বর্ত্তমান নিবন্ধে ণত্ববিধান-ষত্ববিধান নিয়ে এবং দেশী বিদেশী সবরকম শব্দে তাদের প্রয়োগ করা নিয়ে কিছু ভাবনা তুলে ধরছি।
যেখানে-সেখানে ণ লেখা চলে না। যেমন ধরুন দন্ত, ক্লান্ত ইত্যাদি শব্দে ন্ত লিখতে হবে, এক্ষেত্রে ণ-এর ব্যবহার চলবে না। ণ্ত যুক্তাক্ষরটি কখনই লেখা চলে না। কেন চলে না? কারণ ত থ দ ধ ন একই বর্গে; তাই ন ও ত জুড়ে ন্ত হতে পারে, ণ ও ত ভিন্ন বর্গে বলে ওদের জুড়া চলে না। ণ জুড়তে পারে ট-এর সাথে, তাতে পাবেন ণ্ট। ঘণ্টা শব্দে ণ্ট হয়। আমি যেমন ঘণ্টা শব্দে ণ্ট লিখি, তেমনি প্যাণ্ট ইত্যাদি বিদেশী শব্দেও ণ্ট লিখতে চাই। আজকাল কেউ কেউ pant শব্দের লিপ্যন্তরে অর্ব্বাচীন ‘ন্ট’ যুক্তাক্ষরটিও লেখেন বটে, কিন্তু আমার মতে তা উপযুক্ত নয় (কারণ ন ও ট ভিন্ন বর্গে)। কণ্টক বানানে ণ্ট হবে, ন্ট হবে না। সংস্কৃতেও ন্ট নাই।
তাহলে ন্ট যুক্তাক্ষরটি কখন ব্যবহার করব? আমার উত্তর: কখনই না। ন্ট যুক্তাক্ষরের কোন প্রয়োগ সংস্কৃতেও নাই। সংস্কৃত ভাষা যথেষ্ট শুদ্ধ ও যুক্তিপূর্ণ এবং বাংলা ভাষা সংস্কৃতের সেই মহান উত্তরাধিকার বহন করছে। সংস্কৃত ও বাংলাকে দু’টা সম্পূর্ণ পৃথক ভাষা হিসাবে না দেখাই ভাল। আজকাল লোকে বিদেশী শব্দে ণ্ট না লিখে ‘ন্ট’ লিখছে এবং এই প্রয়োগ অর্ব্বাচীন। অর্ব্বাচীন হলেও তা বেশ চালু বলে আমি তাদের অমান্য করছি না, তবে যারা বিদেশী শব্দেও ণ্ট নিখতে চান তারা তা লিখতে পারেন বলেই আমি মনে করি। সেটা অশুদ্ধ হবে না, দোষের হবে না। আমার মতে শেষ বিচারে কোনো শব্দই বিদেশী নয় এবং তথাকথিত বিদেশী শব্দেও ণত্ববিধান ও ষত্ববিধানের নিয়মগুলি মানা চলে। তাতে বানানের নিয়ম যুক্তিপূর্ণ ও সরলীকৃত হবে। ইংরেজী বা আর কোনো ভাষার শব্দকে যখন বাংলা বাক্যে ব্যবহার করা হবে তখন বাংলা বানানের রীতিনীতি মেনে সেটিকে লেখাই ভালো।
ণত্ববিধান নিয়ে একটি সুন্দর বাংলা ছড়া আছে, সেটা বলি :
”ঋ-কার, র-কার, ষ-কার পরে ন-কার যদি থাকে;
ঘ্যাঁচ ক’রে তার কাটি মাথা, কোন বাপ তারে রাখে?”
ঋ, র, ষ-এর পর সর্ব্বদা ণ হয়। যেমন ঋণ, রণ, ষাণ্মাষিক ইত্যাদি। আমি ট্রেণ, ড্রেণ ইত্যাদি শব্দেও ণ লিখতে চাই। তবে অধুনা বেশীরভাগ লোকে ড্রেন, ড্রেন ইত্যাদি লিখছে। কিন্তু দু’-একটি অভিধানে ট্রেণ বানানও আমি দেখেছি এবং আমার মতে তা যুক্তিপূর্ণ ও শুদ্ধ। ড্রেণ বানানও আমার মতে শুদ্ধ।
‘ন্ড’ যুক্তাক্ষরটিও চালু, কিন্তু খুব একটা যুক্তিপূর্ণ নয়। এখানেও ন-এর বদলে ণ চাই, ণ ও ড জুড়ে ণ্ড হয়। ণ ও ড একই বর্গে, ওদের উচ্চারণস্থান একই রকম বলে সংস্কৃতকাররা ওদের জুড়েছিলেন। আমি পণ্ডিত, কাণ্ড, প্রকাণ্ড, অণ্ড, লণ্ডন, লিজেণ্ড — সর্ব্বত্র ণ্ড লিখি। সংস্কৃতে ন্ড নাই। অধুনা লোকে লণ্ডন শব্দটি বিদেশী বলে তাতে অর্ব্বাচীন ন্ড যুক্তাক্ষরটি প্রয়োগ ক’রে ‘লন্ডন’ লিখছেন। আমার মতে এইসব হীনমন্যতা ছেড়ে বিদেশী শব্দগুলিকেও আপনার ক’রে নিয়ে সর্ব্বত্র ণ্ড লেখাই ভাল। এতে শিক্ষার্থীদেরও সুবিধা হবে।
এবার ষত্ববিধান নিয়ে কিছু বলি। ট-এর সাথে ষ জুড়ে ষ্ট হয়, কারণ উভয়েই মূর্ধ্যন্য বর্ণ। সংস্কৃতে কখনও স্ট ব্যবহার করা হয় না। স ও ত জুড়ে স্ত হতে পারে (যথা হস্ত শব্দে), কিন্তু সংস্কৃতে ‘স্ট’ কখনো হয় না (কারণ স ও ট-এর উচ্চারণস্থান আলাদা)। স ও ত জুড়তে পারে, কারণ উভয়েই দন্ত্য বর্ণ। কষ্ট, নষ্ট ইত্যাদি শব্দে ষ্ট হবে; কখনই স্ট হবে না। আমি মাষ্টার, পোষ্ট, আইনষ্টাইন ইত্যাদি বিদেশী শব্দেও ষ্ট লেখার কথা বলি। অধুনা এইসব ক্ষেত্রে ‘স্ট’ এই অর্ব্বাচীন যুক্তাক্ষরটি ব্যবহার করার চল হয়েছে। আমার মনে হয় সেটিকে এবং সব ক’টি অর্ব্বাচীন যুক্তাক্ষরকে লোপ করার কথা ভাবা যায়। আমরা সবাই সেই চেষ্টা করতে পারি।
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে বিদেশী শব্দের লিপ্যন্তরেও ণত্ববিধান ও ষত্ববিধানের প্রয়োগ দেখা যায়, কিন্তু আজকালকার দিনে বাংলা অ্যাকাডেমি বিদেশী শব্দে ণত্ববিধান-ষত্ববিধান প্রয়োগ করতে বলে না। প্রশ্ন: কোন নীতি অধিক যুক্তিপূর্ণ? আমার মতে সর্ব্বত্র ণত্ববিধান ও ষত্ববিধান প্রয়োগ করাই ভাল। শব্দের তৎসম, অতৎসম ভাগটা কৃত্রিম। শব্দের দেশে এই জাতিভেদকে গুরুত্ত্ব দেওয়া চলবে না। আজকের দিনে সার্ব্বজনীন বানানরীতি ও সার্ব্বজনীন নিরুক্তের (universal semantics-এর) কথা ভাবতে হবে। ভাষায় ভাষায় গভীর সম্পর্ক নিয়ে গভীরতর গবেষণা দরকার। বাংলা ভাষার এবং পৃথিবীর সব ভাষার স্বার্থে সংস্কৃত ভাষার চর্চ্চা খুবই প্রয়োজন।
পরিশেষে বলি যে, আমার মতে বিদেশী শব্দেও ণত্ববিধান-ষত্ববিধান প্রয়োগ করলে তা কোনো দোষের হবে না। তাতে সবরকম শব্দের ক্ষেত্রে একই বিধি হওয়ায় বিষয়টি সরল ও শিক্ষার্থীদের পক্ষেও সুবিধাজনক হবে। বাড়তি ন্ট, ন্ড ইত্যাদি অর্ব্বাচীন যুক্তাক্ষরগুলিকে বর্জ্জন করলে সুবিধাই হবে। এই ব্যাপারে পূর্ব্বসূরীদের সমর্থন তো রয়েইছে। এখন বিষয়টি নিয়ে বাঙালী ভাষাবিদদের উদারতা ও আত্মবিশ্বাস দরকার বলে আমি মনে করি। আজ আমরা যদি এই ব্যাপারে সাহসী পদক্ষেপ নিই তাহলে বাংলা ভাষার উপকার হতে পারে। সব শেষে আরো বলি যে, আজকাল কেউ কেউ খোদ ণ ও ষ বর্ণকে বর্ণমালা থেকে তুলে দিতে চাইছেন! আমার মতে তার ফল খুবই ক্ষতিকারক হতে পারে।
শ্রী শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র
(বাঁকুড়া জেলার পাঁচাল গ্রামে আমার বাড়ী। আমি আকাশের তারা দেখতে ও ব্যাকরণ পড়তে ভালবাসি।)