গ ল্ প : জনন || রুবি বিনতে মনোয়ার

0

“কিছু বলবি! বইটা কেমন লাগল বল্।”

ছিপি জবাব দেয়, “ভয় লাগছিল। কয়েক পাতা পড়েছি। আচ্ছা, তুই কেমন করে লিখিস বল্তো! আমি তো পারি না”।

“সবাই কি সব একই রকম পারে! এই যেমন তুই প্রশ্ন কর্‌তে পারিস, আমি পারি না। তোর জনন ক্ষমতা তোর কথায়, প্রশ্নের মাধ্যমে। আমার জনন ক্ষমতা আমার লেখায়, আমি তো তোর মত কথা বল্তে জানি না। বিশেষ করে প্রশ্ন তৈরি কর্‌তে জানি না।”

ছিপি একটু রেগে যায়, “কী যে বলিস! এর মধ্যে জনন ক্ষমতা কেন আসবে? এখানে কি সন্তান ধারণের কোন বিষয় আছে নাকি?”

ছিপির রাগ দেখে আমার খুব হাসি পাচ্ছে। একে ঘুরিয়ে বুঝাতে হবে, নইলে আমাকে কত যে গালি দিবে তার ঠিক নেই।
“ছিপি! তুই তো ভাল রাঁধতে জানিস, তুই সূতার কাজ জানিস! তুই বানিয়ে লিখতে জানিস না… কিন্তু নিত্য নতুন রান্না করে তুই ওখানে মানে রান্নাঘরে জনন ক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছিস, মানে সৃষ্টি করছিস।”

ছিপি মাথা নাড়ে, বুঝতে পেরেছে।
“তুই রসুনটা একটু কড়া ভেজে বাগাড় দিতে পারিস না! যত কড়া ভাজা হবে ডাল তত স্বাদ হবে”।

“হুম। আমার খেয়াল থাকে না। জনন সম্পর্কে বলছি শোন্। জ এমন একটি বর্ণ যার মধ্যে জনন ক্রিয়া থাকে। যে জনন ক্রিয়া চলমান রাখে, সে হল জন। জন করে তাই সে জনক। জনন হল পুনরুৎপাদন। সেটা যে কোন কিছু হতে পারে। পণ্য উৎপাদন হতে পারে, ফসল উৎপাদন হতে পারে, এমনকি সন্তান উৎপাদনও হতে পারে। যা উৎপাদিত হয়, তা হল জনিত। এই জনিতের বা উৎপাদিতের সংবাদ বা খবর থাকে জান-এ। জান এর আধার হল জানা। জ্ঞ হল জননের রহস্যরূপ, কারণ জ্ঞ = জ্+ঞ। এই জ্ঞ কোথায় কী হল না হল সব খবর রাখে। এই জ্ঞ এর আধার হল জ্ঞা, মানে যেখানে জ্ঞান থাকে।”

ছিপি অবাক হয়ে বলে “এত!”

“হুম, আরও আছে। জ্ঞ ইংরেজী gno। ইংরেজী gno রয়েছে ল্যাটিন (g)noscere-এ, যা জ্ঞানের প্রতিশব্দ। ইংরেজীতে যা kno know (g এর বদলে k হয়েছে পরবর্ত্তীতে), বাইবেলে সেই know শব্দের অর্থ জনন করা। আমাদের জ্ঞ, ইংরেজী know-এর একই আদি উত্তরাধিকার, এদের জিন-সম্পর্ক রয়েছে।”

“আশ্চর্য্য! ভাষারও জিন-সম্পর্ক থাকে?”

“থাকে তো, এরকম বহু শব্দ সারা পৃথিবীর ভাষাগুলিতে খুঁজে পাওয়া যাবে। এই জ্ঞানসাধনই হল লিঙ্গসাধন। লিঙ্গ শব্দটি এসেছে লিন্ গ্ ধাতু থেকে, যার অর্থ লীন হওয়ার জন্য গমন করা। সেটা যে কোন কর্ম্মযজ্ঞ হতে পারে। সেই কর্ম্মযজ্ঞে অংশ নেওয়ার জন্য যে যায়, সেই লিঙ্গ। যেমন ধর, আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান কাজে লাগিয়ে আমরা এখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচুর কাজ করতে পারি। এই যে প্রযুক্তিজ্ঞান এটাও একটা লিঙ্গ। লিঙ্গ হল জ্ঞান/কর্ম্ম সাধনের উপায়। যেমন ফসলের ক্ষেতে ফসল উৎপাদন করতে জমি চাষ করে লাঙ্গল দিয়ে, পরে বীজ বুনে দেয়, ফসল উৎপাদন হয়। এক্ষেত্রে লিঙ্গের কাজটি করে লাঙ্গল। এই যে আমাদের চারপাশের পরিবেশ, বা এই পৃথিবীর পরিবেশ তা সব মিলেই বস্তুজগৎ। এই বস্তুজগতের খবর পাই আমরা পঞ্চইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। বস্তুজগতের সাথে আমাদের মন যুক্ত হয় যার দ্বারা, সেই লিঙ্গ। এর মাধ্যমে বাইরের বিভিন্ন বিষয় বা জননের খবর আমাদের মনে প্রবেশ করে বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই যে বাইরের সাথে মনের যুক্ত হওয়ায় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, এটাও জনন। বাইরের জননের খবর মনের জানালা দিয়ে আমাদের মনে প্রবেশ করে বলেই আমরা জানতে পারি। বস্তুজগতের কোটি কোটি জনিত প্রতিক্রিয়াই আমাদের জানা বা জ্ঞ বা জ্ঞান। জনিত হওয়ার খবর বহন করে হাওয়া, এই হাওয়া হল হওয়ার আধার। যেখান দিয়ে হাওয়া এই জনন সংবাদ বা জানাকে নিয়ে মনের ভেতরে প্রবেশ করে তাই হল জানালা। তবে এই জানালা হল মনের জানালা। আর বাহ্যিক জানালা দিয়েও আমরা হাওয়া পাই। লিঙ্গনাশ হল এক ধরনের চোখের রোগ। আর আমরা যে বলি কথায় কথায়— তার লিঙ্গজ্ঞান হয়নি, এর মানে হল তার জ্ঞানসাধন হয়নি, বোধশক্তি নাই।”

“তুই এত কী বললি! এর সাথে জননের কী সম্পর্ক!”

“সম্পর্ক তো আগাগোড়াই, তুই কোনো কাজ করলি— মানে তুই পরিবেশ থেকে কিছু ধারণা আগেই পেয়েছিলি। সেই অনুযায়ী তুই কিছু কাজ করলি— এই যোগসূত্রটা যার মাধ্যমে হল সে লিঙ্গ, আর তুই যে কাজটা করলি তার ফলাফলে যা আসবে সেটাই জনিত, আর প্রক্রিয়াটা হল জনন। তুই জনন, লিঙ্গ এসব শব্দ শোনামাত্র আঁতকে উঠেছিলি, আসলে শব্দের বহুরৈখিকতাকে ধরতে না পারলে এমনটাই হবে। ক্রিয়াভিত্তিক বিশ্লেষণ দিয়ে পৃথিবীর যে কোন ভাষার শব্দকে বিভিন্নভাবে চিনতে পারা যাবে, ইতিহাসকে খুঁজে পাওয়া যাবে, বিভিন্ন ভাষায় শব্দগুলির যে জিনগত সম্পর্ক তা উদ্ধার করা যাবে। আগের দিনের মানুষেরা ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুসরণ করেই সব লিখে গেছেন। কিন্তু কথা হল এ কাজ করবে কে।”

“— বুঝলাম। আধার কী?”

“এই দেখ্, লবনদানীতে লবন নিচ্ছি, এই লবনটা শূন্যে রাখা যাবে? এটাকে কোথাও না কোথাও রাখতে হবে, যেখানে রাখছি সেটা হল এর আধার বা পাত্র। সেরকম যে কোনো কাজকে (ক্রিয়া) দৃশ্যমান হতে পাত্র লাগবে। যেমন তুই বললি খাব, তোর খাওয়ার কাজটি দেখা যাবে না যতক্ষণ না তুই খাওয়ার কাজটি করবি।”

“ঠিক বলেছিস, আমার খিদে পেয়েছে। খেতে দে। বইটা আবার শেষ করতে হবে আমাকে।”

আমি টেবিল সাজাই, ছিপি হাত মুখ ধুয়ে আসলেই দুজনে খেতে বসব।……….

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার