একটি ঘুঘু এবং সোফিয়ার তক্ষক || ঈশান বড়ুয়া

0

অগাস্টিন তখনও গিটার বাজিয়ে যাচ্ছে জামালখান চার্চ্চের সামনে খোলা উঠোনে বসে। সবে মাত্র ক্রিসমাসের আগমনী এসেছে প্রকৃতিতে। চারদিকে বরফ জমানো ঠান্ডা। চারদিকে উৎসব। একের পর এক কাজ করে যাচ্ছে সবাই। এসব কিছুই ছুঁয়ে যাচ্ছে না অগাস্টিনকে। জি শার্পের দিকে গেলেই কেমন যেন সুরটা কেটে যায় অগাস্টিনের! অথচ এই জি শার্প চেপে ধরেই কত গানে সুর বসিয়েছিল একদিন! অগাস্টিনের মাথা কাজ করছে না আসলে। একটু দূর রাস্তায় তাকালেই দেখা যায় বিকেলের রাস্তাটা।

                                                        “সারি সারি লেগুনা যায়,
                                                         বন্ধু তোমার দেখা নাই!”

গানটা এই দুইলাইনেই আটকে আছে অনেকদিন। অনুরাধার জন্য অপেক্ষা করতে করতে জামালখান মোড়েই এই দুটো লাইন লিখেছিল। ভাগ্যিস সেইদিন অনুরাধা আসেনি। আসলে হয়ত আর কখনও মালা গানটা গাওয়া হত না অগাস্টিনের। কী যেন নিঃশেষ হওয়ার আকুলতা। অথচ, নিয়মিত ছাতিমের গন্ধে কোকিলটা ডাকছে। বুক ভারী হয়ে ওঠে এমন নিঃশ্বাস! সোফিয়ার বাসাটায় বা মন্দ কীসে! পকেটে টাকা না থাকলেও ঢু মারা যায় গিটার নিয়ে। স্পেশাল বোতল থেকে দুই পেগ মদও গেলা যায়। অগাস্টিনের কিছুই ভালো লাগে না আর। সোফিয়া কিছুক্ষণ আগে চার্চ্চের ভেতর গেল। অগাস্টিন খেয়াল করে দেখে, সোফিয়া যাওয়ার পথে ছেলেমেয়েরা একটু লাফিয়ে সরে গিয়ে পথ করে দেয়। শালা জোচ্চোর কতগুলা, বলে আপনমনেই হেসে ওঠে। যীশু কি কখনও পতিতা দেখলে সরে যেতো? অবশ্য তিনি ছিলেন মহাপুরুষ, কর্ম্ম দিয়ে মানুষ বিচার করতেন না। জীবিত বা মৃত সবাই তার কাছে আশ্বাস পেত। এই তো সেইদিন, এন্ড্রু যখন মারা যায় আত্মহত্যা করে, লাশ নামাতে এসে দেখে মাত্র আট নয়জন মানুষ! আত্মহত্যা কি মৃত নয়? হোক সে পাপী!

অগাস্টিনের মাথা কাজ করছে না। জি শার্প এখনও আটকে দিচ্ছে গানের নোট। এবার গিটারটা রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে আকাশ দেখতে থাকে সে। আকাশ ভরা সাদা সাদা মেঘ। একটা মেঘ একদম রিটায়ার্ড ফাদারের মত। ফাদার কি আকাশ থেকে তাকে এখনও ভালোবাসে? অগাস্টিনের মাথায় ঘুরতে থাকে রক্তকরবীর সংলাপ, আমি পাহাড়ের মত। শূণ্যতায় আমার শোভা…

না, সেইদিন অনুরাধা আর আসেনি। শরৎের মত সাদা মেঘের মেয়ে অনুরাধা। তাতে অগাস্টিনের রাগ হয়নি অবশ্য। বেচারী ঘুমোতে ঘুমোতেই দিন যায়। যতক্ষণ জেগে থাকে, নির্দয় পৃথিবীর নিষ্ঠুর আচরণ সহ্য করতে হয়। এর থেকে অনুরাধা ঘুমিয়ে থাকুক। কিন্তু সেইদিন অগাস্টিনের সাথে সোফিয়ার দেখা হয়ে যায়! নীল গাউন পরে রাণীর মত দাঁড়িয়ে ছিল জামালখান মোড়ে। কেউ কেউ আদর করে অবশ্য বেশ্যারাণীই ডাকে তাকে। অগাস্টিনকে দেখেই হাসতে হাসতে বলল, একটা কলে যাচ্ছি। আমাকে পৌঁছে দেবে? অগাস্টিনও হেসে বলে, গেলে কী খাওয়াবে? বার্গার?? সোফিয়া হঠাৎ গম্ভীর হয়ে যায়, আমাতে তোমার অরুচি। কই একদিনও আমাকে খেলে না। বার্গার খেতে চাও কেন?

সোফিয়ার চোখ চিকচিক করে ওঠে। ততক্ষণে সোফিয়ার উবারের গাড়িও এসে দাঁড়িয়ে গেছে। সোফিয়া উঠে বসেই দরজা খুলে রাখে। কিন্তু অগাস্টিনের দয়া হয়নি সেইদিনও। সোফিয়ার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে উল্টোদিকে হাঁটা দেয়। অগাস্টিন যদি সেইদিন গাড়িতে চড়ত, আজ হয়ত গল্পটা অন্যরকম হত। হয়ত সোফিয়া কলে যেত না আর কোনদিন। হয়ত, সোফিয়া তার মত দেখতে একটা কন্যার মা হত! অগাস্টিন হয়ত প্রতিদিন সোফিয়ার বুকে মাথা রেখে রাতের সব ক্লান্তি উজার করে দিয়ে ঘুমোত।

জামালখানের ছাতিম গাছটার কোকিলের বসন্ত লাগে না। অযাচিতভাবে কুহু কুহু করে ডাকে প্রায়। একমাত্র অগাস্টিন টের পায় কোকিলটা কান্না করে। একদম একা একা কান্না করে। সোফিয়াও কান্না করে একা একা। অনুরাধাও কান্না করে। ওরা কি সবাই একই? অগাস্টিন টের পায় তার গলায় কেমন যেন শোক। আহা রে, ওরা কেউ টের পেলো না ওদের কান্না কেউ শুনে না। ডিসেম্বরের শীতেও কোকিলটা কান্না করছে।

অগাস্টিন ভাবতে ভাবতেই গির্জার বিশাল ঘন্টাটা বেজে ওঠে। সবাই কাজ বন্ধ করে খেতে চলে যায়। শুধু যায় না অগাস্টিন। চার্চ্চের লাগোয়া সেমিট্রির দিকে চেয়ে বারান্দায় বসে থাকে সে। কিছুক্ষণ পর সোফিয়াও এসে বসে, একটু দূরে। নির্ম্মিষে চেয়ে থাকে প্রাচীন কবরগুলোর দিকে। এত পাশাপাশি তবুও কথা বলে না কেউ। অগাস্টিন গিটারের চাবিগুলোর দিকে চেয়ে আছে। সেইদিনের পর আর টিউন বদলায়নি অগাস্টিন। কি হয়েছিল সেইদিন?

সেইদিন কী হয়েছিল কেউ ঠিক জানেনা। অগাস্টিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখে জামালখানের ব্যস্ততা। খুব ধীরে ধীরে জেগে ওঠেছে এই মোড়। প্রকৃতিকে কেটে কেটে ছোট করে ফেলা হয়েছে। এই মোড় এখন অবকাশযাপন কেন্দ্র। তবুও কি মানুষ যান্ত্রিকতা ছাড়তে পারলো? কোকিলটা আবার কাঁদছে। কেউ শুনছে না। নাতির হাত ধরে দাদু চলে যাচ্ছে কথা বলতে বলতে, টুংটুং বেল বাজিয়ে হেলিকপ্টারের মত রিকশাটা চলে গেলো তম্বী যুবতীকে নিয়ে। এজি চার্চ্চের দেয়ালের লাগোয়া চায়ের দোকানে ভীড় বাড়ছে। অথচ কেউ শুনতে পেল না কোকিলের স্বরে যীশুর কান্না!

অগাস্টিন সুর তুলে গিটারে আবার। পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ না করেই বাজাতে থাকে প্রিয় সুরগুলো এক এক করে। সুরের কী মায়া! সেই কোনদিন বেজে ওঠেছিল পৃথিবীতে আদিমতম সুর? কেউ জানে না, তারপর থেকে অবিরত বেজে চলেছে সুর এই পৃথিবীতে। প্রজ্ঞার মত প্রাচীন, জ্ঞানের মত অধরা! অগাস্টিন ভাবতে থাকে, ঠিক কোনদিন লাগানো হয়েছিল এই ছাতিম গাছটি! অমন এক গাছে দেখেছিল রাঙামাটিতে, ৩৫০ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে একইভাবে! ছাতিমের বয়স কেউ নির্দ্ধারণ করেনি এখনও। অগাস্টিনের শুধু মনে আছে, চার্চ্চের ফাদারের হাত ধরে ছোটবেলায় এই পথ ধরে যেতে যেতে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠার কথা। কী বিস্ময়!! সেইদিনও কথা ছিল অনুরাধার হাত ধরে সে হেঁটে যাবে এই পথে। অনুরাধা কথা দিয়েছিল লাল শাড়িটা পরবে। অগাস্টিনকে বলেছিল বাদাম কিনে রাখতে। অগাস্টিন বলতে পারেনি পকেটে একটা কানাকড়িও নেই তার। শুধু বাদামওয়ালার সাথে শর্ত্ত ছিল, গান শোনাবে সে, বিনিময়ে ছোট ঠোঙায় বাদাম নিয়ে যাবে। অগাস্টিন হঠাৎ উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। পথচারীরা একবার বিরক্ত হয়ে তারদিকে তাকিয়েই চলে যায়। কেউ খেয়াল করে দেখিনি অগাস্টিন হাসছে আপনমনে।

অগাস্টিন খুব ক্লান্ত হয়ে হাঁটতে হাঁটতে পেট্রোলিয়াম বাংলোর পাহাড় ধরে চার্চ্চের দিকে যেতে থাকে। তার হাত ভারী হয়ে উঠে গিটারের ওজনে। অযাচিত লাগে এই ওজনটা। এই গিটার তার তৃতীয় হাত! যদি এটা বেহালা হত? কেউ কি অগাস্টিনের বেহালার গান লিখতো? শহরের দিকে পিছন ফিরে দেখে অগাস্টিন। দেয়াল থেকে মায়া মায়া চোখে যীশু তাকিয়ে আছেন লাস্ট সাপারের বাকিসব আহারীদের মুখের দিকে। অগাস্টিন ভেবে পায় না, ম্যাগদালিনের মুখ কে এঁকেছে ওই বৃদ্ধার আদলে, যে কিনা ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে এক মহিলার হ্যান্ডব্যাগ ধরে টান দেয়! মহিলাও কম কীসে! হাতে ছিল ছাতা, বসিয়ে দিল বৃদ্ধার মাথায়। কোন রক্তক্ষরণ হয়নি বৃদ্ধার। শুয়ে ছটফট করতে থাকে! পথচারীরা নাটক ভেবে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ছটফট করতে করতেই তিনদিন অনাহারে থাকা বৃদ্ধাটা মারা গেলো রাস্তায়, একদম অনাদরে! ম্যাগদালিন কি তাই লাস্ট সাপারের টেবিলে বসে আনমনে চেয়েছিল অন্যদিকে? রুটি মুখে তুলে নেয়নি কেন ম্যাগদালিন?

অগাস্টিন আবার রাস্তায় চোখ ফেরায়। একের পর এক লেগুনা আসছে তো আসছে। ওইতো! লাল শাড়ি!! অনুরাধা এসেছে!! অগাস্টিন দৌঁড়াতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। কই না তো, এ তো লালসালু! শাড়ি কোথায়? অনুরাধার নিশ্চয় দাঁড়ি গজায় না! হাসতে গিয়েও অগাস্টিনের হাসি আসে না। আবার ক্লান্ত শরীরে পাহাড় বাইতে থাকে সে। বৈশিষ্ট্যহীন অগাস্টিন সবার দৃষ্টির বাইরে ক্রিসমাস ট্রি’র সামনে এসে দাঁড়ায়। ছোট থাকতে কত আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত সান্তার জন্য! সান্তা ক্লজের হাতে উপহারের ঝুলি। নেচেকুঁদে সবাইকে হাসাতে হাসাতে উপহার বিলি করত। সান্তার ঝুলি কি অনুরাধাকে আটকাতে খুবই ছোট? অনুরাধা যদি একদিন সান্তার ঝুলি থেকে বেড়িয়ে এসে বলত, অগাস্টিন! না, সান্তার কাছ থেকে খুঁজে নেওয়ার বয়স পার হয়ে গেছে অগাস্টিনের। যদি পেত তবে সোফিয়ার জন্য একটা স্বাভাবিক জীবন চাইত অগাস্টিন! অগাস্টিন আবার উঠে আসে চার্চ্চে। চার্চ্চের যীশুর মুখ নামানো। হঠাৎ খুব রাগ হয় অগাস্টিনের। এমন মুখ নামানো ঈশ্বরপুত্র কেন তুমি? মুখ তুলে রাখলে অন্তত একবার দেখতে আমাদের! সারাজীবন নীচের দিকে চেয়ে কাটালে! পরিত্রাণকারী না তুমি?? সোফিয়া কেন পরিত্রাণ পায় না যীশু?

হঠাৎ একটা ঘুঘু উড়ে এসে বসে এপিটাফে। একদম গোঁসাই’দার ঘুঘুটার মত। গোঁসাই’দার ঘুঘুটাও এইভাবে উড়ে এসে বসে তাদের ছাদে। গোঁসাই’দার মেয়ে আব্দার করে, একটা ঘুঘু কিভাবে একা থাকবে, তার কি সঙ্গী দরকার হয় না? গোঁসাই’দা জোড় মিলিয়ে আরো একটা ঘুঘু কিনে আনে। এরপর গোঁসাই’দার স্কাল্পচার বদলে যায়। শুধু ঘুঘু বানাতো। ঘুঘুদের কি কান্না হয় কোকিলের মত? সোফিয়া কাঁদছে। ঠিক একলা কোকিলটার মত। ছাতিমের সুভাস তো আসেনি চার্চ্চ অব্দি! সোফিয়া কান্না করে কেন? সোফিয়ার বুকে লুকিয়ে থাকা তক্ষকটা কি সোফিয়াকে কাঁদায়! সোফিয়া! তুমি কান্না কর না! সোফিয়া, তোমার কান্নার খবর যে দৈনিক পত্রিকায় ছাপানো হবে না! তোমার কান্না নিয়ে কেউ গান লেখবে না! তুমি যে পতিতা। তোমার কান্নায় কিছুই যায় আসে না এই অগাস্টিনের! সোফিয়া! এসো কান্না মুছে দেই তোমার! কিন্তু আর বলা হয় না অগাস্টিনের। অগাস্টিনের চোখ ভিজে না! অগাস্টিন কি কান্না করেনা? মনে মনে সমুদ্র বানাচ্ছে অগাস্টিন।

নাজারাতের যিশু জন্ম নেওয়ার প্রাক্কালে, হাজার বছরেরও পর যখন এই ঘটনা ঘটছে জামালখান মোড়ে, অনুরাধা তখনও ঘুমে। ঘুমে ঘুমে অনুরাধা একটা ঘুঘু হয়ে যায়। উড়তে উড়তে পার করে লাকসামের ব্যস্ত স্টেশন, কুমিল্লার মৃত নগরী, সীতাকুন্ডের পাহাড়, অলংকার, জিইসি, জামালখান। একটা ঘুঘু হয়ে এসে বসে এপিটাফের উপর। এপিটাফের গোড়ায় অল্প করে ঘাস জমেছে। তীক্ষ্ণ চঞ্চু দিয়ে তুলে পরিষ্কার করে ঘাসগুলো। যীশু আসছে! তিন জ্ঞানী ব্যক্তি উপহার নিয়ে পৌঁছালো বলে। তারাটাও আজ উঠবে, প্রত্যেক বছরের মত। হয়ত আরো উজ্জ্বল হয়ে! আজ যীশু আসবে একটি গোয়ালঘরে। কিন্তু অনুরাধার আর লেগুনা থেকে নামা হয় না অপেক্ষারত অগাস্টিনের জন্য।

সোফিয়া উঠে পরে। সবাই কাজে ফেরে। কেউ লক্ষ করেনি সোফিয়া মাথা নিচু করে চোখ মুছতে মুছতে অগাস্টিন যেখানে বসেছিল, সেখানে গিয়ে বসেছে। সোফিয়ার কান্না খুবই তুচ্ছ। যীশুর জন্মের সময় প্রকৃতি যেমনটা হেসেছিল, সোফিয়া পারে না সেইভাবে হাসতে! প্রত্যাখান যে বড় কঠিন। সোফিয়ার বুকে লুকিয়ে থাকা তক্ষকটা আবার ডেকে ওঠে। টোটটেং টোট টেং…

অগাস্টিনের জি শার্প বাজাতে গিয়েও আর বাজানো হয় না! তক্ষকের ডাকটা খুব স্পষ্ট শুনতে পেল! একদম জি শার্পে। কীভাবে হয়! এই তো আবার ডাকলো! তার সাথে সুর মিলিয়ে ঘুঘুটাও ডেকে ওঠে। হ্যাঁ, সেও জি শার্পে ডাকছে! অগাস্টিনের নাম ধরে ডাকলো কি? অগাস্টিন যীশুর দিকে চেয়ে ফিরে। একি! কাঠের যীশু যে তার দিকে চেয়ে আছে! হাসছে যীশু!! এত নিষ্পাপ কীভাবে হাসেন ঈশ্বরপুত্র? এই হাসিতেই পাপীদের মন পবিত্র হয়। বসন্তে কোকিল গেয়ে ওঠে। শীতের নিদ্রা ভেঙে সাপেরা বের হয় খাদ্য সন্ধানে। যীশু হেসো না! পবিত্র ঈশ্বরপুত্র!

অগাস্টিন ভালো করে চেয়ে দেখে শূন্য হলঘর। কী সুন্দর শূণ্যতা! সারি সারি বেঞ্চগুলো সব অপেক্ষায় আছে, যীশুর পৃথিবীতে আসার শব্দ শুনতে। হায় যীশু! এক জীবনে মানবের তরে এত কষ্ট আর কেউ সহ্য করেছিল? অগাস্টিনের হাজার বছরের প্রতিজ্ঞা ভেঙে যায়। কাঁদতে কাঁদতে বসে পরে যীশুর সামনে। ‘ত্রাণকর্ত্তা, তুমি দেখ আমি কাঁদছি। অনুরাধা আজও আসেনি। সোফিয়ার তক্ষক কেঁদে কেঁদে ওঠে। হে পবিত্র যীশু, ভালবাসার বাইবেলে যে ধূলো জমে! পিতা কেনো দেখে না? এ্যাডামের সেই আপেল খাওয়ার পর থেকে জ্বলছি, তুমি দেখছ না? হায় ঈশ্বর, হায় ঈশ্বরপুত্র! দেখ তোমরা! সোফিয়া পাপের থেকেও আদিম প্রেমে কাঁদছে! তোমার দয়া হয় না যীশু? কীভাবে পার ঈভের মেয়ের কান্না সহ্য করতে? অনুরাধার যে ঘুম ভাঙেনি এখনও! যীশু চেয়ে দেখ, চেয়ে দেখ সোফিয়ার ভাঙন।’

গাছেরা শনশন আওয়াজ করে ঈশ্বরপুত্রের জন্মের আগমনীর জয়ধ্বনিতে। ঘুঘুটা উড়ে যায়। তাকে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে। প্রত্যেকবছরের মত আজকেও কবরটা পরিষ্কার করে গেল নীরবে। এবং প্রত্যেকবারের মত এবারেও কেউ খেয়াল করেনি। আবার ঢং ঢং করে বেজে ওঠে গীর্জার ঘন্টাটা। অগাস্টিনের সময় হয়ে যায়। গিটার হাতে সে এগোতে থাকে তার কবরের দিকে। সোফিয়া কখন যেন এসে কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পতিতা ছুঁয়ে দিলে কি কবর অপবিত্র হয়? অগাস্টিনতো তার কাছে একজন সেইন্ট ছিলো! সেইন্টরা কি অপবিত্র হয় কখনও? অগাস্টিনকে এত কড়াভাবে বলা উচিত হয়নি সেইদিন। অগাস্টিনকে তো সে পেয়েছিল অন্যভাবে। সে পৃথিবীতে এসেছিল যীশুর গান ফেরি করতে। সোফিয়া আবার কাঁদতে শুরু করে। পৃথিবীতে যাকে সে এত ভালবাসতো তার মৃত্যু কি খুব দরকার ছিল ঈশ্বর? তার বদলে আমাকে নিলে না কেন পিতা? আমার বেঁচে থাকা যে তোমার নরকে থাকার সমান। আমাকে যে কেউ ভালোবাসে না পিতা! অগাস্টিন না হয় দূরেই থাকতো! দূর থেকেও কি ভালোবাসতে পারবো না আমি?

ফাদার সোফিয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। সোফিয়ার কান্না দেখতে দেখতে তার মনে পরে যায় কেরালার ঘন নীল আকাশের কথা। সোফিয়া নীল গাউনটায় পরে কেন প্রত্যেকবছর এইদিনে? ফাদার উচ্চস্বরে প্রার্থনা শুরু করে অগাস্টিনের নামফলকের দিকে চেয়ে, “নাজারাতের যীশু যখন জন্ম নিলেন মানবের কল্যাণে, ঈশ্বর বার্ত্তা পাঠাল তিনজন জ্ঞানী ব্যক্তির কাছে। তারা উল্লাসিত হয়ে একে অপরকে অভিবাদন জানায়। তারপর হাঁটতে শুরু করে তারার নির্দ্দেশনা অনুযায়ী…”

সোফিয়ার বুকে লুকিয়ে থাকা তক্ষকটা আবার ডেকে ওঠে একদম নিঁখুত জি শার্পে, টোটটেং টোট টেং…

20232780_10209909098627676_1607613617813110204_oঈশান বড়ুয়া
জন্ম— সেপ্টেম্বর, ১৬, ১৯৯২। নিবাস— রাউজান, চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার