সুফিকবি আমীর খসরু ‘ভারতের তোতা’ || রিফাত আহমেদ

0

1 119778072_615034279185203_2117785804650685810_n
দিল্লীর হযরত নিজামুদ্দীন দরগাহ কমপ্লেক্সে মধ্যযুগীয় কবিগুরু আমীর খসরুর সমাধিসৌধ রয়েছে, যার ভক্ত দিল্লীর সুলতানী আমল থেকে আজও বর্ত্তমান রয়েছে। আমীর খসরুর গজল এবং কবিতা শুধু দক্ষিণ এশিয়ার সুফী দরগাহের কাওয়ালীদের মধ্যেই শোনা যায় না, এমনকি আজকের বলিউডের সিনেমার গানের ভিডিওগুলিতেও সমানভাবে জনপ্রিয়। তার প্রমাণ রাহাত ফতেহ আলী খান ও আবিদা পারভিনের কন্ঠে তাঁর সর্ব্বাধিক জনপ্রিয় রচনা ‘চ্যাপ তিলকে’র গানটি ২৭ মিলিয়নেরও বেশী অনলাইন ভিউ রয়েছে। তাহলে চলুন দেখে আসা যাক, মৃত্যুর প্রায় ৭০০ বছর পরেও আমীর খসরু এত জনপ্রিয় কেন?

2 119784615_333557221318987_924298293729258599_n

তিনি গঙ্গা-যমুনার মিলিত স্রোতধারার মত হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উপাদানগুলির মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে নিজের জীবন ও কাজকে বিকশিত করেছিলেন এবং দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে নিজ দেশ ভারতকে ভালবেসে ছিলেন। গতানুগতিক ধারায় তার তুলনা করলে হবে না। তিনি কেবলমাত্র শাস্ত্রীয় পারস্যের অন্যতম মহান কবি ছিলেন না, হিন্দি ভাষায় বিকশিত হওয়া ‘হিন্দবী’ ভাষা বিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর দরবারের প্রধান কবি ছিলেন। হয়তো তিনিই প্রথম ভারতের প্রশংসা করেছিলেন, যা তাঁর নুহ-সিপাহী’র বা ‘নয় স্বর্গ’ বইতে লিখেছেন: “ভারতে খুব বিদ্বান ব্রাহ্মণরা রয়েছে তবে তাদের গভীর জ্ঞানের কেউই কোনও সুবিধা নেয়নি, যে কারণে তারা অন্য দেশে খুব কম পরিচিত। আমি তাদের কাছ থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করেছি। তাই আমি তাদের গুরুত্ব বুঝতে পারি…। যদিও তারা আমাদের ইসলাম ধর্ম্ম অনুসরণ করে না তবুও তাদের ধর্ম্মের অনেক নীতি আমাদের অনুরূপ…”

3 119735272_2759934254247952_4614686904980294775_n

১৩১৮ সালে রচিত নূহ সিপাহী’র বিশাল দৈর্ঘ্যের রচনায় তিনি আরো লেখেন যে, গণিতের ক্ষেত্রে ভারতের অবদান অতুলনীয়। ভারতের প্রতি তাঁর ভালবাসার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, “আমি দুটি কারণে ভারতের প্রশংসা করছি। এটি আমার জন্মস্থান এবং আমার দেশ, আর দেশপ্রেম নিজেই একটি মহান ধর্ম্ম” । অনেকের মতে, প্রথম সত্যই দেশাত্মবোধক লেখাটি এসেছে ফার্সিতে দিল্লীর কবি আমীর খসরুর কলম থেকে। আমীর খসরু দিল্লীতে গিয়াসউদ্দিন বলবন থেকে মুহাম্মাদ বিন তুগলক পর্য্যন্ত মোট ১১ জন সুলতানের শাসন দেখেছিলেন এবং পাঁচ জন শাসকের দরবারের প্রধান কবি ছিলেন। ১১৯৩ সালে মুহম্মদ ঘোরি দিল্লী বিজয়ের পরে ভারতে দিল্লী সুলতানী শাসনের শুরু হয়। দিল্লীর মামলুক রাজবংশ এবং বেশীরভাগ শাসক শ্রেণীর পাশাপাশি সংস্কৃতিশ্রেণীর মানুষেরা ছিলেন তুর্কী জাতির। তেমনি এক সম্ভ্রান্ত তুর্কী পরিবারে আমীর খসরু ১২৫৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের কাশগঞ্জ জেলার পাতিয়ালিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মঙ্গোল আগ্রাসনের কারণে তাঁর পিতা সাইফুদ্দিন মাহমুদ বর্ত্তমান তুর্কমেনিস্তানের তাকাশ শহর থেকে ভারতে চলে আসেন। তিনি ছিলেন লাচিন উপজাতির প্রধান। যে কারণে তিনি সহজেই দিল্লী শহরে সুলতান ইলতুতমিশের পুলিশ বাহিনীতে অফিসার হিসাবে যোগ দেন। আর আমীর খসরুর নানা ইমাদ-উল-মুলক সুলতান গিয়াসউদ্দিন বলবনের (১২৬৬-১২৮৭) অধীনে আরজি মুমালিক বা প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

4 119737018_931405600714501_8451555242890517754_n

খসরুর যখন মাত্র সাত বছর বয়স তখন তাঁর বাবা মারা গেলে, তিনি তাঁর নানার বাড়িতে বড় হন। ফলে তুর্কী পরিবারে বেড়ে ওঠার পাশাপাশি খসরু দিল্লীর দরবারে যেমন প্রবেশাধিকার পান, তেমনি সুফী-দরবেশদের খাঁনকাহতে প্রবেশাধিকার পেয়ে যান। সেইকালে খানকাহগুলি ছিল বিদ্যা চর্চ্চার বিশেষ কেন্দ্র। জনশ্রুতি মতে, আমীর খসরু হজরত নিজামুদ্দিনের প্রিয় শিষ্য ছিলেন। হযরত নিজামুদ্দিন রাজনীতি থেকে দূরে থাকলেও, আমীর খসরু তা ছিলেন না, তিনি দিল্লী সালতানাতের উত্থান ও পতনের সাথে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে জড়িয়ে ছিলেন। প্রথমে তিনি ১২৭২ সালে ২০ বছর বয়সে সুলতান বলবনের ভাগ্নে মালিক কিশলু খানের অধীনে পেশাগত জীবন শুরু করেন। ১২৮০ সালে তিনি সুলতান বলবনের পুত্র মুলতানের গভর্নর খান মালিক সুলতান মুহাম্মদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। রাজপুত্র ছিলেন উদার এবং কবিতার প্রতি অনুরাগী। খসরু পাঁচ বছরের জন্য মুলতানে অবস্থান করেছিলেন এবং কেবল দরবারের কবি হিসাবেই নয়, সুলতানের সেনাবাহিনীতে অফিসার হিসাবেও কাজ করেছিলেন।

5 119713162_981061602367996_668877834956878735_n

১২৮৭ সালে সুলতান বলবনের মৃত্যুর পরে, তার ভাগ্নে কায়কোবাদ সুলতান হিসেবে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি বিলাসিতা পছন্দ করতেন এবং বর্ত্তমান দিল্লীর মহারাণী বাগে সংগীতজ্ঞ, নৃত্যশিল্পী এবং শিল্পীদের জড় করতেন ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় খসরু সংগীতের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হন এবং কিরাইন সাদাইন নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেটা ছিল সুলতান কাইকোবাদ ও তাঁর পিতার মধ্যের সংঘর্ষ ও মিলনের কাহিনী। যা বাংলার ইতিহাসের একটি প্রাথমিক উৎস গ্রন্থ। তিনি সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখেন। বিশ্বাস করা হয় যে, আমীর খসরুই ভারতীয় বীণা এবং ইরানি তাম্বুরার মিশ্রন করে ‘সেতার’ আবিষ্কার করেছিলেন। তিনিই মৃদঙ্গ থেকে তবলা তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি কাওয়ালি রীতিটিও আবিষ্কার করেন বলে জানা যায়।

সুলতান কায়কোবাদ নিহত হওয়ার পর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হলে তাঁর এক শক্তিশালী সেনাপতি জালালউদ্দিন খিলজী দিল্লীর সিংহাসনে বসেন এবং খিলজী রাজবংশ (১২৯০-১৩২০ খ্রিস্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করেন। এই নতুন খিলজীর শাসনামলেও আমীর খসরু দরবারে নিয়োগ পান। তিনি সুলতান জালালউদ্দিনের দরবারের প্রধান কবি ছিলেন। সুলতান তাকে আভিজাত্যের সম্মানের পোষাক উপহার দিয়েছিলেন এবং বার্ষিক ১২০০ সোনার টংকা বেতন দিতেন। তার দরবারে খসরু নিয়মিত গজল উপস্থাপন করতেন। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বারানীর লেখা বই ‘তারিখ-ই-ফিরুজ শাহী’ হতে জানা যায় যে, ‘আমীর খসরু মেহফিলের জন্য প্রতিদিন নতুন নতুন গজল আনতেন এবং সুলতান জালালউদ্দিন তা শুনে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে দামী দামী উপহার দিতেন।’ সেখানে রসিকতা ও কবিতার আদান-প্রদানের পাশাপাশি নাচ ও সঙ্গীত পরিবেশন করা হত। ধারণা করা হয়, হয়ত সে কারণেই খসরুর অধিকাংশ গজলে সাকী বা মদের পেয়ালা ধারনাকারীর চিত্রটি বারবার ফুটে উঠেছে।

6

সুলতান জালালউদ্দিনের মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন খিলজী ১২৯৬ সালে সিংহাসন আরোহণ করেন। সংগীত ও কবিতার চেয়ে সামরিক বিজয় নিয়ে বেশী আগ্রহী সুলতান আলাউদ্দিন খিলজীর দরবারেও আমীর খসরু প্রধান কবি হিসাবে নিযুক্ত হন। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, বর্ত্তমানে বিতর্কিত আলাউদ্দিন খিলজীর সাথে চিতরের রানী পদ্মাবতীর যে গল্প তুলে ধরা হচ্ছে, সে বিষয়ে কবি ও আলাউদ্দিন খিলজীর জীবনী লেখক আমীর খসরু কিছুই লেখেননি, শুধু চিতোর বিজয়ের ইতিহাস লিখে গেছেন। খাজাইনুল ফুতুহ নামক বইতে খসরু আলাউদ্দিন খিলজীর বিজয়ের ইতিহাস রচনা করেন, যেখানে চিতোর, গুজরাট, দেবগিরি এবং গভীর দক্ষিণের বিরুদ্ধে আলাউদ্দিনের বিজয়াভিযান সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে লিখেছিলেন। এই সময়েই তিনি তাঁর বিখ্যাত পাঁচটি দীর্ঘ কাব্যের মসনবী লিখেছিলেন। সেগুলো হলো: মাতলাউল আনোয়ার, শিরিন খসরু, মজনু-লায়লা, আইন-ই-সিকান্দারী এবং হাশত-বেহেশত। এগুলো একসাথে ‘পাঞ্জ-গঞ্জ’ নামে পরিচিত। এই সমস্ত মসনবিগুলি উস্তাদ নিজামউদ্দিন আউলিয়াকে উৎসর্গ করেছিলেন। তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কাব্য রচনা ‘দেভাল রানি ও খিজর খাঁন’ যেখানে আলাউদ্দিন খিলজীর সুদর্শন পুত্র খিজর খান এবং গুজরাটের রাজকন্যা দেভাল রাণীর একটি মর্ম্মান্তিক প্রেমের গল্প বলা হয়েছে।

7 119724336_1283540158654045_2658453997540380839_n

তিনি হিন্দি এবং উর্দু ভাষার বিশুদ্ধতা ও উন্নয়নে বিরাট অবদান রেখেছেন। যে কারণে বিশ্বজুড়ে তাঁকে ‘তুতি-ই-হিন্দ’ বা ‘ভারতের তোতা’ বলা হয়। তাঁর রচনাবলীর বেশীরভাগ অংশ ছিল ‘হিন্দবী’ ভাষায়, যা ব্রজভাষার একটি উপভাষা। এটি দিল্লীর আশেপাশে এবং বর্ত্তমানে পশ্চিম উত্তর প্রদেশে প্রচলিত। বলা হয়ে থাকে আমীর খসরুই উর্দু ভাষার জনক।

ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতেও তাঁর বিশেষ অবদান রয়েছে। সূফী কবি ও সংগীতশিল্পী আমীর খসরু দেহলভী আরবিক, ফারসি এবং হিন্দবী ভাষার (যেগুলো আজও উত্তর ভারত ও পাকিস্তানের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা নামে পরিচিত হিন্দুস্তানী, দেহলভী ভাষা) শব্দের সমন্বিত শ্লোকের একটি শব্দভাণ্ডার বা অভিধান ‘খালিখ বারী’ তৈরি করেছিলেন। এই সকল কারণেই আজও মৃত্যুর প্রায় ৭০০ বছর পরেও আমীর খসরু এত জনপ্রিয় ও প্রাসঙ্গিক আমাদের কাছে।

এই মহান সাধক আমীর খসরু ১৩৫৫ সালের অক্টোবরে ৭০ বছর বয়সে মারা যান। আধ্যাত্মিক সুফী হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়ার সমাধীর নিকটে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল।

8 119734887_438957527072660_981214084957286086_n

তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া ও ইন্টারনেটের কিছু প্রবন্ধ থেকে তথ্য নেয়া হয়েছে।

118616143_249317479497423_1838404238232491036_nরিফাত আহমেদ
চেয়ারপার্সন, সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুল। কোষাধ্যক্ষ, বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল’স এসিস্ট্যান্স ফাউন্ডেশন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগ থেকে পড়ালেখা শেষ করার পর শিক্ষকতাকে পেশা হিসাবে নিয়েছেন।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার