হাজার বছর ধরে || রুবি বিনতে মনোয়ার

0

কবি জীবনানন্দ দাশ এর অন্যতম একটি কবিতা “হাজার বছর ধরে”। এটি নিছক কবিতা ভাবলে একটু ভুল হবে। কারণ এই কবিতায় লুকিয়ে আছে একটি প্রাচীন ইতিহাস।

”হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।
চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।
সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে— সব নদী— ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।”

কে এই বনলতা সেন?
এ নিয়ে কত কল্পনা, কত কাহিনী, ঠিক যেন কবিতাটিতে ব্যবহৃত অন্ধকার শব্দটির মতই রহস্যময়তায় ঢাকা। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য জনাব আকবর আলি খান দাপ্তরিক কাজে নাটোর অবস্থানকালে (১৯৬৮-৬৯) বনলতা সেনকে আবিষ্কার করার প্রয়াস পান। এ বিষয়ে তাঁর মতামত তাঁর রচিত ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ের ‘লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি’ শিরোনামের প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন, তাঁর ভাষ্যমতে—
“বনলতা সেন পরিচয় কবিতাটিকে একটি সম্পূর্ণ নতুন দ্যোতনা দেয়। কেন আমরা বুঝতে পারি, বনলতা সেন কেন কবিকে ‘দু’দণ্ডের শান্তি’ দিয়েছিল, বুঝতে পারি কেন কবির অভিসার ‘নিশীথের অন্ধকারে’ এবং ‘দূর দূরান্তরে’। এ পটভূমিতে দেখতে গেলে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ একটি সাধারণ প্রশ্ন নয়। বনলতা সেন যেন বলতে চাচ্ছে যে, সে ইচ্ছা করে রূপজীবার বৃত্তি গ্রহণ করেনি, তার জীবনে অনেক ঝড় ঝঞ্ঝা গেছে, সে দুঃসময়ে তার পাশে কেউ ছিল না। ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ একটি সৌজন্যমূলক প্রশ্ন নয়, এ হচ্ছে বিপর্য্যস্ত নারীত্বের আর্ত্তনাদ। বনলতার পরিচয় পেলেই আমরা বুঝতে পারি কবি কেন কবিতার শেষে বলেছেন ‘সব পাখি ঘরে ফেরে’। বনলতাদের সাথে দু’দণ্ড সময় কাটালেও শেষ পর্য্যন্ত জীবনানন্দদের (বিবাহিত পুরুষদের) লাবণ্যপ্রভাদের (স্ত্রীদের) কাছে ফিরে আসতে হয়। বনলতাকে আলোকোজ্জ্বল পৃথিবীতে প্রকাশ্যে পাওয়ার সুযোগ নেই। বনলতার কথা কাউকে বলারও উপায় নেই। বনলতাকে নীরবে নিভৃতে স্মরণ করতে হয় অপরাধবোধ নিয়ে। তাই কবি বলেছেন, ‘থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’ এ অন্ধকার প্রাকৃতিক নয়, এ অন্ধকার মানসিক। আমার জানামতে নিষিদ্ধ প্রেমের আনন্দ ও বেদনা এত সুন্দরভাবে আর কোন কবি ফুটিয়ে তুলতে পারেননি।” (লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি, পরার্থপরতার অর্থনীতি, আকবর আলি খান, পৃষ্ঠা-৮২”। বনলতা সেনকে তিনি একজন বিনোদবালা হিসেবে আবিষ্কার করেছিলেন।
তিনি আরও লিখেন,
“প্রশাসকদের দলির দস্তাবেজ হতে দেখা যায় যে, এ শতাব্দীর প্রথম দিকে নাটোর শুধু কাঁচাগোল্লা বা জমিদারদের জন্য বিখ্যাত ছিল না, নাটোর ছিল উত্তর বঙ্গের রূপাজীবাদের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। আমার মনে হয় ‘নাটোর’ শব্দটির দ্বারা তার পেশা সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে দেখলে বনলতা সেন নামটির তাৎপর্য্যও সহজে বুঝা যায়। সেন পদবী ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, সে ভদ্রবংশ উদ্ভূত। বনলতা বাংলাদেশে ব্যবহৃত কোন সাধারণ নাম নয়। তার স্খলনের পর নিজের পরিচয় লুকানোর জন্য সে হয়ত ছদ্মনাম নিয়েছে”।

আকবর আলি খান এর এই তথ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোঃ আবু তাহের মজুমদার প্রত্যাখ্যান করে তাঁর জীবনানন্দ গ্রন্থের বনলতা নিবন্ধে বারটি পয়েন্টে তাঁর মতামত উল্লেখ করেন, এখানে একটি পয়েন্ট তুলে ধরা হল, “জীবনানন্দ দীর্ঘ যাত্রা শেষে প্রাক-উষালগ্নে বনলতা সেনকে দেখেন, দিনটা কাটে সম্ভবত তার সঙ্গেই এবং সন্ধ্যার পর দুজনে আবার মুখোমুখি বসেন; সব পাখি ঘরে ফিরলেও জীবনানন্দ কিন্তু ঘরে ফেরার ভাবনায় কাতর নন, বরং ধীরে সুস্থে বনলতা সেনের মুখোমুখি বসেন; কাজেই প্রবন্ধকার বিবাহিত পুরুষদের ঘরে ফেরার যে কথা বলেছেন তা অপ্রাসঙ্গিক এবং নিষিদ্ধ প্রেমের যে আনন্দ ও বেদনার কথা বলা হয়েছে তাও অপ্রাসঙ্গিক। মোটকথা, বনলতা সেন একজন রূপাজীবা এ ধরনের বিবেচনা শুধু বিতর্কমূলকই নয়— বিভ্রান্তকর বলেই মনে হয়।
(বনলতা সেন, জীবনানন্দ, মোঃ আবু তাহের মজুমদার, পৃষ্ঠা ৭৩-৭৫)।”

আবু তাহের মজুমদারের নিজের ব্যাখ্যা হল, “বনলতা সেন আসলে বরিশালের ভদ্র ঘরের মেয়ে। তাঁর বর্ণনা জীবনানন্দের কারুবাসনা উপন্যাসে রয়েছে। তিনি ছিলেন জীবনানন্দের পাশের বাড়ির একজন নারী।”

জীবনানন্দের জীবনী থেকে আমরা জানতে পারি যে, খুব ছোটবেলা থেকেই কালিদাসের রচনাবলী পড়া শুরু করেছিলেন জীবনানন্দ। কালিদাস মেঘদূতে প্রাচীন ভারতের এই বিদিশা নগরীকে উপস্থাপন করেছেন সকল পাপাচারের কেন্দ্র হিসেবে। পেশাদার পতিতাদের আশ্রয়স্থল হিসেবেও এই নগরীকে দেখানো হয়েছে মেঘদূতে। বনলতা সেন হয়ত একটি রূপক চরিত্র, যা অন্য নামে বিদিশা নগরীতে ছিল। সেখানে বৌদ্ধ ধর্ম্মের প্রচারক কেউ আশ্রয় নিয়েছিলেন, কিন্তু পাপ তাকে স্পর্শ করেনি, ছিল পাপবোধ ও তা থেকে মুক্তির সাধনা। এসবই আসলে গবেষণার বিষয়। তবে কালিদাসের রচনাবলী জীবনানন্দ দাশকে প্রভাবিত করেছিল, এই কবিতা তার প্রমাণ।

কবিতায় বার বার ব্যবহৃত অন্ধকারই বা কী? গবেষকদের মতে এই অন্ধকার নিজেকে চিনতে না পারার অন্ধকার। এখানে নির্ব্বাণ বা মুক্তি লাভের কথা হয়ত বলা হয়েছে। নির্ব্বাণ লাভ করলেই অন্ধকার থেকে মুক্তি লাভ করা অনেকেই এই কবিতায় বৌদ্ধ দর্শনের বেশ প্রভাব দেখতে পেয়েছেন। তাই এই অন্ধকারকে নিজে চিনতে না পারার কিংবা পাপের অন্ধকার হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

বনলতা সেন কবিতায় দুই প্রাচীন প্রভাবশালী রাজার নাম পাওয়া যায়। এদের একজন মগধের অধিপতি বিম্বিসার আরেকজন মৌর্য্য সম্রাট অশোক। দুইজনই জীবদ্দশায় বৌদ্ধ ধর্ম্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। একজন বৌদ্ধ ধর্ম্ম গ্রহণ করে হয়েছিলেন পাপের শিকার, অন্যজন পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে।

বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রুর ছিল বৌদ্ধ ধর্ম্মের প্রতি বিদ্বেষ। তাই সিংহাসন দখল করে বাবা বিম্বিসারকে কারাগারের অন্ধকারে ঠেলে দেন। সেখানে অনাহারে মারা যায় বিম্বিসার। অন্যদিকে নিজের লোভ আর লালসায় কাবু হয়ে অশোক যুদ্ধ বাঁধিয়েছিলেন। কিন্তু ‘কলিঙ্গ’ যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে পাষণ্ড অশোক বৌদ্ধধর্ম্ম গ্রহণ করেন। তাই একদিকে পাপের শিকার বিম্বিসার অন্যদিকে অনুতপ্ত পাপী অশোককে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি তার কবিতায়। বনলতা সেন কবিতার ব্যাখ্যায় দীর্ঘদিন এই দুই রাজার নামকে প্রাচীনযুগের নিদর্শন হিসেবে নেওয়া হতো। এর গভীরে পাপবোধ আর গ্লানির ইতিহাস চাপা পড়ে আছে।

কবিতাটিতে বিদর্ভ নগরের কথা উল্লেখ রয়েছে। কুশ নামক এক প্রকার ঘাস আছে, যা পায়ে ঢুকে যেতে পারে, একে বিদীর্ণ করা বলে। বিদারণ না করে বিদীর্ণ হয় না। বিদীর্ণ করে বলেই একে (কুশঘাসকে) দর্ভ বলে। বিদর্ভ শব্দের প্রতিকী অর্থ যে দেশে দর্ভ বা কুশঘাস নেই। দর্ভ এর ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ সূদ। যে দেশে সূদ নিষিদ্ধ সেই দেশ হল বিদর্ভ দেশ, যা কবির কবিতায় বিদর্ভ নগর বলে উল্লেখিত। দর্ভ শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল যা দর বা মূল্যকে ভরণ করে। দরের ভরণের ফলে দর আরও বৃদ্ধি পায়, যাকে সুদ বলে। কেউ সুদে টাকা নিলে তা বাড়তে থাকে সময়মত পরিশোধ না করলে। সেই টাকার সুদ ঋণদাতাকে ভরণ করে। কুশঘাস যেমন দ্রুত বৃদ্ধি পায়, সুদও তেমন দ্রুত বাড়তে থাকে। কুশঘাস যেমন পায়ে ফুটে আঘাত দেয়, সুদও তেমন ঋণগ্রহীতার হৃদয়কে বিদীর্ণ করে।

দর্ভ: দর-কে (শ্রম-মেধাদি-দাতার রক্ষণকে) ভরণ-ভক্ষণ করে যে; অথবা, উৎপন্নের বা পণ্যের সার গিয়ে সঞ্চিত হয় যাহাতে; অথবা, যে সম্পদসার লাভ, সুদ, পাইকারী পণ্য ইত্যাদি গিয়া জমা হয়। বিদর্ভ নগরের রাজা ছিলেন ভীম। প্রাচীন ভারতে সুদ, দরাদরি, পণ্যবিনিময় খুব অপছন্দের ছিল।

প্রকৃতপক্ষে বনলতা সেন হল বিশ্ববিখ্যাত সেই ছবি মোনালিসার মত, যার রহস্য আজও উদঘাটিত হয়নি, বরং নানামতে নানা বিশ্লেষণে রহস্যের চাদরে ঢাকা পড়ে আছে। জীবনানন্দের জীবনী কী বলে? বনলতা সেনকে তিনি কোথায়, কোন কল্পনায় পেয়েছিলেন! কারো কারো মতে জীবনানন্দ আ্যালান পো-র ‘টু হেলেন’ কবিতা-প্রভাবিত হয়ে ‘বনলতা সেন’ লিখেছিলেন। আবার কেউ তুলনা করেছেন কিটস’-এর কবিতার সঙ্গে। কিন্তু ‘বনলতা সেন’-এর মধ্যে “যে নিবিড়তা ও বাঙালিত্ব এবং ভারতীয়ত্ব টের পাওয়া যায় তা কবির একন্ত নিজস্ব সৃষ্টি”। রবীন্দ্র বলয়ের প্রভাব হতে মুক্ত হয়ে নতুন ধারার কবিতা সৃষ্টিতে বনলতা সেন কবিতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে, কবিতাটি সে সময় তুমুল হৈচৈ ফেলে দেয়। বাংলা সাহিত্যে এই কবিতা এক অমর সৃষ্টি, এক অনন্য সংযোজন, যা বাংলা কবিতাকে একটি নতুন যুগে প্রবেশ করতে, নতুন ধারা সৃষ্টি করতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। বাঙালী সাহিত্যপ্রেমী মাত্রই বনলতা সেনের মুগ্ধ পাঠক। এই বনলতা সেন কবিতার আবেদন তাই কখনই শেষ হবার নয়।

সূত্র:
* সরল শব্দার্থকোষ— কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী।
* বর্ণসঙ্গীত— শ্রী শুভাশিষ চিরকল্যাণ পাত্র ।
* ইন্টারনেট।
* বনলতা সেন, জীবনানন্দ, মোঃ আবু তাহের মজুমদার, পৃষ্ঠা ৭৩-৭৫।
* ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইয়ের ‘লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যের অর্থনীতি’ শিরোনামের প্রবন্ধ।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার