ডাউন দ্য মেমোরি লেইন
রোদ্দুর রঙ পর্দ্দা উড়ছে ওয়াল্টজ মুদ্রায়
প্যালো স্যান্টো ধোঁয়ায় সুগন্ধি আবছায়া
ইমন কল্যাণ সন্ধ্যে ভিড়ছে রাগেশ্রী নোঙরে
আহ্ আনন্দম্! এস প্রেম, এস অপার!
মসৃণ অভিমান কুয়াশারা তবু চুপিসারে গাঢ়তর
যদিও বিকেলের প্যালেটে ছিল নিখাদ অনুরাগ
ফেনায়িত লাটে কাপে সতৃষ্ণ চুমুক
তুমি বরাবরের লার্জ, ব্ল্যাক, নো সুগার!
কফি বিকেলের ঈপ্সিত বৈঠক শেষে
শহরময় জ্বলে উঠেছিলো সন্ধ্যেবাতি অগণন,
ফায়ার প্লেসের আগুণ দু’চোখে নিয়ে ডাকলে
‘চল, আজ সূর্য্যপ্রেম, গোধূলির ঠিকানায়…’
প্যাসেঞ্জার সিটের উষ্ণতায় গাঢ় কফিঘ্রাণ চুম্বন
কার্ডিগ্যান, স্কার্ফে ইন্দ্রজাল বোনে প্রিয় সৌরভ
কী নিপুণ নির্মাণ তোমার বিকেলময় ইল্যুশন!
ইনকগনিটো সময়, ইনকগনিটো সুঘ্রাণ!
সত্যিই কি ডেকেছিলে আজ অলৌকিক নিমন্ত্রণে
অলীক অপরাহ্নে, খানিক আগে?
টুইটুম্বুর পেয়ালায় শেষ চুমুকের পর
কেন অমন শূন্য বিজন লাগে?
যেন তুমি ডাকনি, যেন দেখা হয়নি কত দিন,
যেন ঘুরে আসিনি দু’জনে, ডাউন দ্য মেমোরি লেইন!
অজুহাত
সিগারেট খাওয়ার ছল করে কি ব্যালকনীতে গেলে?
হয়তো এই সামান্য একটু উৎকণ্ঠার জন্যে তোমাকে
খুঁজে পেতে বের করতে হল মহার্ঘ্য নিরিবিলি।
পেয়েছিলে খুঁজে নিশ্চয়ই, নচেৎ এই অসময়ে
তোমার খানিক অবাক করা, সম্ভবতঃ অকৃত্রিম উদ্বেগ
‘তুমি আগুন থেকে নিরাপদ দূরত্বে আছো তো?’
গ্লোবাল নিউজের নাড়ি নক্ষত্র তো তোমার নখদর্পণে
জানতে না বুঝি আমি অরণ্যের দাবানল থেকে দূরে,
নিরাপদ এই ভর দুপুরে, ব্যস্ত দাপ্তরিক কাজে!
মাঝ রাতে তবু মখমলি জাল বিছিয়ে দিলে আকাশ পেরিয়ে
ডুপ্লেক্স সিঁড়ি ভেঙে এসে ফ্রিজ খুললে,
জলের বোতল, গেলাস, পায়চারী…
হেঁটে হেঁটে ফিরে গেলে, ফিরে ফিরে গেলে বারংবার
সজল আয়নামুখী বিকেলবেলায়,
নামতে নামতে পা ডুবিয়েছিলাম যেখানটায়
জল কি তেমনি শীতল আছে এই ভরা বর্ষায়?
পাড়ের কদম, দুই একটা পড়ে থাকা বাসিফুল,
সেই আসি আসি সন্ধ্যের সাজ?
পুড়ে যাচ্ছে অরণ্যানী, সবুজ আগুনের হলকায়,
আমাকে ছোঁয়নি সে, তুমি পাঠিয়ে দিলে অন্য আগুণ,
শব্দ নিরোধক নিরিবিলি খুঁজেছিলে কি না জানা হল না,
আচ্ছা তোমার কন্ঠস্বর কি তেমনি আছে এখনও?
সম্মোহন মন্ত্র ধরেছিলে একদা কি অপার অবহেলায়,
ভাবতে গিয়ে থামলাম, এইখানে থামতে হয়…
অতঃপর উড়িয়ে দিলাম ভাবনাদের ডানা পালক সমেত
ঐ সুদূর দাবানলের শহরে, উড়ে যাক, পুড়ে যাক!
ঘুমহীন মাঝ রাত পেরিয়ে ভরদুপুরের অফিসের ব্যস্ততা
দূর সুদূরপুর… বড়জোর কিছু ছাই…
ভেসে ভেসে বিষন্ন বাতাসে পেরুবে শহর, দেশ, মহাদেশ!
ফিনিক্স, আপাততঃ ঘুমে, ঘুমায় না সে আজ বহুদিন।
ব্যাক প্যাকার্স ভ্রমণ
তারপর শহরের শীত গ্রীষ্মের অলিগলিতে
হেঁটে হেঁটে চারচক্ষু গ্র্যাফিতি…
সাঁকো পেরুনোর অভিলাষ!
স্প্রে পেইন্ট এর উদাসীন পিচকিরি!
ঘাসের ফলায় সন্ধানী লেন্স,
পেইন্ট ব্রাশের এক একটা অকপট স্ট্রোক…
গতিময় ক্যানভাস!
দ্বিমাত্রিকতা পেরিয়ে ত্রিমাত্রিক উচাটন রঙ!
রেলব্রিজকে বুকে ধরে একদিন
রেলব্রিজের ওপার, আরো দূর
পিছুডাকের চারু ধূপছায়া,
এক এক করে পেরিয়ে যাওয়া…
আগল খোলা আকাশময়
নর্দার্ন লাইটস এর ধ্রুপদ নাচের মুদ্রা!
নক্ষত্রের আলোয় পথ হারানো নেভিগেশন,
নাটাই ছেঁড়া আকাশ।
ব্যাক প্যাকার্স ভ্রমণে একদিন আমরাও,
যদি বল, নিরুদ্দেশ…
ঠিক ঠিক আমরাই, ওই যে,
যেখানে আজও যাওয়া হয়নি,
মনে আছে তো, ভ্রমণবৃত্তান্ত,
সেই যে খসড়া খাতায় লেখা?
পাঁচ মিনিট বিরতি
তখন তুমুল বৃষ্টি তোমার শহরে
আমার শহর বরফের রোজনামচা লিখে যায়,
আবহাওয়ার পূর্ব্বাভাস বলে সুপ্রভাত প্রতিদিন…
তুমি বৃষ্টির গল্প শুরু করেই
চিরাচরিত পাঁচ মিনিট বিরতিতে…
এদিকে খুব মিহিন বরফ কুচিরা উড়ছে
ঠায় দাঁড়ানো ল্যাম্পপোস্টটার হলদে আলোয়,
ঘড়ির টিকটিক পাঁচ মিনিট পেরিয়ে
পরের ঘন্টাগুলো ঘুরে ঘুরে আসে,
পেরিয়ে যায় রানিং ট্র্যাকের মতন
আমি অত দৌড়ুতে পারি না, পিছিয়ে পড়ি,
স্বগতোক্তি করি, দম রাখো, লম্বা এ দৌড়!
প্রায়ই যেমন পাঁচ মিনিট বিরতি শেষমেশ
অধিবেশন মুলতবীতে গড়ায়, তেমনই একদিন…
দু’ একদিন ব্যতিক্রম গোনায় ধরি না ইচ্ছে করেই!
ও কিছু নয়, তুমি হয়তো জানোই না
অপেক্ষা বলেও একটা এপিসোড থাকে!
তোমার গল্পগুলোয় চারুপাঠ,
নিবিষ্ট স্রোতার ভূমিকায় লক্ষীমন্ত সময়
পাঁচ মিনিট কখনো মহাশূন্যে
কখনো এক জীবন, কখনো অন্য জীবন,
ফ্ল্যাশ ব্যাক, পাঁচশালা পরিকল্পনা, কোনটা নয়?
পাঁচ মিনিট, কখনো ফুরোয়, হয়তো বিলম্বে,
কখনো কখনো ফুরোয় না আবহমান কাল!
জ্বরের ঘোরে
তোমার জ্বর গায়ে মেখে হাঁটছি কুয়াশার শহর
জেট ল্যাগ পেরুচ্ছি, মাইলেজ বাড়ছে স্মরণ যাপনে…
ট্রেঞ্চ কোটের পকেট বোঝাই উষ্ণতায় তোমার ভর দুপুর
উইন্ড চিল মাইনাস কুড়ি, হু হু হাওয়ার ঝাপটা চোখে মুখে…
টুপি দস্তানা মাফলারে ওম খুঁজছো, ওতে কি আর যথেষ্ট হয়?
হবে নাকি গরম চা, ঝাল মুড়ি, কম্বল-মুড়ি অলস আবডালে?
পরিযায়ী শিশির ঝরুক কোথাও নিঝুম ঐকতানে,
কোথাও হয়তোবা তুষারপাত, ফিনফিনে মিহিন মায়ায়…
ভূগোল, মানচিত্র, সীমা-রেখার আঁকিবুঁকি, টাইম জোন
গুলিয়ে ফেলুক দিন রাত্রির দিশা, কিছুটা সময়…
আমাদের শীতের গল্পগুলো জুড়ে থাক উষ্ণতার স্মৃতিচারণ
এক একটা ক্রস ওয়ার্ড পাজল সলভ করার চতুরতা!
কিছু প্রগাঢ় হেঁয়ালি, বিরহ আসক্তি, নিবিড় নিশ্চুপি!
যদি বলে ফেলো আজ সেই কথা,
সময়ের পাণ্ডুলিপিতে সম্ভাবনা বৃত্তান্ত।
টেক্সটিং
তোমার জন্যে মেঘমল্লার, আকাশ ছেঁচে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি,
এই অবেলার বর্ষণে ভিজবে কি না ভেবে দেখতে পার…
পরদিন সকাল বেলায় রোদ্দুর মাখা সুপ্রভাত বলে
আলো জ্বেলে দিলে দিন দুপুরে…
উত্তুরে রেল গাড়ি গোলাপ বন পেরিয়ে উষ্ণতার দিকে চললো,
ব্যস্ত দিনমান কেউ কি বলবে থেকে থেকে, আছি, খুব কাছাকাছি?
আসছো তো লাঞ্চ ব্রেকের ছুট ছুট চকিত তাড়ায়?
নাকি অপেক্ষায় বেলা গড়াবে শেষ বিকেলে?
সেল ফোন শান্ত শিষ্ট ভালোমানুষের মত চুপচাপ
ব্যাগের কোনে পড়ে রইলো, কোন সাড়া শব্দ নেই,
আঙ্গুলগুলো এটা সেটায়, একটু অলসতার আদিখ্যেতায়!
তুমি ভাবলে পুবের শব্দ তরঙ্গেরা ভুলে গেছে অতীত উচাটন…
আমি বললাম, নৈশব্দের সাথে সখ্য,
ভাবনায় ভাবনায় টেক্সটিং পেরিয়ে দূর পাল্লার দৌড়…
তুমি বললে, বেশ! শেষ বিকেল তখন বাড়ি ফিরছে
পথ ভেঙে ভেঙে, রিয়ার ভিউ মিররে সূর্যের সাথে
চোরা চোখাচোখি, তোমাকে সেই কথাটা বলা হ’ল না।
সল্ট এন্ড পেপার
তোমার সন্ধ্যেগুলো সিল্ক মিহিন ভাসছে, কলমকারি নকশায়,
সৈকত ঘেঁষা পাব প্যাটিওর উন্মাতাল আটলান্টিক হাওয়ায়!
আকাশ ধীরে ধীরে নীল থেকে সোনালী হচ্ছে খুব নিঃশব্দে,
তুমুল ভালোবাসছো তুমি জীবন যাপনের এক একটা দিন!
হাতের গ্লাসে সিগনেচার ককটেল, ‘টোয়াইলাইট ট্যাঙ্গো’,
কোন দিন ‘সান কিসড ব্লুজ’, নামগুলো তোমারই দেয়া!
চুল ছুঁয়ে থাকা সূর্য্যাস্তের শেষ কিরণ চমৎকার ব্লেন্ড করে যাচ্ছে
রূপোলী স্ট্রিকগুলোর সাথে… আজকাল সল্ট এন্ড পেপারে তোমাকে
কি দূর্দান্ত দেখায়? কৌতূহল তো হতেই পারে, সেলফি উইথ মৌতাত
কিংবা সূর্যাস্তের ওয়াইড এঙ্গেল শট, কল্পনায় সাবধানী কুয়াশার ছোপ।
নস্টালজিয়ার শব্দের মতন ঝমঝমিয়ে কোন কোনদিন বৃষ্টি নামে
মেঘ চুঁইয়ে, আকাশ পেরিয়ে, তুমি ভিজে যাও, ভিজতেই থাকো…
‘সল্ট এন্ড পেপার’ সেই উনিশের ক্রাশ, কি ক্ষেপাতেই না তখন!
সল্ট এন্ড পেপার, ভারী কাঁচ, চোখ আর মারকুটে দৃষ্টি ব্লেন্ড করে করে
এক একদিন এক একটা পোর্ট্রেট, শুধু ক্ষেপাচ্ছে না কেউ আজকাল!
সেইসব সঘন এক একটা সন্ধ্যেয় বছর পেরোও তুমি, পঁচিশ, দশ, পাঁচ…
পাঁচ মাত্রার সুরেলা সংলাপ, মাতাল হাওয়ারা তখন বড্ড বেশী দূর্দান্ত!
এই প্রান্তে পাঁচ মাত্রারা কবিতায়, সংলাপগুলো এক একটা অণুগল্প…
বাড়ির পথ পেরুচ্ছে টাইম জোনের এক্সপ্রেস ড্রিম ওয়ে,
কনভার্টিবল এর খোলা ছাদের আশকারায়
সল্ট এন্ড পেপারে এলোমেলো ঝড়, স্পষ্ট দেখছি!
তোমার সঘন সন্ধ্যেগুলো গাঢ় রাত্রিমুখো, টলোমলো পায়ে!
মারমেইড মুহূর্ত্ত
মারমেইড মুহূর্ত্তগুলো
স্রোত সাঁতরে রূপান্তরের নোঙরে…
উপকূল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাযাবর পাল-মাস্তুল
শূন্যযাত্রায় বাড়িয়েছ আকাশ,
ছায়া নকশায় বিহান-সায়ংকাল,
ট্রপিক্যাল সবুজ ছাড়িয়ে
পর্ণমোচী পদাবলী দিনলিপি জুড়ে!
নিবিড় বিকেলবেলায়
দোল দোল দুলুনি… এক এক দোলায়
চলকে যাচ্ছে চায়ের কাপ!
পায়রা ওড়ানো সকালে
করতলে নমিত আকাশ, আজ বহুদিন!
গিরিবাজ, জালালী, নোটন…
নাম বাহারী পারাবত সময়!
ফড়িং ওড়নায় ভেলভেট বৃষ্টিজল
ঝড়ো সঙ্গীত, বর্ষা কদম, জলের এস্রাজ!
স্মৃতি-মেঘ, একান্ত চন্দ্রাতপ!
ভাসতে ভাসতে উড়ে যাও
নাটাই খুলে নভোনীল অন্তরীক্ষে,
আসমুদ্র জোয়ারে ডুবো-মন আটলান্টিস,
জলে ভেজা চিঠি, প্রত্ন ঠিকানা জলের তলায়!
তুমি ডাক শুনছো, শুনতে পাচ্ছো,
নিমগ্ন অথৈ জল পেরিয়ে লোহিত কণিকায়?
মাঝ রাত্রের তৃষ্ণাজলে ঢেউ উঠছে,
ছুঁয়ে যাচ্ছে কোন বেলাভূমি?
এখনও
এখনও কী রাত্রি জাগো আলোর নীচে?
ঘুম পেরুনো অতল প্রহর রূপোর সিঁড়ি
পায়ে পায়ে নেমে গেলেই সুবর্ণ-মেঘ?
বৃষ্টি ফুলে গাঁথতে পারো শ্যামল নূপুর?
কৌতূহলে দিচ্ছো ছুঁয়ে অবাক দুপুর
নিলয় স্রোতে পাল ওড়ালে প্রত্ন-খাঁড়ি!
বালু-ঘড়ির ঝর্ণাধারায় মগ্ন সময়
অল্পস্বল্প গরজ আছে ব্যস্ততারও…
যদি বলো চিরকুটের সেই গল্পগুলো,
শুনতে পারি এবার গূঢ় একাগ্রতায়!…
লুবনা ইয়াসমিন
সাম্প্রতিক এক যুগ বাদ দিলে লুবনা ইয়াসমিন এর পুরো জীবন কেটেছে ঢাকা শহরে। ছোটবেলা থেকেই প্রতি জন্মদিনে বাবার কাছ থেকে বিশেষ উপহার থাকতো বেশ কিছু বই, সেই থেকে সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। প্রিয় কবি আবুল হাসান, প্রিয় লেখক পাওলো কোয়েলো। বর্তমান আবাস কানাডার টরণ্টো শহরের দিনলিপি কবিতায় কবিতায় লিখে যান, সবচে’ প্রিয় বন্ধু প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্য্য।