কোমলতা
কিছু শব্দ হলে ভাল হয়।
এই যে রাতের গায়ে জলের মত ঘোরলাগা, নারকেল পাতার শিরশিরে বাতাসের মত কিছু শব্দ। মোলায়েম। পেলব প্রেমিকের আঙুলের মত।
অবয়বহীন কিছু শব্দ। কোন পরিচিত ঘ্রাণ, খুব পুরোনো ঘ্রাণ যেমন দিয়ে যায় এক অদৃশ্য হাহাকার। ভাঙা বুক নিয়ে না ভাঙা জানালা আঁকড়ে ধরলে যে শব্দ হয় তার মত কিছু, কিংবা আরও কিছু যারা কেমন আমরা কখনো জানবো না।
সবটা তো জানা যায় না। আমাদের তো বৃক্ষের মতো শেকড় নেই যারা পরস্পরকে স্পর্শ করে জেনে নেবে কোন্ প্রকোষ্ঠে কতটা গভীর ক্ষত ঢাকা পড়ে গেছে দীর্ঘকালীন অনাদরে।
সময়ের সুদ খেয়ে বেঁচে আছি এক টুকরো জীবন।
শ্রাবণের শেষ রাতে সপ্তর্ষির দিঘী থেকে আমরা তো উঠে আসিনি আজও। ছুঁয়ে দেখিনি তার অতল জলের প্রাসাদ ঝিনুকের ভেতরে কতটা জমে থাকে।
কিছু ভাল শব্দ দরকার; শিষ্ট, বিশ্লিষ্ট। চারুশব্দ, কারুশব্দ, নিপুণ ও নিখুঁত শব্দ।
যারা ফুল হয়ে গন্ধ ছড়াতে গিয়ে পরাগ হয়ে জন্ম ছড়াবে না।
যারা কলমের গোলগাল ডগা হতে গিয়ে সহসাই হয়ে ওঠবে না তীক্ষ্ণ তীরের ফলা।
তেমন কিছু সাবধান শব্দ চাই।
কাঁটাতারের আটকে আছে ভেলা
শামুকের খোল থেকে গড়িয়ে এসেছে রাত, লেগে আছে কাঁচের দেয়ালে। তার গায়ে অবিরাম শীতল গন্ধ, নিরেট নিস্তব্ধ ঝিঁঝিঁদের আলাপ।
আমার চোখ খুলে দিয়েছিলাম এমন এক রাতকে, এক দুগ্ধফেননীভ ঘোরগ্রস্ততায়, তারপর গলিত আলোর ছড়া মিশে গেছে নদীদের গায়, সেখানে পাটের দড়ির নড়বড়ে বাঁধনে ইতস্তত দুলতে থাকে স্বচ্ছ শৈশবকালীন নামতা।
শাকপাতা বাছে বসে অশ্বত্থের তলে এক কমলা রঙের নারী, তার আঁচলের নাগাল থেকে বহুদূর সরে গেছে জলের দাগ, আঙুল তুলে বলে বিসর্জ্জনের কালে বিশালাক্ষীর চোখেরাই নৌকা হয়ে জন্ম নেয়, অসীম তাদের ভাসান, যতদূর তাতে যেতে পারে মাঝিমাল্লার বৈঠা ততদূরই পৃথিবীর জ্ঞান, ততদূর যায় পড়া প্রাকৃত পুঁথি, পৃথিবীর উদ্বোধনের ততোদূর ঠাঁই। গলা ভারী হয়ে আসে তার, বলে, আজকাল বিসর্জ্জনের জল পাওয়াও বড় দূর হাঁটাপথ।
কবেকার বাসি বৃষ্টিতে ভিজে ওঠে তার শুকনো হাহাকার। দিনের পর দিন ভাসতে না পেরে ফেটে ওঠা চোখগুলো কেবল ঘুম খুঁজে বেরায়। এপারে বৈঠা কামড়ে আছে জলের গায়ে বসানো কাঁটাতারের দাঁত, ওপারে বেহুলা স্বর্গ থেকে স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে এনে দাঁড়িয়ে আছে। শত শত বছর পেরিয়ে গেলে ক্ষুধায় মরে আসছে লখীন্দরের চোখ, কার কাছে নাচবে তুমি এবার?
বরাহী কিংবা নাম হারানো নদীদের কাছে
এমন ধোঁয়া ওঠা বৃষ্টি দেখলেই মনে পড়ে বরইয়ের কাঁটায় ছাওয়া সবুজ পুকুর
হেলান দেয়া বন্ধ চোখের মতো উল্টে রাখা কালো নৌকা
গোলাপি পদ্মের চোখে চোখ রেখে ডুব দিয়ে ওঠা এক শ্যামল কিশোরী
আমার হাতে তার ছবি তোলার যন্ত্রণা ছিলো, ছবি হওয়ার পুকুর ছিল না।
একটা ভেঙে যাওয়া মাটির নৌকা মনে পড়ে
খড়ের পুতুল, ধুনুচি, ফুরোনো প্রদীপ সব গেঁথে থাকে জলের তলের বুকে, পায়ের ছাপ;
কতদিন থাকে? স্মৃতির আয়ু কতদিন?
কড়ই গাছ কতদিন মনে রাখে কিশোরদের ঘুড়ি?
নিরুদ্দেশ হতে হয় সকলকে। সকলের থেকে। এই সত্য জেনেও আমরা হাজিরা দিয়ে যাই প্রতিদিন।
অথচ মৃত্যুর খবরে মানুষের নিয়ম করে অবাক হওয়া পূর্ব্ববর্ত্তী খবরটির ভুলে যাওয়াকেও ভুলিয়ে দেয়।
একদিন সব মুছে যায় নদী আর নদীর নামের মতো।
বরাহী, কিংবা এমন কিছু নাম নিয়ে যারা কিছুদিন হেঁটেছিলো পৃথিবীর প্রাণে।
মাটি মাটি মাটি আর আগুন
মনে কর এক বাতাসের রাতে আমি চোখ ফিরে পাব নিজের, নিজেদের সংঘবদ্ধ হারানো চোখগুলো এক অতল সরোবর থেকে অশ্বত্থের শেকড়ের পথ বেয়ে উঠে আসবে, মুখোমুখি বসবে, দেখবে নিজেকে এবং অপরকে।
মনে কর আজ সেই মহিমান্বিত রাত।
দেখ পৃথিবীর প্রাচীনতম বৃক্ষের নীচে আমরা বসে আছি, তার পাতার এই শব্দ শুনে বাঁধা হয়েছিলো প্রথম সুর, সেই সুরে আজও নেচে চলে হৃদয়ের ধ্রুপদী পদচিহ্ন। দেখো এই চাঁদ আলো দিয়েছে পৃথিবীর প্রথম হত্যা এবং প্রেমের রাতে, মানুষের ছুঁয়ে থাকা রক্ত কিংবা অশ্রুর আঙুলের রেখায় বয়ে গেছে আলো, আজও বয়ে যায় বিলুপ্ত হয়ে থাকা নারীদের এবং নদীদের পথ ধরে। আমাদের রেখাহীন হাতে লাঙলের আঁচড় কেটে দিলে এক বিদীর্ণ স্রোত ধুয়ে দেবে সব অভিমান।
সেই দাগ ধরে ফিরে আসবে পৃথিবীর প্রথম কৃষাণী, ক্ষুধার্ত ব্যার্থ শিকারি যার পায়ে রেখেছিল প্রথম পদ্মফুল। আজ সেই মহিমান্বিত প্রত্যাবর্তন। আমরা প্রত্যেকে নিজেদের খুলে বিছিয়ে রেখেছি এখানে।
এখানে সমস্ত নৈঃশব্দ ভেঙে যায়, বেজে ওঠে আদিম প্রাকৃত ঢাক, করতালের মতো উদ্বেলিত হাসির স্রোতে ধূলো হয়ে যায় সমস্ত বাঁধ, এখানে চিৎকার অপেক্ষা সুন্দর কোন শব্দ নেই আজ। এই সেই মহিমান্বিত রাত, আকাশজুড়ে আনন্দিত লেলিহান শিখার উৎসব, মাটিতে প্রাগৈতিহাসিক কৃষকের আত্মার পদভারে বিধ্বস্ত টেকটোনিক প্লেট। মাটির দাবিতে ভূমিপুত্রের চোখ ঠিকরে বের হওয়া আগুনে পুড়ে যাচ্ছে সমস্ত শীতল শয্যা, এর চেয়ে পবিত্র আগুন পৃথিবী কোনোদিন দেখেনি আর।
ভাসান
বড্ড বাতাস বয় গো! জোরে জোরে বাতাস বয়, কী গোঙানি! আমার বুকের ভেতরখান উথাল পাথাল করে ডাবগাছের মাথার মত! ডাবগাছটা কি মাথাভরা ফুল নিয়া আবার জন্মাইছে, আর কোথাও? কী গন্ধ রাতভর, কী বৃষ্টি! অথচ জানালা খুললেই ঝকমকা জোছনার ঢল, আমি সেই কবে ভাইসা গেলাম, পার হইয়া গেলাম মাছরাঙার চর! সোনালী মাঠ, সকালের চোখদুটা কবর দিয়া থুইয়া গেলাম কড়ই গাছের তলে। নীল রঙের বন একটা বাসা বাঁধল কত যে ভিতর! আমি কেবল জল মাপি, গহীন নদীর জল, পদ্মার বুক তার এক বাও মেলে না দু বাও মেলে না মেলে না জন্মের বাও!
আমি কেবল চায়া দেখি সাদা বালুচর, কড়ই কাঠ কাইটা আমারে বানায় দিছে ডিঙি, ভাসে ভাসে আর ভাসে পৃথিবীর তিনভাগ জলে! আমি কেবল জল মাপি ঝিঁঝিঁর ডাকের মতো একটানা, বাতাসের গোঙানির মতো উথাল-পাথাল হইয়া খুঁজি, ডাঙার দেখা পাই না।
কে হবে রুদালী
প্রথম পুকুর আর প্রথম জানালার স্বাদ আজও ভুলিনি, কেবল ভুলে গেছি প্রথম মুখ দেখা। তোমার নয়,
নিজের। হাতের আড়ালে রাত বাড়ে,রাতের আড়ালে অদৃশ্য ঝিঁঝিঁর ডাক, আমাদের সাথে তাদের কোনোদিন দেখা হয় না। আজকাল ফড়িঙ দেখলে, পাখি দেখলে, মাছ দেখলে এমনকি জীবনে প্রতিযোগিতার বীজ বোনা গল্পের সেই অধ্যাবসায়ী কচ্ছপ দেখলেও মানুষ আয়নার আড়ালে নিজেকে দেখতে চায়। কারও কী মনে আছে সেই প্রথম মুখ দেখা!
এক ঘোর লেগে আছে চোখে। উত্তরাধিকার ঘোর। নুনহীন পুকুর ছেয়ে কচুরিপানার ভীষণ নরম ফুল। সেই কোন কাল থেকে এই নরম বেগুনি হলুদের সাথে বসবাস, অভ্যাস, মায়া। আলগোছ প্রেম। ফুলের কষ্ট হবে বলে উজাড় করে কাঁদেও নি মানুষ, কত বর্ষার নদী ছাতি ফেটে মরে গেলো তাই! এত পলকা পানাফুল মাড়িয়ে কোন বিশালাক্ষী রুদালী হবে, নুনজলে ধুয়ে দেবে সমস্ত না দেখার কাল!
তার পর নিজের মুখ দেখা আমাদের আর কোনোদিন হয়ে ওঠে না তারপর!
বাঁটোয়ারার সংলাপ
না নাদের আলী, তোমার আর তিন পহরের বিল পর্য্যন্ত যাওয়া চলবে না। ওখানে সাপ আছে, ভোমর আছে, পদ্মফুল আছে। ওদের ছাড়তে হবে তোমায়। ওদের ক্ষতি হবে তুমি গেলে। তুমি বাপু দেড় পহর অবধি যাবে, ওখান থেকে মাছটাছ নিয়ে ফিরে আসবে। দেড় পহর পার হবে না।
নাদের আলী হাসে।
দেখো নাদের আলী, কথা শোন। বেশি লোভ কর না। সাপ, ভোমর, পদ্মফুলে তোমার কী কাজ? তোমার বৈঠার আঘাতে বিলের কত কষ্ট হয় জানো? দেড় পহর পাড় হলে তোমার নৌকা নিলাম হবে, এই আমি বলে দিলাম।
নাদের আলী তাও হাসে।
হাসছো যে, কথা কানে যাচ্ছে না?
তুমি আজ সত্যিই বড় হয়েছো দাদাঠাকুর। নাদের আলীকে বিল চেনাও! তা বলি দাদাঠাকুর, মাছকে বলেছ তো, সে যেন দেড় পহর অবধিই থাকে? বিলকে বলেছ, দেড় পহরের পর সে যেন না বয়?
নুসরাত জাহান
জন্ম : ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে। পদ্মাপাড়ের রাজশাহী জেলায়। বর্ত্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত।