ব্যাকরণ ও নিরুক্তের নিয়ম লঙ্ঘন করে যাদৃচ্ছিক বানান লেখার ফলে আজকাল বাংলা বানানের জগতে নানা রকম অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে এবং সমস্যাগুলিকে সামাল দিতে গিয়ে ব্যাকরণবিদেরা বারে বারে বেসামাল হয়েছেন। একটি লোক কাদায় ডুব দিলে ঘটির জল দিয়ে তার কানের কাদা, মুখের কাদা, পায়ের কাদা ইত্যাদি আলাদা আলাদা করে ধুয়ে দেওয়া খুব কষ্টকর। সেক্ষেত্রে উপযুক্ত কাজ হবে তাকে একবার গঙ্গাস্নান করিয়ে দেওয়া, যাতে করে সব কাদা একসাথে দূর হয়ে যায়। তেমনি বাংলা বানানের অধুনাসৃষ্ট সমস্যাগুলি দূর করার সহজতম উপায় হল আর দেরী না করে দেশিকোত্তম শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে প্রদত্ত বাংলা বানানে ফিরে যাওয়া। আমি এই কথা বলছি তার কারণ হল ওই অভিধানে প্রদত্ত বানান ব্যাকরণের নিয়মানুসারী, কিন্তু পরবর্ত্তী কালে প্রণীত অভিধানগুলিতে বারে বারে ব্যাকরণের নিয়ম লঙ্ঘন করা হয়েছে।
অধুনা কেউ কেউ (যথা ভাষাবিদ পবিত্র সরকার) শশিবাবু বানান ‘শশীবাবু’ এবং মন্ত্রিগণ বানান ‘মন্ত্রীগণ’ লেখার কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হল শশী, কালী, মন্ত্রী ইত্যাদি শব্দে ঈ-কার কিন্তু শশিবাবু, শশিভূষণ, কালিদাস, মন্ত্রিগণ ইত্যাদি শব্দে ই-কার হয়। চিরকাল তাই হয়ে এসেছে এবং কেন হয়েছে তার কারণও আছে (কারণটা ব্যাখ্যা করার অবকাশ এখানে নাই)। সেই কারণটা বুঝে সেটা মেনে চলাই শ্রেয়, তাহলে আর এই জাতীয় সমস্যায় পড়তেই হয় না। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই যুক্তি (যথা কালী বানানে ঈ-কার আর কালিদাস বানানে ই-কার হয় কেন) আজকাল অনেকে বলতেই পারেন না। কেউ মন্ত্রিগণ বানান ‘মন্ত্রীগণ’ করার কথা বললেই তা করতে হবে এমন নয়।
বাংলা একাডেমী (ভারত ও বাংলাদেশের) রেফের নীচে দ্বিত্ব বর্জ্জনের পক্ষে। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। যেমন ব্যাকরণের বিচারে ধর্ম্ম ও কার্ত্তিক বানান যথাক্রমে ‘ধর্ম’ ও ‘কার্তিক’ লিখলে ভুল হয় এবং এই শেষোক্ত বানানগুলি পরিত্যাজ্য। কার্ত্তিক বানানে যে ত্ত হবে তা কৃত্তি, কৃত্তিবাস, কৃত্তিকা ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে তুলনা করলে বুঝা যেতে পারে। কৃত্তিকা থেকেই কার্ত্তিক নামটি এসেছে। তেমনি বৃত্ত, বৃত্তি, বার্ত্তিক, বর্ত্তমান ইত্যাদি বানানে ত্ত হবে; এদের একটাতে ত করে দিলে (যথা ‘বর্তমান’ লিখলে) তা শুদ্ধ হবে না।
বাংলা একাডেমী তৎসম, তদ্ভব ও বিদেশী শব্দের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন বানানরীতি মেনে নিয়েছেন। এই বিষয়ে আমার বক্তব্য হল ব্রাহ্মণ ও বাউরীকে একত্রে পংক্তিভোজন করাতে যেমন কোন অসুবিধা নাই তেমনি তৎসম তদ্ভব বিদেশী ইত্যাদি সব ধরণের শব্দের ক্ষেত্রে একই বানানবিধি মেনে চলতে খুব একটা সমস্যা নাই, বরং সেটা করলে বানান নিয়ে বহু ফালতু জটিলতা এড়ানো যায়। তা নাহলে যুক্তিপূর্ণ বানান লেখার সমগ্র পরিকল্পনাটি বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে এবং আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষতি হয়, ভাষাকে অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। আরো বলি যে, ঈদ শব্দটিকে বিদেশী বিবেচনা করে ‘ইদ’ লেখা অনুচিত। শেষ বিচারে কোন শব্দই বিদেশী নয়।
অনেকে পেণ্ডুলাম বানান ‘পেন্ডুলাম’ লিখে থাকেন। এই ব্যাাপারে আমার বক্তব্য হল পণ্ড, পণ্ডিত প্রভৃতি শব্দে যেমন ণ্ড হয়, তেমনি পেণ্ডুলাম বানানে ন্ড না লিখে ণ্ড লেখাই শ্রেয়। এর কারণ ণ ও ড একই বর্গে আছে। একইভাবে ন ও ত একই বর্গে আছে বলে ওদের যুক্তাক্ষর (ন্ত) হয়, যথা দন্ত প্রভৃতি বানানে। দন্ত বানানে যেমন ন্ত (ণ চলে না) হয় সেই তুলনায় লণ্ডন বানানে ণ্ড হবে ( ন্ড না লেখাই শ্রেয়)। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে যে আমরা কি London বলার সময় ণ্ড-এর উচ্চারণ করি? তার উত্তরে বলা চলে বানান সবসময় উচ্চারণানুসারে হয় না। যেমন আমরা লিখি ‘ঘড়ি’ কিন্তু উচ্চারণ করি ‘ঘোড়ি’। উচ্চারণানুসারে ‘ঘোড়ি’ লেখার কথা কেউই বলেন না। বানান হয় শব্দের বুৎপত্তি ও অর্থানুসারে, শুধু উচ্চারণানুসারে নয়।
একইভাবে অষ্টম, কষ্ট, মাষ্টার, ষ্টীমার ইত্যাদি সর্ব্বক্ষেত্রে ষ্ট ব্যবহার করাই শ্রেয় বলে আমি মনে করি। শ্রীহরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয় মাষ্টার, ষ্টীমার ইত্যাদি বানানই লিখেছেন এবং সেটা তিনি ঠিকই করেছেন। আজকাল অনেকে ‘মাস্টার’, স্টীমার ইত্যাদি বানান লেখেন; এগুলি পরিত্যাগ করাই ভালো। আমরা মাষ্টার, ষ্টীমার ইত্যাদি শব্দে ষ-এর সঠিক উচ্চারণ করি কিনা অথবা ইংরেজরা ওই শব্দগুলি ঠিক কীভাবে উচ্চারণ করেন বাংলায় বানান লেখার সময় সেটাই সবচেয়ে বড় কথা নয়। বাঙালায় ব্যবহৃত ইংরেজী শব্দের উচ্চারণ সর্ব্বদা ইংরেজীর টানে করতে হবে বলে মনে করি না, বরং বাংলা কায়দায় বা বাংলা শব্দদের সঙ্গে মিলিয়ে করাই ভাল বলে মনে করি। বঙ্গমানসকে ইংরেজীর শাসন থেকে মুক্ত করাই দরকার।
কেউ কেউ কলকাতা বানান ‘কোলকাতা’ লেখেন। আমার মতে তার দরকার নাই। কলকাতা শব্দের অর্থ বিচার করে আমার নিজের সিদ্ধান্তও তাই। শব্দটি মূলে কলকেতা ছিল বলে মনে হয়। আজও অনেকে ‘কলকেতা’ উচ্চারণ করেন এবং কোন কোন অভিধানে ‘কলকেতা’ বানান আছে। কলকেতা মানে হল ‘কলই কেতা’ যেখানে বা ‘যেখানে কলের রাজত্ব শুরু হয়ে গেছে’। পরবর্ত্তী কালে (সম্ভবত বুৎপত্তিগত অর্থ ভুলে যাওয়ার ফলে) কলকেতা শব্দটি কলকাতা, কলিকাতা ইত্য়াদি হয়ে যায়। আজকাল অনেকে ‘কোলকাতা’ উচ্চারণ করেন বটে, তবু অর্থের বিচারে ‘কোলকাতা’ বানান মানা চলে না। শব্দটি ‘কলকেতা’ লেখাই সবচেয়ে ভাল বলে আমি মনে করি। যারা ‘কোলকতা’ বানান লিখছেন, অনুগ্রহ করে তারা তা পরিহার করুন, এই অনুরোধ রইল।
শব্দের বানান কীভাবে তার অর্থকে ধারণ করে সেইটা বুঝে বানান লিখলে বানান নিয়ে বহু সমস্যার সমাধান পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে আজকাল বহু বাঙালী বিদ্বান পাশ্চাত্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাগর্থ-সম্পৃক্তি তথা নিরুক্তের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে মনে করেন যে শব্দার্থ যাদৃচ্ছিক (Word meanings are arbitray)। এর ফলে শব্দের অর্থের সঙ্গে তার বানানের সম্পর্কটি তাঁরা স্পষ্ট করে বুঝতে পারেন না এবং ভাষা ও বানান নিয়ে সৃষ্ট সমস্যাগুলির সমাধানের রাজপথটিও দেখতে পান না।
বাংলা বানানের ব্যাপারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কী বলেছে বা পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি কী বলছে তা বিনা বিচারে মেনে নেওয়া যায় না এবং এইসব বিষয়ে সবরকম গোঁড়ামি ও দ্বিধা বর্জ্জন করে ব্যাকরণের যুক্তিকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। বানান সরলীকরণ করতে গিয়ে আমরা নানা ঝামেলায় পড়েছি। ব্যাকরণ বুঝলে ব্যাকরণসম্মত বানান লিখতে কোন অসুবিধা, জটিলতা হয় না। ব্যাকরণ ও নিরুক্ত চর্চ্চা করলে বিষয়গুলি শুধু সহজ হয়েই যাবে না, রসপূর্ণও হবে। ব্যাকরণ ও নিরুক্ত যে অগাধ রসের শাস্ত্র সেটা যারা এইসব শাস্ত্র চর্চ্চা করেন তারাই জানেন। অবশ্য না বুঝে মুখস্থ করলে ব্যাকরণ নীরস লাগে। পণ্ডিতেরা একটু বুঝেসুঝে শুদ্ধ বানান লিখলে সাধারণ মানুষ তাঁদের অনুসরণ করতে পারেন।
সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত শ্রীকলিম খান ও শ্রীরবি চক্রবর্ত্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ ও ‘বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান’ গ্রন্থে বাংলা বানান সমস্যার যুক্তিপূর্ণ সমাধানের রাস্তা দেখানো হয়েছে। মৎপ্রণীত ও সদ্য প্রকাশিত ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক পদ্যাভিধান ‘বর্ণসঙ্গীত’ গ্রন্থে আমিও অর্থানুসারী এবং যুক্তিপূর্ণ বাংলা বানান নিয়ে কিছু কিছু আলোচনা করেছি। আমি বাঙালী ব্যাকরণবিদদের এবং পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির কর্ত্তাদের অনুরোধ করব হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস ও খান-চক্রবর্ত্তীর অভিধানে এবং মৎপ্রণীত পদ্যাভিধানে প্রদত্ত নিরুক্তসম্মত বানানরীতি যথাযোগ্য গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে। এর থেকে শুধু বানানের নৈরাজ্য দূর করতে সুবিধা হবে তাই নয়, শব্দকে ভেঙে স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক অর্থ নিষ্কাশনের (নির্ব্বচনের) নিয়মটিও বুঝা যাবে। বাংলাপ্রেমীরা শুদ্ধ বাংলা বানান বিষয়ে আলোচনা ও চর্চ্চা চালিয়ে যান। এটি হবে দেশপ্রেম ও ভাষাপ্রেমের কাজ।…
শ্রী শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র
(বাঁকুড়া জেলার পাঁচাল গ্রামে আমার বাড়ী। আমি আকাশের তারা দেখতে ও ব্যাকরণ পড়তে ভালবাসি।)