আমরা নিজেদের চিনে উঠতে পারিনা সম্যকভাবে, বহু বহুদিন পরেও, তাহলে কীভাবে ভেবে নিই যে অন্য কাউকে বুঝতে পারব?! অথচ চেষ্টাটা হয়ত সবার মধ্যেই থাকে। কারুর কম, কারুর মধ্যে বেশি।
ভণিতা না করে চলে যাই আজকে যে বিষয়টা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
একটা ছেলে, জন্ম থেকে না হোক, জ্ঞান হবার বয়েস থেকে শুনে আসে তাকে হতে হবে শক্তপোক্ত— সে শারীরিক হোক বা মানসিক দিক, যেটাই হোক। যদিও তারা যথেচ্ছ ভালবাসা ও পরিবারের সকলের মধ্যমণি হয়েই বেড়ে ওঠে— তবুও, ওই অলিখিত নিয়মটি কেন কে জানে তাদের ওপর ন্যস্ত থাকে…
এ সমস্ত আলোচনা অবশ্য আমি একটি সাধারণ আবহে বড় হয়ে ওঠা শিশুকে নিয়েই করবো। জীবন যাকে নানান বিশ্রী পরিস্থিতিতে ফেলেছে ছোট থেকেই, সেই মানুষের বলাই বাহুল্য, এমনিতেই বেশি যত্ন, সাহচর্য্য ও ভালবাসা লাগেই।
তো, এখন এগোনো যাক আমাদের বিষয়বস্তু নিয়ে আরেকটু বিস্তৃত পরিসরে। কী বলতে চাইছি আমি, ঠিক ঠিক? এইটা আপনাদের কাছে আমি এখনো বলিনি সহজভাবে, যাকে বলে “জলবৎ তরলং”! যাই হোক, অহেতুক শব্দের খেলা বাদ দিয়ে দ্রুত মূল বিষয়ে চলে যাই।
একটি পুরুষ, তার বাচ্চা বয়স থেকে সঙ্গীসাথীদের সাথে খেলাধুলো, পড়াশোনার মাধ্যমে অনেক কিছুই শিখে নেয়, যেটা হয়ত পারিবারিক গন্ডীতে সামনে আসে না। তার শিশুমনে অনেক ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারার প্রভাব পড়ে। সাধারণত, আমাদের উপমহাদেশের মানুষরা, তাদের ছেলে সন্তানকে কোনভাবে মাথায় প্রোথিত করে দিতে চান একটাই কথা— “সে এক লৌহপুরুষ, সিংহের ন্যায় তার শক্তি, হাতির মত তার যুথবদ্ধতার গুণ”— ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এই ধারণাই মোটামুটি আরেকবার বলবৎ হয়, যখন সে পড়ার নাম করছ বহির্বিশ্বে পা রাখে। স্কুল জীবনের অজস্র খুনসুটি, স্যারদের কঠোরতা-মিশ্রিত-ভালবাসার ছায়ায় বেড়ে ওঠা, ক্লাসের অসংখ্য কাঁচা, সদ্য শেখা অশালীন ভাষা প্রয়োগ সমূহ পেরিয়ে, বয়ঃসন্ধিতে প্রবেশ করে তারা। সেই “ম্যাচো”, ইমেজের আরোই কদর বেড়ে যায় পারিপার্শ্বিকে! আশপাশের কন্যা শিশুরা তখন সদ্যযৌবনা, তরুণী! সেই প্রজাপতিকে বশ করার যে এক অদ্ভুত এবং অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়— সে আর জীবনভর থামে না।
কলেজ থেকে পেশার খাতিরে জীবনের চাকায় গড়িয়ে, পিষে যায় দিনগুলি।
আমি এসব কেন বললাম? ঠিক কী বলতে চাইছি, বলুন তো?!
আমি যা যা বললাম, এগুলো পড়ে সবাই বলবে, “হ্যাঁ, তা এরকমই তো হয়! নতুনত্ব কী দেখলেন আপনি এতে!?”
হুম। ঠিক। প্রায় এরকমই হয়, হুবহু এসব না হলেও।
এখানে আমি প্রথমেই যেটা বলতে চেয়েছি, সেটা হল ছেলেদের ওপর একপ্রকার, একতরফা চাপিয়ে দেওয়া একটি মতবাদ, যা দীর্ঘসময় ধরে প্রচলিত, বোধহয় বিশ্বের সর্ব্বত্র!
একটা ছেলেকে, “পুরুষসিংহ”, হতেই হবে!
সে ঠিক— ভুল না জানলেও, এঁড়ে তর্ক্ক করতেই হবে সবসময়। তাকে কখনো নিজেকে নমনীয় দেখানো থেকে বিরত থাকতে হবে। সে সর্ব্বদা হাসিমুখে থাকবে বা গাম্ভীর্যের আড়ালে নিজের আসল সত্তাকে লুকিয়ে রাখতে হবে!
কেন?!
— “পাছে লোকে কিছু বলে!” এইজন্য!
এরজন্য তারা তাদের ফেমিনিন দিকটা বের করতে, দেখতে ভয় পায় নিজেরাই, আর অন্যের কাছে কী সহজ হবে! প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে একটা ফেমিনিন আর ম্যাসকুলিন, দুইরকমের ভাগই আছে। এটা সবার পার্সোনালিটিতেই থাকে।
হরমোন আর বায়োকেমিস্ট্রির ভারসাম্য মেনটেনের খেলায়, আমাদের ব্যবহার নির্ভর করে। সেটা অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছি, পরে এ নিয়ে আরো বলব।
যেটা বলছিলাম— একটা ছেলেও সেনসেটিভ হয়। নরম মনের অধিকারী হয়, ব্যথা পায় কাছের কেউ ঠকালে বা হৃদয় নিয়ে খেলা করে গেলে। উপরন্তু রয়েছে তাদের শরীরের প্রতি অমোঘ টান। মুশকিল হল, বেশিরভাগ মেয়েদের মধ্যে অনেক বাধা কাজ করে, যার দরুণ তারা নিজেদের চাহিদা সম্বন্ধে এমনিতেই ওয়াকিবহাল হয় না বা তাদের মতামত ও বিশেষ কেউ জানতেও চায়না।
কিন্তু ছেলেটি তো এমনিও বিপদে পড়ে, ওমনিতেও। আপনি তাকে সামাজিক নিয়মে জুতে গোয়ালের গরু বানাতে সংসারের হালে লাগিয়ে দিন বা সে নিজের মত কিছুসময় একলা থাকুক— ফলাফল প্রায় এক। এরা মোটামুটি নারী-বিবর্জ্জিত সমাজে অনেকদিন বড় হয়ে ওঠে হঠাৎ করে মেয়েদের দেখে যারপরনাই থতমত খেয়ে যায়। তারপর আসে দ্বিধাদন্দ আর পাহাড়সম ভয় ডিঙিয়ে এই উল্টো অথচ পরিপূরক প্রজাতিটির কাছে যাওয়া।
কীভাবে মিলমিশ হয়, কতদিনে এবং কেন বা কোন্ পরিস্থিতিতে, আমি তার মধ্যে যাচ্ছি না। রোমান্টিক বা অন্য জঁরের অনেক নভেল লিখে ফেলব না-হলে। যেটা বলার, সেটা হল— প্রায় একটি অন্ধমানুষের হাতিদর্শনের মত করেই তাদের, নারীদর্শন বা নারীসঙ্গের অভিজ্ঞতা হয়!
আমি ভুল বললে অবশ্যই সম্মানিত বন্ধু পাঠককুল শুধরে দেবেন; কিন্তু এগুলো আমি একদম আমার মনের খাঁটি চিন্তাগুলো বললাম। আশপাশে ভাই, বন্ধুদের দেখেশুনে, আমার এই ধারণা বহুদিন ধরেই আছে। তারা না পারে কারোর কাছে সহজভাবে নিজেদের তুলে ধরতে, আবার এমনটাও খুব কম হয়, যে কোন মেয়ে নিজে থেকেই বুঝে, পড়ে ফেলে তাকে/তাদের!
ওই যে ছোট থেকে ইগোর পাহাড়ে তারা চেপে বসে, আফসোস, ওইখান থেকে দেখলে, পৃথিবী সুন্দর নাও লাগতে পারে। এরসাথেই দু-একটি ফেইলড রিলেশনের ঠেলায় ভয়, লজ্জা, ব্যথা— সব জড়ো হয়। মানুষকে বিশ্বাস করা দূরস্থান, তারা তখন নিজেদের ওই অনূভুতির জায়গাটাকেই প্রাণপন মেরে ফেলার চেষ্টায় থাকে।
আর, আমরা তখন তাদের হৃদয়হীন, পাথর, অসংবেদী, কাঠখোট্টা, অসভ্য দেহলোভী, প্রতারক ইত্যাদি ভূষণে, ভূষিত করি।
যেখানে, তাদের হয়ত সহজেই একটু ভাল ব্যবহার, ভালবাসা দিয়ে জয় করা সহজ হতে পারত।
খুব কঠিন না, একটি ছেলেকে বুঝে, ভালোবাসতে পারা। হ্যাঁ, অনেকেই বলবেন এবারেও, “ওমা এ আর নতুন কী, এত আমরা করিই, চাইই তো ভালবাসতে!” — ঠিক। ঠিক।
কিন্তু…
একটা, কিন্তু আসছেনা, কথার মধ্যে? আসার কথা। পুরুষরা যে রুপেই আমাদের জীবনে থাকুক— বাবা, ভাই/দাদা, প্রেমিক/বর বা বন্ধু… আমরা বোধহয় সবটুকু তাদের কখনোই বুঝতে পারি না।
তারা সেটা হতে দিতে চায় না। ওই যে মাথায় কাঁটার মুকুট পরে জীবনে চলা শুরু করে, হাজার অপমান, ঝড়ঝঞ্ঝার পরেও তাদের গাম্ভীর্যপূর্ণ ব্যবহার করে যেতে হয়। প্রেয়সীর কাছে অকাতরে আদরের বাসনা বুকে চেপেই হয়ত অন্য কোন কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হয়। হাজার কষ্টেও, রাগের মুখোশটাই…
প্রিয় পুরুষরা,
এরকম করবেন না। যার কাছে শান্তি পান, সেই মানুষটিকে আপনার জীবনে আসতে ও থাকতে দিন সর্ব্বতোভাবে। মনের মিলের ঘাটতি না থাকলে, শারীরিক সুখও কতগুণে বেড়ে যায়! উভয় পার্টনার, নিজেদের বুঝলে— সে ভালবাসা, সে জীবন আরো কত আনন্দের, সুখের হয়, হতে পারে! অযথা হয়ত মাঝরাস্তায় সম্পর্ক ভাঙেনা…
ওপরে এমন অনেক কথা বলেছি, যেগুলো আমাদের সকলের জন্যই প্রযোজ্য। তবে আমি জোর দিলাম ছেলেদের ওপর; মেয়েদের নিয়ে কেউ না কেউ বলেনই, আমিও লিখবো।
কিন্তু এই লেখাটা আমার সমস্ত ভাইব্রাদার, বন্ধুমানুষ ও অন্যান্য সম্পর্কের ছেলেদের জন্য। আপনারা ভালো না থাকলে, আমরাও ভালো থাকি না ।
সেটা জানেন?!…
পৌষালী সেনগুপ্ত
জন্ম : ০৪ জাননুয়ারী, ১৯৮০।
জন্মস্থান : আগরতলা, ত্রিপুরা। ছোটবেলা ওখানে থাকা পিতার চাকুরী সূত্রে, পরবর্ত্তীতে কলিকাতায় আবাসিক স্কুলে পড়তে চলে আসা। ইংরাজী মাধ্যমে পড়লেও, বাংলা ভাষা, যা মাতৃভাষা— তার প্রতি অনুরাগ অটুট রয়েছে পারিবারিক শিক্ষার দরুন।
প্রকাশিত কবিতার বইগুলি : অযাপিত জীবন— ২০১৯; জাগরণ পাবলিশার। ইচ্ছেঘুড়ির টানে— ২০২০; বার্তা প্রকাশন।