যমরাজের বয়স হয়েছে। নিয়মিত বিচার সভায় বসতে পারে না। বেশির ভাগ সময় সোমরস খেয়ে ঘুমিয়ে থাকে। মাস ছয়েক আগের কথা। একদিন বিচার সভায় বসে যমদূতদের খুব এক চোট ঝাড়লেন।
— শুধু খেয়ে খেয়ে ভুঁড়ি মোটা করা হচ্ছে। মর্ত্তের খবরটবর কিছু রাখ? ওখানে তো জনবিস্ফোরণ হচ্ছে। কিছু একটা কর, নইলে চাকরি নট।
যমদূতরা পারফরমেন্স বাড়ানোর জন্য মর্ত্তে করোনা দেবীকে এজেন্ট নিয়োগ দিল। আমাদের পুলিশের লোকরা যেভাবে এজেন্ট নিয়োগ দেয় বখরা আদায় করার জন্য। করোনা দেবী সাইজে ছোট হলে কী হবে, খুবই করিৎকর্ম্মা। সারা পৃথিবীকে আতংকিত করে তুলেছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ মরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এক সাথে এত মানুষ মারা যাচ্ছে যে, ঠিক মত সৎকার পর্য্যন্ত হচ্ছে না।
এদিকে চিত্রগুপ্ত স্বর্গে বসে এতো লক্ষ লক্ষ আত্মার পাপ পূন্যের স্প্রেডশীট ডাটাশীট ম্যানেজ করতে হিমশিম খাচ্ছে। তবু ভাল আগের মত হাতে লেখা খাতা সিস্টেম নেই। ‘চিত্রগুপ্তের খাতা’ কথাটা এখন নেহায়েত কথার কথা। এখন সব কিছু ডিজিটাল। কম্পিউটারে প্রোগ্রাম সেট করা আছে। ডাটা এন্ট্রি দিয়ে একটা কমান্ড দিলেই রিপোর্ট বেরিয়ে আসে কে স্বর্গে যাবে, কে নরকে যাবে। যমরাজের শুধু একটা অনুমোদন লাগে। তা, অনুমোদনটা ঘরে বসে অপ্সরাদের সাথে দোল খেতে খেতে করে দিলেই পারে। এখন তো ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে। না, বুড়ো সেটা করবে না। বলে জনপ্রিয় আর দেবপ্রিয় তো এক জিনিস না। কম্পিউটারে সে হাত দেবে না। বুড়ো মানুষদের যা কমন সমস্যা। তাকে রিপোর্ট, সাথে রিপোর্টের সাপোর্টিং পেপার সব কিছুর প্রিন্ট আউট দিতে হবে। এদিকে অফিস সাপ্লাই ঠিক মত পাওয়া যায় না। আজ পেপার নেই, তো কাল প্রিন্টারের টোনার নেই। সাপ্লাই কেনাকাটার মাঝে স্বর্গেও দুর্নীতি স্বজনপ্রীতি ঢুকে গেছে। তার উপরে আছে প্রিন্টারে পেপার জ্যামের সমস্যা। বেটা বিশ্বকর্ম্মা আগে লোহা লক্করটা ভাল বুঝত। এখনকার এসব হাইটেকের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না। বললেই বলবে একটা নতুন মেশিনের চাহিদা পত্র পাঠাও। তারপর বাজেট, কোটেশন, পার্সেস অর্ডার নানান রকম তালবাহান চলতে থাকে। এসব নিয়ে চিত্রগুপ্তের মেজাজ খাট্টা হয়ে থাকে। মেজাজ খাট্টা হওয়ার আরেকটা কারণ খাদ্য ঘাটতি। প্রতিদিন ঠিক মত খাবার পাওয়া যায় না। তার পছন্দের খাবার আদা, মধু, কাঁচা হলুদ। করোনা প্রতিরোধের নামে মর্ত্তের লোকেরা সেগুলো খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে। পূজার প্রসাদ হিসাবে এখন এগুলো আর কেউ দেয় না। যাহোক এসব কথা বলে কোন লাভ নেই। সময় মত পাপ পূণ্যের রিপোর্ট তাকে করতেই হয়।
এতো লক্ষ লক্ষ আত্মার রিপোর্ট দেখে তো আজ যমরাজের মেজাজ খুব গরম। স্বর্গ-মর্ত্তের জায়গারও তো একটা লিমিটেশন আছে। নতুন কনস্ট্রাকশনের জন্য বাজেট চাইতে চাইতে বুড়ো হয়ে গেছে। এখন আর কোন চাওয়া পাওয়ার হিসাব নেই। এখন কাজ শুধু ম্যানেজ করে চলা। যমরাজ জরুরী সভা ডেকে ঘোষনা দিল, সব আত্মাকে ইমিডিয়েট মর্ত্তে ফেরত পাঠাতে হবে। তার জন্য ব্রহ্মার অনুমোদন লাগবে। চিত্রগুপ্তকে দায়িত্ব দেয়া হল অনুমোদন বের করার। কারণ চিত্রগুপ্ত বললে ব্রহ্মা কোন বিষয়ে না করে না। স্বজন প্রীতি শুধু মর্ত্তে না, স্বর্গেও সমান ভাবে কার্য্যকর। ব্রহ্মার সাথে চিত্রগুপ্তের একটি ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে। ব্রহ্মার দেহ থেকেই চিত্রগুপ্তের জন্ম।
— কিন্তু বাবা তো এখন ধ্যানমগ্ন। চিত্রগুপ্ত বলল।
— তাতে কী, আমি কামদেবকে বলে দিচ্ছি। সে উর্ব্বশীকে পাঠিয়ে দেবে ধ্যনভঙ্গ করার জন্য। তোমার বাবার চরিত্র তো আমাদের সবারই জানা। কথাটা বলে যমরাজ একটু ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে হাসল।
কামদেব অপ্সরাদের ডিপার্টমেন্টাল হেড। তার সাথে যমরাজের সম্পর্ক বেশ ভাল। এক সাথে সোমরস পান করে। তাছাড়া ভাল একজন অপ্সরার সেবা পেতে কামদেবকে সবাই একটু তোয়াজ করে চলে। অপ্সরাদের মাঝেও আবার শ্রেনী বিভাগ আছে। সবাই শুধু উর্ব্বশী, মেনকা আর রম্ভাকে চায়। তারা তো ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরের সেবা দিতেই ব্যস্ত থাকে। অন্য দেবতাদের কপালে জোটে মরীচি, শুচিকা আর অম্বিকার মত দ্বিতীয় তৃতীয় শ্রেণীর অপ্সরা। যমরাজ টেলিফোনে বলা মাত্রই কামদেব বলল, বস! উর্ব্বশী, মেনকা আর রম্ভা তিনজনই ইন্দ্রের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। আপনি সরাসরি ইন্দ্রের সাথে কথা বলে দেখেন। উর্ব্বশীকে একটু ছাড়তে পারে কি না। ব্রহ্মার ধ্যান ভাঙাতে তো উর্ব্বশীকে লাগবে। শেষ পর্য্যন্ত ইন্দ্রকে বললে, সে মেনকাকে ছাড়তে রাজি হল। এটা এক ধরনের ভাব। যাকে চাওয়া হল তাকেই ছেড়ে দিলে তো আর ভাব থাকে না। তাছাড়া ইন্দ্র বলে কথা। তার ভাবটাই একটু বেশি বেশি। তবে ধ্যান ভাঙানোর জন্য মেনকারও বেশ সুনাম আছে। বিশ্বামিত্রের ধ্যান তো মেনকাই ভাঙিয়েছিল। শুধু ধ্যানই ভাঙায়নি বিশ্বামিত্রকে রীতিমত কামাতুর করে তুলেছিল। বিশ্বামিত্র আর মেনকার সেই মিলনেই জন্ম হয় শকুন্তলার।
— কিন্তু এত আত্মা একসাথে মর্ত্তে যাবে কীভাবে? তাছাড়া হাসপাতালগুলো সব অকুপাইড হয়ে আছে কোভিড পেসেন্টে। ডেলিভারী হবে কোথায়? এরকম পরিস্থিতিতে মর্ত্তে পাঠালে তো আত্মাগুলো পিংপং বলের মত স্বর্গ টু মর্ত্তে আর মর্ত্ত টু স্বর্গ করতে থাকবে। চিত্রগুপ্ত উদ্বিগ্ন ভাবে যমরাজকে কথাগুলো বলল।
— তুমি চিত্রগুপ্ত, কেরানি মানুষ সারা জীবন কেরানিই রয়ে গেলে। তুমি ওসব বুঝবে না। আরে বাবা, আজ বললে কালই তো আর হাসপাতাল লাগছে না। সিস্টেম অ্যাক্টিভেট করার পরেও নয় মাস সময় পাবে। এর মাঝে করোনাকে স্টপ করাও। হাসপাতাল ক্লিয়ার হয়ে যাবে।
ব্রহ্মার কাছ থেকে পুনর্জন্মের অনুমোদন পেতে চিত্রগুপ্তের বেশ সময় লাগল। ধ্যান ভাঙার পরেই সে মেনকাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চিত্রগুপ্ত আর কাছে ভিড়তে পারে না। গুহার বাইরে বসে বসে ভাবতে থাকে করোনাকে কিভাবে স্টপ করাবে। বুড়ো যমরাজটা তো বলেই খালাস কিন্তু কাজটা হবে কীভাবে? করোনা দেবী তো আর কোন দেবী নয় যে, ডাক দিলেই স্বর্গে ফিরে আসবে। করোনা হল ভাইরাস। মর্ত্তের লোকাল প্রডাক্ট। শুধু লোকাল প্রডাক্টই না। রীতিমত চাইনিজ প্রডাক্ট। ওটা না জীবিত, না মৃত। যে কারনে যমদূতদের নির্দ্দেশ দিয়ে কোন ফল হবে না। যমদূতরা করোনা ভাইরাসের আত্মা খুঁজেই পাবে না। যে, খপাৎ করে ধরে নিয়ে চলে আসবে। এখন পর্য্যন্ত ভাইরাসের ম্যানেজমেন্ট মর্ত্তের বিজ্ঞানীদের হাতে। বিজ্ঞানীদেরকে সাহায্য করতে পারে একমাত্র দেবী সরস্বতী। তিনি জ্ঞানের দেবী। তিনি তো মর্ত্তে যাবেন সেই ফেব্রুয়ারী মাসে। এতোদিন দেরী করা যাবে না। বরং সরস্বতীর সাথে আলাপ করে একটা বুদ্ধি বের করতে হবে বিজ্ঞানীদের জ্ঞান বৃদ্ধি করার। সে কাজটা চিত্রগুপ্ত করতে পারবে কারণ সরস্বতীর সাথেও তার একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। দুজনেই ব্রহ্মা থেকে সৃষ্ট।
এইসব ভাবতে ভাবতে ব্রহ্মার গুহায় ঢোকার অনুমতি পাওয়া গেল। কাজটাও নির্ব্বিবাদে হয়ে গেল। দেরিতে হলেও চিত্রগুপ্ত অনুমোদন নিয়ে তার দপ্তরে ফিরে এসে দেখে যমরাজ তখনও তার জন্য অপেক্ষা করছে। পুনর্জন্ম অনুমোদনের সংবাদ শুনে যমরাজ মহাখুশি। এক পেগ সোমরস গলায় ঢেলে দিয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিল। তারপর হাতে তালি দিয়ে গাইতে থাকল—
ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি
এই আষাঢ় মাসে সেই প্রথম দিনে
অ্যাডাম আর ইভ ইডেন গার্ডেনে
ইভ এনেছে আপেল কিনে
অ্যাডাম গবগব খেলো টিফিনে
তারপর ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্মটি।
স্বপন বিশ্বাস
জন্মঃ ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৪। কৃষি বিষয়ে স্নাতক ও ব্যবসা ব্যবস্থাপনায় স্নাতকোত্তর। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের শুল্ক বিভাগে কৃষি বিশেষজ্ঞ হিসাবে কর্ম্মরত। বসবাস নিউ ইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। প্রকাশিত গ্রন্থ একটি।
ইমেইলঃ swapan64@gmail.com