যোজনগন্ধবিকার : ‘সিষ্টেম ডিজাইনিং’-এর একটি সমস্যা || কলিম খান

0

‘শ্রীভগবান কহিলেন … হে ভারত। মহৎ ব্রহ্মই আমার যোনি। তাহাতেই আমি গর্ভ নিক্ষেপ করি। তাহা হইতেই সর্ব্বভূতের উৎপত্তি হয়।’ … গীতা ১৪ : ৩।
‘There are other pitfalls, including the widespread practice of manipulating information. Public relations people, for example, often put out press releases which are little more than sales promotion.’ — William Davis in ‘Great Myths of Business’.

অমৃতলিঙ্গম ও ব্রহ্মযোনি কথা
…………………………………………
The Story of Software & Hardware
‘লিঙ্গ’ শব্দের প্রথম অর্থ ‘জ্ঞানসাধন’১। অর্থাৎ, যার দ্বারা জ্ঞান সাধিত হয়, তাকে লিঙ্গ বলে। আজকের সাধারণ শিক্ষিত বাঙালীর কাছে কথাটা বেশ অদ্ভুত মনে হতে পারে। তবে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার পণ্ডিতেরা জানেন কথাটা শতকরা একশ ভাগ নির্ভুল। বহু প্রাচীনকাল থেকেই লিঙ্গ শব্দের ঐরূপ অর্থ প্রচলিত হয়ে আসছে। প্রায় সমস্ত পুরনো অভিধান ও শব্দকোষে ঐরকমই উল্লেখ রয়েছে। তাহলে কেন সেকথা ভাষাবিশেষজ্ঞ শিক্ষকেরা তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীদের শেখালেন না? কেন আজকের শিক্ষিত বাঙালী ছেলেমেয়েরা এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের বাবা-মায়েরাও, লিঙ্গ শব্দের কেবল gender ও penis এই দুটি অর্থই জানলেন? — এর অনেকগুলি কারণ আছে। একটি কারণ হল, কেন যে ‘লিঙ্গ’কে ‘জ্ঞানসাধন’ বলা হত, কিংবা ‘জ্ঞানসাধন’কে ‘লিঙ্গ’ বলা হত, সেকথা তথাকথিত ভাষাবিশেষজ্ঞ শিক্ষকেরা নিজেরাই জানেন না। আর যা জানা নেই, অভিধানে লেখা আছে বলেই সেকথা ছাত্রকে শেখাতে যাওয়া বেশ বিপজ্জনক। তার চেয়ে বরং ব্যাপারটা চেপে যাওয়াই মঙ্গল। সেইজন্য এ নিয়ে ঘাঁটাঘাটিঁ করা সমীচীন মনে করেননি তাঁরা। কিন্তু একটি শব্দের দশটি অর্থের ভিতর থেকে মাত্র দুটিকে এইভাবে উত্তরসূরীদের শেখানোর ফলে বাংলাভাষার শতকরা আশী ভাগ যে বাদ পড়ে যেতে পারে, সেকথা তাঁরা খেয়াল করেননি।

আর একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হল, বাংলাভাষায়, ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হলে পর, বাংলা শব্দের ‘আত্মাবদল’২ সাঙ্গ হয় এবং তার ফলে লিঙ্গ যোনি প্রভৃতি শব্দগুলির ভিতর থেকে তাদের পুরনো ও বহুকালক্রমাগত অর্থগুলিকে বের করে ফেলে দিয়ে কেবল একটি (বা কদাচিৎ দুটি) করে অর্থকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে যেমন লিঙ্গ শব্দের ভিতরে penis এবং যোনি শব্দের ভিতরে vagina প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়। যেহেতু প্রভু ইংরেজের ভাষায় একটি শব্দে একটি বিষয় বা বস্তুকে বোঝানোর একরৈখিক নিয়ম প্রচলিত, বাংলাভাষার ভিতরেও সেই নিয়ম প্রচলিত হয়ে যায়। আক্ষেপের কথা এই যে, রাজনৈতিকভাবে আজ ব্রিটিশ চলে গেছে বটে, কিন্তু বাংলাভাষার ভিতরে সে আজও উপনিবেশ চালিয়ে যাচ্ছে বহাল তবিয়তে। তাই বহুরৈখিক বাংলাভাষার পুনর্নবীকরণ করা যায়নি, আজও। আর সে কাজে প্রধান বাধা একালের তথাকথিত বাংলাভাষা-বিশেষজ্ঞরাই।

যাই হোক, লিঙ্গ যোনি প্রভৃতি শব্দগুলিকে তাদের বহু অর্থসম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন-বঞ্চিত করে একার্থবাচক (বা একার্থের শৃঙ্খলসম্বল প্রলেতারিয়েত) শব্দে পরিণত করবার পর থেকে আমরা বাংলাভাষাভাষিগণ ঐ শব্দ দুটির সাহায্যে মানবশরীরের দুটি অঙ্গ মাত্রকেই বুঝে থাকি। এর ফলে, আমাদের পূর্ব্বপুরুষেরা তাঁদের শাস্ত্রগুলিতে— লিঙ্গপুরাণ, যোনিতন্ত্র প্রভৃতি গ্রন্থগুলিতে, মহাভারত থেকে শুরু করে সকল প্রকার পৌরাণিক, প্রাকৃত ও প্রাচীন বাংলাভাষার গ্রন্থগুলিতে, লিঙ্গ যোনি বিষয়ে যে শত শত পৃষ্ঠা লিখে রেখে গেছেন, সেগুলি আজ আর আমরা বুঝতে পারি না। শুধু তাই নয়, আমাদের দেশে যে শত শত লিঙ্গমন্দির, লিঙ্গমূর্ত্তি, যোনিমূর্ত্তি, লিঙ্গপূজা, যোনিপূজা ও তৎসংক্রান্ত আচার-আচরণ, জল ঢালা, দুধ ঢালা ইত্যাদি ইত্যাদি— এসব কিছুই আজ আমরা বুঝতে পারি না। যে জাতি শূন্যের আবিষ্কারক, সংস্কৃতের মত ভাষার স্রষ্টা, যার সঙ্গীত ও নৃত্য উচ্চ কোটির মস্তিষ্কের সাক্ষ্য দেয়, যে জাতি বস্ত্র থেকে চিনি পর্য্যন্ত বহু পণ্যের আবিষ্কর্ত্তা, সে ঐ সমসময়ে হঠাৎ লিঙ্গ ও যোনি পূজা করতে গেল কেন— এমন প্রশ্ন আমরা করি না। ‘নিম্ন অধিকারী’র৩ penis ও vagina পূজাকে ভারতীয় মনীষার লিঙ্গ-যোনিপূজা ভেবে গ্লানিতে ভুগি বা আত্মপ্রসাদ লাভ করি। প্রায় চোখের উপর গান্ধী-মার্ক্সের মহানতা ও বিশালতা আমরা দেখেছি, আবার তাঁদের জন্মদিনে পাড়ার দুর্ব্বৃত্তকে তাঁদের ফটোতে মালা দিতেও আমরা দেখি, এবং এক্ষেত্রে যদিও প্রকৃত গান্ধী-মার্ক্সের সঙ্গে দুর্ব্বৃত্তের গান্ধী-মার্ক্সের যে আসমান জমিন ফারাক তা আমরা বেশ বুঝতে পারি, কিন্তু পৌরাণিক লিঙ্গ-যোনি তত্ত্ব এবং প্রাচীন ভারতীয় মনীষার দূরতর নিম্ন-অধিকারী উত্তরসূরীদের লিঙ্গযোনি-পূজার মধ্যে যে বিরাট পার্থক্য তা আমরা দেখতে পাই না। ভাবি সবই এক, বর্ব্বরদের কীর্ত্তি। তারপর আবার ব্রিটিশের মত করে ঐগুলিকে ঘৃণার চোখে দেখি, দেখতে শিখি। প্রভু ব্রিটিশের শিক্ষায় শিক্ষিত হই, তাদের ভালমন্দ বোধ দ্বারা ‘আলোকপ্রাপ্ত’ ও কলুষিত হই, এবং আমাদের পূর্ব্বপুরুষদের ভালমন্দ বোধ থেকে, আমরা শিক্ষিত বাঙালীরা একসময় সম্পূর্ণ রূপে বিচ্যুত হয়ে যাই। একদিকে পুরুষানুক্রমে আগত বৈদিক অচলায়তন ও অপরদিকে নিম্ন-অধিকারীদের নানা প্রকার আচারসর্ব্বস্বতা, লিঙ্গপূজা, যোনিপূজা, অনাচার ইত্যাদি এই দুই বিপরীত মেরুর মৌলবাদিতা আমাদের নিজেদের ঐতিহ্যের হাত থেকে ছাড়ান পেতে প্ররোচিত করে। সেই সুযোগের যথার্থ সদ্ব্যবহার করে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ আমাদেরকে আমাদের অতীত থেকে এমনভাবে উৎপাটিত করে দিয়েছে যে, আমরা আমাদের মাটি থেকে পৃথক হয়ে গেছি। আজ আমরা আমাদের নিজস্ব মাটিকেই না চেনার চেষ্টা করি, ঘৃণা করি। কারণ আমাদের প্রভু ইংরেজ ঐ মাটিকে ঘৃণা করত, করতে শেখাত। এভাবেই আমরা আমাদের অতীতকে অস্বীকার করতে শিখে গেছি। এই দৃষ্টিভঙ্গী যে আমাদের কত ক্ষতি করেছে, করছে, তা আর বলে শেষ করা যাবে না। নিজেদের অতীতকে ঘৃণা করতে শিখে, আমরা শিক্ষিত বাঙালীরা, ক্রমে একদিন মানসিকভাবে অনাথ হয়ে যাই।

এই দুরবস্থা ও দুর্ব্বিপাকের সুযোগে শেষ মার মারেন ‘লঙ্’ সাহেব। এমনিতেই আমাদের বর্ণাশ্রমবাদীরা বঙ্গীয় শব্দসমাজেও গুরুচণ্ডাল ভেদ তো চালু করেই রেখেছিলেন— মড়ার সঙ্গে দাহের এবং শবের সঙ্গে পোড়ার বিবাহবন্ধন মেলামেলি নিষেধ করে রেখেছিলেন— তার উপর ‘লঙ্’ সাহেব দিলেন অস্পৃশ্যতার হুকুম, বিধান। লিঙ্গ যোনি থেকে শুরু করে ভগ, …., …., ইত্যাদি ইত্যাদি বহু বহু শব্দই অচ্ছুৎ, অন্ত্যজ, ইতর শব্দ রূপে ঘোষিত হয়ে গেল; ভদ্রলোকদের এলাকায় তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়ে গেল। বলা হল, অমুক শব্দ শ্লীল, তমুক শব্দ অশ্লীল। শব্দসমাজেও যে সুজাত, অজাত, কুজাত ও বজ্জাত প্রভৃতি উচ্চ নীচ ভেদ হয়, এমন ধারণার সঙ্গে বাঙালীর ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটল। ক্রমে একদিন ভাষাজগতে চালু হল লাইসেন্স পারমিট গেটপাস আইডেণ্টিটি কার্ডের প্রথা; দেখা দিল শব্দেরও আইডেণ্টিটি ক্রাইসিস। ‘ভগ’ শব্দের মত যে সকল ‘ভগবান’ জাতীয় হাই ক্যাচ ছিল, তারা কোন মতে পার পেয়ে গেল বটে, কিন্তু বেশীর ভাগ অচ্ছুৎ শব্দের ভাগ্যে পাঠশালায় (অ্যাকাডেমীতে) প্রবেশ করবার অনুমতি মিলল না। অগত্যা তাদের থেকে যেতে হল কামারশালায়, কুমারশালায়, কর্ম্মজগতে, ক্ষেতখামারে; দরিদ্র-বাঙালী মূর্খ-বাঙালীর এক্তিয়ারে। ভদ্রলোকদের লোকালয়ে প্রবেশ করবার জন্য প্রয়োজনীয় শ্লীলতার গেটপাস তারা পেল না। আর সেই সকল গেটপাস পাওয়ার অযোগ্য শব্দগুলিকে স্থান দেবার অভিযোগ থেকে পুরাণাদি গ্রন্থগুলিকে ৪ নিষ্কৃতি দেওয়া হ’ল সম্ভবত বর্ব্বর ভারতীয়দের বর্ব্বরযুগের কীর্ত্তি বলে। ‘অমৃতলিঙ্গম’ পদবীধারী মানুষদের নিষ্কৃতি জুটল, খানিকটা অমৃতের সঙ্গে সম্পর্কের কারণে, খানিকটা এই অজুহাতে যে, নামবাচক বিশেষ্যমাত্রেই অর্থহীন। মোট কথা, নেটিভ্ ও কালো মানুষদের যে দুরবস্থা ব্রিটিশরা করেছিল, এই সকল ‘ব্ল্যাক-লিষ্টেড’ শব্দসমূহের একই অবস্থা করে ছাড়ল তারা। তারপর একদিন ব্রিটিশরা চলে গেল। শোনা গেল, অবহেলিত অচ্ছুৎ অন্ত্যজ দলিত নিপীড়িতরা এবার সামাজিক ন্যায়বিচার (সোস্যাল জাষ্টিস) পাবে। কিন্তু সংবিধানের পাতা থেকে বেরিয়ে সমাজের দিকে যাওয়ার তোড়জোড় করতেই সোস্যাল জাষ্টিসের পঞ্চাশ বছর খরচ হয়ে গেল। ভারতসমাজে ও ভারতীয়দের শব্দসমাজে নিপীড়িত অবহেলিত অস্পৃশ্য দলিতদের আজও এই একই হাল। ৫

তা সে যাই হোক, আজ যখন সারা দুনিয়া জুড়ে মানবসমাজে বড় ছোট ক্ষুদ্র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অন্ত্যজ অস্পৃশ্য অপাঙক্তেয় দলিত নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীগুলি তাঁদের মর্য্যাদার দাবী নিয়ে উঠে আসছেন, নিষিদ্ধ অবহেলিত অস্পৃশ্য শব্দেরাও আপন মর্য্যাদার দাবি নিয়ে যে উঠে আসবেই, তাতে সন্দেহ নেই। কেবল তাই নয়, মানবসমাজের ঐ আগুয়ান গোষ্ঠীগুলি যেমন ইতিহাস খুঁড়ে আত্মপরিচয় অনুসন্ধান করে নিজেদের আইডেণ্টিটি গড়ে নিচ্ছে, শব্দসমাজের নিষিদ্ধেরাও খুঁজে ফিরছে নিজেদের যথার্থ পরিচয়। সেই খোঁজই বহু দূর থেকে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদককেও প্ররোচিত করছে নিষিদ্ধদের নিয়ে কথা বলতে। ছন্নছাড়ারা তাই ছন্নছাড়াদের কথা বলতে চেষ্টা করছে। মানবসমাজে ও শব্দসমাজে নিষিদ্ধদের এ এক নিঃশব্দ সংগ্রাম। এবার তাহলে যাওয়া যাক, চলুন, আমরাও ঐ সংগ্রামে সামিল হয়ে পড়ি।

যার দ্বারা কর্ম্ম সাধিত হয়, সেই ‘কর্ম্মসাধন’কে সাধারণভাবে হাতিয়ার বলা হয়ে থাকে। মার্ক্সীয় টারমিনোলজি অনুসারে একে বলা হয় ‘মিনস্ অফ্ প্রোডাকশন’ বা ‘উৎপাদনের উপায়’। হাতের সাহায্যকারী বন্ধু বা ইয়ার বলেই কর্ম্ম সাধনের নাম হয়েছে হাত-ইয়ার বা হাতিয়ার। কিন্তু শুধুমাত্র হাতিয়ার নিয়েই মানুষ কোন কর্ম্মে লিপ্ত হয় না। শরীরের অন্যান্য অঙ্গকেও, যথা চোখ কান ইত্যাদি এবং সর্ব্বোপরি মনকেও মানুষ একই সঙ্গে কর্ম্মে নিয়োগ করে। অর্থাৎ কর্ম্মে নিযুক্ত হওয়ার সময় মানুষ তার দেহ ও মন দুটিকেই নিয়োগ করে থাকে। দেহের দ্বারা যাকে মানুষ পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করে তার সাধারণ নাম হাতিয়ার, সন্দেহ নাই; কিন্তু মন দিয়ে যাকে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রণ করে তার নাম কী? প্রশ্নটিকে অন্যভাবেও উপস্থাপন করা যায়— হাতের যেমন ‘হাত-ইয়ার’ আছে, তেমনি মনের কি কোন ‘মন-ইয়ার’ আছে? থাকলে সে মনিয়ারের নাম কী?

জ্ঞানচর্চ্চার ক্ষেত্রে ইউরোপ প্রশ্নটিকে আজও ঠিক এইভাবে উত্থাপন করে উঠতে পারেনি। বস্তুত পাশ্চাত্য জ্ঞানজগতে বিশেষত তাঁদের অ্যাকাডেমিক জ্ঞানচর্চ্চার ক্ষেত্রে, এইভাবে এই প্রশ্ন কখনো উঠেনি, ফলে উত্তরটিও তাঁদের সরাসরি জানা নেই। তারা জানেন অন্যভাবে, এবং সে জানাও কম মহত্ত্বপূর্ণ নয়, (তবে সে বিষয়ে আমরা পরে আসব)। কিন্তু প্রাচীন ভারতবাসী কেবল যে, প্রশ্নটি ঐভাবে উত্থাপন করতেই সক্ষম হয়েছিলেন তাই নয়, তার উত্তরটি তাঁরা উপলব্ধি করে প্রকাশ করতেও সক্ষম হয়েছিলেন। দেহের সাহায্যকারী হাতিয়ারের পাশাপাশি মনের হাতিয়ারটিকেও তাঁরা শনাক্ত করেছিলেন এবং তার নাম দিয়েছিলেন ‘লিঙ্গ’। প্রাচীন ভারতীয় পণ্যের কাঁধে চেপে প্রাচীন ভারতীয় শব্দের বিদেশভ্রমণ ও যস্মিন দেশে যদাচার গ্রহণের নীতি মান্য করে ঐ লিঙ্গ শব্দই Lingo, Lingual, Linguist, Linguistic, Language৬ (‘অর্থপ্রকাশন সামর্থ্য’ / দ্র. পাদটীকা ১) প্রভৃতি অনাবাসী ভারতীয় উত্তরসূরীদের জন্ম দিয়েছে, সে কথা নিঃসন্দেহে এখন বলে দেওয়া যায়। আর Language যে মনের হাতিয়ারগুলির মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, সেকথা একালের পোষ্টমডার্ণ সমাজতত্ত্ববিদগণ এখন খুব ভালই জানেন।৭

এই মুহূর্ত্তে কমপক্ষে চারখানি প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। (ক) তাই যদি হয়, প্রাচীন শব্দকারগণ মানসিক হাতিয়ারকে ‘লিঙ্গ’ শব্দে প্রকাশ করতে গেলেন কেন? (খ) লিঙ্গ শব্দের যদি এইরকম অর্থ হয়, তবে যোনি শব্দের প্রকৃত অর্থ কী? (গ) সেই লিঙ্গ যোনি শব্দ শেষমেষ penis ও vagina-তে পরিণত হল কী করে? (ঘ) প্রাচীন রচনাগুলিতে শব্দদুটি কি কখনো মানবশরীরের ঐ অঙ্গদ্বয়ের অর্থ প্রকাশ করার জন্য ব্যবহৃত হয়নি?

বিষয়টিকে যথাসম্ভব সরলভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা যাক। কর্ম্মে রত হওয়াকে রতি বলে। সেই রতিক্রিয়ার (রতিক্রীড়ার নয়) বিস্তারিত উপলব্ধি থেকে বিষয়টি অনেক সহজবোধ্য হয়ে যাবে। ধরা যাক আপনি একটি টেবিল তৈরি করবেন বলে ঠিক করেছেন। এই কর্ম্মে রত হতে গেলে সর্ব্বাগ্রে চাই একটা টেবিলের কল্পনা, ছক বা নক্সা, যা থাকবে আপনার মনে। সেই অনুযায়ী আপনি তক্তা, বাটাম ইত্যাদি সংগ্রহ করবেন এবং সেগুলিকে মনের ছকটির মত করে কেটে কুটে জুড়ে যাতে বানিয়ে ফেলা যায় সেইরকম হাতিয়ার অর্থাৎ হাতুড়ি, বাটালি, করাত ইত্যাদি শুরুতেই আপনি সংগ্রহ করবেন। এরপর ছক ও হাতুড়ি ইত্যাদি নিয়ে আপনার দেহমন ঝাঁপিয়ে পড়ল সামনে রাখা তক্তা ও বাটামগুলির উপর, শুরু হয়ে গেল রতিক্রিয়া। এবার দেখুন, কীভাবে কোন্ কোন্ কাঠের টুকরোগুলির উপর কখন কোন্ হাতিয়ার চালাবেন এবং কেমন করে তাদের জুড়বেন, সেটা কিন্তু নিয়ন্ত্রণ করছে আপনার মনের ছকটা। ক্রমে আপনার ঐ ছকটা বাস্তব দেহ পাচ্ছে, আর আপনার মন রেকর্ড করছে ছক অনুসারে কাঠ ও হাতিয়ারের সমন্বয় সাধন করতে গিয়ে কোথায় কোথায় কী কী অসুবিধা হচ্ছে। অর্থাৎ, আপনি কাজটি করতে করতে বুঝে গেলেন, কল্পিত ছকটি কেমন হলে আরও ভাল হত। এটা একটা অভিজ্ঞতা হল। টেবিলটাও তৈরী হয়ে গেল— প্রাচীন ভারতীয় ভাষায় ‘পুত্ত্র’ লাভ হল।… এই যে সমগ্র ঘটনাটি আপনি ঘটালেন, দেখা যাচ্ছে, এতে দেহের দ্বারা ব্যবহৃত হাতিয়ারের সাহায্যে পাওয়া গেল কর্ম্মফল রূপে টেবিলটা, আর মানসিক ছকটির সাহায্যে পাওয়া গেল অভিজ্ঞতা বা জ্ঞান। মনের মধ্যে ঐ যে ছক, নক্সা বা পরিকল্পনা, সেটাই সমগ্র ক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক এবং অন্তিমে অভিজ্ঞতা-অর্জ্জনকারী। মানসিক নিয়োগ (ছক) রূপ লাভ করছে কর্ম্মফলে, এবং দৈহিক নিয়োগের সুবিধা-অসুবিধাগুলি জ্ঞানফল রূপে গিয়ে জমা পড়ছে মনের ভাগে— ব্যাপারটি ঘটছে বিপরীতভাবে। ছক বা পরিকল্পনা অর্থাৎ লিঙ্গ যদি কর্ম্মরত না হত, ঐ জ্ঞান তার ভাগে জুটত না। তাই ঐ ছকই মন-ইয়ার। তাই মন-ইয়ারই জ্ঞানসাধন। জ্ঞানসাধনই লিঙ্গ।

মার্ক্সীয় ভাষায় এই মন-ইয়ারকে বলে ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’। বানর ফল পেড়ে খায়, সেটি মার্ক্সীয় ভাষায় ‘শ্রম’ নয়। যদি সে ‘বিশেষ উদ্দেশ্যে’ একটি গাছের ডাল ভেঙে হাতে নিয়ে অর্থাৎ ভাঙা ডালটিকে হাতিয়ার বানিয়ে তার সাহায্যে ঐ ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’ সফল করে অর্থাৎ ফলটি পাড়ে, তবেই সেটিকে বলা হবে ‘শ্রম’। তার মানে, মনে থাকবে বিশেষ উদ্দেশ্য বা ছক, হাতে থাকবে হাতিয়ার, সামনে থাকবে ঐ ছক ও হাতিয়ারের যুগপৎ নিযুক্ত হবার ক্ষেত্র— তবে হবে ‘শ্রম’। ঐ মানসিক পরিকল্পনা বা ছক বা ‘বিশেষ উদ্দেশ্য’কেই প্রাচীন ভারতীয়রা বলতেন ‘লিঙ্গ’। ‘বানর থেকে মানুষে উত্তরণে শ্রমের ভূমিকা’র বর্ণনায় এঙ্গেলস ঐ ‘উদ্দেশ্য-প্রণোদিত’ শ্রমের কথা বিস্তারিত বলেছেন। বস্তুত আজকের যুগের বিশাল জ্ঞানভাণ্ডার ও বিপুল পণ্যসম্ভার ঐ ‘উদ্দেশ্যে’র বা লিঙ্গের সৃষ্টি। প্রাচীন ভারতীয়রা তাই লিঙ্গদেবকেই শ্রেষ্ঠ দেবতা বলে ঘোষণা করেছেন।

কেন ঐ ‘মন-ইয়ার’কে লিঙ্গ নাম দেওয়া হয়েছিল? ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি ৮ অনুসারে ‘লীন-হবার-জন্য-যে-গমন-করে’ তাকে ‘লিঙ্গ’ বলে। এই সুবাদে বিশ্বে যা কিছু লীন হবার জন্য যায় তারা প্রত্যেকেই লিঙ্গ পদবাচ্য। হতে পারে সে টেবিলের ছক, হতে পারে নতুন কৃষি পরিকল্পনা, হতে পারে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারসমূহ, হতে পারে যে কোন রকমের সফ্টওয়ার, এমনকি পুংজীবের লিঙ্গও হতে পারে। কেবল দেখা দরকার তারা প্রত্যেকেই ‘লীন হবার জন্য’ যাচ্ছে কি না। বহুরৈখিক প্রাচীন বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার এই কারিস্মা। স্বভাবতই লিঙ্গ শব্দ বহু সংখ্যক অর্থ ধারণ করে, অর্থাৎ মানবশরীরের লিঙ্গ থেকে শুরু করে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অতিচেতনা পর্য্যন্ত সর্ব্বপ্রকার লীনভাবাকুল সত্তাকেই ‘লিঙ্গ’ শব্দে উল্লেখ করা সম্ভব। আবার বিপরীতে যেখানে নিযুক্ত হয় সেই ক্ষেত্রকে অর্থাৎ ‘যোজন-বিযোজন গ্রহণ করে যে’ সেই কর্ম্মক্ষেত্রকে ‘যোনি’ বলে। হতে পারে সেটা টেবিলের জন্য আনা তক্তাগুলি, হতে পারে বিশেষ ভূখণ্ড, হতে পারে বিভিন্ন ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট বা ইণ্ডাষ্ট্রিয়াল zone (যোনি), হতে পারে যে কোন প্রকারের হার্ডওয়ার, এমনকি স্ত্রী-জীবের যোনিও হতে পারে। মোট কথা যে কোন ক্ষেত্রই বা zone-ই যোনি পদবাচ্য। ভারতের ভূতপূর্ব্ব প্রধানমন্ত্রী পি ভি নরসিমা রাও যখন দাভোস শীর্ষ সম্মেলনে, গ্যাট চুক্তির প্রাক্কালে, বিশ্বের ‘পুঁজি ও নো-হাউ’ রূপ লিঙ্গকে ভারতে ‘বিনিয়োগ’-এর জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, ‘ভারত গর্ভ উন্মোচন করে’৯ অপেক্ষা করছে, তখন তিনি ঐ প্রকার লিঙ্গ-যোনি জ্ঞানেরই প্রকাশ ঘটান, হয়তো বা নিজের অজ্ঞাতসারেই। ১০

তাহলে দেখা যাচ্ছে, লিঙ্গ শব্দের ছত্রচ্ছায়ায় শিশ্ন, পুংচিহ্ণ থেকে শুরু করে থিয়োরী, তত্ত্ব, ডিজাইন, জ্ঞান, নো-হাউ, বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি ইত্যাদি ইত্যাদি এমনকি এযুগের সফটওয়ারও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। বিপরীতে যোনি শব্দের ছত্রচ্ছায়ায় স্ত্রী-চিহ্ণ, ‘ভগ’ থেকে শুরু করে প্র্যাকটিস, প্রয়োগ, এগজিকিউশন, কর্ম্ম, নো-হাউ, পুঁজির রমণক্ষেত্র ইত্যাদি ইত্যাদি এমনকি এযুগের হার্ডওয়ারও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। লিঙ্গ যোনি বিষয়ের এই প্রকারের বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে লিঙ্গপুরাণ, যোনিতন্ত্র প্রভৃতি গ্রন্থে এবং নানা পৌরাণিক ও তান্ত্রিক গ্রন্থসমূহে এবং কামসূত্র সংক্রান্ত গ্রন্থসমূহেও। তবে সেগুলিকে ক্রিয়াভিত্তিক (বহুরৈখিক, ভেরিয়েবল) শব্দার্থবিধিতে পাঠ করতে হয়, কেননা সেগুলি ঐ বিধি মান্য করেই রচিত। আধুনিকোত্তর ভাষায় সকল প্রকার লিঙ্গকে কেন্দ্র ও কনটেণ্ট শব্দেও বোঝানো হয়ে থাকে এবং সকল প্রকার যোনিকে প্রান্ত ও ফর্ম শব্দেও বোঝানো হয়ে থাকে। প্রকৃতপক্ষে লিঙ্গ বলতে মানবশরীরের লিঙ্গ থেকে শুরু করে লিঙ্গদেহ বা অমৃতলিঙ্গ পর্য্যন্ত সর্ব্বপ্রকারের লিঙ্গকেই বুঝতে হবে। তেমনি আবার যোনি বললে মানবযোনি থেকে শুরু করে ব্রহ্মযোনি পর্য্যন্ত সর্ব্বপ্রকার যোনিকেই বুঝতে হবে। অধুনান্তিক ইকোফেমিনিষ্ট দার্শনিকরা এই দুই ক্ষেত্রে Universal masculinity ও Universal femininity শব্দ দুটি আজকাল প্রয়োগ করছেন, বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারার পর। আজকের কমপিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় বললে বলতে হয়, বিশ্বের ধরা-অধরা সব সফট্ওয়ারই ‘লিঙ্গ’ পদবাচ্য এবং বিশ্বের সমস্ত জানা-অজানা হার্ডওয়ারই ‘যোনি’ পদবাচ্য। আগুন জ্বালাতে পারার বিদ্যা যদি আদি সফট্ওয়ার হয় তো পরমাণু জ্বালানি জ্বালতে পারা এযুগের সফট্ওয়ার। তেমনি সমিধকাঠ যদি আদি হার্ডওয়ার হয় তো নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্রোজেক্ট এযুগের হার্ডওয়ার। এ যুগের যত প্রকারের infrastructure, superstructure ইত্যাদির কথা বলা হয়, তা সবই যোনি পদবাচ্য।… এইভাবে সর্ব্বত্র বিরাজমান অতিচেতন যখন অমৃতলিঙ্গ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রসারিত সম্পর্কের নিয়মজাল১১ তখন ব্রহ্মযোনি। তন্ত্রশাস্ত্রে কোন কোন স্থলে একে বিশ্বযোনি১২ শব্দেও উল্লেখ করা হয়ে থাকে।

যোগসাধনা ও তন্ত্রসাধনা
……………………………………
Coupling & System Designing
মনুষ্যলিঙ্গ থেকে অমৃতলিঙ্গ এবং মনুষ্যযোনি থেকে বিশ্বযোনি পর্য্যন্ত লিঙ্গ ও যোনির যে বহু রূপ, তাদের মধ্যেকার সম্বন্ধ কী? তারা পরস্পরের বিপরীত গুণবিশিষ্ট, এবং সে কারণেই তারা পরস্পরের পরিপূরক (complementary), তাই তারা পরস্পরে যোগ্য। ‘যাহাকে যোগ করা যায়’ তাকে যোগ্য বলে। যেমন নরকে নারীতে বা নারীকে নরে যোগ করা যায় বলে তারা পরস্পরে যোগ্য। এইভাবে শ্রম তক্তায় যোগ্য, কৃষি মজুর ও সার-বীজাদি ক্ষেতে যোগ্য, নো-হাউ ও পুঁজি ইণ্ডাষ্ট্রিতে যোগ্য ইত্যাদি ইত্যাদি; অর্থাৎ সর্ব্বপ্রকার লিঙ্গ যথাযথ বিপরীত যোনিতে যোগ্য। একথা উল্টোভাবেও বলা যায়। এবং এই তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা যেতে পারে। মোট কথা যার সঙ্গে যোগসাধন সম্ভব, যোগসাধন হলে যারা পরস্পরে কর্ম্মরত হয়, অর্থাৎ যোগসাধন হলে যাদের মধ্যে রতিক্রিয়া প্রবর্ত্তিত হয় এবং ফলে পুত্র বা সন্তান১৩ উৎপাদিত হয়, তারাই পরস্পরের পরিপূরক বা যোগ্য। যারা পুংসবন (বীজমন্ত্র নিষেক) করতে অক্ষম, সেই সকল নপুংসক ও যারা গর্ভধারণে অক্ষম সেইসকল নিগর্ভযোগিনীদের কথা এখানে বলা হচ্ছে না। কিংবা তাদের কথাও বলা হচ্ছে না যারা রতিক্রীড়ায় রত হয় বলে সন্তান উৎপাদন হয় না, এবং কদাচ রতিক্রিয়ায় রত হয় না। একমাত্র যথাযথ যুগ্মের (binary-র) যোগসাধনেই রতিক্রিয়া প্রবর্ত্তিত হয় এবং তার ফলেই সৃজন সম্ভব হয়। শাস্ত্রে বলেছে, ‘সম্পূর্ণ বিপরীত গুণবিশিষ্ট হইলেই যে কোন শক্তিদ্বয়ের সহসা সংযোগ বা মিলন দ্বারা কোন এক অভিনব ক্রিয়ার উন্মেষ হইয়া থাকে।’ ঐ অভিনব ক্রিয়াই নতুন সৃষ্টি, যা কিনা দুই বিপরীত গুণবিশিষ্টের অমীমাংসেয়তার (aporia) ফল। এই সৃষ্টিই মানুষকে, সমাজকে, বিশ্ব-প্রকৃতিকে এগিয়ে চলার পথ করে দেয়, উপস্থিত অচলায়তনকে এড়িয়ে অহিত বিনাশের উপায় করে দেয়। সেই কারণে যুগ যুগ ধরে মানুষ লিঙ্গ-যোনির যথাযথ যুগ্মের অনুসন্ধান করে তাদের যোগসাধন করে চলেছে। আধুনিক কমপিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় এই যুগ্মের যোগসাধনাকে coupling বলে।

‘একের সহিত অন্যের মিলন কার্য্যই যোগ’, বলেছেন তন্ত্রসাধকেরা। এ যুগের তন্ত্রসাধকদের বলা হয় ‘System Designers’। System (তন্ত্র) শব্দের আদি অর্থ standing together। পুরুষ প্রকৃতি বা লিঙ্গ যোনিকে একত্রিত করে একটা ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের রতিক্রিয়া হতে দেওয়ার বিদ্যাকেই এযুগের ভাষায় বলে সিষ্টেম-ডিজাইনিং। বিশেষ উদ্দেশ্যের সঙ্গে যথাযথ ক্ষেত্রের, তত্ত্বের সঙ্গে প্রয়োগের, জ্ঞানের সঙ্গে কর্ম্মের ইত্যাদি ইত্যাদি কোটি রকমের যোগসাধনেই উদ্ভূত হয়েছে বিশ্বের বিপুল সৃষ্টিসম্ভার, জ্ঞানসম্ভার ও পণ্যসম্ভার। তন্ত্রসাধনা বা সিষ্টেম-ডিজাইনিং সেই উদ্দেশ্যে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতিকে কোটি রকমের যুগ্মে (binary-তে) বিন্যস্ত করে দেখে নিয়ে তাদের যোগসাধনে ব্রতী হয়। প্রথমে দুই, তারপর চার, ছয়, আট… এইভাবে গড়ে তোলে বাইনারি-ট্রী এবং অবশেষে বাইনারি-ফরেষ্ট। এইভাবে তন্ত্রসাধক বা সিষ্টেম-ডিজাইনারগণ বাইনারি-বিপরীত (পরিপূরক) গুলির সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে এক প্রকার ব্যবস্থা (তন্ত্র) বা সিষ্টেম গড়ে তোলেন, যা বিশেষ সৃষ্টিকে অব্যাহত রাখে। এই কাজে সফল হবার জন্য কোন্ লিঙ্গের সঙ্গে কোন্ যোনির যোগ সম্ভব, সে বিষয়ে সম্যকরূপে জানতে হয়। জানতে হয় সমস্ত মিলনব্যাকুল বিরহকাতরদের কথা। আর সেই কথা জানার জন্য তন্ত্রসাধক বা সিষ্টেম ডিজাইনারদের যার উপর নির্ভর করতে হয় তার নাম ‘যোজনগন্ধ’।

‘যোজনগন্ধ’ (প্রকৃত যৌনতা)
…………………………………
Real Information
নর থেকে নারীর উদ্দেশে, নারীর থেকে নরের উদ্দেশে কিংবা লিঙ্গ থেকে যোনির উদ্দেশে এবং যোনি থেকে লিঙ্গের উদ্দেশে— মোট কথা পুরুষ-প্রকৃতির পরস্পরের উদ্দেশে যে গন্ধ বা ইশারা বা সংবাদ সদাসর্ব্বদা স্বতঃস্ফূরিত হতে থাকে, তাকে যোজনগন্ধ বলে। অর্থাৎ কিনা, যোজনগন্ধ হ’ল যোগসাধনের সম্ভাবনার সংবাদ বহনকারী গন্ধ। যার সঙ্গে যার যোগসাধন সম্ভব, তারা পরস্পরের উদ্দেশে ঐ সম্ভাবনার খবর পাঠাতে থাকে, নিজেদের অজ্ঞাতসারেই। (সচেতনভাবে, জেনেশুনে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত-ভাবেও ঐ খবর পাঠানো হয়ে থাকে, তবে সে প্রসঙ্গে আমরা পরে যাব)। স্বভাবতই ঐ যোজনগন্ধ একান্তভাবেই অস্তিত্বের নিজস্ব ধর্ম্ম। যে কোন অস্তিত্ব থেকেই যোজনগন্ধ যথাযথ যোগ্যের উদ্দেশে উৎসারিত হতে থাকে, কেননা শাস্ত্রমতে এ বিশ্বজগৎ পুরুষ-প্রকৃতি রূপে (যুগ্ম যুগ্ম রূপে) কামসূত্রে গ্রথিত, এ যুগের বিজ্ঞানমতে যা পরস্পরের পরিপূরক (complementary), যুগ্ম (binary) অস্তিত্বসমূহের সুশৃঙ্খল এক মহা-অবয়ব। তাই যোজনগন্ধের স্ফূরণ ঘটানো যেমন অস্তিত্বের স্বভাবধর্ম্ম, তেমনি যোজনগন্ধের গ্রাহক হওয়াও অস্তিত্বের স্বভাবধর্ম্ম। সেই কারণে যোজনগন্ধ দু-রকমের— (ক) যে যোজনগন্ধ যোনির (প্রকৃতির) থেকে স্বতোৎসারিত হয়ে লিঙ্গের (পুরুষের) উদ্দেশে ধাবমান হয়, তাকে স্ত্রী-যোজনগন্ধ বলে; আর বিপরীতে (খ) যে যোজনগন্ধ লিঙ্গ (পুরুষ) থেকে স্বতোৎসারিত হয়ে যোনির (প্রকৃতির) উদ্দেশে ধাবমান হয়, তাকে পুং-যোজনগন্ধ বলে। স্ত্রী-যোজনগন্ধ মন্ত্রণা দেয়— ‘এস! এস! আমাতে যোজিত হও।’ বিপরীতে পুং-যোজনগন্ধ আবেদন জানায়— ‘অবকাশ দাও, তোমাতে লীন হয়ে যাই।’ প্রকৃতি ও পুরুষ পরস্পরের প্রতি এই চিরন্তন লীলার আকাঙ্ক্ষায় চিরব্যাকুল। কর্ম্মক্ষেত্র কর্মীর উদ্দেশে, কর্মী কর্ম্মক্ষেত্রের উদ্দেশে সদাসর্ব্বদা ঐ যোজনগন্ধের স্ফূরণ ঘটায়। (‘মাটি মাগে ভাই হলের আঘাত, সাগর মাগিছে হাল…’ ইত্যাদি)। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র অস্বাভাবিকতা নেই। এর কোন শ্লীল-অশ্লীল হয় না। যেমন ফুলের প্রস্ফুটিত হওয়া ও সৌরভ ছড়ানোর কোন শ্লীল-অশ্লীল, উচিত-অনুচিত হয় না, তেমনি। এটা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক অনিবার্য্য এক নিয়ম। তাই একে স্বাভাবিক-লিঙ্গতা (পুং-যোজনগন্ধ) বা স্বাভাবিক-যৌনতা (স্ত্রী-যোজনগন্ধ) বলা যেতে পারে। কিংবা উভয়ের ক্ষেত্রে একে প্রকৃত-যৌনতাও বলা চলে।

যদি পৃথিবীতে দিন রাত না হত, আবহাওয়ার কোনরকম পরিবর্ত্তন না হত, তাহলে পার্থিব সময়কে চিহ্ণিত করা একটি কঠিন কাজ হত, সন্দেহ নাই। চিহ্ণিত করতে হলে বদল চাই, পার্থক্য চাই, ভেদ চাই। শাস্ত্রে বলেছে— ভেদ থেকেই বেদের (জ্ঞানের) সৃষ্টি। জ্ঞান হ’ল— বস্তুর পরিচ্ছেদ্য নির্দ্ধারণী বৃত্তি১৪। অভেদ থেকে জ্ঞানের উন্মেষ নেই। কারণ ভেদ নেই বলে অভেদ পরিমাপযোগ্য নয়। ভেদ থাকলে তবেই পরিমাপ করা সম্ভব হয়। আদিগন্ত বিস্তৃত চিহ্ণহীন একরূপী মরুভূমিকে খুঁটি পুঁতে আলাদা করতে না পারলে জরিপ করা যায় না। সবাই জানেন, জরিপ বা পরিমাপ দিয়েই বিজ্ঞানের শুরু। ভেদগ্রস্ত বা বিকারগ্রস্ত হলে, তবেই তা ইন্দ্রিয়গোচর হয়ে পরিমাপযোগ্য হয়ে ওঠে। যোজনগন্ধ যতদিন অবিকৃত ছিল, ততদিন তাকে অজানা ধারণা-র (wild-concept-এর) অসীম এলাকা থেকে পোষা ধারণা-র (pet-concept-এর) সসীম এলাকার অন্তর্ভুক্ত করে তার নামকরণ করা যায়নি। জগতে যোজনগন্ধ ছিল, কিন্তু যোজনগন্ধ নামে কেউ তাকে চিনত না; কারণ অবিকৃত ছিল বলে তাকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। যেমন অনবচ্ছিন্ন ও সমরূপী স্থান কাল বা পাত্রকে শনাক্ত করা যায় না, তেমনি। চিন্তাবিদেরা জানেন— অমন অশনাক্ত কত বিষয় ও বস্তু যে এই পৃথিবীতে রয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।

আদিম সাম্যবাদী সমাজে, নরমানুষ সহ সকল প্রকারের পুরুষই স্বভাবত যেমন পুং-যোজনগন্ধ বিকিরণকারী ছিল, তেমনি নারীমানুষ সহ সর্ব্বপ্রকারের প্রকৃতিও স্বভাবতই স্ত্রী-যোজনগন্ধ স্ফূরণকারিণী ছিল, কিন্তু তাদের সেই স্ফূরণগুণ বা বিকিরণগুণ চিহ্ণিত ছিল না। চিহ্ণিত হল ভেদগ্রস্ত বা বিকৃত হয়ে যাওয়ার পর। সামাজিক উৎপাদন কর্ম্মজগতে, পুরুষ-প্রকৃতির মধ্যেকার সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়ে গিয়ে মর্য্যাদার অসাম্য প্রতিষ্ঠিত হলে পর, একসময় সর্ব্বপ্রকারের লিঙ্গগন্ধ ও যৌনগন্ধের স্বাভাবিকতা নষ্ট হয়ে গেল অর্থাৎ সর্ব্ব’প্রকারের যোজনগন্ধই একসময় বিকৃত হয়ে গেল। পরস্পরের পরিপূরক অবস্থান থেকে লিঙ্গ ও যোনি অর্থাৎ পুরুষ-প্রকৃতি যথাক্রমে শাসক-শাসিতে পরিণত হয়ে গেল। ‘পরস্পরকে উচ্চ বলিয়া ব্যবহার’ ১৫ — এর সনাতন নীতি থেকে পুরুষ-প্রকৃতি বিচ্যুত হলে পর, অর্থাৎ ‘সমুচ্চয়’-এর নীতি পরিত্যক্ত হলে পর, পুরুষ-প্রকৃতির মধ্যে ‘দাম্পত্য’ ১৬ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হল। তাই যে যোজনগন্ধ শেষমেষ দাম্পত্য সম্পর্কে পরিণত হয় তাকেই ‘বিকৃত যোজনগন্ধ’ বলা যায়। তখন একজন হয়ে যায় দমিত, অন্যজন হয়ে যায় দমনকারী। আর তখনই, সেই বিকৃত যোজনগন্ধই প্রথম চিহ্ণিত হতে শুরু করে এবং সেটাও একতরফা। পুরুষ শাসক বলে, তার বিকৃত পুং-যোজনগন্ধ বা বিকৃত লিঙ্গগন্ধ বা লিঙ্গতার নাম হয়ে যায় পৌরুষ; আর প্রকৃতি শাসিত বলে তার বিকৃত স্ত্রী-যোজনগন্ধ বা বিকৃত যোনিগন্ধ বা যৌনতা যৌনতা নামেই নিন্দনীয় হয়ে যায়। প্রকৃতির যোজনগন্ধ ছড়ানো এরপর থেকে পুরুষের সম্মতিসাপেক্ষ, কিন্তু পুরুষ অবাধ। সতীত্বের প্রশ্ন ওঠে আর সেটা কেবল প্রকৃতির জন্য নির্দ্দিষ্ট এবং অবশ্য পালনীয় হয়ে যায়। এমনকি সতী শব্দের পুংলিঙ্গও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এবার থেকে পুং-যোজনগন্ধের নাম পৌরুষ, যা কিনা গৌরবজনক এবং স্ত্রী-যোজনগন্ধের নাম যৌনতা, যা কিনা নিন্দনীয়। লিঙ্গতা শব্দটিকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। যোজনগন্ধী পুরুষ এখন থেকে তার পৌরুষের সৌরভের জন্য সংবর্দ্ধিত; যোজনগন্ধ্যা ১৭ প্রকৃতি তার যৌনতার জন্য দুর্গন্ধবতী নামে নিন্দিত। … কর্ম্মজগতের এই বিশাল পরিবর্ত্তন ছায়া ফেলল মানুষ-মানুষীর ব্যক্তি জীবনেও। তাদের যোজনগন্ধ বিকারের নাম হয়ে গেল যৌনতা। আর সেই যৌনতা অশ্লীল হয়ে গেল।

যোজনগন্ধ সঙ্কোচ ও যোজনগন্ধ বিকার
………………………………………………
Information hiding and misinformation
একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তির মৌলবাদী দক্ষনীতি প্রতিষ্ঠা পেলে পর, পুরুষ-প্রকৃতির সম্পর্কের বিকৃতি ঘটে। যোজনগন্ধের উপর তার প্রভাব পড়ে সোজাসুজি।

প্রথমত একই ক্ষেত্রে বারংবার একইভাবে নিযুক্ত হবার ফলে ‘জ্ঞানসাধনের’ বা লিঙ্গের অর্জ্জন হয়ে যায় সীমিত। নিত্যনতুন ক্ষেত্রে, নিত্যনতুন পদ্ধতিতে উৎপাদন কর্ম্মে লিপ্ত হবার আবিষ্কারমূলক সৃজনশীল শৈবনীতি পরিত্যক্ত হবার ফলে, একই কর্ম্মের পুনরাবৃত্তিজনিত ‘কর্ম্মময়ী-অবিদ্যা’র জন্ম হয়। সেই অবিদ্যা স্বভাববশতই কর্ম্ম ক্ষেত্রকে গোপন করতে প্ররোচিত করে। ফলে উৎপাদন ক্ষেত্রকে গোপন করার, বেড়া দেওয়ার, ঘিরে দেওয়ার প্রথার প্রচলন হয়ে যায়। আজকের কম্পিউটার বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে information hiding; সেই উৎপাদন ক্ষেত্র গোপন থেকেই তার আদিম সূত্রপাত। মানুষ শিখে যায়, কেবল কৃষিক্ষেত্রটিই নয়, সর্ব্বপ্রকারের উৎপাদন ক্ষেত্রকেই সুরক্ষিত ও গুপ্ত রাখাই উচিত। অর্থাৎ কিনা, কৃষি কাজ করতে শেখার পর মানুষ যেদিন তার শস্য উৎপাদন ক্ষেত্রকে গোপন করবার বিদ্যা অর্জ্জন করেছিল, তার পর থেকেই সে তার লিঙ্গ ও যোনিকে ঢেকে রাখা উচিত বলে বিবেচনা করেছিল। বলতে কি, যোজনগন্ধ সঙ্কোচের সেই আদি সূত্রপাত। … তারপর থেকে সঙ্কোচপ্রথা ক্রমান্বয়ে বিকশিত হয়েছে। পুরুষ কেবল শাসক হয়নি, প্রকৃতির মালিক হয়ে গেছে বলে মনে করেছে— নিজে ভোক্তা আর প্রকৃতি ভোগ্যা। তাই কর্ম্মক্ষেত্রের সীমা, জমির সীমা, দেশের সীমা প্রভৃতি ঘিরে নানারকমের দেওয়াল তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্রমশ বেড়েছে আবরণ, আচ্ছাদন। বিশ্বের সর্ব্বপ্রকারের লিঙ্গ ও যোনিকে ঢেকে রাখতে কত শত আইন যে তৈরি করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নাই। নর নারীকে বোরখা পরিয়েছে, মুখোশ পরিয়েছে, সীমাবদ্ধ করেছে। আকাশ সীমা, সমুদ্র সীমা, জ্ঞানের সীমা, কর্ম্মের সীমা, কর্ম্মক্ষেত্রের সীমা, ভূখণ্ডের সীমা, এক্তিয়ারের সীমা ইত্যাদি ইত্যাদি— আর সেই সকল সীমা-লঙ্ঘন নিয়েই চলেছে দুনিয়ার সমস্ত জুডিশিয়ারীর কর্ম্মকাণ্ড। আর, প্রত্যেকের যোজনগন্ধ যেন তার নির্দ্ধারিত সীমার মধ্যেই থাকে। তাই সীমায় সীমায় লক্ষ লক্ষ পাহারাদার। সীমা সুরক্ষাবল বা বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের শেষ নেই। ঘরের চারদিকে, কারখানার চারদিকে, বাগিচার চারদিকে, দেহের চারদিকে, মনের চারদিকে, দেশের চারদিকে কত না বাউণ্ডারী ওয়াল, কত না বিধিনিষেধ, কত রকমের সীমা! ‘আবরণ’১৮ অত্যাচারের শেষ নেই। কোন সীমা দেখতে পাওয়া যায়, দেখতে পাওয়া যায় দেহের চোখ দিয়ে, কোন সীমা দেখতে হয় মনের চোখ দিয়ে। আর পাহারাদারও কত রকমের। কলেজের অধ্যক্ষ জেঠু যদি কলকাতার ছেলেমেয়েদের পোষাকের সীমা পাহারা দেন, তো, জাতিসঙ্ঘের জেঠুরা ‘হিউম্যান-রাইটস’-এর সীমা পাহারা দেন ইরাকে, বসনিয়ায়, সার্ব্বিয়ায় …। যত সীমা তত সীমালঙ্ঘনকারী, আর তত পাহারাদার। কর্ম্মক্ষেত্র, ধর্ম্মক্ষেত্র, কোন ক্ষেত্রই নিরাপদ নয়। একদল বাউণ্ডারি ওয়াল তোলে তো অন্যদল সেটা ভাঙে কিংবা টপকায়। প্রতিটি বিষয়ের সীমা নির্দ্দেশ করে দেওয়াল তোলা যদি দক্ষের ধর্ম্ম, তো সেই সীমা লঙ্ঘন করা শিবের ধর্ম্ম। যোজনগন্ধ-সঙ্কোচ দক্ষধর্ম্ম, তো স্বাভাবিক-প্রাকৃতিক যোজনগন্ধ-বিস্তার শিবধর্ম্ম। সম্প্রতি বিশ্ব জুড়ে সব দেওয়াল ভেঙে পড়ছে দেখে বিশ্বের দক্ষেরা তাদের শেষ আশ্রয় গড়ছে পেটেণ্ট-আইনের সীমা বরাবর উঁচু করে দেওয়াল তুলে। নিজেদের দেওয়া সীমাটি বাদ দিয়ে, বাদবাকী সমস্ত সীমাগুলিকে অকেজো করে দেওয়ার জন্য দুনিয়ার সমস্ত সীমালঙ্ঘনকারীদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তারা ট্রান্সপারেন্সির ডাক দিয়েছে। তাদের একান্ত বাসনা, সব একাকার হয়ে যাক, কেবল তাদের ‘নোহার জাহাজ’টি১৯ একার্ণবের ‘মৎস্যের ন্যায়’ বেঁচে থেকে যাক। নরনারীর ও তাদের সমাজের এই যোজনগন্ধ-সঙ্কোচ কয়েক হাজার বছর পেরিয়ে এভাবেই শেষ পর্য্যন্ত গিয়ে হাজির হয়েছে ‘জ্ঞানের মালিকানা’র সঙ্কোচনে; পেটেণ্ট আইন বানিয়ে তার সীমা বরাবর পাহারা বসানোর তোড়জোড়ে।

যোজনগন্ধ-সঙ্কোচ প্রকৃত বিচারে এক প্রকারের নন্-ট্রান্সপারেন্সি, এক প্রকারের গোপনীয়তা। এই গোপনীয়তাই প্রকৃতির উপর পুরুষের২০ সমস্ত ক্ষমতার উৎস। ‘ঢাক ঢাক গূঢ় গূঢ়’ পুরুষের ও ক্ষমতাধারীর আদি মন্ত্র। সিক্রেট-কারী সেক্রেটারি (secretary=who secrets) ক্ষত্রিয়দের২১ সচিবদের২২ সাহায্যে ও মন্ত্র গোপন করবার অঙ্গীকারবদ্ধ মন্ত্রগুপ্তির শপথ গ্রহণকারী মন্ত্রীদের ছাড়া কোন ক্ষমতাকেন্দ্র একদিনও টিকে থাকতে সমর্থ নয়। কিন্তু খবর গোপন করলে লোকে সেটা খোঁজে। তাই সত্য গোপন করার ভাল উপায় হল ভুল খবর দিয়ে দেওয়া। এই সেই কারণ, যে জন্য একদিন যোজনগন্ধ-সঙ্কোচ করার চেয়ে যোজনগন্ধ-বিকারের ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। সত্য গোপন নয়, ‘সচ’-এর ছলনা। সচ্-ছলনা করেই একদিন দক্ষপুরুষ ‘সচ্ছল’ হয়ে যায়। আধুনিক ভাষায় একে বলে ডিপ্লোমেসী, অ্যাডভার্টাইজিং, বিজ্ঞাপন, সেল্স-প্রমোশন। এর ফলে সমগ্র সমাজ নানা প্রকারের যোজনগন্ধবিকারে কলুষিত হয়ে ওঠে। মিডিয়া বা বায়ুর প্রকোপ বাড়ে। অধুনাতন যুগে গড়ে উঠেছে information highway। তাতে information-এর সাথে সাথে misinformation, disinformation-ও সমানে দৌড়াচ্ছে। এমনকি information jumble-ও ঘটছে। যোগ্যের জন্য যোগ্যের যে ব্যাকুলতা, তার উপশম ঘটাতে হয় এই কলুষিত প্রদূষিত আবহাওয়ায়। [তবে highway তৈরি হওয়া ভাল। আজ যদি তা লুঠেরার কাজে লাগে, কাল তা মানুষের কাজে লেগে যেতে পারে]।

আজকের যুগের পত্রপত্রিকাগুলিও এর যথার্থ সাক্ষ্য বহন করে। ‘আনন্দবাজার’, ‘আজকাল’, ‘প্রতিদিন’, ‘বর্তমান’, The Statesman, Telegraph, Asian Age-এর পাতা খুললেই চোখে পড়বে। দেখা যাবে, পাত্র-পাত্রীর বাবা-মায়েরা পরস্পরের উদ্দেশে যোজনগন্ধ পাঠাচ্ছেন। তারা নিজেরা নয় (আজকাল অবশ্য ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ স্বয়ং ঐ বিজ্ঞাপন দেয়), তাদের অভিভাবকেরা। কারণ, পুত্র-কন্যারা এখনও পিতা-মাতার অধিকারভুক্ত। এই সেই অধিকার, যে অধিকারে পৌরাণিক যুগে গাধির পিতা তাকে গলায় দড়ি বেঁধে গরু-বেচার মত বেচতে এসেছিল। আরও আছে। কর্ম্মপ্রার্থী ও কর্ম্মখালির কলম। কারখানা যোজনগন্ধ পাঠাচ্ছে হবু শ্রমিকের উদ্দেশে, বিপরীতে শ্রমিক যোজনগন্ধ পাঠাচ্ছে কারখানার উদ্দেশে। আছে শিক্ষার কলম। সেখানে সাধারণত শিক্ষক (পুরুষ) ছাত্রের (প্রকৃতির)২৩ প্রতি যোজনগন্ধ পাঠায় ঐ বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। কিংবা সম্পত্তি, ঘরবাড়ি ভাড়া এমনকি ব্যক্তিগত কলমও, প্রকৃত বিচারে, পুরুষ-প্রকৃতির পরস্পরের উদ্দেশে যোজনগন্ধ পাঠানোর আধুনিক মাধ্যম। কেবল পুরুষ শাসকে পরিণত হয়ে কলুষিত হয়ে গেছে ব’লে, আর প্রকৃতি শাসিতে পরিণত হয়ে গ্লানিগ্রস্ত হয়ে গেছে ব’লে, এবং এই অবস্থা বেশ কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসছে ব’লে, এই প্রকার মাধ্যমের সাহায্যে এযুগে যে যোজনগন্ধ পাঠানো হয়, তা বিকারগ্রস্ত। যোজনগন্ধ গ্রাহককে বোকা বানানো যোজনগন্ধ প্রেরকের স্বার্থের পক্ষে অনুকূল বলে, ঐ বিকার ঘটানো হয়। কারণ এখন গ্রাহক-প্রেরক উভয়েরই ‘ব্যক্তিগত স্বার্থ’ বিদ্যমান, কেননা ব্যক্তিমালিকানা বিদ্যমান। তাই যোজনগন্ধকে বিকৃত করা হয়, মিথ্যা প্রচার করা হয়, তীক্ষ্ণ তীব্র কৃত্রিম গন্ধ ছড়ানো হয়। একালে কার্য্যত কিছু তো করার নেই! ব্যবস্থা যতই কলুষিত হয়ে যাক না কেন, মিলনব্যাকুলদের তো পরস্পরের উদ্দেশে খবর পাঠাতেই হবে। কখন ব্যবস্থা নিষ্কলুষ নির্ম্মল হবে সেই আশায় তারা তো বসে থাকতে পারে না। চিকিৎসাব্যবস্থা যতই কলুষিত হোক, রুগীর তো উপায় নেই। তাকে প্রচলিত ব্যবস্থার সাহায্য নিয়েই আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে হয়।

আমরা জেনেছি, লিঙ্গই জ্ঞানসাধন। তাই কর্ম্মজগতের ছায়াই জ্ঞানজগৎ। সেই কারণে কর্ম্মজগৎ যে রীতিতে চলে, আমাদের মানসিকতাও সেই অনুযায়ী চলতে শুরু করে। সামাজিক উৎপাদন কর্ম্মজগৎ এখনও প্রধানত দু-ভাবে চালানো হয়— সমাজতান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক। যোজনগন্ধ প্রেরণ-গ্রহণের রীতিও তাই দুই রকমের। ফলিত সমাজতন্ত্র প্রধানত যোজনগন্ধ-সঙ্কোচে বিশ্বাসী, যখন কিনা ধনতন্ত্র প্রধানত যোজনগন্ধ-বিকারে বিশ্বাসী। মূলত দুটি প্রক্রিয়াই আসলে সত্যগোপন। আর সত্যগোপনই সমস্ত ক্ষমতার উৎস। পুরুষ যে আজ পর্য্যন্ত প্রকৃতির উপর রাজত্ব করে আসছে তার প্রকৃত ভিত্তি হচ্ছে এই যোজনগন্ধ-সঙ্কোচ ও যোজনগন্ধ-বিকার, এক কথায় সত্যগোপন।

আজকের পরিস্থিতি কিন্তু ভিন্ন। তথাকথিত সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্র সেকেলে হয়ে গেছে। নতুন বিশ্বব্যবস্থার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। দেওয়া হচ্ছে ট্রান্সপারেন্সির ডাক। বলা হচ্ছে সত্যগোপন চলবে না। যোজনগন্ধ-সঙ্কোচও চলবে না, তার বিকারও চলবে না। প্রকৃতি উঠে আসছে সমমর্য্যাদার দাবি নিয়ে। এবার যোজনগন্ধ হয়ে যাবে স্বাভাবিক— পৌরুষ নেমে আসবে তার স্বাভাবিক লিঙ্গতায় এবং যৌনতা উঠে আসবে তার স্বাভাবিক পবিত্রতায়। পুরুষ-প্রকৃতির সমমর্য্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করেছে কোন কোন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে। ফলে লিঙ্গতা ত্যাগ করছে অহঙ্কার, যৌনতা হারাচ্ছে গ্লানি; স্বাভাবিক হয়ে উঠছে তারা। প্রকৃত যোজনগন্ধের সৌরভ ক্রমশ বাড়ছে। অচিরে জগতের সমস্ত প্রকারের পুরুষ-প্রকৃতি প্রকৃত যোজনগন্ধের সৌরভে আকুলিত হবে, এমন আশা করা যেতে পারে। সব ব্যাপারেই গোপন-গোপন ভাব দূর হবে। যা স্বাভাবিক, তার উপর মিথ্যার আবরণ ভাল কথা নয়। সিষ্টেম ডিজাইনিং-এর বা তন্ত্রসাধনার সেটি অন্যতম বাধা। তাই তা ক্রমান্বয়ে বিদূরিত হবে। স্বাভাবিক বিশুদ্ধির (শিবতার) নীতি মান্য করে মানুষ ক্রমশ স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, আশা করা যাক।

টীকা :
1. দ্রষ্টব্য : হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিরচিত ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’। এই নিবন্ধের বেশীর ভাগ শব্দার্থ ঐ শব্দকোষ থেকেই নেওয়া হয়েছে। পরে আর সেকথা পৃথকভাবে উল্লেখ করা হযনি। এক্ষেত্রে ঐ শব্দকোষ লিঙ্গ শব্দের অর্থ দিয়েছেন— জ্ঞানসাধন, সাধ্যের সাধন, চিহ্ণ, লক্ষণ, ভেখ, পুংশ্চিহ্ণ, স্ত্রীচিহ্ণ, শিশ্ন, gender, মূর্ত্তি, হেতু, সূক্ষ্মশরীর, অর্থ প্রকাশন সামর্থ্য ইত্যাদি।
2. দ্রষ্টব্য : ‘ভাষায় ঔপনিবেশিকতা’। এই গ্রন্থের ৮ম প্রবন্ধ।
3. ভারতীয় শাস্ত্রালোচনায় অধিকারিভেদ ছিল। একই বর্ণনার উত্তম ও নিম্ন অর্থ ছিল এবং উত্তম অর্থের সূত্রগুলি সবাইকে দেওয়া হত না, সবাই সে অর্থ ধারণেও সক্ষম ছিল না। অধিকারিগণ তাই ‘উত্তম-অধিকারী’ ও ‘নিম্ন-অধিকারী’ এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন।
4. পুরাণাদিতে যে সকল ‘অশ্লীল’ শব্দের প্রয়োগ আছে, তা শুনলে, শিক্ষিত বাঙালিদের কর্ণ কদমগাছ (চক্ষু চড়কগাছের বদলে) হয়ে যাবে। তবে সেই পুরাণ রচয়িতারা কতখানি বর্ব্বর(?) ছিলেন তা ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা কিন্তু জেনে গিয়েছিলেন— ‘Indians were people for ages, cultivated by all the arts of polished life whilst we were yet in the woods’. অর্থাৎ ভারতীয়দের তুলনায় আমরা ইউরোপীয়রা জংলী।— কথাগুলি বলেছিলেন কট্টর ভারতবিরোধী এডমণ্ড বার্ক ভারততত্ত্ববিদ উইলিয়াম জোন্সকে। দ্রষ্টব্য : India and the Romantic Imagination – by John Drew.
5. সম্প্রতি এক সেমিনারে বাংলা সাহিত্যের এক দিকপাল লেখক জানালেন যে, পঞ্চাশের দশক পর্য্যন্ত লিঙ্গ যোনি শব্দ দুটির সাহিত্যসভায় (পড়ুন– ভদ্রলোকদের সাহিত্যসভায়) প্রবেশাধিকার ছিল না। তাঁদের ‘অক্লান্ত চেষ্টায়’ শব্দদুটি এখন ছাপার অক্ষরে লেখা যাচ্ছে (পড়ুন– প্রধানত লিটল ম্যাগাজিনে)। এ যেন শব্দসমাজে ভারতসমাজের সেই ঘটনার প্রতিচ্ছবি, যে ঘটনার মাধ্যমে ভারত সরকার জাকির হুসেন, জৈল সিং, কে আর নারায়ণ প্রমুখকে ‘শো-পিস, করে সংশ্লিষ্ট মর্য্যাদা দেওয়া গেছে বলে দাবী করেন কিংবা সিকন্দর বখত্-কে একই উদ্দেশ্যে ‘শো-পিস’ বানায় বিজেপি।
6. প্রাচীন সংস্কৃত শব্দই যে বিদেশে গিয়ে সব মুখ্য ভাষাগুলির জন্ম দিয়েছে, সেকথা প্রমাণ করার চেষ্টা অনেকে ইতোপূর্ব্বেই করেছেন। তবে ব্যাপারটি বিশ্ব-শাসকদের মনঃপূত নয় বলে, ব্যাপারটিকে তেমন স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে শ্রীমদনমোহন সিংহানীয়া একজন একনিষ্ঠ প্রচেষ্টাকারী বিস্মৃত ব্যক্তি বলে শুনেছি। (দিশা থেকে বিদিশায়… গ্রন্থ প্রকাশের কিছুকাল পরে এ বিষয়ে লেখকের ধারণা বদলায়– আদি মানবের একটিই ভাষা ছিল, তার থেকেই প্রতিটি জাতির ভাষার বিকাশ ঘটেছে)।
7. আগে ছিল সৈন্য, পরে হল পণ্য, এখন হয়েছে শব্দ (word)। এক কালে যার সৈন্য বা পণ্য যত পরাক্রমী ছিল, সে ছিল তত বড় শাসক। এখন যার ভাষা যত বেশী সর্বত্রগামী, সে তত শক্তিশালী শাসক। এটি ইদানীন্তন উপলব্ধি।
8. একমাত্র সংস্কৃত ও তার কন্যাস্বরূপা ভাষাগুলির ক্ষেত্রে, বিশেষত বাংলাভাষার ক্ষেত্রে, একটি বিশেষ নিয়ম থাকায়, তা পৃথিবীর অন্য সকল ভাষা থেকে বাংলাকে পৃথক বিশেষত্ব দিয়েছে। এই বিশেষ নিয়ম হল, এই ভাষার শব্দেরা বর্ণের মাধ্যমে অর্থবহন করে এবং তার মূলে রয়েছে এক বা একাধিক ক্রিয়া। এই ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি বিষয়ে লেখকের একাধিক রচনা বিদ্যমান।…
9. বাক্যাংশটি নেওয়া হয়েছে শ্রীনিরপেক্ষ মহাশয়ের একটি নিবন্ধ থেকে, দাভোস সম্মেলনের পরে পরেই আনন্দবাজার পত্রিকায় যেটি প্রকাশিত হয়।
10. অবশ্য প্রাচীন ভারতীয় ধারণায় ক্ষেত্র দুই প্রকার। যে ক্ষেত্রে বীর্য্য / বীজ নিষেক করার পর ক্ষেত্র সন্তানকে একই পথে বমন (woman) করে তাকে বলে প্রিয়ব্রত-যোগ। যেমন জমি, নারী ইত্যাদি। আর যে ক্ষেত্রে বীর্য্য নিষেক করার পর ক্ষেত্রই সন্তানে নবরূপ পায় তাকে বলে উত্তানপাদ-যোগ। যেমন টেবিল, বস্ত্র ইত্যাদি।
11. দ্রষ্টব্য : ‘ব্রহ্মবিহার’ অধ্যায়; এই লেখকের মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে শীর্ষক গ্রন্থটি। সেই নিয়মজালে মানুষ কীভাবে মনন নিষেক করে তার ব্যাখ্যা আছে সেখানে।
12. ‘অতএব শক্তি বা নাদই সমস্ত বিশ্বের যোনি। অথবা সমস্ত বিশ্ব যোনিস্বরূপ।’ পৃষ্ঠা ৩০৪। ‘ইনি বিশ্বযোনি নামে খ্যাতা’। পৃষ্ঠা ১১৩। দ্রষ্টব্য : জ্ঞানার্ণবতন্ত্রম।
13. পুত্র, সন্তান, উৎপাদন, পুংসবন, নপুংসক, নিগর্ভযোগিনী, রতি, রতিক্রিয়া, রতিক্রীড়া প্রভৃতি শব্দগুলির যথার্থ অর্থ গ্রহণ করতে হয়, ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধির মাধ্যমে। এগুলি প্রত্যেকটিই বহুরৈখিক শব্দ, স্বভাবতই বিশেষ বিশেষ ক্রিয়াকারীদেরকে বোঝায়। রতিক্রীড়ার পার্থক্য সবচেয়ে ভাল আলোচনা করেছেন মিস্টার প্লেখানভ তাঁর ‘Some Unaddressed Letters of G. Plekhanov’ গ্রন্থে, যেখানে তিনি জীবজন্তুর খেলা নিয়ে আলোচনা করেছেন। আর আমাদের ক্রিয়া ও ক্রীড়া শব্দ দুটির ভেতরেই সেই রহস্য লুকানো রয়েছে।
14. দ্রষ্টব্য : শিবপুরাণ, বায়বীয় সংহিতা, ৪ : ১১।
15. দ্রষ্টব্য : ‘ভাষায় উপনিবেশিকতা ও বাৎস্যায়নের কামসূত্র’, এই গ্রন্থের ৮ম প্রবন্ধ।
16. দম+পতি=দম্পতি। দম=যাকে দমন করা হয় <দম<Dame<Damsel, ইকুয়াল পার্টনারশিপের সম্পর্ক্ককে নষ্ট করে, অপরকে ঠেলে নামানোর জন্য যে নিজেও নীচে নামতে থাকে বলে পতিত হতে থাকে, সেই-ই পতি-পদবাচ্য। [potent=‘physically strong / having great authority, control or domination’, domination দমন / ইত্যাদি]।
17. যৌথসমাজে কোন গোষ্ঠী বা ব্যক্তি যদি ব্যক্তিমালিকানাগন্ধী বা আমিষগন্ধী হয় তো সে নিন্দনীয় হয়। তাই পরাশর (‘যে পর-আশ্রয়ভোগী’) সহযোগিনী যোজনগন্ধা মৎস্যগন্ধ্যাও ছিলেন দুর্গন্ধবতী। পরাশরের চেষ্টায় (=বরে) মৎস্যগন্ধাই একদিন ‘গন্ধবতী’ রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।
18. রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা গ্রন্থের আবরণ নিবন্ধটি দ্রষ্টব্য। নিবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়ের বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন। উলঙ্গ স্বাভাবিকতার পক্ষে অমন সওয়াল পোস্টমডার্ণ ভাবুকদেরও করতে বুক কেঁপে যাবে। এই নিবন্ধের প্রেরণার একটি উৎস রবীন্দ্রনাথের ঐ প্রবন্ধটি।
19. বাইবেলে ও কোরাণে এই মহাপ্লাবনের কাহিনী বর্ণিত আছে, যেখানে নোহা পৃথিবী ডুবে যাচ্ছে বলে ধান, গম প্রভৃতির বীজ, জীবদের একটি করে sample নিয়ে তাঁর জাহাজে চেপে যান। একই কাহিনী আছে পুরাণে— মৎস্যের কাহিনীতে।
20. ভারতীয় শাস্ত্রমতে পুরুষ দুই প্রকার– শিব ও দক্ষ। প্রকৃতি-প্রেমিক পুরুষ ও প্রকৃতি-শাসক পুরুষ। এখানে কেবল দক্ষ পুরুষের কথা বলা হচ্ছে।
21. ক্ষত্রিয় শব্দের একটি অর্থ ‘সত্যগোপনকারী’।
22. সচ্-ইব। সচের মত। কিন্তু সচ্ নয়। সুতরাং মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর।
23. কে কখন পুরুষ কখন প্রকৃতি তার একটি তালিকা পাওয়া যাবে এই গ্রন্থের ১৪শ প্রবন্ধে।

[“দিশা থেকে বিদিশায় : নতুন সহস্রের প্রবেশবার্ত্তা” গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়]।

23669107_991937210946531_3818214380102258710_o (1)কলিম খান
জন্ম: ০১ জানুয়ারী ১৯৫০, মামুদাবাদ (মেদিনীপুর)। মৃত্যু: ১১ জুন ২০১৮, কলকাতা।

কলিম খানের প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:
১. মৌলবিবাদ থেকে নিখিলের দর্শনে (১৯৯৫)
২. দিশা থেকে বিদিশায় : নতুন সহস্রাব্দের প্রবেশবার্তা (১৯৯৯)
৩. জ্যোতি থেকে মমতায় : ফ্রম এনলাইটেনমেন্ট টু…. (২০০০)
৪. পরমাভাষার সংকেত (২০০১)
৫. আত্নহত্যা থেকে গণহত্যা : আসমানদারী করতে দেব কাকে (২০০২)
৬. পরমা ভাষার বোধন উদ্বোধন : ভাষাবিজ্ঞানের ক্রিয়াভিত্তিক রি-ইঞ্জিনিয়ারিং (২০০২)

কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তীর প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:

১. বাংলাভাষা : প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ (২০০৬)
২. অবিকল্পসন্ধান : বাংলা থেকে বিশ্বে (২০০৮)
৩. বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ১ম খণ্ড (২০০৯) ও বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ২য় খণ্ড (২০১১)
৪. সুন্দর হে সুন্দর (২০১১)
৫. বঙ্গযান (২০১২)
৬. সরল শব্দার্থকোষ (২০১৩)
৭. বাংলা বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে (২০১৩)
৮. বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান : বাংলাভাষা থেকে সভ্যতার ভবিতব্যে (২০১৫)
৯. ভাষাই পরম আলো (২০১৭)

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার