আলোচনা: ঞ প্রসঙ্গ || খোন্দকার শাহিদুল হক

0

কতিপয় গানের পাখী একত্রিত হয়েছে মাতৃভাষার বিপর্য্যয়রোধকল্পে আলোচনার জন্য। আলোচনা সভায় ময়না, টিয়া, টুনটুনি, শ্যামা, কোকিল, বুলবুলি, ফুলঝুরি, খঞ্জন, ফুটফুটি, কমলাবউ, বেনেবউ, নীলটুনি, মুনিরা, দুধরাজ, ফটিকজল, সহেলিসহ আরো অনেকেই উপস্থিত হয়েছে। আজকের আলোচনা সভার সভাপতিত্ব করছেন, বাংলার জাতীয় পাখী দোয়েল। পরিচালনায় আছে মিষ্টি মেয়ে টুনটুনি। প্রথমে মুক্ত আলোচনাকালে অনেকেই বলল, এভাবে মাতৃভাষার বিপর্য্যয় চলতে থাকলে তারা মনের দুঃখে গান গাওয়া ছেড়ে দেবে। দোয়েল বলল, আমি জানি মাতৃভাষার বিপর্য্যয়ের কথা শুনে সকলেরই মন খারাপ। কিন্ত সব জেনে-শুনে মন খারাপ করে বসে থাকলে চলবে না। যেভাবে বছর বছর বাংলা ভাষাকে বিকৃত করা হচ্ছে তার একটা বিহিত করতে না পারলে খুবই ক্ষতির আশংকা রয়েছে। তবু মাথা ঠাণ্ডা রেখে গঠনমূলক আলোচনার মাধ্যমে এর একটা প্রতিকার করতেই হবে। মাতৃভাষার সকল দায় কেবল বাংলা একাডেমীর উপর এককভাবে ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে চলবে না। মাকে রক্ষা করার দায়িত্ব প্রতিটি সন্তানেরই রয়েছে। সুতরাং এই দায়িত্ব পালনের বিষয়ে প্রথমে আমাদের পুরোপুরি সচেতন হতে হবে।

টিয়ে বলল, তা তো অবশ্যই। তবে সরকারিভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকেই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। হয়ত তারা না জেনে, না বুঝেই ভারতের বাংলা আকাদেমীকে অনুসরণ করতে গিয়ে আমাদের বাংলাভাষাকে ভুলপথে পরিচালিত করছে।

টুনটুনি বলল, আমাদের মূল সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করা দরকার। যারা এ বিষয়ে জানে তাদের কথা বলা উচিৎ। তবে একজনের কথা বলা শেষ না হলে অন্য কেউ যেন কথা না বলে।

বেনেবউ দাঁড়িয়ে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল, আমরা জেনেছি বা শিখেছি যে, চ ছ জ ঝ এর পূর্ব্বে নাসিক্য ধ্বনির প্রয়োজন হলে সর্ব্বদা ঞ হবে। এভাবে প্রত্যেকটি বর্গের শেষে পঞ্চবর্গীয় বর্ণটিই বর্গভুক্ত বর্ণের প্রথমে রেখে শব্দের সঠিক বানান লিখতে হবে। এক বর্গের বর্ণ অন্য বর্গের পূর্ব্বে বসলে তাতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। যেমন ক খ গ ঘ এর পূর্ব্বে তদানুযায়ী ঙ বসবে। কিন্তু বাংলা একাডেমী কর্ত্তৃক প্রকাশিত বাংলা একাডেমী আধুনিক বাংলা অভিধানে (প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০১৬) বর্ণিত নিয়ম অনুসারে বিদেশী শব্দের ক্ষেত্রে ঞ ব্যবহার চলবে না। অতৎসম শব্দের ক্ষেত্রে ঞ না লিখে ন লিখতে হবে। যেমন পূর্ব্বে লেখা হত ইঞ্জিল অথচ এখন থেকে লিখতে হবে ইনজিল। ইঞ্চি হবে ইনচি। ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যাবে ইনজিনিয়ার। এবার আপনারা বলুন, তারা আমাদের ঘাড়ে কী ভয়ংকর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে। তারা হয়ত ঞ বর্ণটাকে ক্রমান্বয়ে হত্যা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।

টিয়া বলল, আমাদের জানা উচিৎ বাংলা বর্ণগুলোকে কোন্ পদ্ধতিতে সাজানো হয়েছে। আর আমরা তা জানতে পারলেই কেবল সঠিকভাবে লিখতে পারব, বলতে পারব এবং বুঝতেও পারব। আমাদের আরও জানতে হবে প্রত্যেকটি বর্ণের নিজস্ব একটা অর্থ আছে এবং তার ক্রিয়াও আছে। চ ছ জ ঝ এর পূর্ব্বে নাসিক্য বর্ণের প্রয়োজন হলে সকলক্ষেত্রে ঞ দিলেই ঝামেলা শেষ। এ নিয়ে বিতর্কসৃষ্টির কোন কারণ নেই। অথচ তারা এখানেও তৎসম আর অতৎসম এর বিভেদ টেনে আনছে। তাদের এই অপতৎপরতা রুখতেই হবে। তা না হলে আমরা পিছনের দিকে তাকালে কিছুই দেখতে পারব না।

মুনিরা টিয়ার কথার মর্মার্থ বুঝে খুবই ব্যথিত হল। বলল, সমস্যা এতটা গভীরে পৌঁছেছে তা তো আমি জানতাম না। আমরা নিশ্চয় সকলেই জানি, চ বর্গের আওতাভুক্ত প্রত্যেকটি বর্ণের নিজস্ব একটি অর্থ আছে। যেমন: চ-তে চয়ন, ছ-তে চয়নস্থিতি। জ-তে জনন এবং ঝ-তে জননস্থিতি। ঞ-তে চায়ীরহস্য। বাংলা একাডেমীর মহাপণ্ডিতদের যদি এই চায়ীরহস্য সম্পর্কে জ্ঞান না থাকে তবে তো তারা তাদের ইচ্ছেমতোই বিধি-বিধান জারী করতে থাকবে। ফলে মাতৃভাষার ধ্বংস অনিবার্য্য হয়ে উঠবে।

দুধরাজ বলল, মুনিরা তুমি ঠিকই বলেছ, চ বর্ণটি চ অন ক্রিয়ার ধারক। চ-য়ের একদিকে রয়েছে চাওয়া এবং অপরদিকে রয়েছে চাওয়া পুরণের আকাঙ্ক্ষা। দুটির যোগফলে চ-অন হয়। সুতরাং চ বর্ণে চয়নেচ্ছা, চয়নেচ্ছু, চয়নেচ্ছায় কারী, চয়নেচ্ছায় গামী চয়নেচ্ছায় ধাবক, চয়নেচ্ছায় ধারী, চয়নেচ্ছায় ধারক, চয়নেচ্ছায় ভ্রামক প্রভৃতি সত্তাগুলি সবই চ পদবাচ্য। যেমন চঞ্চল শব্দটি ভাঙলে পাব, চঞ্চ বা চয়নেচ্ছা রহস্যময় রূপে চলে যাতে; অথবা কাকে কখন কোথায় কীভাবে চয়ন করবে সে বিষয় স্থির করতে না পেরে যে মুহূর্মুহু দিক পরিবর্ত্তন করে এদিক ওদিক চলতে থাকে। আর ল-য়ে ঐ চেতনা লালিত হয়। এখন যদি এই চঞ্চল থেকে ঞ-টাকে সরিয়ে দিয়ে ন দেওয়া হয় তাহলে আর তার অর্থ ঠিক থাকবে না।

শালিক বলল, দুধরাজ তুমিও ঠিক বলেছ। চ-য়ের চয়ন ছাদিত অর্থাৎ আচ্ছাদিত যেথায় অথবা চয়নাদি(চ) আচ্ছাদিত যাতে কিংবা, আস্তরণরূপে ছাদনেচ্ছা এবং ভেনরূপে ছিদনেচ্ছাদি থাকে যাতে তাকেই ছ বলে। সহজ করে বললে বলতে হয় চ-য়ের আশ্রয়স্থলকে বা চ-কে যে আশ্রয় দেয় বা চ যেখানে আশ্রয় প্রাপ্ত হয় তাকে ছ বলে। যেমন ছল শব্দটিকে ভাঙলে আমরা পাবো ছ ও ল। ছ-য়ে আচ্ছাদন আর ল-য়ে লালিত। সুতরাং আত্মস্বরূপ যেখানে আচ্ছাদিত রেখে ভাব প্রকাশ করা হয় তাকে ছল বলে। ছলে প্রকৃত তথ্য থাকে না। সুতরাং ছল দ্বারা প্রতারিত হতে হয়। আবার ছ-য়ের আধারকে ছা বলে। আত্মজ যেখানে আচ্ছাদিত থাকে।

ফটিকজলও বাংলা একাডেমীর বিতর্কিত সিদ্ধান্তে ব্যথিত। ফটিকজল বলল, আমিও জানি যে, জ-তে জনন ক্রিয়া থাকে। অর্থাৎ জনিত বা জাত অথবা স্বরূপ ও স্বগুণকে আপন হতে চয়ন করে বহির্গত করে যে তাকে জ বলে। জন শব্দটিকে ভাঙলে আমরা পাব জ ও ন। জ-তে জনন এবং ন-তে অনকৃত। জননক্রিয়া চলমান যেখানে কিংবা যে নিজেকে বা অন্য কোন বিষয়কে জনন বা উৎপাদন করে বা করতে পারে । এককথায় যাকে আমরা ব্যক্তিমানুষ বুঝে থাকি তাকে জন বলে।

নীলটুনি বলল, আমিও জানি যে, ঝ-য়ে জননস্থিতি যাতে অর্থাৎ যে জনন থেকে উৎপন্ন শব্দ ঝংকার করে যেখানে আশ্রয় প্রাপ্ত হয় তাকে ঝ বলে। মূলত ঝ বর্ণে জনিত হয়ে স্থিত হওয়া বুঝায়।

শ্যামা বললো, এসব আমরা বুঝলে তো হবে না। বুঝতে হবে বাংলাভাষাকে যারা লালন-পালন করার জন্য নিয়োজিত তাদেরকে। তারা যদি না বোঝে তবে মহান ভাষা শহীদের আত্মত্যাগের গৌরব ক্ষুণ্ন হবে। তাদের আত্মা আমাদের ক্ষমা করবে না।

কোকিল বলল, দোয়েল, আমাদের জাতীয় পাখী। তিনি আমাদের সভাপতিও বটে। জাতির কাছে তার একটা গুরুত্ব আছে। সুতরাং দোয়েল যদি এ বিষয়ে একটা উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে তাহলে বাংলা ভাষা নিয়ে যে ছিনিমিনি খেলা চলছে তা হয়ত কিছুটা প্রশমিত হতে পারে। অন্যথায় এই অবস্থা চলতে থাকলে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে যাবে। পাকিস্তানের পশুরা বাংলাভাষার ক্ষতি করতে চেয়ে যতটা ক্ষতি করতে পারেনি আজ আমরা তার চেয়েও বেশি ক্ষতি করছি। দেশের সকলের ধারণা, একটা কিছু লিখলেই হল। তাতে ভুল হবে না। সুতরাং এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না।

সকলেই সমস্বরে সমর্থন ব্যক্ত করে জানালো, কোন অবস্থায় বাংলাভাষার তথা মাতৃভাষার বিকৃতি মেনে নেওয়া হবে না। যদি কোন পরিবর্ত্তন আনতে হয় তাহলে কেন পরিবর্ত্তন করা হচ্ছে তার সঠিক ব্যাখ্যা জাতির সামনে তুলে ধরে সকলের মতামত নিতে হবে।

তাদের দীর্ঘ আলোচনা শেষে সিদ্ধান্ত হল, আজকের আলোচিত বিষয়গুলো জাতির সামনে মতামতের জন্য তুলে ধরা হবে। সকলের মতামত নিয়ে পরবর্ত্তীতে আরো বিশদভাবে আলোচনা করে যথাযথ প্রতিকার পাওয়ার জন্য যথাযথ কর্ত্তৃপক্ষ বরাবরে গানের পাখীদের পক্ষ থেকে আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি একটি স্মারকলিপি পেশ করা হবে।

আজ আর কোন আলোচনা না থাকায় সভাপতি সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

.

.

.

21083055_1532469283480091_9035127846267060223_oখোন্দকার শাহিদুল হক
জন্ম : ফেব্রুয়ারী, ২৮, ১৯৬৪খ্রি.। প্রশাসনিক কর্ম্মকর্ত্তা, জেলাপ্রশাসকের কার্য্যালয়, গাজীপুর, বাংলাদেশ।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার