গানটি শুনেননি এমন কেউ আছেন যারা সত্তর আশির দশকে নিয়মিত রেডিও শুনতেন! আমার এক পরিচিতার নাম ছিল বেলা, অবাক হয়ে ভাবতাম বেলাপু কীভাবে বয়ে যায়! মধুমতী গ্রামের নাম সেটা ঠিক বুঝতে পেলেও বেলাপুর বয়ে যাওয়াটা ঠিক বুঝতাম না। এরপর ব্যাকরণ বইতে পেলাম “বেলা যে পড়ে এল, সখী জলকে চল”— আহা কী সুমিষ্ট! আমি যে কতবার করে পড়তাম, আর ভাবতাম বেলা পড়ে অথচ জলকে যেতে বলে কেন? আসলে অনেক কিছু না বুঝেও নিজের মত বুঝে নেওয়া যাকে বলে। বাংলায় একটি শব্দের অনেক অর্থ আছে। ধরি একটি শব্দের দশটি অর্থ থেকে একটি রাখা হল আর বাকী নয়টি শব্দ কেটে ফেলা হল, তখন কী হবে? হ্যাঁ, কেটে ফেলা হচ্ছে সহজীকরণের জন্য। ইংরেজী ভাষার অনেক শব্দ হারিয়ে গেছে, বাংলা ভাষার শব্দগুলো এখনও টিকে আছে কোন না কোন ভাবে। সেক্ষেত্রে ইংরেজীর সঙ্গে অনুবাদে সমতা আনতে গিয়ে আমরা অনেক শব্দ কেটে বাদ দিয়ে দিচ্ছি, একটি ভাষার জন্য এটা হুমকিস্বরূপ।
বল একটি শব্দ, বল দিয়ে খেলে, খেলার মাধ্যমে ছুটাছুটি করলে শরীরের বল ক্ষয় হয়, তুমি বল কথা ঠিক কীনা! — বল শব্দটি যেমন বিভিন্ন অর্থ প্রকাশ করছে, তেমনি এর থেকে আরও অনেক শব্দ তৈরী হয়েছে। কেউ বলে রুটি বল, আবার কেউ বলে রুটি বেল। বেল— বলয় করা হয় যেখানে। রুটি বেলা হলে বলয় বা বৃত্তের মত গোল গোল হয় বলেই একে বলে বেলা। বেল্ একটি ক্রিয়ামূল, বেল্ + অ = বেল। বেল যেখানে আশ্রয় পায় তাই বেলা। তাই রুটি বেলতে বেলতে বেলা বাড়ে, গৃহিনীরা জানেন এটি সহজ কাজ নয় মোটেই। রুটি বেলতে বেলন লাগে, বেলন ঠিকমত বলয়াকারে ঘুরাতে না পারলে গৃহকর্ত্তার কাছে বেলা (মর্য্যাদা) থাকে না; বল-এর দিশাগ্রস্ত অবস্থানকে বেল বলে, বেল অন থাকে বেলনে। বেলন দ্বারা রুটিকে বেলে প্রসারিত করা হয়, সেরকম প্রসারিত স্থানকে বেলা বলে, যেমন সমুদ্রবেলা। প্রসারিত কালকেও বেলা বলে, যেমন সকালবেলা, বিকালবেলা। প্রসারিত পাত্রকেও বেলা বলে, বল এর স্থান-কাল-পাত্রই বেলা। তার বেলা, আমার বেলা, সববেলাই বেলা বাড়ে, তখন বেলা পড়ে আসে। যে ফলে বল বাড়ে, তার নাম বেল। বেলায় বেলায় কাজ শেষ করে অনেকেই বেলের শরবত খেতে পছন্দ করেন। স্কুলে একবেলা পড়া শেষে বেল বাজে, ছুটির বেলায়ও বেল বাজে।
যে বেলা এমনি কাটে তাকে বলে রাক্ষসীবেলা। বিকালকে রাক্ষসীবেলা বলে, কারণ এসময়টাতে কাজের অবসর থাকে। যে জীবন বেকাজে কাটে, কলুর বলদের মত ঘানি টেনে, যে জীবনে কাজে কোন আনন্দ থাকে না, আত্মার তৃপ্তি হয় না, সে জীবনের বেলা পুরোটাই রাক্ষসীবেলা। এই যে আমরা সভ্যজগতের মানুষেরা এতদিন গতিরোগে ভুগছিলাম, যন্ত্রের মত ছুটছিলাম— সেই জীবনে কেবলই ছুটে চলা ছিল ঘড়ির কাঁটায়। করোনা আসায় বুঝতে পারছি আমরা, কতটা যান্ত্রিক হয়ে গেছি আমরা।
সেই মধুমতী গ্রামের নাম হয়ত এখনও আছে, সেখানে কেউ আর বেলা পড়লে কলসী নিয়ে জলের ঘাটে যায় না, ঘরে ঘরে পানির কল আছে যে। সেই গান সেই সাহিত্য তাই আজ আর নেই, সবই যেন আজ রাক্ষসীবেলা অতিক্রম করছে।
“বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্!”—
পুরানো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে,
কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল!
কোথা সে বাঁধা ঘাট, অশথ-তল!