জংলা নদীর ধারে
ধ্যানী বক,
আমাকে ধর্ম্মের শিক্ষা দেয়,
কেমন ভাবের মর্ম্মে
দাঁড়িয়ে থাকতে হয়
এক পায়ে;
যেমনটা আছে মাননীয় তালগাছ! …
পাঠশালা,
ধর্ম্মশিক্ষা জানে,
বারবার
লাড্ডু খাওয়া আমি,
রসার্থে সন্ধান করি
ভবাপাগলার মালাই বিতান! …
মাড়াই পথের মোড়
নিতাইগঞ্জের। …
জংলা নদীর ধারে
(ধ্যানী বক,
করমে ন জানে ধরম বিতান! …)
অকূলে বাজে গো বাঁশী:
ওহো
জয় রাধা > ধারা …
ভাঙাগড়া নদীটার মনে
বহতা সুরের
ঢেউউউ
কাঁখের কলসে বাজে
ছলাৎ! ছলাৎ! পরিবর্ত্তনা চৌধুরাণী। …— পরিবর্ত্তনা চৌধুরাণী ।। আরণ্যক টিটো
প্রতিষ্ঠিত সমাজ, সভ্যতা, রাষ্ট্র, ধর্ম্ম, বিশ্বাস সবকিছুকেই একদিন পরিবর্ত্তনের মুখোমুখী হতে হবে। যতই আমরা স্থিতির খুঁটী আঁকড়ে ধরে থাকি কিংবা পরিবর্ত্তনকে অস্বীকার করার মানসে যতই চোখ বন্ধ করে রাখি, পরিবর্ত্তনের স্রোত আমাদের ভাসাবেই। … প্রকৃতি নিজস্ব প্রবাহের ভারসাম্য রক্ষায় পরিবর্ত্তিত হবেই, পরিবর্ত্তন ঘটাবেই। হাজার হাজার বছরের চলমান ইতিহাস এ-ই সাক্ষ্যই দেয়। …
‘পরিবর্ত্তনা চৌধুরাণী’ পরিবর্ত্তন বিষয়ক মরমিয়া উপলব্ধিজাত কবিতা। শিরোনাম পড়লেই বুঝা যায়, কথক পরিবর্ত্তনকে নারী-রূপে কল্পনা করেছেন। একি নিছক নিজের ভিন্নতা প্রকাশের জন্য নাকি অন্য কারণ? … এখানে পরমাপ্রকৃতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর যেমন আভাস পাওয়া যাচ্ছে তেমনি আভাস পাওয়া যাচ্ছে শাক্ততন্ত্রের। কারণ শাক্ততন্ত্র মতে, প্রকৃতি নিজেই শক্তি দেবী এবং কালী, চণ্ডী, ডোম্বী প্রভৃতি নামধারী শক্তি/দুর্গা দেবীর বিভিন্ন রূপই জগৎ পরিবর্ত্তনের কারণ। …
হতে পারে, পরিবর্ত্তনই কাক্সিক্ষত সখী— পরিবর্ত্তনা চৌধুরাণী …
কবিতার শুরুতে বলা হচ্ছে, জংলা নদীর ধারে ধ্যানী বক কথককে ধর্ম্মের শিক্ষা দিচ্ছে। শিক্ষা দিচ্ছে, কেমন করে ভাবের মর্ম্মে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এক পায়ে কিংবা মাননীয় তালগাছটার মত। …
নদীর ধারে কিংবা বিলের মাঝে কোন বককে এক পায়ে কিংবা দু’পায়ে নিশ্চুপ ধ্যানস্থের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে আমাদের মনে হতে পারে, এ তাপসপক্ষী কোন জন্মে অবশ্যই কোন মুনিঋষি ছিল। কিন্তু মুরুব্বীরা বলেন, বক পাখীর এমন ধ্যানস্থ হওয়ার ব্যাপার নাকি আসলে তার শিকারের প্রস্তুতি। অর্থাৎ মাছের সাথে একপ্রকার ছলনা। এজন্য ধর্ম্মের লেবাসধারী শিকারী লোকদেরও বক-ধার্ম্মিক বলা হয়। আমাদের মধ্যযুগের সাহিত্যগ্রন্থ ময়মনসিংহ গীতিকায়ও এমন কথা পাওয়া যায়। পণ্ডিত সমাজও হয়ত এ ব্যাপারে সায় দেন। বক-ধার্ম্মিক শব্দের অর্থ সকলের জানার কথা। অভিধানে এ শব্দের পরেই আরও কিছু শব্দ উল্লেখ থাকতে পারে— বক-বৃত্তি, বক-ব্রতী প্রভৃতি। বক-ধার্ম্মিক শব্দের মানে যারা জানবে তারা এরকম অন্য শব্দেরও অর্থ বের করে নিতে পারবে। …
মজার ব্যাপার হচ্ছে পাখী-বক শুধু নিজেই ধ্যান করে কিন্তু মানুষ-বক শুধু নিজে ধ্যান করে না, অপরকে ধ্যান বিষয়ক শিক্ষাও দেয় আর নিজের বক্তব্যের বিশ্বাসযোগ্যতার যুক্তি বা দৃষ্টান্তস্বরূপ তালগাছের গল্প উপস্থাপন করে। তালগাছের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বক নিজের সমর্থন যুগিয়েছে আর কথক বক চরিত্রের ওপর একটু প্রশংসার প্রলেপ লাগিয়েছেন। … কবিতার এ চরণে গূঢ়ার্থমূলক অলঙ্কার ব্যাবহার করা হয়েছে। তাই এখানে বাচ্যার্থের বাইরে আরেকটা গূূঢ়ার্থও আছে। প্রশংসার ছলে নিন্দা করায় এইটা আব-ার ব্যাজস্তুতি অলঙ্কারও ধরা যাবে। চরণটার গূঢ়ার্থ অনুসন্ধানের জন্য আমরা বকপক্ষীকে যে কোন প্রতিষ্ঠানের (প্রতি)নিধি বলে ভাবতে পারি আর প্রতিষ্ঠানটা হতে পারে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্ম্মীয় যে কোন প্রতিষ্ঠান। বকের ভাষায়, যেইটা মহিমাময় তালগাছ আর এই তালগাছেই আসলে বকের বাসস্থান। … এখানে প্রশ্ন হতে পারে, বক কেন জংলা নদীর ধারকে বেছে নিয়েছে? কারণ হতে পারে, জংলাবিশিষ্ট নদীই শিকার এবং লোকের চোখে ধ্যানী বলে প্রতীয়মান হবার উপযুক্ত স্থান। বকের ধ্যানশিক্ষা দেবার ব্যাপারটা আসলে প্রতিষ্ঠানের (প্রতি)নিধির স্বীয় প্রতিষ্ঠানের প্রচার আর তালগাছের মহিমার ব্যাপারটা তার প্রতিষ্ঠানের মজবুত ভিতের মহিমা। যা শুনে শ্রোতার অন্তরে প্রতিষ্ঠানের ধারণাটা অনেক মহৎ বলে অঙ্কুরিত হয়! …
পরের চরণে বলা হচ্ছে—
পাঠশালা,
ধর্ম্মশিক্ষা জানে,
বারবার
লাড্ডু খাওয়া আমি,
রসার্থে সন্ধান করি
ভবাপাগলার মালাই বিতান! …
দেখা যাচ্ছে এখানেও ব্যাজস্তুতি অলঙ্কার ব্যাবহৃত হয়েছে। পূর্ব্বের চরণে আমরা দেখেছি, প্রশংসার ছলে নিন্দা করা হয়েছে আর এখানে আত্ম-নিন্দার ছলে নিজের প্রশংসা করা হয়েছে। প্রশংসার ছলে পাঠশালার/ধর্ম্মশিক্ষারও নিন্দা করা হয়েছে। অর্থাৎ এখানে কথক পাঠশালার অযোগ্য না বরং পাঠশালা আর ধর্ম্মশিক্ষাই কথকের অযোগ্য। কারণ প্রেমে … ভাবে … উদ্দীপ্ত কথক একজন রসিক ভাবুক। ভোগ অপেক্ষা (উপ)ভোগের মূল্যই তার কাছে বেশী। স্বার্থ সিদ্ধির কোন প্রতিষ্ঠান তার যোগ্য হতে পারে না। কথকের দরকার রসের। তাই ভবা পাগলার মালাই বিতান সন্ধান করা তার কাছে প্রতিষ্ঠানের চেয়ে জরুরী। রস বলতে এখানে মনে হয়, হৃদয়ের খোরাককে বুঝানো হয়েছে। তাই হয়ত ভবা পাগলার মালাই বিতান নিতাইগঞ্জ বা নিতাইগঞ্জের মোড়ের কথা বলা হচ্ছে। এসব শব্দ দিয়ে আধ্যাত্মিক সাধকরা মনজিলে মকছুদ, অচিনপুর, আয়নামহলের মত স্থানকেই নির্দ্দেশ করে। …
জংলা নদীর ধারে ধ্যানী বক কর্ম্ম না জানা ধর্ম্ম বিতানের মত। … এখানে ‘করমে ন জানে ধরমবিতান’ পংক্তি মধ্যযুগের সাহিত্য থেকে আন্তর্বয়ান করা হয়েছে। মূল টেক্সট থেকে এতে একেবারে ভিন্ন অর্থ আরোপ করা হয়নি তবে অর্থের বিস্তার অবশ্যই ঘটেছে। ধর্ম্মবিতান এখানে ধ্যানী বকের উপমান। তাই ধর্ম্মবিতান যেমন ধর্ম্মমণ্ডপ তেমনি প্রতিষ্ঠানের (প্রতি)নিধি কিংবা স্বয়ং প্রতিষ্ঠান। তাহলে ধর্ম্মবিতানের কর্ম্ম না জানার অর্থ কী হতে পারে?! … কর্ম্মের কারণেই ধর্ম্ম নষ্ট হয়, কর্ম্মই ধর্ম্ম— এমন অনেক কথা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। যেগুলোর মূল ভিত্তি গীতা কিংবা গীতার নিষ্কাম কর্ম্ম বিষয়ক ধারণা। … এখন ভাবতে পারি, বকরূপী প্রতিষ্ঠানের (প্রতি)নিধি ধার্ম্মিক কপট ভণ্ড লোকেরা কর্ম্মফলের লোভে অর্থাৎ স্বার্থরক্ষার মোহে জগৎ ও প্রকৃতির পরিবর্ত্তন সমূহকে অস্বীকার করে। ভাবে, তার এই ‘প্রতিষ্ঠান’ ‘রীতি’ ‘নীতি’ চিরদিন টিকে থাকবে। কিন্তু তা কি আসলে সম্ভব? …
অকূলে বাঁশী বেজে উঠছে— ‘ওহো জয় রাধা > ধারা’ নামে …
এ বাঁশী আসলে প্রকৃতির (নী)রব সংকেত, সৃষ্টিপ্রবাহ কিংবা সৃষ্টিধারার কম্পন/শব্দ। … পণ্ডিতদের মতে, রাধা শব্দের আদি রূপ ধারা। এখানে (>) নির্দ্দিষ্ট চিহ্ন ব্যাবহার করে একথাই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। …
একূলে বাঁশী বাজছে, সে সুরের ঢেউ উঠছে ভাঙা-গড়া নদীর মনে আর সে ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ ছুঁয়ে যাচ্ছে কাঁখের কলসীকে। …
পরিবর্ত্তনা চৌধুরাণী আসবে! …
পরিবর্ত্তনের প্রতাপে শুধু তালগাছ নয়, আমাদের প্রচলিত ‘প্রতিষ্ঠান’ ‘রীতি’ ‘নীতি’ ‘বিশ্বাস’ ‘ধারণা’ ‘মতবাদ’ সবকিছু ভেঙে গড়ে ওঠবে নতুনত্বে… নতুন নামে… নতুন মাত্রায়। … এ-ই প্রকৃতি … এ-ই প্রকৃতির বয়ে চলার ধারা। … ভাঙা গড়া নদীটার মনে বহতা সুরের ঢেউ উঠছে … বাজছে … কোমর কিংবা বগলের কলসীতে। ঢেউ এক জায়গায় তার আঘাত অন্যত্র— এটাকে আমরা অসঙ্গতি অলঙ্কার ধরতে পারি। তাহলে কাঁখের কলসীটা কী? কলসীটা হতে পারে আমাদের সমাজ সভ্যতার প্রাণবাহী জলের আধার! আমাদের এই ব-দ্বীপ অঞ্চলের জন্য নদী এমন এক জায়গা যার প্রবাহে পরিবর্ত্তন আসলে পরিবর্ত্তন আসতে পারে ভূখণ্ডে, ভূখ- থেকে আমাদের জীবন ধারায়। … হতে পারে, ভাঙা-গড়া নদীটা এখানে পরিবর্ত্তনের দৃষ্টান্ত মাত্র। যাতে কাঁখের কলসীটা স্পর্শ করালেই বেজে উঠছে পরিবর্ত্তনের ভাষা। …
এমনও হতে পারে যে, নদীর জলে বয়ে যাচ্ছে পরিবর্ত্তনের ধারা আর সেই জল কাঁখের কলসে ‘ছলাৎ … ছলাৎ …’ বয়ে যাচ্ছে (ব)দ্বীপবাসীর ঘরে ঘরে! …
দ্বীপ দিদার
জন্ম: ০৭ ডিসেম্বর ১৯৯১, মাতারবাড়ী, মহেশখালী, কক্সবাজার। প্রকাশিত গ্রন্থ: সহপাঠ গুপি গাইন, বাঘা বাইন…
{পরিবর্ত্তনা চৌধুরাণী : পরিবর্ত্তন বিষয়ক খসড়া [বঙ্গীয় শব্দকোষ (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়), বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ বিধি (কলিম খান-রবি চক্রবর্তী) ও প্রকৃতিপুরুষ ভাষাদর্শন অনুসৃত] চারবাক-এর বানান রীতিতে (যথাসম্ভব) সম্পাদিত ও প্রকাশিত হল।
— সম্পাদকীয়}