খেলাবুড়া

0

মরা গরুর উপরে বসা মাছির ঝাঁক দেখছে-এ রকম চোখে দর্শকের দিকে তাকায়। বুড়া খেলা দেখাবে। তার সারা শরীরে প্রস্তুতির ভঙ্গি। শহীদ মিনারের সামনে লোকেরা গোলাকার দাঁড়িয়েছে। সে এক পাক ঘুরে মুখে চিতা বাঘের আদল আনে। বলে, শোনেন ভাইসকল, মাইনষের পোঁদে লাত্থি মারা এহন দারুণ কাজ।

গাঢ় সন্ধ্যায় বুড়ার ন্যাড়া মাথা সোডিয়াম লাইটে চকচক করে। সে খালি পায়ে সঙের রাজা সেজেছে। চোখ ছোট করে বলে, রাজনীতির গালে জোঁকের সমান কাটা দাগ। গোলাকার দর্শককে প্রশ্ন করে, চেতনের পচা লাশ দ্যাইখতে চান গো ভাইয়েরা? এ্যাই দ্যাখেন রাজা। বাম পায়ের উপর ডান পা উঠিয়ে ইজি চেয়ারে বসার আরামে মুখ বাঁকা করে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ার ভঙ্গি করে। লোকেরা হেসে ওঠে। এক পাক ঘুরে হাত নাড়িয়ে সুর ধরে, তার চাইয়া ভাই এইডা ভালো, মন থাইকা সব মুইছা ফেলো। বলে, মোরা লেহাপড়া শিখি না। লেহাপড়ার বদলে লোহা পোড়ানোর কাম করি। লোহা কারা পোড়ায় জানেন নি? কথা বলেছে বলে এক পিচ্চিকে ধমক মারে, যা কর্ণফুলীত মুইত্যা আয় গা। শুয়ার কোনহানের। কামার হয়ে লাল লোহা পিটানোর কাজ দেখিয়ে বলে, চাক্তাই খাল চিনেন নি? কয়েকজন দর্শক অনুচ্চ জবাব দেয়, চিনি। মুখ ঘুরিয়ে কোনো কিছু পাত্তা না দেওয়া ক্রোধের ঢঙে বলে, চিনলে মোর বাল হইবু নি? রঙ্গ দেখার বৃত্তে দাঁড়ানো মানুষের মুখে ভাঁজ।

তার এখন মহামানুষের ভঙ্গি। মাথা ও মুখ আকাশের দিকে। মুষ্টিবদ্ধ দুহাত পেছনে। লুঙ্গি গোছ দেওয়া। যেভাবে দাঁড়ানো, লিকলিকে কালো পা দুটা যেন শহীদ মিনারের কাঠামোর ভেতরের লোহা। দানা মিয়ার তলপড়া পেট দেখে লোকেরা ভাবে, এই রসের বুড়া বহুদিন ভালো করে খেতে পায়নি।

দানা মিয়ার বড় সাধ ছিল বাঘের পিঠে চড়বে। আহা, কত সাধ যায়রে চিতায়! দীর্ঘদিন গাঙপাড়ে বাস করেছিল। এখন কে সি দে রোডে কার্তিকের বৃষ্টির পর সময়টাকে উইয়ের ঢিবি বানায়। ঝাল মরিচের লাল চামড়া দাঁতের ফাঁকে লেগে আছে। জগৎ জুইড়া জাল ফেলাইছে পলাইয়া বাঁচবি কোনাই? দর্শকের কাছে জবাব না পেয়ে অতি আশায় বাঘের বাসায় যাবে বলে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। কার্তিকের সুবৃষ্টিতে ভালো তুলা হবে। তাই স্বপ্নের ভেতর সে চাষা। হাতে লাঙল। এই জটলায় কোদালের কোপে আঁধার কাটতে গিয়ে খেলার মধ্যে নিজেকে হাজার টুকরা করে। ওরে গাড়িয়াল ভাই গানের সুরে হাসতে হাসতে বলে, দিছি মোরে গাঙে ভাসাইয়া। ভাইয়েরা মোর ইতিহাস শুনবা নি? ঐ আসমানে চাইয়া লও। মেঘের নাও দ্যাখা যায় নি? গলা হাঁ করে সুর তোলে, চলেন ভাই বেরাদর আসমান ছুইয়া আসি।

আজ সকাল ছিল মেঘে ভরা। মাথা ন্যাড়া করতে গিয়ে নাপিতকে বলেছিল, মোর শইলের কুনো অংশে সততা নাই। নাপিতের ক্ষুর ধরা হাতের পেছনে বেড়ায় ঋত্বিক, ঐশ্বরিয়া ও মাধুরী। নাপিত বলে, আপনে এমন বাচাল হইছেন কেমনে?
জবাবে দানা মিয়া জানায়, ছোটকালে মুরগির পুঁদরি খেয়ে খেয়ে সে নাকি এরকম হয়েছে। উকুনের জ্বালায় মাথায় এয়ারপোর্ট বানাচ্ছে। কপালের ঘায়ে যেন ছাগলের খুঁটি গাড়বে, তেমন চুলকাতে চুলকাতে বলে, তিত করল দিয়া পান্তা খাইছি। মন তিতা হইয়া আছে। পদ্মার ইলিশ দিয়া ভাত খামু।

বটতলী স্টেশনের দিকে হেঁটে আসার সময় একটা পুরনো বগিতে টাক ডুমাডুম ঢোলের বাজনা শুনেছিল। ববকাট, লেপ্টানো লিপস্টিক, সায়া ও কামিজ পরা বাজার-মেয়ে নাচে। তিনজন পুলিশ ঢিলেঢালা দাঁড়িয়ে মজা দেখে। একটা রেলস্টেশনে ঢোকে। পুলিশ বন্দুক কাঁধে নেয়। জন্ডিস রোগীর মতো হেঁটে সামনে এগোয়। তাদের চোখে ধান্ধার ব্যস্ততা।

সোডিয়াম লাইটে দেখা যায় আসনে বসা বুড়ার কালো-বাদামি চামড়ায় অসংখ্য ভাঁজ। তার কাছে আনন্দের একশ বিশটা খেলা আছে। ভদ্রলোক না থাকলে তার কোনো কৈফিয়ত নাই। এটা জানিয়ে লম্বা তালি বাজায়। আঙুল আর তর্জনী মুখে ঢুকিয়ে কুই হু করে শিস দেয়।

শহীদ মিনারের পাশে গাঢ় সন্ধ্যার আঁধার। ফুটপাতে জাহাঙ্গীরের জোড়া বাঘ মার্কা মলমের পাশে কয়েকজন বুড়া বিবিসি শোনার জন্য প্রতীক্ষা করছে। বুড়ার মুখে খই, আমি ভদ্দলোকের কাছে ভদ্দলোক, বিয়াদবের কাছে বিয়াদব।

এক দর্শকের মুখ বাঁকা, বউত পুরান বিটিশ।

বুড়া অভিনয় করে বলে, আমি গাও গেরাম লোকাল আইল্যান্ডের মানুষ। আমারে দেইখা পেসিডেন্টের বাপহগল পরযন্ত খাড়া হইয়া যায়। মার আমারে মার। মাইরা দাঁত বন্ধ কর। আননেরা এশ্শ টেহা টিকিট কিন্না দ্যাখবেন নি আমার জাদু?
দর্শক বিমূঢ়।

ডরায়েন না, ডরায়েন না। আইরে ভদ্দলোকের রাগ দাতে, অভদ্দরের রাগ হাতেরে-এ-এ। আমি হইলাম গিয়া… নোংরা বালকটি হেসে দেয়। এ্যাই হালা খানকির পুত বলে লাঠি নিয়ে তেড়ে যায় বুড়া। মুখ ফিরিয়ে বলে, জীবন গোসাই সবাইরে ডাহে। সরকারি, বেসরকারি, আধাসরকারি, গোয়েন্দা আয়েন্দা, হাই ক্লাস, হাই লেভেল আপনার পায়ে আমার ছালাম। দুই হাত ভাঁজ করে। তালি মারেন। কোন তালি বাজাইছেন? একতালি বাজাইতে হইবু। হিতারা কেলাস করনু। একজনের দিকে তাকিয়ে হাসে। আপনাগোরে কেলাসে নিতে হইবু। পাস করাইতে হইবু। আপনাগো পায়ে ধইরা কই, কেলাসটা কেমুন হইছে?

দর্শকের মুখে মুচকি হাসি। বলে, ফাস কেলাস। এবার কিছু খেলা দ্যাখান।
বুড়া বলে, আমার বেশডা থাড কেলাস। তারপর হাঁটু মুড়ে বসে। ঘামরঙা গেঞ্জি দিয়ে সাপ বানায়। সাপকে কোকের খালি বোতল থেকে মিছেমিছি কোক খাওয়ায়।
দুনিয়াতে ইনসাফ আছে? প্রশ্ন করে বোতলকে। আপনাগোরে সার্কেস কে দ্যাখাইছে? আমি সাইত্রিশ বছর দ্যাখাই। আমারে অনুরোধ কইরা নিতে হইবু। হাই পাওয়ার। বাম চোখ উপরে ওঠে। মারে বাবারে কইরে চিক্কার দিলে কাম হইবু না। এক বুড়ার চশমার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ভেংচায়, যেই বয়সত ইস্কুল কলেজ হেই বয়সত বিয়া দিছেন মাইয়ার। পাশের তরুণ হাসলে উঁকি মেরে তার দিকে চোখ নাচায়, তোমার থাইকা মোটা মোটা চালাক আছে। জান নি? ফোকলা দাঁত দেখিয়ে মোটা গলায় বলে, শরীর ব্যাডারি ডাউন। মাথা উত্তর-দক্ষিণ করে। পাছা চুলকায়। এখন তার দেহ কাত। বড় বড় চোখ। দর্শকের সময় গিলে। পদ্মা যেভাবে ভেঙে যেতে থাকে, ঘর খায়, স্বপ্ন খায়, মানুষের অসহনীয়তা গাঢ় করে, তার হাসি দেখায় তেমন। খেলা দেখানো দানা মিয়ার পায়ের তলে এখন পদ্মা, ঘোলা জল, হতাশা। মৃত্যু পরাজিত হচ্ছে তার কাছে। অতিরিক্ত পানি মগজে ঢুকিয়ে পদ্মা নদীকে ডান হাতের মুঠোয় রেখেছে। দুহাত পেছনে নিয়ে কুঁজো হয়ে চক্কর দেয়। দ্রুতগতিতে দুপা উপরে তোলে। হাতে হেঁটে নদীকে শিশুর জিহ্বা ভেংচানো দেখালে লোকেরা মজা পেয়ে চানাবুট ভাজার গন্ধ ভুলে যায়।

রিকশাওয়ালা রিকশার উপর দাঁড়িয়ে খেলা দেখছে। বুড়া বলে, রিকশা সরা। পাথর মাইরা দিমু। রিকশাওয়ালা হাসে।

মাস্তানি চুদাইলে মাইরা দিমু কইলাম।

এহানে সরকারি মানুষ আছে নি? প্রশ্ন করার পর বুড়া বলে, এট্টু আগে হেলিকপ্টারে সায়েবরা আইছিল খ্যালা চাইবার লাইগা। দিছি পুংটা মাইরা। ফাও খাইবেন? তালি মারেন। জোরে তালি বাজে। কোনো আন্দোলন সংগ্রাম চালায়েন না। কিচ্ছু আদায় কইরতে পাইরবেন না। একজন কিটকিট হাসে। আশাহত ভঙ্গি গিলে ফেলে বুড়া শিস দেয়। এক চক্কর ঘুরে আসে। আন্নেগো কাছে অনুরোধ কইরলাম। কথা কাটিয়েন না। বিষ্যুদবাইরে দিন। মাথা ঘুরিয়ে চোখ উপরে তোলে, আমারে বুঝতি হলি অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পড়তি হইবু। দু তালুতে থুতু ছিটিয়ে ঘষে তালি বাজায়। মাথায় চাঁটি মারে। বলে, ল্যাং কাটলে, কুনু আন্দোলন চালাইলে খবরদার আমার সম্মান যাইবু না। কমালান্দ থেকে গোয়ালন্দ যাইবেন? সব মেডেলের ভদ্দলোক ঢাকা মেইল। সতর্ক চোখ হাঁটিয়ে চক্কর দেয়। তার তলপড়া পেট ঢলঢলায়।
ইন্টারন্যাশনাল খেলা দেখানো বুড়া শরীরের বিভিন্ন ভঙ্গিকে একত্র করে মেম সাহেব নাচ দেখিয়ে আজব জীবের নাচটা নাচে। কারো কারো ডাইনোসরের লম্বা গলা, লেজের কথা মনে পড়ে।

এইডা কি দ্যাখান? জানতে চায় হকারটা। তার দুই পা তখন আকাশের দিকে। মাথা পিচে লাগানো। মুখ দিয়ে হাঁপানির শব্দ বেরুচ্ছিল। বলে,  ইয়েস-নো খেলা। দ্রুত কয়েকটা চিদ্দির মিদ্দির খেয়ে পেটের কুঁচকানো চামড়া টানে আর হাসে। রূপচাঁদা মাছের মতো চ্যাপটা হাসি। তার খেলা বুঝতে হলে প্রাইমারি পাশ দিতে হবে। হাই স্কুলের হেডমাস্টার হতে হবে। তারপর কলেজের প্রফেসর হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা টিচার হতে হবে। তালি দাও। জীবনভার বুড়া হাঁপায়। দম নেয়। পিচ্চি দর্শকের হাসির পাশে দাঁড়িয়ে ছোট চোখে সবজান্তা ভাব নেয়, তোর কইলজা খামু।

অকস্মাৎ সব চুপ। গাড়ির হর্ন থ্যাতলানো। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত। ডান হাত কপালে। সূর্যালো ঢাকার ভঙ্গি। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে কথাকে আসমানে তুলতে শোনা যায়, হারামজাদা পেট খালি বুঝস না? খালি পেডে পিরথিবিত আইলি ক্যান?

তার তর্জনী মিনারের পিলারসম। চিৎকার করে, পকেট সাবধান। মুরগা হাটে মুরগা আন্ডা পাড়ে। ইজি চিয়ারে বসা ভদ্দলোক পান খায়, গান শুইনা ফোন কইরা ফুটানি করে। এইডা হইছে বড় আরামের আরাম। কিছুক্ষণ চুপ থাকে। কচ্ছপ চিনেন নি? জলখাসি! বিয়াদবরে আদব দিবেন। এক পাক ঘোরে। বুড়া এবার কচ্ছপের মতো হাঁটে। দর্শকের বায়েজিদ বোস্তামীর গজারি-মজারির কথা মনে পড়তে পারে। বুড়া আবার প্রশ্ন রাখে, কত কচ্ছপ দ্যাখছেন এ্যাই মানুষ কথা কন না ক্যান? তার তালুতে ঘাম। খেলায় তার কচ্ছপ পা নবাব সলিমুল্লাহর মতো হাঁটে। তারপর কুনো ব্যাঙ হয়ে লাফিয়ে রৌদ্রময় চৈত্রের দিন পেরোয়। জ্যৈষ্ঠের মেঘ গর্জনের বৃষ্টিতে কৈ মাছ হয়ে কানকো বায়। দর্শকেরা হাসে। ডাঙার মানুষেরা ধরে ধরে যেভাবে কৈ-এর কানকো কাটে তেমন ভঙ্গি করে। হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার, ছত্রিশ বচ্ছর আমি মাদ্রাজের সার্কিসের পেলিয়ার। আমার কষ্ট দুই ট্যাকা। মাত্র দুই ট্যাকা। চিৎকারে গলার রগ ছেঁড়ার উপক্রম। বলে, আমি চক্ষে ঠাহর পাই না। আবার পুরোপুরি নাকচ করে। বুড়া আঙুল নাচিয়ে একটা ছেলের পেটে গুঁতা মারে। বলে, চেডের মাথা। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

বিদ্যুৎ বিভাগের লেজার ঘাটা এক দর্শক বলে, চুদির পুত ডেঞ্জারাস। পানের রস ফেলতে ফেলতে গপ্পো ঢঙে পাশেরজনকে বলে, বুঝলেন নি? হেতে মায়ের পেট থাইকা কয়েকবার বাইর হইছে মনে লয়।

হঠাৎ পিড়পিড়ানি। যেন হাজার হাজার পিঁপড়া হাঁটছে। নাভির নিচের শুকনা দাউদ ভালো করে চুলকায়। চোখ বন্ধ। চুলকানি তাকে কাতুকুতু দিয়ে অনেক দূরে নিতে চায়। ভাবে, নিজের পোলা দুটা তাস খেলে সময় কাটায়। বুড়া কিছু বললে রক্তচক্ষু দেখায়। সেসময় পূর্বপুরুষ এসে তাকে বাঘের ডাক শোনায়। সে বাঘের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ায়। দেখে বড় দাদা এবং দাদি লোহার শিকলে বাঁধা বাঘ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের হাতে তরবারি। একটি পাড়ার সামনে এসে তারা খেলা দেখানোর প্রস্তুতি নেয়। বাঘটির শিকল খুলে দেওয়া হয়। বড় দাদা হাতে চাবুক নিয়ে খালি গায়ে বাঘের সামনে নাচে। বাঘকে চাবুক মারে, ঘুষি মারে ও লাথি মারে। ক্রুদ্ধ হয়ে বাঘ গর্জন করতে থাকে। তার ওপর লাফিয়ে পড়ে। তারা দুজনেই এক সঙ্গে গড়াতে থাকে। তারপর দাদা বাঘের গলার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ দুপক্ষ অনড় থাকার পর খেলা শেষ হয়। বাঘের গলায় আবার শিকল পরায়। খেলোয়াড় আশপাশের ঘর থেকে বাঘের জন্য খাদ্য চায়। লোকেরা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী চাল, ধান ও টাকা-পয়সা দেয়।

বুড়া ঘুরে ঘুরে টাকা নেয় আর বলে, বাবা মাত্তর দুইডা ট্যাকা এ্যাক কাপ চা-র থাইকা কম।

টাকা রেখে কোমর দুলিয়ে লুঙ্গি নাচায়। ক্রীতদাসী কিনবা? আমার আছে হাজার লক্ষ। কাল্পনিক গোঁফে তা দেয়। ঠোঁটে মচমচ ভঙ্গি আনে। খুব মজা। দাওরে ভাই দাও মাত্তর এ্যাক সোনার দিনার। ও ভাই তাইলে এ্যাক ট্যাকা দাও। নিমু, বেইচা দিমু। দর্শকের গলার কাছে হাসি চুলকায়। সে ভঙ্গি দিয়ে মাথায় বিশাল পাগড়ি পরে। আয়নায় দেখে। গায়ে লম্বা আলখাল্লা পরেছে। রাজার মতো কয়েক পা চলে। ভঙ্গি দিয়ে বলে, আমি রাজার রাজা। তারপর একটি বর্শা নিয়ে ছুঁড়ে মারে অদৃশ্য শত্র“কে। দিলখোলা হাসিতে ভাসিয়ে দেয় আবর্জনা। লোকের মাঝেও হাসি ঢুকে পড়েছে। তারা নড়েচড়ে দাঁড়ায়। কেউ পকেটটা ছুঁয়ে দেখে। চোর খোঁজা দৃষ্টিতে আশপাশে তাকায়। মুসলিম হলে পুতুলনাচের পোস্টার। স্টুডিও থিয়েটারে নাট্য উৎসবের পুরনো ব্যানার। রাজা এবার বাউল হয়ে একতারা হিসেবে নেয় পোঁটলাটা। মুখে টেটেন টেটেন টাঁডা টাঁডা সুর তোলে। আমি কইয়া দি, ভাইছাব, কিনবা নি ক্রীতদাসী? টেটেন টেটেন, আরে ঐ-ই-ই ওরে সোনা রূপার ঘর দ্যাখছি মনে চম্মৎকার।

পরক্ষণে চোখ আগুন মারে। কজন মা-র পুত, কজন বোনের পুত, কজন হতিনের পুত? এশ্শ ট্যাকা না হইলে পোষায় না। চোখের উপরে ও নিচে ঘাম। মরিচা দাঁতে ধার কমে আসে। চাইরগা মাইয়া, দুইডা পোলা সাহায্য করেন। আমার মুনাজাত খালি হাতে ফিরায়েন না। আমি ফাডা কফালডা লইয়া আইছি। আবার কাকে যেন উদ্দেশ্য করে বলে, ধর্ম কারে কয় হে চিনে না।

এক দুষ্ট দর্শক জিজ্ঞেস করে, কার কথা কন জেডা?

তোমাগো।

বাদামতলে মলমের জোড়া বাঘের গায়ে আঁধার। বেতারে বিবিসি চলছে। বিপরীতে গণগ্রন্থাগার, মুসলিম হল, স্টুডিও থিয়েটারে অন্ধকার। করবীগাছের তলে গাঁজার টান। রডের পাশে কঙ্করের স্তূপে শিশু শ্রমিক হাত গোছায়। শহীদ মিনারের সিঁড়িতে কয়েকটা ছেলের দাবা খেলা ও খোশগল্পের পাশে জলাধারে একটি মাত্র শাপলা। মাগুর মাছ উঁকি মারে। লাল গাড়ির ডানে রাস্তায় দেখে দেখে বেছে বেছে নেওয়ার জন্য টাল কোম্পানির দশ টাকার চিৎকার। কবিরাজের চার চাকার গাড়িতে গাছ-গাছড়ার ভাণ্ডার। নালার বোটকা গন্ধের পাশে ওজন মাপে বুড়া। মাত্র এক টাকা। কাঠচাঁপার নিচে পার্কের ক্ষয়িত ফলকে ঝর্ণা চপলা গিরি গরবিনী তন্বী তটিনী কর্ণফুলী উন্মাতাল চট্টলা ভূমির পদ চুমি কাব্যে লেপ্টে আছে পুরনো কবির বাঙালি কাল। ফুলহীন অসংখ্য ফুলের বৃক্ষ। বড় বড় মশা। তত্ত্বাবধায়কের ব্যান্ডেজ-মুখ। ঘুমগাছের বিস্তার। মসজিদ ভেঙে মার্কেট বানানোর কাজ এগোচ্ছে। দোতলায় মসজিদ হবে। ট্রাকের গর্জন শুনে চার হাত-পায়ে হাঁটা ভিক্ষুক স্বামীকে মাঝ রাস্তা থেকে কোলে তুলে দ্রুত ওপারে যায় কিম্ভূত নারী।

বুড়ার এখন রাজনৈতিক নেতার ঢং। আমার ঘামের দাবি থাইকব চিরকাল। লাফাইয়া কষ্ট হইছে। চায়নিজ খেলা হিম্মতঅলা। বাপের বেটা আমি দুব্বল। আমি লাইন কোম্পানির ফিটার। এহানে চালাকির কথা খাডাইব না। চ্যাঙের ঘরলক্ষ্মী ব্যাঙের কেপাসিটি দ্যাখাইছে আমারে। বাল বাইচ্চা লইয়া বাইচবার লাইগা আমার হাওয়া আসন পাইছ? মারলা? গুজরাট হিল্লি দিল্লি থাইকা আইছি। আবার হাত পাতে। শ্রমমূল্য করুণামিশ্রিত।

লোকেরা নড়ে চড়ে। কয়েকজন হাঁটা ধরে। অদূরে দুই ফরাসির কৌতুক চোখ। কয়েক লাফ ব্যাঙ লাফিয়ে বুড়া হাঁপানি বোঝে। পোকায় খাওয়া ফোকলা দাঁতে নেংটি ইঁদুরের ধার এনে বলে, পয়সা চাইলে ধুন খাউজ্যে পোন খাউজ্যে। পোন খাউজ্যেন্যে খ্যালা দ্যাখাই না।

মনের মধ্যে কারা যেন দেয়াল তোলে। পুনরায় কচ্ছপ হাঁটা হেঁটে কার্তিকের ঝাঁঝে ঝিমিয়ে মরছে সে। কপালে কোকের বোতল নিয়ে মুখ আকাশের তারায় রেখে স্বপ্নের দেশে হাঁটে। ডাবওয়ালা, গাছের চারা বিক্রেতা ও চা দোকানিকে সাথে নেয়। লম্বা, কুঁজো নারকেলগাছের পাতায় সোডিয়াম আলোর ছটক। মৃদু বাতাসে শির শির আওয়াজ।

দানা মিয়া বলে, গতকাইল আমিরিকা ঘুইরা আইলাম। হেই লোক কেমনে আইলাম জিগান না ক্যান? দোকানবালক মুচকি হাসে। বুড়া ব্যাঙ, কৈ মাছের পর কচ্ছপ হয়ে এবার খরগোশকে ভেংচায়। কচ্ছপ তো আর ঈশপের গল্পে বসে নেই। সে এখন মোবাইলে কার সাথে কথার অভিনয় করছে। কথার পর মিছে মোবাইলটা লুঙ্গির গিঁটে ঢুকিয়ে হাসে, আমিরিকার সঙ্গে আমার ফাইন লিংক। তারপর দুহাতে পুরুষাঙ্গের স্থানটা ঢেকে পা বাঁকিয়ে হাঁটে। ফিসফিসিয়ে কাতরোক্তি করে, হেই বাপধন যাইছ না, যাইছ না কইলাম। আপনাগো মোবাইল ঠিক আছে নি?
দর্শকেরা হাসে।

দ্যাশ যাউকগা জাহান্নামে। আমি বেড়াইতে যামু আমিরিকায়। মজার খানা খাওয়ার মতো মাথা নাড়ে।

জেডা আমরারে নিবেন নি?

তার পাঁজরে কটকট আওয়াজ। যেন জোড়া খুলছে। বেরিয়ে আসছে বেঁচে থাকার অস্তিত্ব। অভিজ্ঞতায় ঝুনা নারকেল বুড়া পোঁটলা মানে সাপের গিঁট খুলে ফ্যাকাসে পাঞ্জাবি বের করে গলায় গলিয়ে দেয়। বোতাম মারতে, টুকটাক গুছিয়ে পোঁটলাকে সাপ বানাতে কয়েক মিনিট। অদূরে ঝগড়া করে দুই রিকশা শ্রমিক। তৃতীয় রিকশাওয়ালা চিৎকার করে বলে, মার বাঙালিরে মার। জাহাঙ্গীরের বাঘের কান ছিঁড়ে গেছে। তখন বড় বড় ঢেউ বুড়ার ঘর ভাঙে। সর্দির শিকনির চেয়েও ঘন বন্যা। সম্মুখে দানব পদ্মা। পদ্মা ঘর ভেঙে মন ঢেকে পাক খায়। উড়িয়ে দেয় অস্তিত্ব। তার ওপর সৎ মা-র বিষাক্ত তীর। তীরের বিষে মনে মেঘ জমে। মেঘগুলো পোঁটলায় নিয়ে দানা মিয়া হাঁটে।

চাচা সাবধানে যাইও, সন্ত্রাসে ধইরব। কয়েকজন দর্শক পানি ছিটায়।

বাবুর্চি জিজ্ঞেস করে, চাচা আপনের নাম কি?

সে চোখ বড় করে বলে, চালান কইরা দিবেন নি?

হতভম্ভ বাবুর্চি জিজ্ঞেস করে, দ্যাশে যান না?

হিল্লি দিল্লি তুর্কিস্তান পাকিস্তান অনেক রংরঙিলা দ্যাখলাম। ফোকলা দাঁত বের করে বলে, কিন্তুক আমি মইরা গেলাম না।

মইরবেন ক্যান?

খ্যালা দ্যাখাইতাম যাই ফুটকি দিয়া গু বাইর হয় বইলা। দাঁত-মুখ বিকৃত অতি হাসির নীরব ভঙ্গি করে।

গোলাকার দর্শক পুরোপুরি ভেঙে গেছে। কয়েকজন গা-ছাড়া হাসে। অদূরে সংলাপ, হালায় মাল জব্বর এ্যাকখান।

বুড়া একতারার ভাঙা সুরের মতো হাঁটে। বিড়ি ধরায়। কোঁচার টাকা গুনে মনে মনে। হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেটের মোড়ে আসে। দালাল, হিজড়া, পতিতা আর হকারদের কাণ্ডকারখানায় অশ্লীল হতে চায় দাঁত। দুই নম্বর গাড়িতে চড়ে ভিড়ের চ্যাপটায় খানকির পোলা অনুচ্চ গালি দেয়। আল্লা জানে মালে আলো রাইখো। ঠোঁট নেড়ে কী সব পড়ে। ভাবে, বাসায় গিয়া ডারসে খানা খামু।

দেওয়ানহাট নেমে ভাবে, গাড়ি না হাঁটি? চলতে চলতে ইখতিয়ার উদ্দিনের মন নিয়ে অন্ধকার পথে শের শাহকে খোঁজে। ট্রাংক রোড তার পোকা খাওয়া দাঁতের মতো। মনে ক্লান্তির পুঁজ জমে। পুঁজ নাকে টানতে টানতে পৌঁছে মুরগি কলোনি।

কামাল অটো পার্টসের সামনে আড্ডার খিঁচুড়ি। কানা কুদ্দুস বলে, অ খ্যালা চাচা, কী খবর? আর কতদিন তালিমালি গরিবা? আইও পেডত পেরাক মারি দি।

বুড়ার জিহ্বা আড়ষ্ট। কবরস্থানের পাশের পুকুরে ময়লা ঘন হয়েছে। অসংখ্য নক্ষত্র দৃশ্যমান। পাদ দিয়ে কুকুর তাড়ানো শেয়ালের ভঙ্গিতে মাছের মতো ভেজা ও আঁষটে গন্ধের কলোনিতে ঢোকে।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার