…………
নাগরদোলায় দোলে নগরজীবন!
নাগরিকা, দেখে জানালায়, দূরদেশ— গ্রাম— হাতছানি!…
আর
প্রাসাদী শাড়ীর কারূকাজে
ঢাকে দেহের সুষমা—
ফুল, পাখী, প্রজাপতি, বনানী, পাহাড়, নদী…
নাগরদোলায় দোল খেয়ে খেয়ে
আধোঘুমে ভাবে,
জলের সোহাগভরা কাঁখের কলসে পিপাসা মেটানো নদীর যুবক,
হাঁটে কুয়াশাঘেরা আড়ালে,
নদীবাংলার কূলে বাজে বাঁশী,
বাঁশীর পরাণে জাগে সুর— গ্রামপতনের ধ্বনি!
নাগরিকা জানে,
ইটের টোপর পরা নগরবাসরে জাগিবে আবার অর্দ্ধনারীশ্বর, নিয়ে যেতে তারে সবুজপ্রণয়ে!……….
— গ্রামপতনের ধ্বনি || আরণ্যক টিটো
কেউ কেউ মনে করেন, ‘নগর’ শব্দের সাথে ‘নাগ’ শব্দের একপ্রকার সম্পর্ক রয়েছে। নাগের/সাপের ফনার মত নগারাঞ্চলে অট্টালিকার ভয়ানক সুন্দর অবস্থানের কারণেই নাকি এ জায়গাকে বলা হয় নগর। কিন্তু আমাদের অভিধান গুলো বলে, নগের/পাহাড়ের মত অসংখ্য সুউচ্চ অট্টালিকার ভিড়ের কারণেই এমন স্থানকে নগর বলা হয়। তবে ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ মতে, নগ শব্দের অর্থ, স্থিরতা। যেমন, ন + গ = নগ। অর্থাৎ ন মানে ‘না-কৃত/নেই’, গ মানে গমন — কথা হল, নেই গমন যাহার তাহা নগ! এই মতে পাহাড়ও নগ— যেহুতু পাহাড় বা মাটির চূড়া দাঁড়িয়ে থাকে… স্থির… গমনশীল না। আর এই নগ বা পাহাড়ের মত অট্টালিকার সমারোহ দাঁড়িয়ে থাকে বা রহে যেখানে তাহার নাম নগর— ‘নগ’ পূর্ণ শব্দের সাথে ‘রহে’ শব্দের ‘র’ যুক্ত হয়ে ‘নগর’ শব্দটি গঠিত— যেমন, নগ + র মানে নগর।… অথবা ‘নগর’ শব্দটি পাহাড় শব্দটির সাথে অন্য কোন সম্পর্কও নির্দ্দেশ করতে পারে।…
যাই হোক, নগুরে জীবনজনিত আমাদের বিরক্তি, গ্লানি, ক্লেদ, দীর্ঘনিঃশ্বাসের দিকটি বিবেচনায় নিলে মনে হয়, নগর জীবনে সত্যিই আমরা কোন বিষধর সাপের ফণার নীচে বাস করছি!? শহুরে মানুষের যে সীমাহীন গ্লানি হতাশা বর্ণনের যাত্রা আরম্ভ হয়েছিল আমাদের আধুনিক সাহিত্যে সে ধারা এখন আরও তীব্রতর হচ্ছে আমাদের বাস্তব জীবনে, সাহিত্যে।… নগরকে আমরা সর্ব্বদা একপ্রকার যান্ত্রিকনরক হিসাবে দেখতে আগ্রহী। নগরের রুক্ষ্ম, জটিল-কঠিন পরিবেশ-প্রতিবেশ আমাদের কাছে নারকীয় (প্রতি)ভাত হয়।… এখন প্রশ্ন হতে পারে, নগরের কি আদৌ কোন সৌন্দর্য্য নাই?! নগর জীবনে আদৌ কি কোন স্বস্তি নাই?!… আমরা যারা গ্রাম থেকে আসি বৈচিত্রপূর্ণ শহরের রূঢ়-কঠিন পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলা আমাদের পক্ষে বেশ দুরুহ। তাই আমরা শহরকে একপ্রকার নন্দিত নরক হিসাবেই নিই। কিন্তু এমনও দেখা যায় যে, শহরে জন্মগ্রহণ করে, শহরে বেড়ে উঠেও কেউ কেউ শহরকে আপন বলে মেনে নিতে পারে না। শহুরে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে শহরের প্রতি বিশেষ বিরক্তি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু অনেক উচ্চবিত্ত লোকজনকেও দেখা যায় যন্ত্রচালিত শহরের যান্ত্রিক জীবনের প্রতি বিরক্তি ও অস্বস্তিবোধ করতে। এভাবে হতাশা গ্লানি কিংবা যান্ত্রিক বিলাসিতা ভোগ করেও আমরা একটি প্রশান্তির জায়গা খুঁজি। আমাদের কল্পনায় লালিত হয় নদী, ফসলি মাঠ, বৃক্ষের ছায়া, আকাশের বিশাল বিস্তৃতি আর মাটিবর্ত্তী একটি গ্রাম। নগুরে চাকচিক্য কিংবা বিমুগ্ধ যান্ত্রিক যাতনার জীবন থেকে সবার হয়ত কাঙ্খিত প্রশান্তির গ্রামে যাওয়া হয় না। কিন্তু সবাই স্বপ্নে/ কল্পনায় একটি গ্রাম নিয়েই ঘুরে।… কেন এমনটা হয়, এ কি নিছক নদীর এ পার কহে ছাড়িয়া নিশ্বাস’র মত কোন আপেক্ষিকতা, নাকি ভিন্ন কিছু?!…
মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঠিক কখন থেকে নগর পত্তনের শুরু হয়েছিল তা বলা কঠিন।… কিন্তু সভ্যতার ইতিহাস বলতে আমরা হয়ত নগর সভ্যতার ইতিহাস থেকেই শুরু করি। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা, মিশরিয় সভ্যতা, মেসোপটেমিয় সভ্যতা প্রভৃতি একপ্রকার নগর সভ্যতারই দৃষ্টান্ত। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে আমরা যেমন হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো নগরের প্রত্নতাত্ত্বিক খবর জানি তেমনি ভারতীয় পুরাণ ও সাহিত্যগ্রন্থে আছে বিরাট বিরাট নগরীর কথা। আবার এসব নগর কিন্তু আমাদের আজকের আধুনিক শহরের মত এমন প্রকৃতি বিধ্বংসী নগর নয়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন কিংবা ধর্ম্মগ্রন্থ, পুরাণ, সাহিত্যগ্রন্থে যে সব নগরের কথা আমরা জানি সেগুলো নিসর্গনগর।… রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক কারণে হোক, ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারের কারণে হোক যে সব নগর এখানে গড়ে উঠেছিল সেগুলোর সুউচ্চ প্রসাদের কথা আমরা যেমন জানি তেমনি জানি বিচিত্র বৃক্ষে সুশোভিত ভবন ও রাস্তাঘাটের কথা। তাই কবিরা সে সব নগরকে কখনো কখনো প্রকৃতির কোলে শায়িতা দয়িতাও ভেবেছেন।…
আচ্ছা, জীবনমানের উন্নয়নের জন্যই হোক কিংবা অন্যকোন কারণে হোক মানুষের জন্য নগরায়ণটা কি আদৌ অনিবার্য্য ছিল?!…
যাই হোক, পৃথিবীর বুকে নগরায়ণ ঘটেছে/ঘটে চলছে। মানব সভ্যতায় লোহা-বিদ্যুতের আবিষ্কার, মানুষের দৈনন্দিন চাহিদা, ব্যক্তিপুঁজির আগ্রাসন, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্রমোন্নতি নগরায়ণকে আরও দ্রুত ও দ্রুততর করেছে। এখন নগর টিকে আছে যন্ত্রের উপর, নগর চলে যন্ত্র দ্বারা। এমন কি নগর নিজেই একটি জটিল যন্ত্র। আধুনিক নগরের সাথে যন্ত্রের যেমন গভীর সম্পর্ক তেমনি নগরায়ণের সাথে গভীর সম্পর্ক রয়েছে শিল্প বিপ্লবের। আমাদের দেশে আধুনিক নগরের সুত্রপাত বৃটিশদের হাত ধরেই আর পুরো বৃটিশ পিরিয়ড জুড়ে উপমহাদেশে চলেছে নগরায়ণ। বৃটিশরা চলে যাওয়ার পর তা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।
আমাদের আবাহমান গ্রামীণ সমাজ বিন্যাস আর নগুরে সমাজের মধ্যে বিস্তর তফাৎ। তাই দ্রুত নগরায়ণের ফলে আমাদের গ্রামীণ জনপদের সরল জীবনে যে জটিল জীবনাচার প্রবেশ করে মোহাবেশে আমরা তার দিকে ঝুঁকে পড়লেও তার সাথে মানিয়ে উঠতে পারি না সহজে। এমন জটিল মুল্যবোধ ও জীবনাচারজনিত মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত আমাদের ভেতর জন্ম দিতে থাকে নিদারুণ অস্থিরতা, নৈরাশ্যসহ আরও আরও বিচিত্র সমস্যা। নগরায়ণের ফলে আমাদের গ্রামীণ সমাজ শুরু থেকেই কী রূপ অবক্ষয় আর বিপর্য্যস্ততার মধ্য দিয়ে গেছে, ইতিহাসের চাইতে আমরা তার যথাযথ চিত্র পেতে পারি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ও বিংশ শতাব্দীতে রচিত সাহিত্যের নানান শাখায়।…
নগরের ইট-কংক্রিট আমাদের প্রতিনিয়ত বঞ্চিত করছে মাটির মায়াবী স্পর্শ থেকে, বহুতল ভবন বঞ্চিত করছে আকাশ-জ্যোৎস্না (উপ)ভোগের আনন্দ থেকে। কলকারখানার বর্জ্জ্য, গাড়ির ধোঁয়া এসব যেমন আমাদের মাটি বাতাস নদী দূষিত করে তোলে তেমনি এসবের বিকট শব্ধ নিত্ত্য বিরক্তির হুল ফোটাচ্ছে আমাদের মননে-মগজে। যন্ত্রের সাথে যন্ত্রের মত খেটে খেটে প্রতিমুহূর্ত্ত আমাদের দুর্ব্বিসহ হয়ে ওঠে। একেতো যান্ত্রিক জীবন, তার ওপর আবার বিচিত্র জটিল সম্পর্কের দায়— পাশাপাশি থাকা মানুষগুলোকে কেমন যেন দূরের মনে হয়! মানুষের ওপর মানুষের যেন নির্ভরতার জায়গা নেই!
শহর নিয়ে আজ আমাদের যতই অস্বস্তি আর বিরক্তি থাকুক, শহরকে আর আমরা জীবন থেকে বাদ দিতে পারি না কিছুতেই। বহুবিধ অমোঘ বাস্তবতার কারণে ধীরে ধীরে আমরা ঢুকে পড়েছি নগরায়ণের জটিল জালে।… এই যে আমরা নগর জীবনের নিদারুণ অস্বস্তির মধ্যে থেকেও একটি সরল গ্রামীণ জীবনের স্বপ্ন দেখি তাও একেকেবারে আপেক্ষিতা মনে করার কিছু নয়। এর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয় প্রকৃতির প্রতি আমাদের জীবন ধর্ম্মীয় টান, নিসর্গের সাতে বিচ্ছেদের আর্ত্তনাদ!.. এখানে একটা বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে যে, গ্রামীণ জীবনকে আমরা যতটা আদর্শ সরলতার প্রতীক মনে করি তা আদতে অতটা সরল না-ও হতে পারে। কারণ গ্রামেরও আছে অনেক সীমাবদ্ধতা, জীবন জনিত সংঘাত-সংঘর্ষ। আবার এ-ও ভাবা দরকার যে, জীবনমানের উন্নয়নজনিত ধারণা আক্রান্ত আমাদের বিচিত্র চাহিদা কি গ্রামে পূরণ হওয়া আদৌ সম্ভব?! তা যা-ই হোক, এখন দুর্ব্বিসহ নগর আর কাঙ্খিত আদর্শ সরলতার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমাদের ভাবতে হবে, এ দুইয়ের সহজ সমন্বয়। যেমনটা ভাবা হয়েছে ‘গ্রাম পতনের ধ্বনি’ কবিতায়।
প্রথম পঙ্ক্তিটাই মনে হচ্ছে, একটি পূর্ণ চরণ এবং পূর্ণ চিত্রকল্পনা— নাগরদোলায় দোলে নগর জীবন।…
নাগরদোলার সাথে আমাদের একপ্রকার মুগ্ধতাজনিত আবেগ জড়িত। নাগরদোলা দেখতে যেমন চাকচিক্যতায় পূর্ণ তেমনি ঘূর্ণনে অদ্ভূত আবার গঠনে তেমনি জটিল বৈচিত্রময়। ‘নাগর দোলা’ নাম শব্দের পাশাপাশি আমাদের স্মৃতিতে নাড়া দিতে পারে মেলা, উৎসব প্রভৃতির চিত্র। নাগর দোলা এখানে হয়ত যন্ত্রের প্রতীক হিসাবে এসেছে যাতে নিত্ত্য দোল খেতে খেতে চলে যান্ত্রিক নগর জীবন। আমরা আগেই বলেছি, শহুরে জীবন গ্রামীণ জীবন অপেক্ষা অনেক জটিল ও বৈচিত্রপূর্ণ। মানি, শহরের তেমন নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য থাকে না। কিন্তু শহরের যে বস্তু চাকচিক্যতা, বর্ণাঢ্য ঝাঁকঝমকপূর্ণতা, এ-ও তো হতে পারে একপ্রকার সৌন্দর্য্য।… এখানে নাগরদোলায় নগর জীবনের দোলা খাওয়ার ব্যাপারটা নাগরিক প্রতিবেশ ও সমাজ বিন্যাসের জটিলতা যেমন ইঙ্গিত করে তেমনি ইঙ্গিত করে নাগরিক জীবনের যন্ত্রনির্ভরতার কথা। আবার তা নগর জীবনের প্রতি একপ্রকার মুগ্ধতাও প্রকাশ করে। এরপর আবারও সমজাতীয় এবং বর্ণানাত্বক চিত্রকল্পনা। অথবা এটি পূর্ব্বের চিত্রকল্পনারই প্রসারণ— নাগরিকা জানালায় দেখছে দূরদেশ— গ্রাম হাতছানি। আবার প্রাসাদী শাড়ীর কারুকাজে ঢাকছে দেহের সুষমা— ফুল, পাখি, বনানী, পাহাড়, নদী।… এখানে নাগরিকা হতে পারে স্বয়ং নগর কিংবা নাগরিক জীবন যা একই সাথে স্বপ্ন দেখে নিসর্গবর্ত্তী গ্রামীণ জনপদ/জীবন। আবার প্রাসাদী শাড়ীর কারুকাজে/কৃত্রিম সৌন্দর্য্যে/পোষাকী সৌন্দর্য্যে ঢেকে রাখে দেহের সুষমা, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য।
নাগরিকা নাগরদোলায় দোল খেয়ে খেয়ে আধোঘুমে ভাবে এক নদীর যুবককে, যে জলের সোহাগ ভরা কাঁখের কলসিতে পিপাসা মিটায়, হাঁটে কুয়াশাঘেরা আড়ালে। নাগরিকা ভাবে— নদী বাংলার কূলে বাঁশী বাজে আর বাঁশীর পরাণে জাগে সুর— গ্রাম পতনের ধ্বনি।… এখন ভাবতে হবে, নদীর যুবকটা আসলে কে/কী হতে পারে— এ কি নাগরিক মনের কল্পনায় বাস করা সেই আদর্শ গ্রাম, কোন নদীবর্ত্তী জনপদ, যেখানে নদীই জীবিকার উৎস, (প্র)শান্তির নির্ভরতা?!… এখানে তন্দ্রাচ্ছন্ন নাগরিকার যে ভাবনাচিত্র, তা স্পষ্টতই একটি গ্রামীণ দৃশ্য। কিন্তু বাঁশীর পরাণে যখন গ্রাম পতনের ধ্বনি বেজে ওঠে তখন ব্যাপারটি বেশ সাংঘর্ষিক ও ভয়ানক হয়ে পড়ে। যে কাঙ্খিত দৃশ্য দেখা হচ্ছে সে দৃশ্যের উপাদান যেন দৃশ্যপতনেরই সংবাদ ঘোষণা করছে। এ কি তবে তন্দ্রাচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে একপ্রকার হেঁয়ালি ভাবনা প্রত্যক্ষণ, নাকি এর সাথে জড়িত আছে কোন সাংঘর্ষিক বাস্তবতা?! হতে পারে, এটি নগর মানসের যান্ত্রিক সুবিধার প্রতি আসক্তি আর নিসর্গের প্রতি অনুরক্ততার মত মনস্তাত্বিক রূপ। না, তা হয়ত নয়— নাগরিক কল্পনায় যে নৈসর্গিক জনপদের ছবি আঁকে তা সময়ের কঠিন বাস্তবতায় ভেঙে পড়ে এবং তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় অনাকাঙ্খিত এক বস্তুকেন্দ্রিক যান্ত্রিক জীবন। কেড়ে নেওয়া হয় প্রকৃতির মত সরল জীবন— হতে পারে এমন ট্রাজিক বয়ান। এমনও হতে পারে যে, মানুষের নিত্যনতুন চাহিদার ভিড়ে উন্নয়ন নামক মায়াবী লালসার নগরকেন্দ্রিক আধিপত্যের সময়ে গ্রামপতনের অনিবার্য্যতায় এখানে প্রকাশ পেয়েছে।
নাগরিকা জানে, তাকে সবুজ প্রণয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইটের টোপর পরা নগর বাসরে জেগে উঠবে অর্দ্ধনারীশ্বর।… এখানে নগরকে ইটের টোপর পরা বাসর রূপে কল্পনা করা হয়েছে যেথায় নানাবিধ দায়গ্রস্থতা নিয়ে ঠেকে থাকে নগর জীবন। কিন্তু নাগরিকা তার কাঙ্খিত জীবনকে ভুলে না। তার বিশ্বাস, কাঙ্খিত জীবন/অর্দ্ধনারীশ্বর এসে তাকে সবুজপ্রণয়ে/নৈসর্গিক জনপদে নিয়ে যাবে।…
এখানে নগরের প্রতি চরমভাবে কোন বিরক্তি বা বিদ্বেষ প্রকাশ করা হয়নি, নগরকে ইটের টোপর পরা বাসর হিসাবে কল্পনা করার মধ্য দিয়ে বরং নগরের বস্তু সৌন্দর্য্যকে স্বীকার করা হয়েছে। আবার তাই বলে নগর জীবন এতে সন্তুষ্টও নয়। তবে নাগরিকার/নগর জীবনের কাঙ্খিত আদর্শ জায়গাটা আসলে কী আর অর্দ্ধনারীশ্বরই বা কী/কে, যে নগর জীবনকে সবুজ প্রণয়ে নিয়ে যাবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করা হচ্ছে!?
অর্দ্ধনারীশ্বর হচ্ছে ভারতীয় একপ্রকার সমন্বয়বাদী ধারণা। যা শিব-পার্ব্বতী/পুরুষ-প্রকৃতি/আধার-আধেয় প্রভৃতি বিষয়কে প্রকাশ করে।…
অর্দ্ধনারীশ্বর প্রতিমাকে যেমন শিব রূপ দেখলে শিব, পার্ব্বতী রূপে দেখলে পার্ব্বতী তেমনি অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু কণাকে কণা রূপে দেখলে কণা আর তরঙ্গ রূপে দেখলে তরঙ্গ। এভাবে অর্দ্ধনারীশ্বর ধারণার মাধ্যমে জীবন-জগতের অনেক কিছুরই সমন্বয় প্রকাশ করা যায়। এখানে অর্দ্ধনারীশ্বর’কে আমরা গ্রাম আর নগরের সমন্বিত রূপ নিসর্গনগর/অরণ্যনগর হিসাবে নিতে পারি। এতে একই সাথে থাকবে নাগরিক সুযোগ সুবিধা আর নৈসর্গিক পরিবেশ। ফলে একে নগর রূপে দেখলে নগর প্রতীয়মান হবে আর অরণ্য রূপে দেখলে অরণ্য বলে প্রতীয়মান হবে।… এই যে যান্ত্রিক নগর বাস্তবতার জটিল জীবন বিন্যাস থেকে (স)চেতন ভাবে সরল জীবনে প্রবেশ করা— এটা মাত্র চাট্টিখানি কথা নয়। (স)চেতন ভাবে এটা করার জন্য দরকার হতে পারে চরম কঠোর প্রয়াসের। তাছাড়া শুধু মাত্র নৈসর্গিক পরিবেশ তৈরী হলেই যে গ্রামীণ সারল্য অর্জ্জিত হবে এমনটাও নিশ্চিত নয়। এজন্য প্রয়োজন হবে সামাজিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিকসহ অনেক কাঠামোগত পুণর্বিন্যাসের। আবার স্বাভাবিক/অচেতনিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুদীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হলেও তা সম্ভব হতে পারে।… প্রকৃতির প্রতি অনির্ণীত টান থেকেই শহররে মানুষ আজ ব্যালকনি, ছাদ, দাওয়ার শোভা বর্দ্ধনের জন্য কিংবা অন্যান্য কারণে লালন করছে বিচিত্র বনসাই ও সাধারণ গাছগাছালি। বাড়ির গেইটে, সীমানা প্রাচীরে লালিত হচ্ছে নানান প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ ও লতানো বৃক্ষ।…
অচতেনিক প্রক্রিয়ার পাশাপাশি (স)চেতনে পরিকল্পিত ভাবেও বিশ্বের কোথাও কোথাও চলছে নিসর্গনগর নির্ম্মাণের নানান উদ্যোগ। সুউচ্চ বৃক্ষের ওপর রেস্টুরেন্ট, হোটেলসহ বিচিত্র ধরণের অবকাশ শালা নির্ম্মাণের মত চমক লাগানো খবর আসে বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে। সম্প্রতি চীন দেশে অরণ্যনগর প্রকল্পের খবর প্রকাশিত হয়েছে। নিছক অবকাশ যাপনের জন্য নয়, সরাসরি নিয়মিত আবাসিক হিসাবেই নাকি নির্ম্মিত হবে এ নগর। এতে নাগরিক সুযোগ সুবিধার পাশাপাশি থাকবে নৈসর্গিক পরিবেশ। অসংখ্য বৃক্ষে সুশোভিত থাকবে বাসস্থান ও রাস্তাঘাট। বিদ্যুতের কাজ করবে সৌরপ্যানেল আর যন্ত্র ও যানবাহনগুলো চলবে সৌর বিদ্যুতে।…
এভাবে পরিকল্পিত ভাবে হোক, (স)চেতন ভাবে হোক ধীরে ধীরে একদিন হয়ত পুরো বিশ্বটাই হয়ে উঠবে অরণ্যনগর/নিসর্গনগর। পল্লী জীবনের যে চারিত্রিক সারল্যের কথা আমরা কল্পনা করি, রুক্ষ্ম নাগরিক চরিত্রের বদলে সেই সারল্যই আবার হয়ত ফিরে আসবে একদিন। এভাবে নিসর্গনগরে বাস করবে অর্দ্ধনারীশ্বর/আরণ্যক নাগরিক।…….
দ্বীপ দিদার
জন্ম: ০৭ ডিসেম্বর ১৯৯১, মাতারবাড়ী, মহেশখালী, কক্সবাজার। প্রকাশিত গ্রন্থ: সহপাঠ গুপি গাইন, বাঘা বাইন…