বাঙ্গালী কবি চন্দ্রাবতী || রিফাত আহমেদ

0

118604448_310219906954102_5908841820148110991_n

118603840_315432513063036_6148640256905923854_n

118599640_1574697496035712_1585336241141943718_n

শেক্সপিয়ার, মোনালিসা, ওমর খৈয়াম যেমন জনপ্রিয়, তেমনি বাংলার কবি চন্দ্রাবতীও সেই জনপ্রিয়তার দাবিদার। পাশ্চাত্য সংস্কৃতি এইসব মানুষদের তাদের সৃষ্টির জন্য অমর করে রেখেছে। আমাদের এই বাংলা, বারবার পরাধীনতার শিকলে বাঁধা পরে ছিল। তাই, বাংলার এই কবিরা কালের গহ্বরে হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন সময় হয়েছে, সেইসব শিল্পীদেরকে তাদের যোগ্য সম্মান ফিরিয়ে দেয়ার।

১৫৫০ সালে কিশোরগঞ্জে কবি চন্দ্রাবতীর জন্ম। অসংখ্য গীতিকবিতা, পালাগান তিনি লিখেছেন। প্রেম বিরহগাঁথা, বৈষম্য, অবিচার চন্দ্রাবতীর গীতিকা-সাহিত্যের অংশ হয়েছিল। চন্দ্রাবতীর বাবা দ্বিজ বংশীদাস ‘পদ্মপুরাণ’ এবং ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যের রচয়িতা। তিনি ভাসান গানের দল নিয়ে গান গেয়ে বেড়াতেন।। সেই থেকে চন্দ্রাবতীরও সাহিত্যে পদচারণা। এমনকি বাবার কথাতেই তিনি রামায়ণের বাংলা অনুবাদ শুরু করেন। রামায়ণের অনুবাদ চন্দ্রাবতীর অমর সৃষ্টি হিসেবে আজও স্থান পায় বাংলা সাহিত্যে।

চন্দ্রাবতীর লেখার গাঁথুনি খুবই ভাল ছিল। তিনি প্রায় পাঁচশ বছর আগে বিভিন্ন কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লিখেছেন। অত্যাচার, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাহিত্যে তার কথা তুলে ধরেন। চন্দ্রাবতী রামায়ণের পুরোপুরি অনুবাদ করেননি। সীতার প্রতি যে অবিচার রামায়ণে করা হয়েছে, সেসবই তিনি অত্যন্ত সুক্ষ্মভাবে তুলে ধরেছেন। নারীবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে রামায়ণ অনুবাদ করেছিলেন চন্দ্রাবতী। এতে করেই চন্দ্রাবতীর রুচিশীলতা, মুক্তচিন্তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
118603840_315432513063036_6148640256905923854_n
তার এই সাহিত্য রচনা, পড়াশোনা, খেলাধুলার একমাত্র সাথী ছিল জয়ানন্দ। ছোটবেলা থেকে একসাথে বেড়ে উঠছিল তারা। তারা দুজনেই কবিতা লিখতে ভালবাসত দ্বিজবংশীর পদ্মপুরাণে চন্দ্রাবতী এবং জয়ানন্দ, দুজনেরই কবিতা রয়েছে। একসময় বুঝতে পারে তারা একজন আরেকজনকে পছন্দ করে। বাবা দ্বিজবংশী ও পরিবারের মতে চন্দ্রাবতী ও জয়ানন্দের বিয়ের দিন ঠিক হয়। ঠিক সেদিনই ঘটে চন্দ্রাবতীর জীবনের সেই অঘটন। তার সেই ছোটবেলার সাথী জয়ানন্দ ধর্ম্মান্তরিত হয়ে বিয়ে করে ফেলেন এক মুসলমান মেয়ে আসমানীকে (কমলা)।
118600131_762695301230654_7459363215029140493_n
জয়ানন্দের দেয়া এই আঘাত চন্দ্রাবতী সহজে মেনে নিতে পারেননি। সে তার বাবার কাছে প্রার্থনা করে, ফুলেশ্বরী নদীর তীরে তার জন্য শিব মন্দির তৈরি করে দেয়া হোক। সেখানে তিনি কুমারী থেকে সারা জীবন শিবের উপাসনা করে কাটিয়ে দিতে চান। পিতাও কন্যার অনুরোধ মেনে নেন। কন্যা-পিতার কথা কবিতার চরনে:
                                                              চন্দ্রাবতী বলে ‘পিতা সম বাক্য ধর।
                                                              জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর॥
                                                              শিবপূজা করি আমি শিবপদেমতি।
                                                              দুঃখিনীর কথা রাখ কর অনুমতি’॥
                                                              অনুমতি দিয়া পিতা কয় কন্যার স্থানে।
                                                              ‘শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে’॥

চন্দ্রাবতীর দিন কাটতে থাকল শিবের আরাধনা করে। আর অবসর সময়ে তিনি রামায়ণ রচনা করতেন। কথায় আছে, আঘাত না পেলে, সৃষ্টি করা যায় না। তার সবচেয়ে কাছের মানুষের দেয়া আঘাত তাকে নব নব সাহিত্য সৃষ্টির দরজা খুলে দিয়েছিল।
118616654_1122672518128933_9028602316805731101_n
এর বেশ কিছুদিন পর জয়ানন্দ নিজের ভুল বুঝতে পারে। সে তখন চন্দ্রাবতীর কাছে ফিরে আসে। মন্দিরের দরজার কাছে বসে বার বার চন্দ্রাবতীর কাছে ক্ষমা চায়। কিন্তু চন্দ্রাবতী শিবের আরাধনায় এতোই মগ্ন ছিলেন যে জয়ানন্দের কথা সে শুনতে পাননি। এদিকে জয়ানন্দ মনে করেন চন্দ্রাবতী তাকে ক্ষমা করেননি। তাই তিনি চন্দ্রাবতীর উদ্দেশ্যে একটি কবিতা লিখে সেখান থেকে চলে যান আর নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে ফুলেশ্বরী নদীতে আত্মাহুতি দেন। চন্দ্রাবতী যখন মন্দিরের বাইরে আসে তখন সে বুঝতে পারে জয়ানন্দ এসেছিল আর তার আগমনে মন্দির অপবিত্র হয়েছে। তাই সে পানি আনতে নদীতে যায় আর সেখানে জয়ানন্দের মৃতদেহ দেখে। অনেকের ধারণা, চন্দ্রাবতী নিজেও তখন সেই নদীতে ঝাঁপিয়ে আত্মাহুতি দেন। আবার অনেকে বলেন, জয়ানন্দের মৃত্যুর পরেও তিনি অনেকদিন বেঁচে ছিলেন এবং তার স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছিল।

চন্দ্রাবতীর মত দুঃখের জীবন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। নিজের কষ্ট ছাপিয়ে তিনি যে কাব্যগাথা, অসাধারণ পালাগান পরিবেশন করে গিয়েছেন তা এখনো গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। তার জীবনীভিত্তিক পালাগান গীত ও অভিনীত হয়ে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে এখনও। আর এভাবেই দুঃখিনী কবি চন্দ্রাবতী আজো বেঁচে আছেন বাংলাদেশের পল্লীহৃদয়ে বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে।
118595498_787726038650903_5470192803742337169_n
অন্যান্য গীতিকা থেকে মৈমনসিংহ গীতিকাগুলি একটু আলাদা। এতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি সংস্কৃতিই দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন বাংলা সাহিত্য প্রধানত ধর্মাশ্রিত ও দেবদেবী কেন্দ্রিক হলেও মৈমনসিংহ গীতি কবিতায় ধর্ম্মের প্রভাব খুবই অল্প। এসব গীতিকায় তুলে আনা হয়েছে পূর্ব্ববঙ্গের সহজ সরল পল্লী-জীবনের কাহিনী। গীতিকায় পটভূমি বর্ণনা করা হয়েছে নায়ক নায়িকাদের প্রাত্যহিক জীবনের খুঁটিনাটি, তাদের প্রেম ভালবাসা-বিরহ দিয়ে। এছাড়াও তখনকার পল্লীবাংলার দৈনন্দিন সমস্যা, গ্রামীণ জীবনের প্রকৃত অবস্থা আমরা পেয়েছি এইসব গীতিকাব্যগুলির মাধ্যমেই। বিভিন্ন রোগ, বন্যায় ফসল নষ্ট, দুর্ভিক্ষ, ক্ষুধা, দারিদ্রতা এসব লোকগীতিতেই পেয়েছি। এমনকি, একটা মানুষ তার বেঁচে থাকার শেষ সম্বল গরু বা বসতবাড়ি বিক্রি বা বন্ধক করে জীবন চালিয়েছে এবং তাতেও না কুলালে দেশ ছেড়েছে এমন ঘটনাও চন্দ্রাবতী তার ‘মলুয়া’ ও ‘কেনারাম দস্যু’ পালার ছত্রে ছত্রে লিখে গেছেন। একজন কবি হিসেবে তার স্বার্থকতা রেখেছেন তার কবিতার মাঝে। একই কবিতায় একইসাথে হিন্দু ও মুসলিম সমাজের ব্যবহৃত শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন। আজ থেকে ৫০০ বছর আগে যা অকল্পনীয় ছিল। নারী হিসেবে তো কল্পনারও অতীত ছিল। একদিকে তিনি দুর্গাপূজা, লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের কথা বলছেন, অন্যদিকে মুসলিম দোয়া, পানি, ছাওয়াল এসব শব্দ স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করেছেন চন্দ্রাবতী।
118355374_2422298581403639_8265138428037387684_n
চন্দ্রাবতী যে রামায়ণ রচনা করছিলেন তা তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। তাই অনেকে এই রচনাকে অসমাপ্ত ও দুর্ব্বল সাহিত্য বলে ফেলে রেখেছেন। আসলে এটা কোনো দুর্ব্বল বা অসমাপ্ত সাহিত্য নয়। এটি একটি নারীর রচিত কবিতা, যেখানে রামের গুণগান না করে, সীতার দুঃখ, দুর্দ্দশা, অসহায়ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। তার এই সৃষ্টিকে তখনকার পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধচারণ হিসেবে দেখা হয়েছে। তাই তার অন্যান্য কবিতাগুলো খ্যাতি পেলেও রামায়ণ তেমন একটা জায়গা করে নিতে পারেনি। কিন্তু তার এই নারীপ্রধান রামায়ণ সারাজীবন অবহেলিত নারীদের কিছুটা হলেও মুক্ত করেছে।

118616143_249317479497423_1838404238232491036_nরিফাত আহমেদ
চেয়ারপার্সন, সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’স এসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়ালেখা শেষ করার পর শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে নিয়েছেন।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার