লাতিন আমেরিকার সাংবাদিকতায় যা ঘটছিল তা দেখে বিমর্ষ হয়ে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর নোবেলজয়ী লেখক এবং নিজে একজন প্রাক্তন সংবাদ-প্রতিবেদক, ১৯৯৫ সালের মার্চে চালু করেন ফাউন্ডেশন ফর অ্যা নিউ ইবেরো-আমেরিকান জার্নালিজম— যেটাকে তিনি বলেন “দেওয়ালবিহীন বিদ্যানিকেতন”। ভ্রাম্যমাণ কর্মশালার মাধ্যমে ঐ অঞ্চলের সাংবাদিকতাকে চাঙা করা এর উদ্দেশ্য। তিনি জোর দিয়ে বলেন, যা শেখানো হচ্ছে এবং চর্চিত হচ্ছে তার আশু সংস্কার প্রয়োজন এবং তিনি অভিযোগ করেন এখনকার সাংবাদিকেরা সৃজনশীলতা ও নৈতিকতার চাইতে ব্রেকিং নিউজ আর প্রেসের পাস-এর সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার পিছনে দৌড়াতেই বেশি আগ্রহী। কোনো একটা গোপন দলিল উল্টেপাল্টে পড়ার সুযোগ পেলে তারা গর্ববোধ করে, তিনি বলেন, কিন্তু তাদের কাজ ব্যাকরণের ভুল আর বানান-বিভ্রাটে ভরা এবং অগভীর। সূচনা মন্তব্যে তিনি লিখেন, “সবার আগে জমা দেওয়া লেখাটাই যে সেরা লেখা না, বরং সবচেয়ে ভালোভাবে লেখাটাই যে সেরা লেখা— এই গোড়ার কথাটা দ্বারা তারা চালিত নয়।”
লাতিন আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর সংবাদপত্র প্রকাশকেরা এই কাজটাকে যেভাবে দেখে গার্সিয়া মার্কেস তার প্রতি সমালোচনামুখর। তিনি মনে করেন এটা পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। পেশাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে মনে করে সাংবাদিকেরা শিল্পী নন, এর সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করে গার্সিয়া মার্কেস মনে করেন সাংবাদিকতা “একটা সাহিত্য-আঙ্গিক।” সংবাদপত্রগুলোকে তিনি প্রযুক্তি খাতে কম খরচ করে প্রশিক্ষণ খাতে বেশি খরচ করতে পরামর্শ দেন।
কোলোম্বিয়ার বার্রানকিইয়াভিত্তিক গার্সিয়া মার্কেস ফাউন্ডেশন ইউনেস্কোর সহায়তায় দুই বছরেরও কম সময়ে আটাশটি কর্মশালার আয়োজন করেছে, যেখানে এগারোটি দেশের তিনশ বিশ জন সাংবাদিক অংশ নিয়েছে। মুদ্রণমাধ্যম, রেডিয়ো এবং টেলিভিশনের জন্য রিপোর্ট তৈরির আখ্যানিক কৌশল শেখানো থেকে শুরু করে নৈতিকতা-প্রসঙ্গ, প্রেসের স্বাধীনতা, বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে রিপোর্টিং এবং এই পেশায় প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ ইত্যাদি ছিল কর্মশালাগুলোর বিষয়বস্তু। প্রতিষ্ঠিত পেশাদার ব্যক্তিবর্গ কর্মশালাগুলোতে প্রশিক্ষণ দেন এবং অনূর্ধ তিরিশ বছর বয়সী তরুণ প্রজন্মের সাংবাদিকদের মধ্যে যাদের কমপক্ষে তিন বছরের অভিজ্ঞতা আছে তারা এ-কর্মশালাগুলোর উদ্দিষ্ট অংশগ্রহণকারী। কলম্বিয়াভিত্তিক হলেও ইকুয়োদোর, বেনেসুয়েলা, মেহিকো এবং স্পেনেও এ-কর্মশালা হয়েছে। রিপোর্টাজ-এর ওপর মার্কেসের দেওয়া তিন দিন ব্যাপী প্রশিক্ষণটি ফাউন্ডেশনের পাঠক্রমের মূল অংশ।
লাতিন আমেরিকার ওপর ইংরেজি ভাষায় লেখালিখি করে এমন একজন মুক্ত সাংবাদিক হিসাবে আমি কর্মশালায় অংশ নেওয়ার জন্য আবেদন করি এবং পঞ্চম কর্মশালায় অংশগ্রহণ করার অনুমতি পাই। তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি এতটাই উত্তেজিত ছিলাম যে, যে-আমি সবকিছুতে দেরিতে যাই সেই আমিই কিনা লাল বেগনিয়া গাছ ও প্রাঙ্গণে ঝর্ণাশোভিত চমৎকারভাবে সংস্কারকৃত, স্প্যানিশ সরকারের মালিকানাধীন দ্বিতল বাড়ি কার্তাহেনার স্প্যানিশ কাল্চারাল সেন্টারে সবার আগে গিয়ে পৌঁছি। এর চাইতে যথাযথ সজ্জা আর হয় না। কার্তাহেনা গার্সিয়া মার্কেসের বাড়ি এবং মার্কেসের গল্পের অনেক চরিত্র হেঁটেছে এই শহরের ঔপনিবেশিক কেন্দ্রের সংকীর্ণ খোয়া-বিছানো পথ দিয়ে। কাল্চারাল সেন্টারের কয়েক ব্লক দূরের ক্যাথেড্রাল স্কয়ারে ফারমিনা দাসা-র হাঁটা দেখে আরিসা খেয়াল করেছিলো যে সে আর স্কুলবালিকাটি নেই। সিয়ের্ভা মারিয়া দে তোদোস লোস্ অ্যানহেলেস, বারো বছর বয়সী আরিসার মৃত্যুর পরেও তার চুল বেড়ে চলছিল, থাকতো কাছের সান্তা ক্লারার আশ্রমে। কার্তাহেনাকে ইংরেজ জলদস্যুদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতো যে-দেওয়াল, সে-দেওয়ালের সঙ্গে লাগোয়া গার্সিয়া মার্কেসের বাসাটা আশ্রমের— যেটা এখন পাঁচতারা হোটেল— এতো কাছে যে মেহ্মানরা সরাসরি লেখকের বাড়ির অন্দরমহল দেখতে পেত। “এটা খুব বিব্রতকর,” হোটেলের এক মেহমান আমাকে বলেন, “আমি তাঁকে প্রতিদিন সকালে নাস্তা করতে দেখতে পেতাম। শেষ পর্যন্ত আমি পর্দা টানিয়ে দিয়েছিলাম।”
সোমবার, এপ্রিল ৮, ১৯৯৬
সকাল ৯:০০টা
কাঠের একটা বড়োসড়ো ডিমাকার টেবিল ঘিরে বসে থাকা বারো জন সাংবাদিকের মধ্যে একজন আমি। নিশ্চুপ, ক্লাশ শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষারত জেস্যুট স্কুলের সুশৃঙ্খল ছাত্রছাত্রীদের মতো। গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস দরজা খোলেন, এবং আমাদের দিকে দুষ্টুমির চোখে তাকিয়ে ভিতরে ঢোকেন, যেন তিনি জানেন কীরকম নার্ভাস আমরা। গার্সিয়া মার্কেস— গাবো, সবাই তাকে যেভাবে জানে— সাদা জামা পরা। এখানে কোলোম্বিয়ার ক্যারিবিয়ান উপকূলের পুরুষেরা প্রায়ই সাদা পোশাক পরে, জুতো পর্যন্ত পুরোটাই সাদা। তিনি আমাদেরকে সুপ্রভাত জানান, আর মুহূর্তের জন্য মনে হয় আমরা উঠে দাঁড়াই, মাথা নোয়াই অথবা সৌজন্য প্রকাশ করে যেন সমস্বরে বলি: “বুয়েনস্ দিয়াস্, প্রফেসর।”
ঘরের মধ্যে জানালার দিকে মুখ আর দরজার দিকে পিঠ দেওয়া দুটো খালি চেয়ার। গাবো আমার পাশে বসা মেহিকান সাংবাদিক সেসার্ রোমেরোকে উঠিয়ে দেন— আমরা মুখ করে আছি দরজার দিকে— এবং তাকে তাঁর চেয়ারে বসতে বলেন। “আমি অনেক বেশি কাউবয় মুভি দেখেছি,” তিনি বলেন: “আমি কখনো দরজার দিকে পিঠ দিয়ে বসি না। এবং নিশ্চিত জানি তোমাদের চেয়ে আমার শত্রু অনেক বেশি।”
“দোন্ গাব্রিয়েল্,” সেসার্ রোমেরো বলে, “নিশ্চয়ই।”
গাবো যখন পায়চারি করছেন তখন আমার মনে পড়ে আমার কুবীয় বন্ধুর কথা, যে কিছুদিন আগে হাবানার বাইরে গার্সিয়া মার্কেসের স্থাপিত ফিল্ম স্কুলে স্নাতক হয় এবং মাঝে মাঝে ওখানে পড়ায়। “চমৎকার সময় কাটবে তোমার,” হুয়ান কার্লোস বলেছিল। “ক্লাসে উনি সবসময় ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের দিকে বেশি মনোযোগ দেন। তিনি বলেন নারীরা তাঁর জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে।” টেবিলের চারপাশে তাকাই। বারো জন অংশগ্রহণকারীর মধ্যে আন্দ্রেয়া বারেলা আর আমিই শুধু নারী।
গাবো আমার বামপাশে বসেন, আমিতো নার্ভাস। আমার হাত ঘামতে থাকে। আমি প্যান্টে হাত মুছি। আমি আমার হাতদুটো আড়াআড়ি রাখি। উনি আড়াআড়ি রাখেন উনার পা দুটো। আমি মেঝের দিকে চোখ নামাই। তাঁর সূঁচালো, সুন্দর করে পালিশ করা জুতোগুলো সাদা। ওপরে তাকাই। তাঁর হাতঘড়ির ফিতাও সাদা। আমার চোখ পড়ে তাঁর গুয়াবেরার ওপর, লাতিন পুরুষদের প্রিয় শার্ট ওগুলো, প্যান্টের বাইরে পরে, নিতম্বের ওপর পর্যন্ত আসে, চারটা পকেট থাকে, কখনো এমব্রয়ডারি করা আর কখনো কুঁচি দেওয়া থাকে। এগুলোকে পিতামহ, কেবিনেট মন্ত্রী আর জমিদারদের সঙ্গে মানানসই বলেই আমার মনে হয়েছে সবসময়, যাদের গা থেকে কোলন আর মাঝে মাঝে স্কচের গন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর শার্টটা সাদামাটা, কুঁচি নেই, গন্ধ নেই, আর এত পাতলা লিনেনের তৈরি যে এপাশ-ওপাশ দেখা যায়। তাঁর দুমড়ানো-কুঁচকানো প্যান্টটাকে এটার সাথে বিদ্ঘুটে দেখায়।
তিনি টেবিলের ওপর চামড়ার কালো একটা হাতব্যাগ রাখেন, সাতের দশকে সৌম্য পুরুষদের হাতে হাতে ফিরতো যেগুলো। চোখে চশমা রেখেই ক্লাসে অংশগ্রহণকারীদের নামের তালিকা বের করেন একটা কালো ফোল্ডারের ভিতর থেকে। তিন দিনের কর্মশালায় সমালোচনা আর সম্পাদনা করার জন্য আমাদের লেখা যে-রিপোর্টগুলো গাবোর কাছে জমা দিতে বলা হয়েছিল, সেগুলোও ওখানে আছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রকের ঘরঘর শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। কেউ তাঁর দিকে খুব একটা তাকাচ্ছে না, অথচ আমরা, দুর্ধর্ষ সাংবাদিকগণ, সবাই-ই এর চেয়ে অনেক দুরূহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করে এসেছি। কালি-র রুবেন বালেন্সিয়া একা একাই গিয়েছিল উরাবায়, যা কিনা কোলোম্বিয়ার সবচেয়ে সহিংস অঞ্চল যেখানে মাদক চোরাচালানকারী, গেরিলা, এবং আধাসামরিক বাহিনীগুলো একটা আরেকটাকে ধ্বংস করার কাজে লেগেই আছে। মেদেয়িনের শহরতলিতে ঘুরে ঘুরে মাদকের কারবারি, বেশ্যা আর গ্যাংসদস্যদের সঙ্গে বিশ দিন কাটিয়েছে উইলসন্ দাসা। চিয়াপাস-এ সাপাতিস্তা অভ্যুত্থান কাভার করেছে সেসার রোমেরো। মাদকজোটের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সেম্পারের গোপন আঁতাতের তদন্ত করেছে এসগার তেইয়েস।
কিন্তু ১৯৮২ সালে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর গাবো নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর লেখক থেকে ক্রমশ সেলিব্রিটি এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। লাতিন আমেরিকায় বিশেষ করে কোলোম্বিয়া এবং মেহিকোতে, যেখানে তিনি বেশিরভাগ সময় কাটান, এমনকি প্রেসিডেন্টরাও এতমর্যাদা পান না। এখানে তাঁর তারকা খ্যাতিকে তুলনা করা যায় শুধু ফুটবল খেলোয়াড়দের আর সৌন্দর্যরাণীদের খ্যাতির সঙ্গে। লোকেরা তাঁকে অটোগ্রাফ নেওয়ার জন্য রাস্তায় দাঁড় করায়, এমনকি যারা তাঁর লেখা পড়ে নি তারাও। প্রেসিডেন্টগণ, মন্ত্রীবর্গ, রাজনীতিবিদগণ, সংবাদপত্র প্রকাশকবৃন্দ, গেরিলা নেতারা তাঁর মতামত নেন, তাঁর কাছে চিঠি লিখেন, তাঁকে কাছে পেতে চান। যে-কোনো বিষয়ে যা-ই তিনি বলেন তা-ই সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়। গত বছর কোলোম্বিয়ায় একটি গেরিলা সংগঠন একজন প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের ভাইকে অপহরণ করে। তাদের দাবি ছিল গার্সিয়া মার্কেস যেন প্রেসিডেন্টের পদ গ্রহণ করেন। দাবিনামায় তারা লিখেছিল: “মহাত্মন্, দয়া করে পিতৃভূমিকে বাঁচান।”
আমাদের কোলোম্বিয়ানদের জন্য, গার্সিয়া মার্কেসকে তাঁর ডাকনাম গাবো ধরে ডাকার মানে তাঁর সাফল্যকে আমাদের আরো কাছে নিয়ে আসা, একটি গর্বিত পরিবারের মতো, তাঁর মহত্ত্বকে নিজেদের করে নেওয়া। সহিংসতা, দারিদ্র্য, মাদক চোরাচালান আর দুর্নীতিতে ছেয়ে যাওয়া একটি জনপদে তিনি হলেন সেই ছেলেটি, পরিবার যাকে বাইরের লোকের কাছে প্রদর্শন করে— এমনকি যারা ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বকে অনুমোদন করে না তারাও। আমার নিজের শহর বার্রানকিইয়া, যেখানে তিনি ১৯৫০ সালে প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেছিলেন এবং যেখানে স্ত্রী মের্সেদেস-এর সঙ্গে তাঁর দেখা হয়, আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে তাঁকে। সেখানে তিনি এমনকি গাবোও নন, গাবিতো— বাবা-মা, স্বামী-স্ত্রী এবং বন্ধুরা যেরকম আদুরে নাম ধরে তাদের প্রিয়জনদেরকে ডাকে।
আমাদের সুন্দরী প্রতিযোগিতাগুলোতে পোপের নাম যতবার আসে তাঁর নামও ততবার আসে। প্রতিযোগিনীদের উত্তরগুলো হয়ে গেছে পুনরাবৃত্তিমূলক: তোমার প্রিয় লেখক কে? গার্সিয়া মার্কেস। তুমি সবচেয়ে বেশি সম্মান কর কাকে? আমার বাবা, পোপ এবং গার্সিয়া মার্কেস। কার সঙ্গে তুমি দেখা করতে চাও? গার্সিয়া মার্কেস আর পোপ। একই প্রশ্ন যদি লাতিন কোনো সাংবাদিককে করা হতো, উত্তরগুলো মনে হয় একই-ই হতো— সম্ভবত পোপকে বাদ দিয়ে। আমরা, লাতিন আমেরিকার সাংবাদিকেরা, যারা কেরিয়ারের শুরুর দিকে আছি, তাদের কাছে তিনি অনুকরণীয় আদর্শ। আমরা বলতে পছন্দ করি যে ঔপন্যাসিক হওয়ার আগে তিনি প্রতিবেদক ছিলেন। তিনি বলেন এই দুই পরিচয়ের একটিকেও তিনি কখনো ছাড়েন নি।
তালিকা থেকে আমাদের নামগুলো পড়েন গাবো এবং প্রত্যেকটির সঙ্গে একটিই মন্তব্য করেন— সর্বদা কৌতূহলী, সর্বদা উষ্ণ। রুবেন বালেন্সিয়া এবং আরো কয়েকজন তাঁকে মায়েস্ত্রো বলে ডাকে, যেটাকে আমার কাছে একটু বাড়াবাড়ি রকমের ভক্তিসূচক বলে মনে হয়। তাঁর সম্পর্কে কথা বলার সময় আমি তাঁকে গাবো বলে ডেকেছি অনেকবার, কিন্তু সামনাসামনি একবারই, যেটাকে একটু আগবাড়ানোই মনে হয়। তাঁর খাতির সবচেয়ে বেশি আন্দ্রেয়ার সঙ্গে, যে এরই মধ্যে তাঁর সঙ্গে আরো একটি কর্মশালায় ছিল। “তুমি কাজে যতটা সময় কাটাও তার চেয়ে বেশি সময় কাটাও এখানে কর্মশালায়,” তাকে আন্দ্রেইতা বলে ডেকে সকৌতুকে বলেন। “আমরা তোমার বস্কে কল করব আর তোমার বিছানাপত্র এখানে পাঠিয়ে দিতে বলব।” আন্দ্রেয়া এমনিতেই লাজুক, আর গাবোর উষ্ণতা তাকে লজ্জায় লাল করে দেয়।
হঠাৎ করে দরজা খুলে যায়, এবং একটি যুবক— উর্দ্ধশ্বাস, হালকা নীল শার্ট বুকের সঙ্গে সাঁটা আর বগলের তলায় একটা খবরের কাগজ গোঁজা— কার্তাহেনা শহরতলির উষ্ণতা ও কোলাহলকে ভেতরে নিয়ে আসে।
“পেরমিসো” বলে ক্ষমা চায় সে, এবং সেসার্ রোমেরোর পাশে দ্রুত বসে পড়ে।
“তুমি কে হে?”
“তাদেয়ো মার্তিনেস।”
তাদেয়ো নার্ভাস এবং মার্কেস তা জানেন।
“তাদেয়ো মার্তিনেস। এল্ পেরিওদিকো দেকার্তাহেনা,” তালিকা থেকে পড়ে তিনি বলেন। “এখানে তোমার সহকর্মীরা, চল দেখি, কারাকাস, বোগোতা, কালি, মেদেয়িন্, সান হোসে, মেহিকো, ন্যুইয়র্ক এবং মিয়ামির বাসিন্দা, কিন্তু তুমি, যে কিনা এখানের আশপাশেরই লোক, এলে সবার পরে।”
ওর জন্য আমাদের সবার খারাপ লাগে, কিন্তু এরপর গাবো মাথা ঝাঁকান আর মৃদু হাসেন।
সকাল ১০:০০ টা
গাবো শুরু করেন সিমোন বলিবার্কে নিয়ে তাঁর লেখা বইয়ের কথা দিয়ে। সিমোন বলিবার— আমাদের জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন, একদেহে লীন আমাদের সব আদিপিতাগণ— যিনি পাঁচটি দেশকে মুক্ত করেছিলেন স্পেনীয় শাসন থেকে এবং স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি অবিভক্ত লাতিন আমেরিকার, ক্যালিফোর্নিয়া থেকে শুরু করে একেবারে নিচের দিকে তিয়েরা দেল ফুগো পর্যন্ত বিস্তৃত। এল লিবেতাদোর; পাবলিক অফিসের দেওয়ালে দেওয়ালে যেমনটা দেখা যায়, সবসময় ধোপদুরস্ত সামরিক পোশাক পরা, যুদ্ধের জন্য কিংবা তাঁর শাদা ঘোড়ার পিঠে চড়তে প্রস্তুত।
“কিন্তু বলিবারের জীবনীতে কেউ কখনো লিখেন নি যে তিনি গান গাইতেন বা তাঁর কৌষ্ঠকাঠিন্য ছিল,” গাবো বলেন। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীটা দুই দলে বিভক্ত: “যারা ঠিকমতো হাগতে পারে আর যারা পারে না; এই ব্যাপারটা চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা তৈরি করে। কিন্তু ইতিহাসবেত্তারা এইসব কথা বলেন না, কারণ তাঁরা মনে করেন এগুলো গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।” অফিসিয়াল ইতিহাসবেত্তাগণ তাঁর নায়কের যে-কাঠখোট্টা ছবিটা হাজির করেছেন, তাতে তাঁর অসন্তোষ থেকেই বোঝা যায় কেন তিনি গোলকধাঁধাঁয় সেনাধিনায়ক লিখার সিদ্ধান্ত নিলেন, যে-বইয়ের পাতায় ধরা আছে সেই ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ আলোচনা যিনি তাঁর রাজনৈতিক চিন্তার ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছেন। তিনি আমাদেরকে বলেন যে এ-বই তিনি লিখেছেন রেপোর্তাজ তথা রিপোর্টাজের আঙ্গিকে।
“রিপোর্টাজ হল পুরো স্টোরিটা, কোনো ঘটনার সম্পূর্ণ পুনর্নির্মাণ। প্রতিটি খুঁটিনাটির গুরুত্ব আছে। এটাই একটা স্টোরির প্রামাণ্যতা ও শক্তিমত্তার ভিত্তিমূল। গোলকধাঁধাঁয় সেনাধিনায়ক-এ প্রত্যেকটি যাচাইসাপেক্ষ সত্য, যত সরলই হোক নাকেন, পুরো লেখাটায় শক্তি যোগায়। যেমন: মে ১০, ১৮৩০ তারিখের যে-রাতে সিমোন বলিবার ঘুমিয়েছিলেন, সে-রাতের বর্ণনায় আমি একটা পূর্ণিমার দৃশ্য— পূর্ণিমার দৃশ্য ঢোকানো তো খুব সহজ— ঢুকিয়ে ছিলাম। আমি জেনে নিতে চেয়েছিলাম সে-রাতে আসলেই পূর্ণিমা ছিল কিনা, তাই আমি মেহিকোর একাডেমি অব সায়েন্সে ফোন করি এবং তাঁরা জানান যে সে-রাতে সত্যিই পূর্ণিমা ছিল। যদি তা না থাকত, তাহলে আমি স্রেফ পূর্ণিমাটা বাদ দিয়ে দিতাম। চাঁদের ব্যাপারটা এমন একটা ডিটেইল যা কেউ খেয়াল করে না। কিন্তু একটা প্রতিবেদনমূলক লেখায় যদি একটা মিথ্যা ব্যাপার থাকে, তাহলে সেটা আগাগোড়াই মিথ্যা হয়ে যায়। ফিকশনে উল্লিখিত কোনো যাচাইসাপেক্ষ ফ্যাক্টের সত্যতা পেলে— এই যেমন গুয়াদুয়সে সে-রাতে পূর্ণিমা ছিল— পাঠকেরা বাকি সব কিছুকেও সত্য বলে বিশ্বাস করবে।”
কেউ একজন রিপোর্টাজে ফিকশনের কৌশলের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। উত্তরে গাবো বলেন যে তিনি গে তালিস, নরমান মেইলার এবং ট্রুমান কাপোটের কাজকে শ্রদ্ধা করেন, যাঁরা সবাই নয়া সাংবাদিকতার চর্চা করেছেন। “নয়া সাংবাদিকতার একমাত্র সাহিত্যিক দিকটা হচ্ছে এর বর্ণনাকৌশল। সাহিত্যিক লাইসেন্স ততক্ষণ পর্যন্ত অনুমোদযোগ্য যতক্ষণ তা বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে এবং অপরাপর যাচাইসাপেক্ষ ব্যাপারগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের দিক থেকে সত্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।” তিনি যখন এটা বলছেন, তখন আমার কারাকাস বিষয়ে গাবোর একটা লেখার কথা মনে পড়ে, যেখানে ভয়ঙ্কর খরা এবং পিচফলের রস দিয়ে জনৈক ব্যক্তির দাড়ি কামাতে শুরু করবার কথা আছে— এটা এমন একটা ঘটনা যা অবশ্যই বিশ্বাসযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, কিন্তু এতে সাহিত্যিক কল্পনার ছোঁয়াও আছে বটে। বলা হয়ে থাকে যে গাবো এতটাই সৃজনশীল যা একজন ভালো সাংবাদিক হওয়ার পক্ষে অযোগ্যতার পর্যায়ে পড়ে। যাই বলি না কেন, তিনি তো সেই একই লেখকটাই যিনি তাঁর উপন্যাসে, সোজাসাপ্টাভাবে, রেমেদিউস দ্য বিউটিকে আকাশে উড়িয়েছিলেন এবং সান্তিয়াগো নাসারের বহুঘোষিত মৃত্যুর পর তার শরীরের দুর্গন্ধকে পুরো শহরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন।
যেন আমার মনের কথা পড়ছেন এমনভাবে তিনি বলেন, “আমার উপন্যাসের উদ্ভট পর্বগুলো সব বাস্তব, অথবা বাস্তবতার মধ্যে এগুলোর কোনো ভিত্তিমূল বা আরম্ভবিন্দু আছে। আমরা যা তৈরি করতে পারি তার চাইতে বাস্তব জীবন কিন্তু অনেক বেশি কৌতূহলোদ্দীপক।” তিনি বলেন রেমেদিউস দ্য বিউটির আকাশভ্রমণের ব্যাপারটা তাঁর মাথায় আসে একটা মহিলাকে দুহাত চিতিয়ে পরিষ্কার শাদা কাপড় সূর্যের দিকে মেলে ধরতে দেখে। তিনি আরো বললেন যে “জাদু এবং বাস্তবের মধ্যে গতায়াত করার জন্য সাংবাদিক হতে হয়।” তিনি আমাদেরকে জাহাজডোবা এক নাবিকের কাহিনী সম্পর্কে বলেন, যেটা তিনি বোগোতায় এল্ এস্পেক্তাদোর-এ স্টাফ রিপোর্টার হিসাবে কর্মরত থাকার সময় ধারাবাহিক স্টোরি আকারে লেখেন। সাগরে হারিয়ে যাওয়া একজন নাবিকের রোমাঞ্চকর ঘটনাবলি সম্পর্কে তাঁকে লিখতে বলা হয়েছিল, কিন্তু ঐ স্টোরির ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ ছিল না। “সবগুলো প্রত্রিকা ঐ বিষয়ে লিখে ফেলেছিল।” কিন্তু এরপর তিনি সদয় হন। সেই সময়, পাঁচের দশকে— সেই সব দিনগুলোয়, যখন লন্ডনের ব্রডশিট পত্রিকাসমূহে চার্লস ডিকেন্স-এর উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল— বিপণন-কৌশল হিসাবে ধারাবাহিক লেখা ছাপানোর চল ছিল। গাবোর দায়িত্ব ছিল ঐ নাবিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া এবং তা ধারাবাহিকভাবে তা প্রত্রিকায় লেখা। দুই কিস্তি ছাপা হওয়ার পরে, দোন গিইয়ের্মো কানো, ঐ পত্রিকার সম্পাদক (১৯৮৬ সালে তিনি মাদক চোরাকারবারিদের হাতে নিহত হন), তাঁর টেবিলে দিকে হেঁটে আসেন। “ ‘ওইগা, গাবিয়েলিতো, আপনি যা লিখছেন— ওগুলো কি গল্প নাকি সত্যি?’ আমি তাঁকে বললাম, ‘এটা একটা কল্পনা এবং এটা সত্যি।’ এরপর উনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এবং আরো কত কিস্তি জমা দেওয়ার কথা ভাবছেন আপনি?’
“ ‘আর দুই কিস্তি,’ আমি বললাম।
“ ‘অসম্ভব, বিক্রি তিনগুণ বেড়ে গেছে। আমাকে একশ কিস্তি দেন।’
“আমি চৌদ্দ কিস্তি লিখেছিলাম।
“আমি জানতাম ঐ নাবিক সাগরে পথ হারিয়ে চৌদ্দ দিন কাটিয়েছিলেন,” গাবো আমাদেরকে বলেন, “তাই আমি চৌদ্দ কিস্তি লেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সাগরে একদিনের জন্য এক কিস্তি। আমি লোকটার সঙ্গে আবার বসলাম এবং তাঁর দিনগুলোকে আরো ছোট ছোট অংশে ভাগ করতে শুরু করলাম। আমি শুরু করলাম প্রতিদিন তিনি কী করেছিলেন তা দিয়ে, এরপর প্রতি ঘণ্টায়, এরপর প্রতি মিনিটে। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কখন হাঙরেরা আসত; কখন তিনি খেতেন।”
দুপুর
এখন প্রায় মধ্যাহ্নভোজের সময়। গাবো ঠিক নয়টায় কথা বলতে শুরু করেছিলেন এবং এরপর থামেন নি। পড়ানোর চেয়ে গাবো আড্ডা দেন, গল্প করেন বেশি। তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আমরা বারোজন বসে আছি, বলেছি অল্পই। আমি সকালে নাস্তা করি নি কিন্তু খিদাও লাগছে না। তিনি কফি খান না, কিন্তু আমাদের অনেকেই খায়। তাঁর গল্পের যোগ্য জুড়ি এটা।
তিনি বলেন, গল্পবলিয়ে জন্মায়, তৈরি হয় না: “গায়ক হওয়াটা যেমন, গল্পবলিয়ে হওয়াটাও এমন একটা ব্যাপার যা জীবন তোমাকে দেয়। এটা শেখা যায় না। কৌশল, হ্যাঁ তা শেখা যায়, কিন্তু গল্প বলার সামর্থ্যটা এমন একটা জিনিস যা সঙ্গে নিয়েই জন্মাতে হয়। কে ভালো গল্পবলিয়ে আর কে না, তা বোঝা খুব সহজ: যে-কাউকে তার দেখা শেষ মুভিটা নিয়ে বলতে বল।
তারপর তিনি জোর দিয়ে বলেন, “কঠিন জিনিসটা হল তুমি যে ভালো গল্পবলিয়ে না সেটা বুঝতে পারা এবং এরপর তা থেকে সরে গিয়ে অন্য কিছু করার হিম্মত রাখা।” পরে সেসার রোমেরো আমাকে বলে গাবোর সব কথার মধ্যে এই কথাটাই তাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দিয়েছিল।
তিনি একটা উদাহরণ দেন। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার অল্প কিছুদিন পরে, মাদ্রিদে গাবো হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় এক তরুণী সাংবাদিক তাঁর কাছে আসে এবং তাঁর একটা সাক্ষাৎকার নিতে চায়। গাবো, সাক্ষাৎকার দেওয়ার অনুরোধ যাঁর নাপছন্দ, রাজি হন নি, কিন্তু তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে বাকি দিনটা কাটানোর জন্য দাওয়াত করেন। “সে আমাদের সঙ্গে সারাটা দিন কাটিয়েছিল। আমরা কেনাকাটা করেছি, আমার বউ দরদাম করেছে, আমরা দুপুরে খেতে গেছি, হেঁটেছি, কথা বলেছি; ও সব জায়গায় আমাদের সঙ্গে গেছে।” তাঁরা যখন হোটেলে ফিরে আসলেন আর গাবো তাকে বিদায় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত, তখন সে আবার তাঁকে অনুরোধ করল সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য। “আমি তাকে বললাম যে তার পেশাবদল করা উচিৎ,” গাবো বলেন। “পুরো গল্পটাই সে পেয়েছিল, রিপোর্টাজ পেয়েছিল।”
এরপর তিনি সাক্ষাৎকার আর রিপোর্টাজের পার্থক্য নিয়ে কথা বলে যান— এ-বিভ্রান্তিটা, গাবো বলেন, সাংবাদিকেরা তৈরি করেই চলেছেন। “মুদ্রণ-সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকার হল সাংবাদিকের সঙ্গে কেউ একজনের সংলাপ, যাঁর কোনো ঘটনা সম্পর্কে কিছু বলবার বা ভাববার আছে। রিপোর্টাজ একটা ঘটনারই অনুপুঙ্খ ও বিশ্বস্ত পুনর্নির্মাণ।
“টেপ রেকর্ডারগুলো বড়ই বদমাশ গোছের, লোকেরা এই ধন্ধে পড়ে যায় যে টেপ রেকর্ডার চিন্তা করতে পারে এবং সেজন্যই যে- মুহূর্তে আমরা এটা চালু করি সে-মুহূর্তে আমরা আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বন্ধ করে দিই। টেপ রেকর্ডার হচ্ছে একটা ডিজিটাল তোতাপাখি, এর কান আছে কিন্তু হৃদয় নেই। ঘটনার অনুপুঙ্খ সে ধারণ করতে পারে না, তাই আমাদের কাজ হল ধারণকৃত শব্দের বাইরে কান পাতা, কী কী বলা হয় নি তা খুঁজে বের করা এবং এরপর পুরো স্টোরিটা লেখা।” তিনি চোখ নামান সামনে রাখা কাগজের গাদার ওপর— আমাদের লেখাগুলো! “লিখা একটা সম্মোহনী কাজ,” তিনি বলেন, “যদি সফল হয় তাহলে লেখক পাঠককে সম্মোহিত করেছেন। যেখানেই হোঁচট খায় পাঠক সেখানেই জেগে ওঠে, তার সম্মোহন ভেঙে যায়, সে পড়া বন্ধ করে দেয়। গদ্য যদি খুঁড়িয়ে চলে, পাঠক তোমাকে ছেড়ে চলে যায়। প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি বর্ণনা, এমনকি প্রতিটি শব্দের দিকে পাঠককে টেনে নিয়ে তাকে সম্মোহিত করে রাখতে হবে। এটা একটা ধারাবাহিক কাজ, যেখানে তুমি পাঠককে বিশ্বাসযোগ্যতা আর ছন্দতরঙ্গের নেশা ধরিয়ে পাঠককে আবিষ্ট করে রাখছো।” তিনি থামেন এবং কাগজগুলোর ওপর টোকা দেন। “এখন আমাকে বলতেই হবে যে তোমাদের সবার পাঠানো লেখা আমি পড়েছি এবং পুরো সময়টা আমি সম্পূর্ণ সজাগ ছিলাম।” আমার দম বন্ধ হয়ে আসে, কেউ কেউ ফিকফিক করে হাসে, আর বাকিরা তাদের চেয়ারের ওপরে অস্বস্তি নিয়ে নড়েচড়ে।
দুপুর ১:০০টা
“চল দেখি আজকের পত্রিকায় কী আছে।” তিনি টেবিলের ওপাশে গিয়ে তাদেয়ো মার্তিনেসের পত্রিকাটা হাতে নেন। তিনি জিজ্ঞেস করেন “এমন কোনো স্টোরি কি আছে, যেটার জন্য আমরা বাইরে যেতে পারি এবং তা কাভার করতে পারি?” তিনি প্রথম পৃষ্ঠাটা পড়েন এবং অসম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়ান। “চমৎকার,” তিনি বলেন। “এটা একটা আঞ্চলিক পত্রিকা অথচ প্রথম পাতায় কার্তাহেনা বিষয়ে কোনো স্টোরিই নাই। তোদেয়ো, তোমার বস্কে গিয়ে বলবে যে আঞ্চলিক পত্রিকার প্রথম পাতায় আঞ্চলিক খবর থাকা উচিৎ।”
“এখানে কিছুই নাই,” পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বিড়বিড় করে বলেন। “দেখিতো, এইখানে কিছু একটা আছে। স্টোভ বিক্রি হবে, অবব্যহৃত, অসংযোজিত স্টোভ। অবশ্যই বেচব। গ্লোরিয়া বেদোয়া, ৬৬০-১১২৭, এক্সটেনশন ১১৩। এইটা একটা স্টোরি হতে পারে। কল করব? আমি বাজি ধরে বলতে পারি এখানে কিছু একটা আছে। এই মহিলা কেন স্টোভটা বিক্রি করছেন, কেন স্টোভটা অসংযোজিত? এ থেকে এই মহিলার সম্পর্কে আমরা কী জানতে পারি? কৌতূহলোদ্দীপক হতে পারে?” একটু বিরতি নেন তিনি, আমাদের উত্তেজিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। কিন্তু একজন মহিলা কেন একটা অসংযোজিত স্টোভ বিক্রি করছেন সে-ব্যাপারে জানতে কাউকেই আগ্রহী মনে হয় না, বিশেষ করে যখন আমরা তাঁর কথাই শুনতে থাকতে পারি।
গাবো সর্বত্রই গল্প দেখেন। পরবর্তী তিন দিন ধরে তিনি অবিরাম বলতে থাকেন “এসো এস রেপোর্তাজ” (এই যে একটা গল্প)। আমি বুঝতে পারি গাবো খুব স্মৃতিকাতর। প্রতিবেদকের কাজটা খুব মিস করেন। তিনি বলেন, “সাংবাদিকতা চাকরি না, এটা একটা গ্রন্থি।”
এই নতুন বই একটি অপহরণ সংবাদ যে নন-ফিকশন কাজ, সেটা কাকতালীয়ভাবে হয় নি। লিখতে যে-তিন বছর সময় লেগেছিল, সেই তিন বছরের মধ্যে এটা তাঁকে আবার নতুন করে প্রতিবেদক হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। পাবলো এসকোবার, মেদেয়িনের সহিংস মাদককারবারি দলের নেতা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রবাসী আসামি ধরার ব্যাপারে কোলোম্বিয়ার সম্ভাব্য চুক্তিকে যে-কোনো মূল্যে যিনি ঠেকাতে চেয়েছিলেন, এর পরিকল্পনামতো ১৯৮৯ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সংগঠিত নয়টি অপহরণের গল্প এটি। নিজের প্রতিজ্ঞা (“যুক্তরাষ্ট্রে একটা কুঠুরির চাইতে কোলোম্বিয়ায় একটা কবরও ভালো”) অনুসারে দালানকোঠার ওপর বোমা ফেলা, রাষ্ট্রপতিপদপার্থী, মন্ত্রী, বিচারক, পুলিশ অফিসার এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে নয়জন মানুষকে অপহরণ করা, যাদের মধ্যে আটজনই সংবাদিক, ইত্যাদির মাধ্যমে এসকোবার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।
কেবল অপহৃতদের ও তাদের পরিবারবর্গেরই নয়, বরং অপহরণকারী, এসকোবারের মাদক কারবারি দলের সদস্য এবং মধ্যস্থতাকারী সরকারি কর্মকর্তাদেরও অধীরতা ও উদ্বেগকে বিধৃত করে ছয়মাসব্যাপী বন্দিদশার জীবন্ত ও রহস্যঘনভাবে পুনর্নির্মিত করেন গাবো। অবশ্যই, তিনি গার্সিয়া মার্কেস বলেই, সে-ধরনের যোগাযোগ ও প্রবেশাধিকার তাঁর ছিল, যে-কোনো সাংবাদিকের যা আরাধ্য। ঐ পরিবারবর্গ এবং তিনজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সহ সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে তিনি দেখা করতে পেরেছিলেন। তিনি কথা বলেছিলেন গান্জ্ অ্যান্ড রোজেস্ শোনা, ভিডিয়োতে বারবার লিথাল ওয়েপন দেখা সেইসব তরুণদের সঙ্গে, যারা ঘোড়াটানা বন্দুক পাশে নিয়ে পাহারা দিত— সেইসব বাচ্চাদের সঙ্গে, যারা তাদের মায়েদেরকে রেফ্রিজারেটর কিনে দেওয়ার জন্য মাদক কারবারিদের হয়ে মানুষ খুন করে। গাবো যখন বইটা লিখতে শুরু করেন, পাবলো এসকোবার ততদিনে নিহত হয়েছেন— ১৯৯৩ সালে পুলিশের গুলিতে। কিন্তু ঐ মাদকসম্রাটের প্রধান সহযোগী ওচোয়া ব্রাদার্সের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল, যাঁরা তাঁকে কারাগারে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। এসকোবারের উকিলেরা তাঁকে হাতে-লেখা চিঠি দেখতে দিয়েছিলেন। “এই বইয়ের প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি বিবরণ সত্য; মানুষের পক্ষে কোনো কিছুর সত্যতা যতটুকু যাচাই করা সম্ভব ততটুকুই এতে যাচাই করে দেখা হয়েছিল। পাবলো এসকোবার যদি নিজে এ-লেখা যাচাই করে না থাকেন, তা হলে এর একমাত্র কারণ হল তিনি তখন মৃত। আমি জানি তিনি আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হতেন।”
যে-কারো সঙ্গে দেখা করবেন বলে ঠিক করলেই যে গাবো তার সঙ্গে দেখা করতে পারেন, এটা তাঁকে সেইসব দিনগুলোর কথা মনে পড়ায় যখন তিনি নামপরিচয়হীন একজন সাংবাদিক ছিলেন, যে-কিনা খাতা হাতে তুলে নিয়েই দেখতে যেতে পারত চুলাটা কেন অসংযুক্ত। “প্রতিবেদন লেখা আমার জন্য এখন কঠিন হয়ে গেছে। যে-গ্রামটাতে পাউরুটির মধ্যে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল ঐ গ্রামটা সম্পর্কে আমি লিখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমি জানতাম আমি ওখানে গেলে খবরটা বিকৃত হয়ে যাবে; খবরের আসল বিষয় হয়ে যাব আমি।” তিনি একটা দুর্ঘটনার কথা বলছিলেন যেটা কয়েক বছর আগে বোগোতার বাইরে ঘটেছিল— পুরো একটা গ্রামে বিষক্রিয়া দেখা দিয়েছিল।
সাংবাদিকতায় ফিরে যেতে দেওয়া ছাড়াও একটি অপহরণ সংবাদ অন্য একটা উদ্দেশ্যও সিদ্ধ করেছিল। তিনি আমাদেরকে বলেন “আমি দেখতে চেয়েছিলাম আমি তখনও সাংবাদিকের মতো লিখতে পারি কিনা।” “আমার যতগুলো বই লিখেছি সেগুলোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে কঠিন। ফিকশন লেখা অনেক সহজ, ওতে আমার হাত পাকা। এর নিয়ন্ত্রণ পুরাপুরি আমার হাতে। কিন্তু এটা সংবাদপত্রের জন্য লিখবার মতো করে লেখা হয়েছিল। এই বইয়ে আমি কোনো সাহিত্যিক বিশেষণ বা রূপক ব্যবহার করি নি। নিজেকে অনুকরণ না করার ক্ষেত্রে এটা আমার জন্য প্রয়োজনীয় একটা অনুশীলন ছিল। নিঃসঙ্গতার একশ বছর লিখবার পর কুলপতির শরৎ লেখাটার চ্যালেঞ্জটা ছিল আমার স্ব-আরোপিত। আমি তিনশটা একশ বছর লিখতে পারতাম। আমি জানি সেটা কীভাবে করতে হয়, সেজন্য আমি ঠিক করেছিলাম কুলপতির শরৎ একদম অন্যভাবে লিখব। বের হওয়ার পর কুলপতির শরৎ সফল হয় নি। আমি যদি আরেকটা একশ বছর লিখতাম, তাহলে ওটা বেশি গ্রহণযোগ্যতা পেত।” তিনি মুচকি হাসেন আর আমাদেরকে বলেন তাঁর সবচেয়ে উপভোগ্য মুহূর্তগুলোর একটা ছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে যখন তিনি নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর একটি সংস্করণ দেখেছিলেন যেটাতে একপাশে ছাইরঙের কালি দিয়ে উপর থেকে নিচের দিকে লম্বালম্বিভাবে লেখা ছিল: কলেরা মৌসুমে প্রেম-এর লেখকের হাতে লেখা। তিনি বলেন, “এটাই নিঃসঙ্গতার একশ বছর-এর ওপর এই বইয়ের জিৎ।”
“যেসব সাহিত্যিককে আমরা পছন্দ করি, লেখক হিসাবে তাঁদের কাছ থেকে আমাদেরকে আত্মরক্ষা করে চলতে হয়। ফাঁদে পড়ে তাঁদেরকে অনুকরণ করা খুব সহজ। যেমন, অনেকে বলতে পছন্দ করেন যে আমি ফকনারকে অনুকরণ করেছি, কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল সফরের সময়, সেবার গিয়েছিলাম মের্সেদেস, কোলের শিশুপুত্র আর আমাদের নামে জমা করা বিশ ডলার নিয়ে, বুঝেছিলাম আমি আসলে তাঁর লেখার চাইতে বেশি প্রভাবিত ছিলাম একটি সত্য দ্বারা, সেটা হল আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চল আরাকাতাকার মতো।
আরাকাতাকা হল কোলোম্বিয়ার ক্যারিবীয় অঞ্চলের ছোট্ট একটা শহর যেখানে তিনি জন্মেছিলেন, আমার দাদা যেখানে বড় হয়েছিলেন সেখান থেকে প্রায় দুইশ মাইল দূরে। গাবো যখন এই ঘরে ঢুকেছিলেন, আমার পাশে বসেছিলেন এবং কথা বলতে শুরু করেছিলেন তখন থেকেই কিছু একটা অনুভূত হচ্ছিল। তিনি অনেকবার বলেছেন যে তাঁর নানির বলা গল্পগুলো প্রায়ই তাঁর মনে পড়ে। গাবোর কথা শুনতে শুনতে মনে হয় যেন আমার দাদার কথা শুনছি— শুধু আমার দাদা যদি লিখতে পারতেন!
গাবো চেয়ারে হেলান দেন, শুভ্রগোঁফে হাত ছোঁয়ান এবং আমাদেরকে সতর্ক করেন, “লিখার সময় যদি তোমার ফোন বেজে ওঠে আর তুমি ফোনটা ধর, তাহলে তুমি ঠিকমতো লিখছ না; অথবা যদি কারেন্ট চলে যায় আর তাতে তুমি খুশি হও। কিন্তু তুমি যদি ঠিক থাকো, তাহলে ফোন বাজলে তুমি ধরবে না; বাতি নিভে গেলে থোড়াই কেয়ার করবে।” কারেন্ট সম্পর্কে তাঁর দেওয়া উদাহরণটা অনেকের কষ্টকল্পিত বলে মনে হবে, কিন্তু আমাদের অর্থাৎ লাতিন আমেরিকার সাংবাদিকদের কাছে, কারেন্ট চলে যাওয়া আর কম্পিউটারে লেখা হারানোটা সবসময়ই আমাদের মাথায় থাকে। গাবো একবার পুরো একটা লেখা হারিয়েছিলেন, নিজের একটা জেনারেটর আছে এখন তাঁর।
আমাদের কিছু কিছু লেখা থেকে কয়েক অনুচ্ছেদ করে জোরে জোরে পড়তে শুরু করেন তিনি; যৎসামান্য সম্পাদনাও প্রস্তাব করেন। কিছু কিছু বাক্য অতিরিক্ত দীর্ঘ এবং গাবো সেগুলো পড়ার সময় দমবন্ধের ভান করেন। তিনি বলেন, “দম ফেলার জন্য কমা ব্যবহার করতে হয়। তা না হলে, ঘোরলাগা ভাবটা থাকে না। মনে রাখবে, পাঠক যেখানেই হোঁচট খায় সেখানেই সে জেগে ওঠে আর পালিয়ে যায়। এবং যেসব কারণে পাঠকের ঘোর কেটে যায় সেগুলোর মধ্যে একটি হল দমবন্ধের জোগাড় হওয়া।”
প্রায় পুরো সকালটাই আমরা গল্পে গল্পে গাবোর পাঠদান শুনে কাটিয়েছি। আমাদের কাজটা হল, বুঝলাম, গা ঝাড়া দিয়ে তাকে উপভোগ করা— যেন সবচেয়ে কাছের বারটাতে বসে দীর্ঘ একটা কফি-বিরতি নিচ্ছি। “আমি জানি সাংবাদিকতা শেখানো যায় না, এটাকে যাপন করতে হয়, তবে আমি নিজের কিছু অভিজ্ঞতা তোমাদের মধ্যে চারিয়ে দিতে পারি। কোনো তত্ত্ব নেই। বাস্তবতার কোনো তত্ত্ব নেই, বাস্তবতা কেবল বলে যায়। এ থেকে আমাদেরকে ফিরে আসতে হবে।”
মধ্যাহ্নভোজের পর
ঘরের মধ্যে আলোটা এত অল্প ছিল যে তাদের দৃষ্টি ঠিক হতে এক মুহূর্ত সময় নিল। তক্তা দিয়ে ঢাকা একটা জানালাসহ দুই বাই তিন মিটারের চেয়ে বড় ছিল না জায়গাটা। মেঝেতে পাতা একটা ম্যাট্রেসের ওপর দুইজন লোক বসে ছিলেন: প্রথম ঘরের লোকদের মতো এঁদেরও মাথায় টুপি টানা ছিল আর তাঁরা টেলিভিশন দেখায় মগ্ন ছিলেন। সবকিছুই ছিল নিরানন্দ আর বিষণ্ণকর। দরজার বাম পাশের কোণায়, লোহার খুঁটি দেওয়া খাটের ওপর, বসেছিলেন মলিন সাদা চুলের ভূতুড়ে এক নারী, যাঁর চোখজোড়া হতবুদ্ধিকর এবং ত্বক হাঁড়ের সঙ্গে সাঁটা। তাদের ভিতরে ঢোকার শব্দ তিনি শুনেছিলেন এমন কোনো লক্ষণ মহিলাটির মধ্যে দেখা গেল না; না এক পলক দেখা, না একটা নিঃশ্বাস। কিছুই না, শবকেও এতটা মৃত মনে হবে না। মারুহা যখন বুঝতে পারল এটা কে, তখন তাকে আবেগের লাগাম টেনে ধরতে হল।
গাবো একটি অপহরণ সংবাদ-এর একটা অধ্যায় পড়ছেন, আমি চেষ্টা করছি তাঁর শব্দমালার কাছে আত্মসমর্পণ করতে, শুধু তাঁর সাদা জুতোজোড়াকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। তাঁর “নেশায়” সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করার জন্য আমি চোখ বন্ধ করি।
রাতের বেলা নৈঃশব্দ্য ছিল পূর্ণ এবং নৈঃসঙ্গ্য সর্বব্যাপী, কেবল একটা ক্ষ্যাপা মোরগের দ্বারা বিঘ্নিত যেটা যখন ইচ্ছা তখন বাক্ দিয়ে উঠছিল। কুকুরের ঘেউঘেউ শোনা যাচ্ছিল দিগন্তে, আর কাছেই একটা ছিল যেটার আওয়াজ তাদের কাছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রহরী-কুকুরের ডাকের মতো ঠেকছিল। বাজে একটা আরম্ভবিন্দুতে উপনীত হল মারুহা। ম্যাট্রেসের মধ্যে গুঁটিসুঁটি মেরে ঢুকে পড়ল সে, চোখ বন্ধ করল, এবং একান্ত প্রয়োজনে ছাড়া কয়েকদিন খুলল না, ঠিকমতো চিন্তা করার জন্য যে একান্ততা দরকার তা অর্জন করতে চেষ্টা করার জন্য। এমনটা নয় যে সে একটানা আট ঘণ্টা ঘুমিয়েছে: হয়তো আধঘণ্টা ঝিমাল এবং আবার জেগে উঠল একই বাস্তবতায়, তাকে ছেয়ে ফেলার জন্য প্রতীক্ষারত সেই একই মর্মবেদনায়। চিরস্থায়ী আতঙ্ক ছিল সেটা: তার পেটের মধ্যে শক্ত, প্যাঁচানো এবং বিস্ফোরণোন্মুখ একটা কিছুর একটানা শারীরিক অনুভূতি। সুখস্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরার উদ্দেশ্যে মারুহা তার পুরো জীবনের ছায়াছবিটা মনশ্চক্ষে একবার চালিয়ে দেখেছিল, কিন্তু অবাধ্য স্মৃতিগুলো বাদ সাধছিল সবসময়।
পুরো অধ্যায় পড়েন তিনি। মারিনা মোন্তোইয়া যখন লালাভ বেগুনি জামাটা আর ছেলেদের বাদামি মোজা পরেছিল এবং দুই রুমমেটকে বিদায় জানিয়েছিল, সে-মুহূর্তের তার সেই আতঙ্কটা আমি অনুভব করি। আমাকে সেই বদ্ধ ঘরের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে প্রহরীরা মারিনাকে বলছে তাকে মুক্ত করে দেওয়া হবে। কিন্তু সবাই জানে মোজা সহ যে-হাই হিলজোড়া সে পরে আছে সেগুলো তাকে মৃত্যুদণ্ডের দিকেই হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
“কোনো মন্তব্য? কিছু পাল্টানো উচিৎ?”
কেউ কিছু বলে না।
“এটা তিন বছর ধরে করা একটা তদন্ত,” গর্ব করে বলেন তিনি, “তদন্তটা গুরুতর ছিল। যা কিছু যাচাই করে দেখার মতো ছিল সবই যাচাই করে দেখা হয়েছে। আমি এই বইয়ের কৃতিত্ব দেই আমার গবেষণা সহকারীকে।”
গাবো কথা বলছেন, কিন্তু আমার মাথা এখনো ভারী হয়ে আছে। আমার ঘোর এখনো কাটে নি। আমি যেন এখনো টলছি এবং এখনো দেখতে পাচ্ছি মারিনার শরীরটা, লালাভ বেগুনি জামা পরা, বোগোতার বিমানবন্দরে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটাকে দ্বিধাবিভক্ত করা ঘাসের ওপর শুয়ে আছে মৃত, আমার বাবা-মার কাছে বেড়াতে গেলে প্রত্যেকবার আমি যে-রাস্তাটা ধরে যাই সেই রাস্তায়।
“একটা ভালো উপদেশ হল শুরুটা আর শেষটা আগে লিখে ফেলা। ছোট্ট মজার একটা কাহিনী দিয়ে শুরু কর আর শেষ কর একটা রেশজাগানিয়া সমাপ্তি দিয়ে। এরপর মাঝখানটা ভরে দাও। গল্পকে ঘেরা দিয়ে রাখতে হবে তোমার, অনেকটা বেড়া দেওয়ার মতো করে। যদি না কর, তাহলে তুমি গবেষণা করতেই থাকবে, আর সেটা তোমাকে অন্যত্র নিয়ে যাবে। গল্পকে বাঁধতে হবে, তথ্যের চক্রটাকে কীভাবে সমাপ্তির দিকে নিয়ে যেতে হয় সেটা তোমাকে শিখতে হবে। অনুপুঙ্খ বর্ণনাগুলো হল তোমার চাবি। আখ্যানের কোনো একটা বুনটসূত্র তোমাকে ধরে থাকতে হবে। না পারলে ডুবে মরবে। এমনকি সের্ভানতেস্ও একটা গাধা হারিয়েছিলেন, আর আমাদেরকে বেশি গাধা হারানো এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে,” তিনি বলেন।
“লেখালিখির ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হল অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন হওয়া। যেভাবে বল সেভাবেই যদি লিখতে পারতে, সেটাই একজন লেখকের স্বপ্ন, যেভাবে বলি সেভাবে লিখতে পারাটা। এটা হয়ে ওঠে না, কেননা যখন কেউ তা করার চেষ্টা করে তখন সে বুঝতে পারে এটা করা কত কঠিন। মেহিকোতে, আমি জানালা খোলা রেখে লিখতাম, যাতে ক’রে পাখির ডাক বা বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাই, এবং সেগুলোকে আমার লেখায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারি। এখন আর সেটা করি না। ঐ যে ব্যাপারটা, বিশেষ জায়গায় বসে একটা বিশেষ ধরনেই শুধু লিখতে পারাটা, ঔপন্যাসিকের একটা বাতিক। এখন আমি যেখানে ইচ্ছা লিখতে পারি, যেমনটা পারতাম আমি যখন সংবাদপত্রের প্রতিবেদক ছিলাম। যে-কোনো হোটেল রুমে বসে শুধু আমার পাওয়ারবুকটার প্লাগ লাগাই। তবে আমি লম্বা স্ক্রিনে লিখতে অভ্যস্ত। লিখতে লিখতে সেইভ করি আর সঙ্গে সঙ্গে ফ্লপি ডিস্কে সরিয়ে নিই। প্রতিটা অধ্যায় একেকটা ফাইল।”
তিনি বলেন যে কাগজের পৃষ্ঠার মতো আকৃতির স্ক্রিনে লিখাটা তাঁর একটা গৎ হয়ে গেছে। কিন্তু ওগুলো এখন আর তৈরি হয় না। “যে কয়টা পাই আমি কিনে নিই। আমার কাছে এগারোটা আছে,” তিনি বলেন। “আমি বিশ্বাস করি যা কিছু আমাদের কাজকে সহজতর করে যেগুলো কেনা প্রয়োজন। কম্পিউটার সত্যিই অসাধারণ। আমি এটা প্রমাণ করে দেখাতে পারি। আমি কম্পিউটারে লিখতে শুরু করেছিলাম কলেরা মৌসুমে প্রেম দিয়ে। দিনে এক পৃষ্ঠার বদলে দিনে দশ পৃষ্ঠা লিখতে শুরু করি, সাত বছরে একটা বই লিখার বদলে শুরু করি প্রতি তিন বছরে একটা বই লিখতে। তবু লিখা কাজটা দুরূহই থেকে যায়। একটা খালি পৃষ্ঠা থেকে লিখা শুরু করতে গিয়ে সেই একই উদ্বেগ জাগে যেমনটা জাগে সঙ্গমের আগে, ঠিকমতো হবে কি হবে না এ-দুর্ভাবনা সবসময়। এই দুর্ভোগটা সবসময়ই থাকে। বোর্হেস যেমনটা বলতেন: যে-ঈশ্বর দাবার গুটি চালে সেই ঈশ্বরের পিছনে কোন্ ঈশ্বর থাকে?”
তিনি আমাদেরকে বলেন তিনি জানেন যে একজন লেখক বা একজন সাংবাদিকের জন্য সবচেয়ে খারাপ মুহূর্তটা হচ্ছে খালি পৃষ্ঠার মুখোমুখী হওয়া এবং এ-ক্ষেত্রে তাঁর নিজের জন্য যেটা কাজে দিয়ে আসছে সেটা আমাদেরকে জানান, ১৯৫৮ সালে দ্য প্যারিস রিভিউকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে যেটা বলেছিলেন: “যা লিখলে তা পড় এবং, পরে কী ঘটবে সেটা তোমার আগাম জানা থাকা অবস্থায় থাম, তারপর সেখান থেকে এগিয়ে যাও। যতক্ষণ উদ্যম থাকে এবং পরে কী ঘটবে জান ততক্ষণ লিখে যাও, এরপর থাম এবং পরের দিন আবার শুরু করার আগপর্যন্ত বেঁচেবর্তে থাক।
গাবো বলেন, “আমি সকাল সাড়ে আটটা থেকে প্রায় দুপুর দুইটা-তিনটা পর্যন্ত লিখি।” বছরের পর বছর চেয়ারে বসতে বসতে আমার পিঠে ব্যথা হয়ে গেছে; সেজন্য আমি প্রত্যেকদিন টেনিস খেলি। মাঝেমধ্যে পিঠের ব্যথাটা এত বেশি হয় যে আমাকে মেঝের ওপর সটান শুয়ে থাকতে হয়।” সাতটার একটু আগে তিনি তাঁর সাদা ঘড়িটার দিকে তাকান। “তোমাদের জন্য আমি কিন্তু টেনিস খেলা বাদ দেব না,” তিনি বলেন। তিনি উঠে দাঁড়ান আর হেঁটে বেরিয়ে যান।
মঙ্গলবার, এপ্রিল ৯
সকাল ৯:০০টা
আজকে প্রায় পঞ্চাশ বছর হল গাবো তাঁর প্রথম টাইপরাইটারটা হারিয়েছেন— যেটা দিয়ে তিনি তাঁর প্রথম প্রকাশিত গল্প “তেরসেরারে সিগনাসিওন” (তৃতীয় মৃত্যু) লিখতেন। বোগোতার শহরতলির একটা কমদামি হোস্টেলে বাস করা এক অসুখী আইনশিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। ক্যারিবীয় উপকূলের উত্তাপ খুব মিস করত সে। কদাচিৎ ক্লাসে যেত: আইনশিক্ষা, যে-বিষয়ে পড়াটা তার পরিবারের চাওয়া ছিল, তাকে কখনোই টানে নি। ৯ এপ্রিল ১৯৪৮ তারিখের মধ্যাহ্নভোজের সময়ে গাবো খেতে বসতে যাবেন এমন সময় তিনি শুনতে পান যে হোর্হে এলিয়েসের গাইতান্, কোলোম্বিয়ার প্রথাগত রাজনৈতিক কাঠামো যিনি ঝাঁকিয়ে দিচ্ছিলেন, নিহত হয়েছেন।
গাবো আমাদেরকে বলেন তিনি ঐ স্কয়্যারে গিয়েছিলেন “যেসব লোকেরা গাইতানদের রক্তে রুমাল ভিজাচ্ছিল” তাদেরকে খুঁজতে। বোগোতার রাস্তাগুলো পুড়ে গিয়েছিল এবং গাবোর টাইপরাইটার দাবানলের ভিতরে হারিয়ে গিয়েছিল। কোলোম্বিয়া পঙ্গু হয়ে পড়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর নয় মাস পরে, এখানে কার্তেহানায়, উনিশ বছর বয়সে, গাবো সম্পাদকীয় লেখার মধ্য দিয়ে তাঁর সাংবাদিক জীবনের সূচনা করেন।
“একদিন আমি বাইরে হাঁটাহাঁটি করছিলাম এবং সাভালা, এল ইউনিবার্সোল-এর সম্পাদক, স্কয়্যারের বাইরে তাঁর টাইপরাইটার নিয়ে বসেছিলেন। আমাকে বললেন, ‘আমি তোমাকে চিনি।’ বলেন, ‘এল এস্পেক্তাদোর-এর ছোটগল্পগুলোর লেখক তুমি। আমার সঙ্গে বসে এই যে সম্পাদকীয়টা লিখা শেষ করছি সেটাতে আমাকে সাহায্য কর না কেন তুমি?” আমি কিছু একটা লিখলাম। সাবালা তাঁর পেন্সিল বের করলেন এবং কিছু জিনিস কেটে বাদ দিলেন। পরের বার যখন আমি সম্পাদকীয় লিখি তখন তিনি কয়েকটামাত্র জিনিস বাদ দিলেন। তৃতীয় বার নাগাদ আমি সম্পাদনাহীনভাবে লিখতে শুরু করি। আমি সাংবাদিক হয়ে গেলাম।”
তিনি আজকে আমার পাশে বসে আছেন। সাদা গুয়াইয়াবেরা পরেন নি, পরেছেন ফিরোজা রঙের ছোটহাতা শার্ট। জুতা সাদাই। তাঁর সঙ্গে আমার সংযোগ দূরবর্তী মনে হচ্ছে কিন্তু আমি এখনো তাঁর গল্পে মজে আছি। “গল্প লিখে আমি টাকা কামাতে শুরু করি যখন আমার বয়স চুয়াল্লিশ,” তিনি আমাদেরকে বলেন, “প্রথম বাড়ি কিনেছিলাম, যেটা কুয়েরনাবাকা-য়, ১৯৭০ সালের, আমার প্রথম গল্প প্রকাশিত হওয়ার তেইশ বছর পরে। আমি হিসাব করে দেখেছিলাম, আমার ছেলেদেরকে মুভি দেখাতে নিয়ে যাওয়ার জন্য তখন বারো পৃষ্ঠা লিখতে হত আমাকে, এবং মুভি দেখাতে নিয়ে যাওয়া আর আইসক্রিম কিনে দেওয়ার জন্য লিখতে হত বিশ পৃষ্ঠা। যখন প্যারি-তে ছিলাম, একটানা লিখতাম না এবং অধিকাংশ সময় রাতেই লিখতাম। দিনের বেলা পেটে দানাপানি দেওয়া নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকতে হত আমাকে। এখন আমি জানি দিনের বেলায় লেখাই ভালো, কম্পিউটারে, ভরপেটে এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অবস্থায়।”
কফি বিরতি
ফাউন্ডেশনের পরিচালক হাইমে আলবেইয়ো একজন আলোকচিত্রী ঠিক করেছেন এবং আমাদেরকে একটা গ্রুপ ছবি তোলার জন্য জড়ো করেছেন। এই ফাউন্ডেশন কোনো সনদপত্র দেয় না: “জীবন তার নিজের বিচারেই ঠিক করে দেবে কে যোগ্য আর কে যোগ্য নয়,” গাবো বলেছেন। “নিদেনপক্ষে একটা স্মারক হাতে নিয়ে তোমরা সবাই ফিরে যেতে পার,” জেইমে বলেন। “আস, সিঁড়িতে বস।”
গাবো আত্মতৃপ্ত এবং মাঝখানে বসেন। এল ইউনিবার্সোল-এর আলোকচিত্রী আমাদেরকে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে স্মিতহাস্য করবার নির্দেশ দেন।
“রাখেন,” বলে চিৎকার করে ওঠেন কেন্দ্রের পরিচালক। “আমি গাবোর সঙ্গে একটা ছবি তুলতে চাই।” তিনি আমাদেরকে ডিঙিয়ে ওঠেন এবং তাঁর পাশে গিয়ে বসেন।
দুপুর ১:০০টা
এ ছিল অবশ্যম্ভাবী। ফিদেল কাস্ত্রোকে আসতেই হয়েছিল। আমরা, বা বলা উচিৎ আমি, মোক্ষম মুহূর্তটার অপেক্ষায় ছিলাম। নীতি বিষয়ে কথা বলতে চান গাবো: একজন প্রতিবেদকের কি উচিৎ অনুদ্ঘাটিত কোনো নথি পড়া, যেটাতে ‘সবার আগে সর্বশেষ সংবাদ’ করার সুযোগ থাকে?
তাঁর প্রশ্নটা আমাকে একটা সুযোগ করে দেয়। “এ-ধরনের একটা অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল,” আমি বলি। ১৯৯১ সালে গুয়াদালাহারায় অনুষ্ঠিত প্রথম ইবেরো-আমেরিকান প্রেসিডেন্শিয়াল সামিটের উদ্বোধনী সভায় আমি উপস্থিত ছিলাম। কাস্ত্রোকে বলা হয়েছিল প্রত্যেক সম্মানিত বক্তাকে তাঁর বক্তৃতা সাত মিনিট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। সবাই ভয়ে ভয়ে কাস্ত্রোর পালা আসার অপেক্ষায় ছিলেন, কেননা তাঁর দীর্ঘ বক্তৃতার কথা সর্বজনবিদিত। আমরা সবাই ভাবছিলাম কাস্ত্রো, যিনি ১৯৫৯ সালে বিপ্লবে বিজয়ী হওয়ার পরের দিন একটানা সাত ঘণ্টা স্বতঃস্ফূর্ত বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেই নির্দেশনা মেনে চলতে পারবেন কিনা। তিনি কাঁটায় কাঁটায় সাত মিনিট কথা বলেছিলেন। ডোমিনিকান রিপাবলিকের প্রেসিডেন্ট বালাগের কথা বলেছিলেন পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
বিরতির সময় সকল সাংবাদিক, আমিসহ, ফিদেলকে ঘিরে রেখেছিলেন। সশরীরে তিনি জীবনের চাইতে বেশি প্রভাববিস্তারী, এমনকি তাঁর সামরিক পোশাককে একটু রঙ চটে যাওয়া আর তাঁর শার্টের কলারটাকে খুব বেশি ধূসর হয়ে যাওয়া মনে হলেও। তিনি যখন হেঁটে বাইরে গেলেন, ভীড়টাও পিছু পিছু গেল। মনে হল এটা তাঁর ভালো লাগছিল।
“কমান্ড্যান্ট, ভেনসেরেমোস ব্রিগেডে আমি বেত কেটেছিলাম,” একজন সাংবাদিক চিৎকার করে বলল।
তিনি থামলেন এবং কণ্ঠস্বরটা কোন দিক থেকে আসছে খুঁজলেন। “কোথায়?”
ভীড়ের মধ্যে এক মহিলা একটা সাদা-কালো আলোকচিত্র মেলে ধরলেন— তাঁদের দুজনের একটা যৌথ ছবি যখন তাঁর দাঁড়ি কালো ছিল। “আপনি কি এতে স্বাক্ষর করতে পারেন, কমান্ড্যান্ট?”
“সাত মিনিট কথা বলা কি খুব কঠিন ছিল?” অন্য আরেকজন বলে উঠল।
“আমার সঙ্গে চালাকি করা হয়েছিল,” ফিদেল বললেন। “তাঁরা আমাকে বলেছিলেন আমি যদি সাত মিনিটের বেশি কথা বলি তাহলে গুয়াদালাহারার সবগুলো ঘণ্টা বেজে উঠবে।”
যে-হলুদ গদিটার ওপর বসে ছিলেন সেটার পাশে একটুকরো মোচড়ানো কাগজ দেখতে পেলাম। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে ভীড়টা যখন সরে গেল তখন আমি তাঁর আসনের দিকে ফিরে গেলাম এবং কাগজের দলাটা তুলে নিলাম। খুললাম ওটা এবং তাঁর ছোট ছোট দুর্বোধ্য হস্তাক্ষর পড়লাম: “পোর কুয়ানতো তিয়েম্পোহব্রে হাবলাদো?” (আমি কতক্ষণ কথা বলেছি?) বড় খাতাটাতে সব প্রেসিডেন্টের নাম এবং প্রত্যেকে কতক্ষণ কথা বলেছিলেন তার একটা তালিকা করেছিলেন ফিদেল, এক্কেবারে সেকেন্ডের হিসাবসুদ্ধ। চিরকুটটা রেখে দিয়ে আমি চলে আসলাম। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত এটা নিয়ে আমি আফসোস করি।
“আমি অবশ্যই সেটা লুফে নিতাম,” গাবো বলেন। “বিশ্বাস কর, তিনি যদি মনে করতেন ওটা এতই দরকারি, তাহলে তিনি সেটা ওখানে ফেলে আসতেন না। হ্যাঁ, একটা স্মারক হিসাবে আমি সেটা রেখে দিতাম।”
যেমনটা আশা করেছিলাম, ফিদেল কাস্ত্রো সম্পর্কে কথা বলতে শুরু করেন গাবো। কুবা সম্পর্কে মন খুলে কথা বলেন তিনি, আবেগ ও মনোযোগের সঙ্গে, চে গেভারার পোস্টার দেয়ালে সেঁটে রাখা একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের মতো। কিন্তু ফিদেল সম্পর্কে নেতিবাচক, আপসপ্রকাশক বা এমনকি গোপনীয়তা ফাঁস হতে পারে এমন কিছু তিনি বলেন না। “ফিদেল সম্পর্কে আমি যতটা বলি বিবেচনাবোধ থেকে তার বেশি বলি আবেগ থেকে। পৃথিবীতে আমি যাদেরকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি তিনি তাঁদের মধ্যে একজন।”
“একটা স্বৈরাচারী,” কেউ একজন বলে।
“গণতন্ত্রী হওয়ার একমাত্র পথ নির্বাচন অনুষ্ঠান নয়।”
দলের মধ্যের আমেরিকান সাংবাদিকটি তাঁর সঙ্গে লেগে থাকে। গাবো তার কথার উত্তর দিতে শুরু করেন, কিন্তু খেয়াল করেন যে আমরা সব টুকে নিচ্ছি। তাঁর কণ্ঠ কঠোর হয়ে ওঠে: “এটা কোনো সাক্ষাৎকার না। আমি যদি ফিদেল সম্পর্কে আমার মতামত প্রকাশ করতে চাই, তাহলে আমি নিজেই সেটা লিখব এবং বিশ্বাস কর, আমি তোমাদের চেয়ে ভালো করেই লিখব।”
হয়তো আমাদের সঙ্গে দাঁত কিড়মিড় করে কথা বলার কারণে এক ধরনের অপরাধবোধ থেকেই, ফিদেল সম্পর্কে তাঁর লেখা একটা বৃত্তান্তের বর্ণনা দেন তিনি। “এটা আমি তাঁকে পড়তে দিয়েছিলাম। এতে, সমালোচনামুখর ছিলাম আমি। মুক্ত প্রেস পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছিলাম। কিন্তু সে-বিষয়ে তিনি কিছুই বলেন নি। যেটা তাঁকে সবচেয়ে বেশি বিরক্ত করেছিল সেটা হল, আমি আমার নিবন্ধে উল্লেখ করেছিলাম তিনি প্রতিদিন মধ্যাহ্নভোজের পর আঠারো গোল্লা আইসক্রিম খেতেন। ‘আমি কি সত্যিই আঠারো গোল্লা আইসক্রিম খেয়েছিলাম?’ তিনি আমাকে বারবার জিজ্ঞেস করেছিলেন।”
মধ্যাহ্নভোজের পরে
“তোমার সিগোরোদো সফর সম্পর্কে আমাদেরকে বল।” গাবো রুবেন বালেন্সিয়ার উদ্দেশে বলছেন।
সিগোরোদো হচ্ছে কোলোম্বিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক অঞ্চল উরাবার একটা গ্রাম— অর্থাৎ পৃথিবীর সবচেয়ে সহিংস হিসাবে বর্ণিত একটা দেশের অন্তর্গত। কোলোম্বিয়ার পশ্চিম তীরবর্তী উরাবা উপসাগর হল একটা ভৌগোলিক মলটভ ককটেল। এতে আছে দেশের সবচেয়ে উর্বর ভূমি; এটা অস্ত্র ঢোকার আর মাদকদ্রব্য বের হওয়ার পথ; গরিব চাষা আর ধনাঢ্য জমিদাররা এখানে আছে; আছে গেরিলা দল, সামরিক বাহিনী আর মরণপ্রতিজ্ঞ সংঘ। গত বছর নিহত হয় এক হাজার মানুষ, রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার। সংবাদপত্রের একটা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাইশ বছর বয়সী এক ঘাতক ইতোমধ্যে তিরাশি জন লোককে খুন করেছে। ১৯৯৫ সালের আগস্ট মাসে একটা নাচঘরে খুন হয় আঠারো জন মানুষ। এ-ধরনের ধ্বংসলীলা প্রায়ই ঘটে।
আমার মনে হত রুবেন সিগোরোদো সফর করার পাত্র না। মুখের অনুপাতে অতিরিক্ত বড় চারকোণা চশমা পরা হাড্ডিসার একটা তরুণ সে, চশমার ওপরে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন এত বেশি চেপেছে যে তার চোখগুলো একেবারে পিচ্চি দেখাচ্ছে। “আমি সেখানে গিয়েছিলাম,” সে বলে, “ঐ অঞ্চলের মানুষের ওপর সহিংসতার প্রভাব বিষয়ে লিখতে, গল্পের মানবিক চেহারাটা খুঁজতে।”
যে-লেখাটা সে প্রকাশ করেছিল সেটা কর্মশালায় সে যেটা জমা দিয়েছিল সেটাই। গাবোর হাতে ধরা আছে ওটা। “তুমি গিয়ে পৌঁছানোর পর থেকে যা যা ঘটেছিল সব আমাদেরকে বল। প্রথম যার সঙ্গে কথা বলেছিলে সে কে?” তিনি জিজ্ঞেস করেন।
“শহরটা ছিল জনশূন্য, মায়েস্ত্রো। বারো বছর বয়সী একটা বাচ্চার দেখা পেয়েছিলাম, তাকে জিজ্ঞেস করলাম ঐ নাচঘরটা সে চেনে কিনা এবং সে আমাকে ওখানে নিয়ে গিয়েছিল। ধ্বংসলীলার পর ঘটেছিল একটা অভিনিষ্ক্রমণের ঘটনা, সব কিষাণেরা ভয়ে পালিয়েছিল।” বালেন্সিয়া আমাদেরকে বলে, কথা বলার মতো কাউকে খুঁজে ফিরছিল সে, কিন্তু খুঁজে পেয়েছিল কেবল আতঙ্ক আর নৈঃশব্দ্য। মোটরসাইকেল আরোহী এক মহিলা থেমেছিলেন এবং তাকে এগিয়ে দিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছিলেন আপারতাদো পর্যন্ত, বৃষ্টির সময়ে প্রায় আধঘণ্টার পথ, যেখানে সে আরো কিছু তথ্য পেতে পারে। হোটেল লাস মোলাস-এ উঠেছিল সে। তৃতীয় দিনে একজন সাক্ষাৎপ্রার্থী লবিতে তার জন্য অপেক্ষা করছিল।
“আপনিই কি সেই লোক যে ধ্বংসলীলাটার তদন্ত করছে?” আগন্তুক লোকটা তাকে জিজ্ঞেস করেছিল।
“চলেন বের হই আর কিছু পান করি। আমার মনে হয় আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান।”
“দুঃখিত,” বালেন্সিয়া উত্তর দিয়েছিল। “বড্ড দেরি হয়ে গেছে। সন্ধ্যা নামার পরে আমি বের হই না। আপনি কি আমার রুমে আসতে চান?” রুমে আসার পরে একসময় লোকটা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “আপনি কী খুঁজে পেলেন? কী জানতে চান আপনি?”
“আমি একজন সাংবাদিক, এই সংঘর্ষটার মানবিক চেহারাটা খুঁজছি আমি।”
“ও, হ্যাঁ।”
“কে আপনি?” বালেন্সিয়া শেষ পর্যন্ত তাকে জিজ্ঞেস করেছিল।
“আমি একজন ফেরেশতা,” লোকটি বলেছিলেন।
“কী ধরনের ফেরেশতা”
“একটা শাদা ও একটাকালো ডানাওয়ালা ফেরেশতা”
“আর, আপনি আমার সঙ্গে কোন ডানাটা নিয়ে কথা বলবেন?”
“সেটা নির্ভর করে”
“কীসের ওপর?”
বালেন্সিয়া যখন কথা বলে, আমরা সবাই চুপ হয়ে থাকি, তার গল্পে বুঁদ হই। কেমন জানি ঈর্ষা লাগছে আমার, কী এক গল্পইনা এটা!
“কিন্তু এখানে আমি যেটা পড়েছি সেটাতো এটা নয়,” লেখাটা তুলে ধরে গাবো বলেন। “ঐ গল্পটাই কেন তুমি লিখলে না? এইমাত্র আমাদেরকে যেভাবে গল্পটা বললে সেভাবেই কেন গল্পটা লিখ নি তুমি? আমিতো ঐ গল্পটাই লিখতাম।
“ঐ লোকটার বর্ণনা দাও,” তার দিকে তাকিয়ে গাবো বলেন।
রুবেন চুপ করে থাকে।
“ঐ লোকটার চেহারা কি তুমি মনে করতে পার?”
“হ্যাঁ।”
“তার চেহারা দেখে তোমার কোন প্রাণীর কথা মনে পড়েছিল?”
“একটা ইগুয়ানা”
“হ্যাঁ এইতো, আর কিছুর দরকার নাই,” গাবো বলেন। “পুরো ট্রিপটাই তুমি নষ্ট করেছ, বেটা। আমরা সমাজতত্ত্ববিদ নই, আমরা গল্পবলিয়ে, আমরা মানুষের গল্প বলি। মানবিক কণ্ঠস্বর নিয়ে প্রতিবেদন করাটা একজন সাংবাদিককে বড় করে তোলে। সেই গল্প কোথায়?”
রুবেন, যে কিনা গার্সিয়া মার্কেসকে জোর গলায় মায়েস্ত্রো বলে ডাকে, উত্তর দেয় “এটা সহজ না। সেই গল্প আমি যখনই লিখতে যাই আমার সম্পাদক আমাকে বলেন, ‘বালেন্সিয়া, তুমি গার্সিয়া মার্কেস নও। তথ্য আঁকড়ে থাকো!’
বিকেল ৩:০০টা
“দাসা, তুমি কেন তোমার কোনো একটা লেখা আমাদেরকে পড়ে শোনাও না?” গাবো জিজ্ঞেস করেন। আমি অধৈর্য হচ্ছি। দিন প্রায় শেষ। কর্মশালা প্রায় শেষ, এবং গাবো আমার লেখাটা নিয়ে একটা টুঁশব্দও করেন নি। আমি যেহেতু কুবা নিয়ে লিখেছিলাম, তাই আমি মনে করেছিলাম তিনি বিশেষ আগ্রহ দেখাবেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটা পড়েছেন বলে উল্লেখ পর্যন্ত করেন নি। দাসা লিখেছে মেদেয়িনের আন্ডারগ্রাউন্ডের এক চরিত্র নিয়ে— এমন এক লোকের বৃত্তান্ত যিনি মানুষের চাইতে পশুপাখির সাহচর্য বেশি পছন্দ করেন। তিনি তাঁর নিত্যদিনের বুনেয়েলা, একধরনের ভাজা বড়া, তাঁর একমাত্র খাবার, ভাগ করে খান একটা পোষা ইঁদুরের সঙ্গে। তিনি একটা মুরগিছানাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে হাঁটান এবং ঘরে মক্ষিকা পালেন। দাজা এটা আমাদেরকে পড়ে শোনায়। লেখাটা মর্মস্পর্শী, এর শৈলী গীতিময়, বোধ হয় একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই গীতিময়। প্রথাগত রিপোর্টাজ এটা নয়। “আমি দাসার লেখায় হাত দেব না,” গাবো বলেন, “এখানে হয়তো সে নতুন কোনো আঙ্গিক আবিষ্কারে রত, এমন একটা আঙ্গিক যেটার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না।”
তিনি লেখাটাকে ভালো কি মন্দ ভেবেছিলেন, আমরা জানি না।
দাসা শুধু তার লেখার শৈলীর দিক থেকেই দুঃসাহসী নয়। সেই একমাত্র ছেলে যে কিছুটা অবজ্ঞা দেখিয়েছিল: “গাবো খানিকটা আত্মসর্বস্ব।”
দাসাকে পাঠানো হয়েছিল ইবেরো-আমেরিকান প্রেসিডেন্সিয়াল সামিট কাভার করতে, যেটা ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কার্তাহেনায়। প্রতিবেদকেরা ক্ষেপেছিল, কারণ সভার ব্যক্তিবর্গের সাক্ষাৎকার নেওয়াটা ছিল অসম্ভব। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে গাবো একটা প্রতিনিধি দলের অন্তর্ভুক্ত অতিথি ছিলেন। অনুষ্ঠানের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল গাবো বলেছিলেন অভিযোগ না করে বরং সাংবাদিকদের উচিৎ স্টোরির জন্য পথে বের হওয়া এবং তাদেরকে রুপোর থালায় করে খবর হাতে এনে দেওয়া হবে এমনটা আশা না করা। প্রেসিডেন্টদেরকে পাওয়া না গেলে একজন সাংবাদিক অন্যত্র স্টোরি খুঁজে নেবেন।
দাসা তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলে, “ঐ কথা বলা আপনার জন্য সহজ। এমন মন্তব্য যে আমার কতখানি হতাশাজনক মনে হয়েছিল, বিশেষ করে আপনার কাছ থেকে, সেটা নিয়ে আমি একটা স্টোরি লিখেছিলাম। আমি বলতে চাচ্ছি, আপনি ওখানে ছিলেন, দরজার ওপাশে, সব রাষ্ট্রপতির সঙ্গে।
“ওখানে একজন কর্তব্যরত সাংবাদিক হিসাবে তো আমি ছিলাম না।”
দাসা স্বীকার করে গাবোর তিরস্কারটা কাজে এসেছিল। সে একটা বিবরণ দেয়: গত বছর কার্তাহেনায় অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের সম্মেলন কাভার করতে যখন তাকে পাঠানো হয়েছিল, সে তখন নেতৃবৃন্দ যেখানে সমাবেশ করছিলেন সেই সম্মেলনকক্ষে যায় নি। সম্মেলনে উপস্থিত ইয়াসির আরাফাত এবং ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘর্ষ বিষয়ে লিখার জন্য সে বরঞ্চ গিয়েছিল কার্তাহেনার অসংখ্য দরিদ্র বস্তির একটায়— এমন একটায় যেটার নাম সত্যি সত্যি পালেস্তিনা। আরাফাতের সঙ্গে পালেস্তিনায় বসবাসরত এক মেয়ের অবস্থার তুলনা করে সে একটা স্টোরি লিখেছিল, যে-মেয়েটি একটি ধনাঢ্য, পর্যটকভর্তি শহরের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রান্তিকায়িত।
গাবো বলেন, “তুমি শিক্ষাটা নিয়েছো।”
“আপনিও তো ঐ সম্মেলনে ছিলেন।” দাজা নাছোড়বান্দা। “আপনি কুবার অতিথিদের সঙ্গে ওখানে ছিলেন।”
“আমি ওখানে ছিলাম,” গাবো অসহিষ্ণুভাবে বলেন, “আমি ওখানে ছিলাম, কারণ তখন একটা কানকথা শোনা যাচ্ছিল যে ফিদেলকে মেরে ফেলা হবে। এবং কুবার নিরাপত্তারক্ষীরা ফিদেলকে সেই মিছিলে যেতে দিচ্ছিল না বলে আমি তাঁর সঙ্গে সেই ঘোড়ার গাড়িতে বসতে গিয়েছিলাম। ওদেরকে আমি বলেছিলাম এই কোলোম্বিয়ায় আমি যেখানে বসব সেখানে কেউ গুলি করবে না। তাই চেপেচুপে আমরা পাঁচজন এক গাড়িতেই বসেছিলাম, ঠেসেঠুসে, মজা করতে করতে। ফিদেলকে আমি যখন বলছিলাম কিচ্ছুটি হবে না, তখন ঘোড়াটা সত্যিই হেলেদুলে চলতে শুরু করে দিল।”
নৈশভোজ
তিনি আমাদের সঙ্গে রাতের খাবার খাচ্ছেন কার্তাহেনার সবচেয়ে কসমোপলিটান রেস্তোরাঁ লা ভিট্রোলা-য়। সাজসজ্জা যতটা না স্প্যানিশ তার চেয়ে বেশি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক, কিন্তু সাদা পোশাকপরা সঙ্গীতদল গায় ঐতিহ্যবাহী সোনে। এটা সেই জায়গা যেখানে কোলোম্বিয়ার উচ্চবিত্তরা অবকাশযাপনের সময় খায়, রাষ্ট্রপতি পান করার জন্য থামেন। সোপ অপেরার তারকারা, খুদে কিন্তু জবড়জং মাদক-কারবারিরা, ধনীর দুলাল-দুলালী তাদের প্রথম অভিসারে, আর কিছু স্থানীয় উচ্চাভিলাষী নয়াচাকুরেও আসে। ন্যুইয়র্কেও রেস্তোরাঁর মতো আহার্য ফর্দ। সুগন্ধিসির্কা দিয়ে তৈরি সালাদোপচার, তরতাজা মোজারেলা এবং মদ, কলম্বিয়ার মানে, উত্তম।
ছোট্ট একটা কামরায় বসি আমরা এবং ফলের শরবতে চুমুক দিতে দিতে অপেক্ষা করি। নাভি থেকে বুক পর্যন্ত চেইন টানা গাঢ় নীল রঙের জাম্পস্যুট পরে গাবো আসেন। দিনের বেলায় যিনি ক্যারিবীয় পুরুষ ছিলেন, রাত নামতেই তাঁকে মনে হয় যেন কোনো একটা ফাঙ্ক বা ডিস্কো অ্যালবামের প্রচ্ছদ থেকে এইমাত্র লাফিয়ে নেমে এসেছেন। তাঁর জুতাজোড়া হুবহু আজকে সকালেরগুলোর একই মডেলের, কিন্তু এখনকারগুলো ছাইরঙা। উয়েইটারকে ডেকে একটা হুইস্কি দিতে বলেন। দরজার পাশের প্রাইভেট কামরায় চলে যাই আমরা। তিনি বসেন আন্দ্রেয়া আর আমার মাঝখানে।
খাবারের মেন্যু আগে থেকে ঠিক করা: নারিকেলের সস দেওয়া চিংড়ি অথবা ক্রিম দেওয়া স্ন্যাপারের পর ভাজা জুকিনি। “রাতে খাওয়ার পক্ষে এটা আমার জন্য বেশ ভারী” গাবো অনুযোগ করেন।
হোস্ট আসেন এদিকে। “আপনাদেরকে সস ছাড়া পোড়ানো স্ন্যাপার দিতে পারি? অথবা পাস্তা?”
“কী রকম?” “আপনারা কীরকম চান?”
“সাদাসিধা”
“ব্রোদো দেওয়া পাস্তা কেমন হয়?”
“পাক্কা! আমার জন্য ঐটা আনো”
আমি জানতে চাই আমিও একই খাবার খেতে পারি কিনা; সারাদিন জ্বরজ্বর লেগেছে আমার।
“ঐ খাবার দুইটা আনো”, গাবো তাকে বলেন।
ওয়াইন দেওয়া হলে, তিনি তা খেতে রাজি হন না এবং হুইস্কিই খেতে থাকেন।
রেস্তোরাঁ ভরে যাচ্ছে। আমাদের টেবিলটা স্পষ্ট দেখা যায়। সবাই গাবোকে খেয়াল করে। দরজাটা বন্ধ করে দিতে বলেন তিনি, এবং আমি ওয়েইটারকে তা করতে বলি। গাবোর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য নিউজউইক-এর যে-সাংবাদিক বুয়েনোস আইরেস থেকে এসেছেন, তিনি আমার বামপাশে বসা। কিছুক্ষণ উনার সঙ্গে কথা বলি, কিন্তু আমি আসলে গাবোর সঙ্গেই কথা বলতে চাই, তাঁর সঙ্গে ফিসফাস করি, আমার সহকর্মীদেরকে তাঁর ভাগ দিই না।
আমি তাঁর দিকে ফিরি। নানা বিষয়ে কথা বলেন তিনি। জানতে চান কেন এবং ন্যুইয়র্কের কোথায় আমি থাকি। বলি আমি গ্রামে থাকি এবং জানতে চাই তিনি ন্যুইয়র্ক পছন্দ করেন কিনা। খুব পছন্দ করেন তিনি কিন্তু অতিরিক্ত শীতের সময় না, কারণ রাস্তায় হাঁটা ছাড়া আর কিছুই করতে পছন্দ করেন না তিনি। বলি তাঁকে গ্রামে বেড়াতে নিয়ে যাব এবং তিনি কথা দেন ফোন করবেন। আমরা কথা বলি কুবা বিষয়ে, বার্রানকিইয়া নিয়ে, বিল ক্লিনটন সম্পর্কে, দ্য ন্যুইয়র্কার আর রোববারের পত্রিকাগুলো নিয়ে। খুঁটিনাটি বর্ণনা দিয়ে একটা গল্পের কথা বলেন যেটা তিনি লিখতে চান এবং তাঁর একটা হলুদ শার্টের কথা বলেন যেটা তিনি প্রেমে পড়লে পরেন। তাঁর গ্লাস খালি, তাই তিনি আমারটা থেকে পান করেন। “আমি নারীদের সঙ্গে থাকতে পছন্দ করি। পুরুষদের চেয়ে তাদেরকে আমি বেশি চিনি। তাদের সঙ্গে থাকতেই আমি বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি; আমি নারীসঙ্গেই বড় হয়েছি।”
ওয়েইটার এগিয়ে আসে এবং গাবোর হাতে একটা শাদা রুমাল দেয়, ভাঁজ করা। সেটা খোলেন তিনি এবং এর ওপর যা লেখা আছে পড়েন। ওয়েইটারকে কিছু বলতে মানা করেন। প্রত্যেকেই যে তাঁর কাছ থেকে কিছু কিছু চায়, এটা হয়তো খুব কষ্টকর। তাঁর একটা বন্ধুর কথা বলেছিলেন একটু আগে, যিনি সাংসদ হতে চান, তাঁর কাছে ফোন করেছিলেন। “গাবো, তুমি আমার সম্পর্কে কিছু লিখ, কিছু বল, এমনকি যদি সেটা আমাকে অপমান করার জন্যও হয়।”
দরজা খুলে যায় এবং একটা লোক ভিতরে উঁকি দেন। গাবো চোখ তুলে তাকান, উঠে দাঁড়ান আর, দুই হাত মেলে ধরে সামনে আগান। “আহ, ম আমি, কেল কোয়েঁসিদঁস।” আমার মনে হয় এটাই সেই লোক যিনি রুমালের ওপর লিখে তাঁর কাছে চিরকুট পাঠিয়েছিলেন। আবার যখন এসে বসেন তখন তিনি আমার কানে ফিসফিস করে বলেন, “আমি স্রেফ ঐ জানলাটা দিয়েপালিয়ে যেতে চাই।”
বুধবার, এপ্রিল ১০
সকাল ৯:৩০টা
আবারো টেবিলের এক মাথায় বসে আছেন গাবো, পাণ্ডুলিপি ধরনের কিছু একটা থেকে পড়ে শোনাচ্ছেন, সবাই আসার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি জানেন গতকাল ক্লাসের সবাই রাতের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। যারা সবার পরে গিয়েছিল তাদেরকে দেরিতে আসতে দেখে মজা পান তিনি, বোধ হয় কোনো স্মৃতিকাতরতার ইশারা থাকে এতে। মনে হচ্ছে সবাই ঘুমকাতুরে, গোসল করে নি, অতিরিক্ত মদ্যপানের দরুন মাথাব্যথায় বিরক্ত। সাদা বসনে তাঁকে শুচিশুভ্র দেখাচ্ছে।
আমি টেবিলের অন্য প্রান্তে বসি এবং ভাবি আমাকে উদ্বিগ্ন রাখার জন্যই তিনি আমার লেখাটার কথা এখন পর্যন্ত উল্লেখই করেন নি। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে এগোচ্ছে, একঘণ্টা কেটে গেল, এবং এখনো আলোচনা হচ্ছে কার্তাহেনায় অভিযুক্ত এক মহিলার ওপর করা তাদেরো-র স্টোরিটা নিয়ে, এইচআইভি পজিটিভ হওয়ার কারণে যে-মহিলাকে শাস্তিভোগ করতে দেওয়া হয় নি। “এখানের মধ্যে সবচেয়ে ভালো গল্প ছিল তোমারটা,” গাবো বলেন, “কিন্তু এটা বলতে গিয়ে তুমি খেই হারিয়ে ফেলেছো; এইটার কোনো মাথামুণ্ডু দাঁড়ায় নি।”
অবশেষে তিনি আমার দিকে তাকান। প্রথমে যখন তিনি আমার পাশে বসেছিলেন তখনকার চেয়ে আমি এখন কম নার্ভাস কিন্তু আমার বুক ঢিপঢিপ করেই যাচ্ছে।
“সঙ্গীতে ভালো সমঝদারি আছে আছে সিলবানার,” গাবো বলেন। “আমার মতো সেও পছন্দ করে ভ্যান মরিসন।”
আমার লেখাটা কুবা-য় তরুণ সঙ্গীতশিল্পীদেরকে যেসব প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় সেগুলো নিয়ে, যেখানে রাষ্ট্র তাদেরকে সহযোগিতা করে না আর বেসরকারি উদ্যোগ অসম্ভব। আমি লিখেছিলাম তারহীন গিটারওয়ালা এক সংগ্রামশীল ট্রুবাডারকে নিয়ে যার কণ্ঠকে আমি ভ্যান মরিসনের মতো বলে বর্ণনা করেছি।
“সিলবানা একটা ভালো লেখা লিখেছে, সুগঠিত। আমার কিছুই পাল্টানোর নেই এটাতে,” গাবো বলেন। তবে তিনি আমার দেওয়া কিছু বর্ণনার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন: “এ-কথা বলা কি খুব দরকার যে টেলিভিশন নষ্ট, এটাসাদা-কালো আর এইটা ঠিক করাবার পয়সা নাই? কার্তাহেনায় এই মুহূর্তে এমন অনেক পরিবার আছে যাদের আর্থিক সঙ্গতি কম এবং টেলিভিশন রঙিন নয়। কুবা-র ব্যাপারে না হলে তুমি কি এ-কথাটা লিখতে?”
ঘুরেফিরে কুবা সরকারের সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে আমাদের আলাপ চলতে থাকে। “আমি ওদের সঙ্গে অনেকবার কথা বলেছি,” কথাটা তিনি এমনভাবে বলেন যেন তাঁর কথা তারা শোনে নি বলে তাঁর খারাপ লাগছে। এরপর তিনি উঠে দাঁড়ান, আমার দিকে হেঁটে আসেন এবং আমার লেখাটা আমার হাতে দেন। আর কারো সঙ্গে এটা তিনি করেন নি।
নিজের আসনে ফিরে যান তিনি। আমার পা মাটি স্পর্শ করছে না। নিজেকে মনে হচ্ছে রেমেদিয়োস দ্য বিউটি— শুন্যে ভাসছি আমি।
শেষ কথা বলার রয়ে গেছে গাবোর: “তোমাদেরকে দেখি আমি— তোমাদের ভয়ের মধ্যে, তোমাদের দ্বিধা-সংশয়ের ভিতরে, তোমাদের জিজ্ঞাসুতায়, মনে পড়ে যায় আমি যখন তোমাদের বয়সী ছিলাম তখন আমার কেমন লাগতো। আমার অভিজ্ঞতাগুলো তোমাদেরকে বলায় নিজেকেও দেখতে পেরেছি আমি। যাই হোক, পঞ্চাশ বছর হতে চলল আমি লিখতে শুরু করেছি— আমার জীবনের প্রত্যেকটা দিন লিখেছি। কাজটা তোমার ভালো না লাগলে ইস্তফা দাও। ওরা মনে করে নিজের ভালো লাগে এমন কাজ করার ফলেই কেবল মানুষের মৃত্যু হয়। তুমি যদি তোমার কাজকে ভালোবাস, তাহলে দীর্ঘায়ু এবং সুখ অবশ্যম্ভাবী।
সবাই তাঁর কাছে বায়না নিয়ে লাইন ধরে। নিঃসঙ্গতার একশ বছর, একটি পূর্বঘোষিত মৃত্যুর কালপঞ্জি, কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না সবগুলোর কপিতে সই করা লাগবে। তিনি লিখে দেন সবগুলোতে, আর প্রত্যেকের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করেন। রুবন বালেন্সিয়া কুলপতির শরৎ-এর একটা কপি তাঁর হাতে দেয়। যার প্রতি তাঁর এতটা সম্মানবোধ আর ভালোবাসা তাকে তিনি কী লিখতে পারেন, সেটা জানার জন্য কৌতূহলী হয়ে বালেন্সিয়াকে বলি ওকে লেখা তাঁর অভিলেখটা আমাকে দেখাতে। এতে লেখা: “কুলপতি থেকে ওয়ার্কশপে।” সেসার রোমেরো চায় নবজাতকের জন্য তার বইটা সই করিয়ে নিতে। গাবো লিখেন: “রোদ্রিগোর জন্য, যখন তুমি শুরু করছ।”
তাঁর কাছ থেকে সই করিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো বই আমি আনি নি। আমি দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকি। যখন তিনি আমাকে দেখেন তখন সেই মুচকি হাসিটা দেন যেমন দুষ্টুমিভরা হাসি হেসেছিলেন এই রুমে প্রথমবার ঢোকার সময়। “আর তুমি, সিলবানা, এটা শেষ হয়ে গেল বলে মন খারাপ না তোমার?
কেঁদে ফেলবে না তুমি?”
[Silvana Paternostro-র লিখা ‘Three Days with Gabo’ নিবন্ধটি প্রথম ছাপা হয় The Paris Review পত্রিকায়, ১৯৯৬ সালের শীত সংখ্যায়। পরে ২০০৩ সালে প্রকাশিত Latin American Writers at Work: The Paris Review সঙ্কলনেও স্থান পায় এই লেখা। এর বঙ্গানুবাদ ‘গাবোর সঙ্গে তিন দিন’ মুদ্রিত হয় আলীম আজিজ, দিলওয়ার হাসান, ধ্রুব এষ ও রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী সম্পাদিত সিন্দাবাদ পত্রিকার ‘গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সংখ্যা’য়, ২০১০ সালে। The Business Standard পত্রিকার আলীম আজিজ সম্পাদিত ‘ইজেল’ পাতায় দুই কিস্তিতে প্রথম দুই দিনের অংশ বৈপ্রকাশিত হয় ১লা ও ১০ই জুলাই ২০২০ তারিখে। সিলবানা পাতের্নোস্ত্রো কর্তৃক ইংরেজি ভাষায় রচিত Three Days with Gabo নিবন্ধের এহসানুল কবির-কৃত বাঙলা তর্জমার পুরোটা প্রথমবারের মত (শ্রী হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বঙ্গীয় শব্দকোষ অনুসৃত চারবাক-এর বানান রীতির পরিবর্তে তর্জমাকারীর বানান রীতিতে) বৈপ্রকাশিত হল চারবাক-এর বৈদ্যুতিন সংস্করণে।]
(ছবি— আলোকচিত্রী: কার্লি ব্রান্সউইক। ২৬ জুলাই ২০১২। ভিক্টোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া।)
এহসানুল কবির
ভাষাতাত্ত্বিক ও অনুবাদক। জন্ম ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ, কক্সবাজার। বর্তমান নিবাস মেলবোর্ন। সাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব, অনুবাদ প্রভৃতি বিষয়ে প্রবন্ধ লিখে থাকেন। সম্পাদিত স্যাটায়ার অণুকাগজ গুরুচণ্ডাল । সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘বিশদ বাঙলা’র ঘরোয়া কাগজ বিশদ সংবাদ এর নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। কাঠামোবাদ, উত্তর কাঠামোবাদ ও রলাঁ বার্থ শিরোনামে বক্তৃতা করেছেন ‘বিশদ বাঙলা’ থেকে বিবর্তিত প্রতিষ্ঠান ‘বিস্তার : চিটাগাং আর্ট কম্প্লেক্স’ এর ডাকে সাড়া দিয়ে। ‘প্র্যাক্সিস : নিউ রিডার্স সোসাইটি’র আমন্ত্রণে চিন্তামূলক গদ্যের বঙ্গানুবাদ : সীমাবদ্ধতা ও সম্ভাবনা শীর্ষক আলাপে রেখেছেন মূল আলোচকের ভূমিকা। অনুবাদভিত্তিক সাহিত্যপত্র সিন্দাবাদ এর ‘মারিয়ো বার্গাস ইয়োসা’ সংখ্যার অতিথি সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আগুনখোলা, উলুখাগড়া, কথা, উত্তরাধিকার (নব পর্যায়), কালি ও কলম, আর্টস্ (বিডি নিউজ ২৪), সত্যজিৎচর্চা, প্রথম আলো”, পোনামাছের ঝাঁক সহ নানান মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন মাধ্যমে প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।