যগঠনকালে শব্দের ব্যবহার কোন্ নিয়মে হবে পরমাপ্রকৃতি তা যেন নিজেই ঠিক করে রেখেছিলেন যা প্রাচীন ব্যাকরণবিদগণ দেখতে পেয়েছিলেন।
ব্যাকরণবিদগণ সেই নিয়মগুলিকে ঠিক ঠিক বুঝে নিয়ে উত্তরপুরুষদের জন্য লিখে রেখে গেছেন।
জগতে অসীম সংখ্যক ক্রিয়া (পুরুষ) ও ক্রিয়াকারী (প্রকৃতি) রয়েছে। মানুষের কথা হল ক্রিয়াকারী (প্রকৃতি), আর কথার অর্থ হল পুরুষ।
জগৎ পরিবর্ত্তনশীল তাই তার সাথে তাল মিলিয়ে মানুষের ভাষাও পরিবর্ত্তনশীল।
সেজন্য আমাদের ভাষায় শব্দের গুণ অনুযায়ী দুটো ভাগ করা হয়েছে—
* ব্যয় শব্দ
* অব্যয় শব্দ।

ব্যয় শব্দ পরিবর্ত্তনশীল (পুরুষ), অব্যয় শব্দ অপরিবর্ত্তনীয় (প্রকৃতি)।
জগতের পরিবর্ত্তনশীলতা ধরে রাখার জন্যই ভাষার প্রধান ও মূখ্য অংশ দখল করে রেখেছে ব্যয় শব্দগুলি।
সেই ব্যয় সত্তাও পুরুষ ও প্রকৃতি এই দুই ভাগে বিভক্ত।
আমাদের ভাষার সমস্ত শব্দ দুভাগে বিভক্ত—
এক) ধাতুশব্দ, প্রাতিপদিক শব্দ— এগুলোকে বলে প্রকৃতি।
দুই) সেই শব্দগুলি(প্রকৃতি)কে দিশা দেয় প্রত্যয়, বিভক্তি, উপসর্গ। এরা হল পুরুষ।
উপসর্গ ধাতু ও প্রাতিপদিককে স্থানে প্রতিষ্ঠিত করে।
বিভক্তি ও প্রত্যয়গুলি তাদেরকে কালে ও পাত্রে প্রতিষ্ঠিত করে।
বাক্যে কর্ত্তা ও তার কর্ম্ম থাকে, এই কর্ত্তাও পুরুষ পদবাচ্য।
শব্দতত্ত্বের আলোচনায় পুরুষ-প্রকৃতির সম্বন্ধই প্রধান নিয়ামক।
(বস্তুর দেহবিষয়ক জ্ঞানের প্রাচীন ভারতীয় নাম তত্ব যা হল প্রতীকী ভাষা।
বস্তুর আত্মাবিষয়ক জ্ঞানের নাম তত্ত্ব যা হল ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা। — কলিম খান)

প্রকৃতি
প্রকৃতি = প্র + √ কৃতি, কর্ত্তৃবাচ্যে। (ব.শ), প্রকৃত গতিশীল যাহাতে।
প্রকৃত = যাহা প্রকৃষ্টভাবে কৃত (হইয়াছে)।
যা করা হয়েছে তাকে বলে কৃত, কৃত হয়েছে মানে কারো না কারো দ্বারা তা করা হয়েছে।
এই কৃত যদি প্রকৃষ্ট ভাবে কৃত হয় তবে তা প্রকৃত।
ব.শ মতে প্রকৃষ্টভাবে কৃত হচ্ছে— প্রচুর, প্রস্তুত, সজ্জিত, প্রক্রান্ত, প্রকরণপ্রাপ্ত, ঈপ্সিত, অধিকৃত, বর্ণনীয়, প্রকৃতিসিদ্ধ, বাস্তবিক, আদিম, প্রস্তুত বিষয়, উপমেয়।
আমাদের প্রাচীন শব্দশাস্ত্রীদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তু ও বিষয়ের একটি নির্ম্মল-চিরন্তন-আদি রূপ (সত্ত্বাদিগুণত্রয়ের সাম্যাবস্থা) ছিল, যা কোন কোন ক্ষেত্রে এখনও টিকে আছে। যদি রূপটিতে পরমাপ্রকৃতির গুণে বা কেউ নিজ গুণে হয়ত পৌঁছেছিল, এই পৌঁছানো বিষয়টা প্রকৃষ্টভাবে কৃত।
প্রকৃষ্টভাবে কৃত হতে হলে কাউকে বিশেষ প্রকার ‘স্ব-ভাবে’ প্রতিষ্ঠিত হতে হয়।
এই স্ব-ভাবে প্রতিষ্ঠিত রূপটিই তার স্বাভাবিক বা প্রকৃত রূপ।
তাকেই বলে আদিম রূপ বা real রূপ।
প্রাচীন শব্দবিদগণ মনে করতেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি প্রকৃত দৈহিক রূপ ও একটি প্রকৃত মানসিক রূপ ছিল।
তার মানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড প্রকৃত বস্তু ও বিষয়সমূহের সমাহার।
সেই প্রকৃতগুলি গতিশীল হয়েই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের যাত্রা শুরু হয়েছিল, এই গতিশীল প্রকৃতিগুলিই একত্রে প্রকৃতি আবার এদের নিজ নিজ স্বভাব যার যার প্রকৃতি।
প্রত্যেকটি প্রকৃত এর ভেতরে স্ব-ভাব রয়েছে, যা প্রকৃষ্টভাবে কৃত/করার ফল।
ব.শ বলেছেন জড়বস্তু, জীব, মানুষ, মানুষের সমাজ, নিসর্গ হল প্রকৃতি।
ব.শ মতে পঞ্চভূত মন বুদ্ধি অহংকার এগুলিও প্রকৃতিবাচ্য।
মোটকথা প্রতিটি প্রকৃষ্টভাবে কৃত গতিশীল সত্তা হল প্রকৃতি।

প্রত্যয় ও প্রকৃতি
প্রত্যয় ও প্রকৃতি বিষয়টি গোলমেলে লাগে।
বিশ্বজগতে প্রকৃতি ও প্রত্যয় (পুরুষ) স্থানবদল করে।
যেমন, একটি পরিবারে কর্ত্তা হলেন বাবা, যেহেতু তিনি পরিবারের যাবতীয় বিষয় তত্ত্বাবধান করেন অর্থাৎ পুরে দেন তাই তিনি পরিবারে পুরুষ।
আবার এই বাবা-ই যখন কোন অফিসে কারও অধীনে চাকরি করেন তখন হয়ে যান প্রকৃতি, কারণ তাকে বসের হুকুমে চাকরি করতে হয়।
ব্যাকরণেও আমরা দেখতে পাই প্রকৃতি আবার প্রত্যয় হয়ে যাচ্ছে।
আমরা আলোচনায় যাই।

প্রত্যয়
ছেলেরা ফুটবল খেলে।
এই বাক্যটি থেকে কেবল ছেলেরা শব্দটি নিলাম।
শব্দটিকে ভাঙি—
ছেলে + রা
এখানে রা হচ্ছে প্রত্যয়।
এখানে মূল শব্দ ছেলে হচ্ছে প্রকৃতি আর রা হচ্ছে প্রত্যয়।
প্রত্যয়ের সঙ্গে থাকা বাড়তি বর্ণ ধাতু বা শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয় না, এই বাড়তি অংশ লোপ পায় তাকে ইৎ বা অনুবন্ধ বলে।
প্রত্যয় যুক্ত হলে অনেক সময় কিছু স্বরগত পরিবর্ত্তন ঘটে যাকে অপশ্রুতি বলে। গুণ, বৃদ্ধি, সম্প্রসারণ এই তিনটি পরিবর্ত্তনকে একত্রে বলে অপশ্রুতি।
শব্দকে ভাঙলে আমরা কিছু বিদঘুটে শব্দ পাই যেমন বতুপ্, ঘঞ্, অনট্।
এগুলো আসলে সংস্কৃত প্রত্যয়।

প্রকৃতি
শব্দের মূল হচ্ছে প্রকৃতি।
ব্যাকরণে কাজ করা বোঝায় এমন শব্দকে বলে ক্রিয়াপদ।
ক্রিয়াপদের দুটো অংশ থাকে—
১। ধাতু বা ক্রিয়ামূল বা প্রকৃতি।
২। ক্রিয়া বিভক্তি।
ধাতু বা ক্রিয়ামূল বা প্রকৃতি দুই প্রকার:
ক) ক্রিয়াপ্রকৃতি খ) নামপ্রকৃতি।

ক্রিয়াপ্রকৃতি
যেমন “করে”। করে শব্দটিকে ভাঙলে পাওয়া যাবে
কর + এ
এখানে কর হচ্ছে ধাতু (ক্রিয়াপ্রকৃতি) এবং এ হচ্ছে ক্রিয়াবিভক্তি (প্রত্যয়)।
এই যে ‘করে’ ক্রিয়াপদ তার মূল অংশ ‘কর’ হল ধাতু এবং ‘কর’-এর সাথে যুক্ত ‘এ’ হচ্ছে কৃৎ প্রত্যয়।

নামপ্রকৃতি
ছেলেরা শব্দটি নিয়ে ভাঙলে পাওয়া যাবে
ছেলে + রা
এখানে ছেলে নামপদ তাই এটি নামপ্রকৃতি, যাকে প্রাতিপদিক-ও বলা হয়।
ছেলে নামপ্রকৃতি এবং রা হচ্ছে নাম প্রত্যয়।
বাংলা ধাতু চেনার উপায়

তুই এর পর যে ধাতু ব্যবহৃত হয় সাধারণত সেগুলোই বাংলা ধাতু।
যেমন: তুই চল্, তুই কর্, তুই খেল্।
সংস্কৃত ধাতু চেনার উপায়

যে সকল ধাতুর মধ্যে যুক্তব্যঞ্জন, ঋ-কার, ফলা থাকবে সেগুলোই সাধারণত সংস্কৃত ধাতু।
যেমন: কৃ, ক্র, স্থ

শেষ কথা
আদিতে বিশ্বজগতে প্রকৃতি ও পুরুষের মধ্যে ভেদ জ্ঞান ছিল না। পরমা-প্রকৃতি ও পরম-পুরুষ এক সাথে যুক্ত ছিল। পুরুষ ও প্রকৃতি সেখান থেকে অধঃপতিত নর ও নারী রূপে রূপান্তরিত হয়, যেখানে তাদের সম্পর্ক ছিল পরস্পরের পরিপূরক। এরপরে, তারা আরো অধঃপতিত হয়ে পরস্পরের বিপরীতধর্ম্মী অবস্থানে নেমে আসে। যেমন এখন আমরা বলি নর এর বিপরীত নারী, দিনের বিপরীত রাত।
বিশ্বজগতের মত আদিতে সাম্যবাদী সমাজ ছিল। মানুষের মাঝে কোনও পুরুষ-প্রকৃতি ভেদ ছিল না। সমাজের সবাই মানব ছিল। এই সমাজব্যবস্থাকে একার্ণব বলে।
পরবর্ত্তীতে পুরুষ প্রকৃতি বিভাজন হল, পরিচালিক-পরিচালিত, শা­সক-শাসিতে, মালিক-দাস… হয়ে বিভাজন শুরু হল।
এই বিভাজনের চূড়ান্ত পর্য্যায়ে আবার শুরু হয় বিপরীত যাত্রা।…
অধঃপতনের পালা শেষে বিপরীত থেকে পরিপূরকে, সেখান থেকে অভেদে যাত্রা, অর্থাৎ পুনরায় একবর্ণের দিকে যাত্রা। অভেদে উত্তরণের পর আবার শুরু হয় অধঃপতনের দিকে পথচলা পুনরায় চূড়ান্ত পরিণতির পূর্ব্ব পর্য্যন্ত। এ যেন দিন-রাতের মত, দিন শেষে রাত আবার রাতের পরে দিন।

পুরুষ আর প্রকৃতির এই লীলায় চলছে বিশ্বজগতের চক্রাকারে আবর্ত্তন।…

শুরু থেকে শেষ আবার শেষের পরে শুরু, বিন্দু থেকে বিসর্গ আবার বিসর্গ থেকে বিন্দু— এভাবেই অনন্ত পরিক্রমণ।…

সহায়ক: দিশা থেকে বিদিশায়, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ইন্টারনেট, বাংলা ব্যকরণ ও নির্মিতি, ব্যাকরণ ও বিবিধ।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার