[আলোচ্য শব্দ: মর, অমর, গুণ, নির্গুণ, দগ্ধ, বিদগ্ধ, উত্তীর্ণ, অবতীর্ণ, উর্ব্বশী/ঊর্ব্বশী, মোঘ, অমোঘ, দৃষ্ট, অদৃষ্ট, জল, জলজ্যান্ত]
মর, অমর—
মর: সীমায়িত করে রাখা হয় যাহাতে। মরণশীল, মর্ত্ত্য, মানব, প্রাণত্যাগ করা, মৃতবৎ বা নির্জীব হওয়া, ব্যথিত হওয়া, কমিয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
মর শব্দের অর্থ হল ম (সীমায়িত) রহে যাহাতে। মরা ক্রিয়াটির ভিতরে সত্তার সীমায়িত রূপ থাকে। জীবিত মানুষ সঙ্কুচিত হয়, সীমায়িত হয়ে ঢুকে যেখানে তাই শবদেহ।
মরণ— মর অন (on) যেখানে। মরণ দুইটি ক্রিয়াকে বুঝায়— সত্তার সীমায়িত করণ ও সীমায়িত করে রাখন। দুধকে জ্বাল দিতে দিতে সঙ্কুচিত করে ক্ষীর তৈরি হয়, সেই দুধ আসলে মরে (সীমায়িত) গিয়ে ক্ষীর তৈরি হয়। জীব মরে গিয়ে সীমায়িত হতে হতে বিলু্প্ত হয়, আর প্রাণ ফিরে আসে না। মরা যখন মাটিতে গড়ায় তখন হয় মড়া। আমরা যখন বলি “ঘাটের মড়া”— তখন বুঝতে হবে এই মরা dead body নয়। আবার যখন বলি— “মরণ! কী বলে বুঝি না” তখন এই মরণ death অর্থে নয়। ল্যাটিন mori ক্রিয়ামূল (= মরে যাওয়া), তথা ল্যাটিন সূত্রে পাওয়া ইংরেজি শব্দ mortal (= মরণশীল), immortal প্রভৃতি।
অমর: নেই মরণ যাহাতে, মৃত্যহীন। জন্মিলে মরিতে হইবে— অমোঘ সত্য। তারপরও বলি আমরা, তিনি অমর হয়ে রইবেন ইতিহাসে। মহৎ ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে আমরা বলি— তিনি অমর হয়ে থাকবেন আমাদের মাঝে। এই অমর হয়ে থাকাটা কী?
ব্যাক্তি তাঁর স্বীয় কার্য্যকলাপের মাধ্যমে বেঁচে থাকেন। মানুষ তিনভাবে অমর হন। ১। তার সন্তানের মাধ্যমে। ২। তার উৎপাদিত পণ্যের মাধ্যমে। ৩। মানসজাত, সাংস্কৃতিক উৎপন্নের মাধ্যমে।
সন্তানের মাধ্যমে মানুষ বেঁচে থাকে যতদিন তার বংশধারা থাকে।
মানুষ তার মন শ্রম ও মেধা প্রয়োগ করে যা তৈরি করে, তা বিনষ্ট না হওয়া পর্য্যন্ত তৈরিকৃত বস্তুর মাধ্যমে বেঁচে থাকে। একজন জ্ঞানী আবিষ্কারক তাঁর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকেন। একজন গুরু বেঁচে থাকেন তাঁর শিষ্যের মাধ্যমে। মানুষের দেহের মৃত্যু হয়, কিন্তু তাঁর কৃতকাজের মাধ্যমে মানুষ বেঁচে থাকেন, অমরত্ব লাভ করেন। তাই মরে গিয়েও মানুষ অমর হয়ে থাকেন।
গুণ, নির্গুণ—
গুণ: ইংরেজিতে যাকে Quality বলে বাংলায় তাকেই বুঝি গুণ যা কোনও সত্তার দক্ষতা, প্রকৃতি, শ্রেষ্টত্ব, স্বভাব, চরিত্র, ধর্ম্ম ইত্যাদিকে প্রকাশ করে। এই গুণ যার থাকে তিনি সাধারণ থেকে কিছুটা পৃথক, তাঁকে আমরা বলি গুণী।
গুণ = গু-এর (নবরূপে উত্তীর্ণ গামীর) রহস্যময়তা (বোধ বা জ্ঞান থাকে) যাহাতে। / যাহা আমন্ত্রণ করে, যাহার দ্বারা বন্ধন সাধিত হয়। (ব.শ)
গুণ এর অনেক অর্থ আছে, তবে সব অর্থ প্রচলিত নয়। যে অর্থগুলো অধিক প্রচলিত সেগুলো হল— ধর্ম্ম, ভাব, শ্রেষ্ঠতা, রজ্জু, দড়ি, ধনুকের ছিলা, নৌকা টানার দড়ি, তাঁত, তার, গুণক পূরণ, পৈতা ইত্যাদি। তবে সাধারণত স্বীকৃত অর্থ হিসেবে Quality, Multiply বুঝাতেই ব্যবহৃত হয়।
‘ণ’ বর্ণটি ং-এর রহস্যরূপ। এই রূপটি বোঝা যায় না, কেবল অনুমান করা যায়। যেমন গণ হল গামীর রহস্যময়তা থাকে যাহাতে। এই রহস্যরূপ গামীদেরকে একত্রিত করে ধরে রাখে। আবার গুণ এর বেলায় রহস্যরূপটি থাকে নবরূপে উত্তীর্ণ গামীর। নৌকায় যে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় এতে নৌকার গতিশীলতা গুণটি দড়িতে নবরূপে উত্তীর্ণ, যার ফলে গুণ ধরে টানতে থাকলে নৌকার চলার বেগ বৃদ্ধি পায়।
আমাদের জ্ঞানী পূর্ব্বপুরুষগণ দেহীমাত্রের গুণ বা অস্তিত্বের মূলসূত্রকে দেখতে পেরেছিলেন যা ধরে টান মারলে বা ঠেলা মারলে দেহী আকৃষ্ঠ বা নিগৃহীত হয়।
এই গুণকে বুঝতে পারলে আমরা গণনা করা, গণ্য করা, গুণ করা (পূরণ) গুণ করা (অস্তিত্বের মূলসূত্র যে গুণ) তার সবই বুঝতে পারি।
গণ যখন যায়, তখন এক এক করে যায়— শুরু হয়ে যায় গণের অন হতে থাকা বা গণনা। এই গণনা শেষে মাথায় যে সংখ্যাটি আসে তা রহস্যময় কারণ এটি এমন একটি সংখ্যা যা সত্য আবার সত্য নয়। সত্য কারণ এটি গণ এর গণনফল, মিথ্যা কারণ এটি গণ নয়।
এই যে ধারণা তা অনন্ত শক্তিধর সূত্র। এটি গামী নয়, এ হল গামীদের একটি সূত্র, গামীদের এক গুণ, নবরূপে উত্তীর্ণ গামীর রহস্যময়তা। এই গুণ ধরে টান মারলে সকল গামীরা তাতে এসে যায় গুণফল হিসেবে। এরকম দুই গুণ ধরে টান মারলে এসে যাবে সকল গামীদের হাতের গুণফল, আর বিশ গুণ ধরে টান মারলে এসে যাবে সকল গামীদের আঙ্গুলের গুণফল।
নির্গুণ: নির্গত গুণ যাহা হইতে, যাহার কোনো গুণ নাই অথবা এত গুণ যে তাহার তুলনা হয় না। আমরা সাধারণভাবে বুঝি যার গুণ নাই সেই নির্গুণ— আসলে ব্যপারটি কেবল তা নয়। নির্গুণ একটি অতি উচ্চমানের ব্যপার।নির্গুণ ও গুণহীন আদৌ এক বিষয় নয়। যদি কারও কাছে ১০০ টাকা থাকে তবে তা দিয়ে সে ১০০ টাকার জিনিস কিনতে পারবে, তার অর্থ ওই ১০০ টাকার নোটে ১০০ টাকার জিনিস কেনার মত গুণ আছে। যদি অবুঝ শিশু বা পাগলের কাছে ওই ১০০ টাকার নোট থাকে তবে তার কী গুণ বা মূল্য!
যে পড়তে পারে তার কাছে একটি বই মূল্যবান হতে পারে যদি সে তা থেকে নির্য্যাস নিতে পারে, এক্ষেত্রে সে ওই বই থেকে যা পড়ে বুঝতে পারবে তার কাছে ওই বইটির গুণ ততটুকুই। একজন পড়া না জানা মানুষের কাছে, শিশু কিংবা পাগলের কাছে তার গুণ বা মূল্য কী! আবার ব্ল্যাংক চেক একটি শিশু বা পাগলের কাছে গুণহীন, কিন্তু কারও কাছে এটির অশেষ গুণ। এটিই আসলে নির্গুণ। সেই চেকে যত টাকা লেখা হবে, চেকটির গুণ হবে তত। আর টাকার ঘরে ফাঁকা রেখে সই করা হলে তা হবে নির্গুণ। কাজেই ব্ল্যাংক চেককে শূন্য বলে মনে হলেও তা হল শক্তিপূর্ণ শূন্যতা। একেই বলে নির্গুণ।
দগ্ধ, বিদগ্ধ—
পোড়ে গেলে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়, তা শুকিয়ে গেলেও চিহ্ন থেকে যায়। সেই চিহ্নকে বলে দাগ। যে দাগ দেয় সে দাগী বা দাগাবাজ, আর যা দেয় তা হল দাগা। এই দাগা শরীরে, মনে, এমনকি সম্পদেও দিতে পারে। দাগাবাজ যে দাগা দেয়, তা মানুষের শরীর মন দুটোই পোড়ায়, আবার শত্রুপক্ষকে পরাজিত করতে কামানও দাগা হয়। যে ভাবেই পোড়াক না কেন তা দহন, দহন দগ্ধ করে। যে পোড়ে সে দগ্ধ হয়, আবার বিশেষ ভাবে দগ্ধ হলে হয় বিদগ্ধ। অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে বিদগ্ধ ব্যক্তি বলা হয়। কারণ অভিজ্ঞতার আগুনে পুড়ে পুড়ে তাঁর মন বিশেষ ভাবে দগ্ধ হয়, তাঁর মন পরিপক্ব হয়। কাজেই বিদগ্ধ মানে অভিজ্ঞ ব্যক্তি, পণ্ডিত ব্যক্তিকে আজকাল বিদগ্ধ বলা হয়, যা আসলে বিদগ্ধ শব্দের প্রকৃত অর্থ নয়।
উত্তীর্ণ, অবতীর্ণ—
পরীক্ষার খাতায় ঠিকমত উত্তর দিলে পরর্বত্তী শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়া যায়। একজন ছাত্রের ক্ষেত্রে উত্তীর্ণ হওয়া নির্ভর করে খাতায় উত্তর লেখার উপর (এই উত্তীর্ণ কেবল উত্তীর্ণ হওয়া বুঝাতে ব্যাবহৃত)। কর্ম্মক্ষেত্রে একজন পরবর্ত্তী পদে পদোন্নতি পাওয়ার দাবী রাখেন যদি তার উত্তর (এক্ষেত্রে কাজের দক্ষতা), কেউ তার ভাগ্যকে যদি ইতিবাচক দিকে পরিবর্ত্তন করেন, তবে তাঁর অবস্থার উত্তরণ ঘটে। কাজেই উত্তরণ হলে উত্তীর্ণ হয়, ফলে আগে যা ছিল তার সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান হয়, বিকাশ হয়, বৈপ্লবিক পরিবর্ত্তন হয়, নবরূপে উত্তীর্ণ হয়। উত্তর কথার ক্ষেত্রে আগে ছিল আনীত অভিযোগ খণ্ডানোর জন্য অভিযুক্তের যথাযথ প্রত্যুত্তর, এখন সে মানে বদলে গেছে। উত্তরণ = যেমন কেউ পাহাড় বেয়ে উপরে উঠছে। অবতরণ = কেউ পাহাড় বেয়ে নীচে নামছে। সন্তরণ = কেউ সমতলে হেঁটে যাচ্ছে। সন্তরণ। সম্ + তরণ = সন্তরণ। পানি তার আধারের সর্ব্বত্র সমান ভাবে থাকে, সেজন্য পানিতে সাঁতার কাটা সন্তরণ। * অবতীর্ণ— অ (না) বহন যাহাতে হয়, হয় সে স্থির, নয় নিম্নদিকে যায়। অবতীর্ণ – অব (নিম্ন) স্থানে তীর্ণ যে। * উত্তীর্ণ— উত্থিত হইয়া তীর্ণ। * তীর্ণ— তীর (বাণ) এর ন্যায় দূরে গিয়া পড়ে।
উর্ব্বশী/ঊর্ব্বশী—
উরু (প্রবলশক্তি), ঊরু (সম্পদবান)। উরু বা ঊরুকে বশ করেন যিনি, মহাপুরুষকে বশ করেন যিনি। অপরূপ লাবণ্যময়ী স্বর্গের অপ্সরা। পৌরাণিক অভিধানে উর্ব্বশী/ঊর্ব্বশী বিষয়ে বর্ণনা আছে। ক্রিয়া যখন উর্ হবে তখন “উপরে রহন”, উর বলতে তাকে বোঝায় যে উপরে রহে। উপরে যে রয়, তার বল বা শক্তি রয়েছে বলতে হবে। উর এর আধার ঊর। উর নবরূপে উত্তীর্ণ হয় উরুতে, তখন শক্তি হয় প্রবলশক্তি। সেই উরুকে যিনি বশ করেন তিনি উর্ব্বশী। আবার ঊর্ণ ক্রিয়া হলে যাহাকে ঢেকে রাখা হয় তা ঊরু, জানুর উপরিভাগ। যেমন সুদখোর বা মজুতদার তার সম্পদ ঢেকে রাখে। প্রবলশক্তিকে বশ করে উর্ব্বশী, আর সম্পদবানকে বশ করে ঊর্ব্বশী। দুটো বানানই সঠিক, দুটোই শক্তিকে ধারণ করে। এই শক্তি পার্থিব ভূমিতে সার, মানবশরীরে মেধা, আর সমাজশরীরে পুঁজির সুদশক্তি। বৈশ্যরা যখন যৌথসমাজের আয়-ব্যয়ের হিসেব রাখত, বিতরণকারী ছিল, তখন তাদের ভেতর আদি ফেরিওলা বা দোকানদারের সৃষ্টি হয়। এই দোকানদার উর্ব্বশী, আবার বৈশ্যরা যখন ব্যক্তিমালিক হয়ে যান, তখন তারা হন ঊর্ব্বশী।
মোঘ, অমোঘ—
মোঘ: ব্যর্থ, নিষ্ফল, ত্যক্ত, দীন, প্রাচীন, প্রাচীর, নিরর্থক, বৃথা। মোঘযুক্ত অনেক শব্দ ছিল আমাদের, যেগুলো এখন অপ্রচলিত।
মোঘ = মোহ-তে গত ও স্থিত যে। মোহ = মুহ্-এর সার্ব্বিক আশ্রয়। মোহ অর্থ চিত্তবৈকল্য, অবিবেক। মোহ মোহিত করে, আকৃষ্ট করে, অভিভূত করে। সত্তার সীমায়িত রূপটি পাল্টে গিয়ে বেরিয়ে আসে যে পথ দিয়ে, সেটাই মুহ (হিন্দীতে মুখকে মুহ বলে)।
অমোঘ: অব্যর্থ, উৎপাদনশীল, অক্ষীণ, যথার্থ, সার্থক, বিষ্ণু, শিব। অমোঘ = যে মোঘ (মোহতে গত ও স্থিত) নয়, সত্য সঙ্কল্প যার (ব.শ)। অমোঘ এর আধার অমোঘা। অমোঘা শিবপত্নী, অমোঘার কাহিনীতে ব্রহ্মপুত্র নদ নামক জলধারা সৃষ্টির কথা আছে। প্রকৃতপক্ষে এই জলধারা হল মানসলোকে জন্ম নেয়া অদৃশ্য জ্ঞানধারা।
দৃষ্ট, অদৃষ্ট—
কোনও বস্তুকে যদি দশ দিক থেকে দশ জন একইরকম দেখতে পায় তবে বুঝতে হবে বস্তুটি থেকে আলোকশক্তির বিচ্ছুরণ একইসময়ে সমানভাবে সবদিকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। অর্থাৎ দৃ (আলোকদাতার আবর্ত্তমান) শ্ (সার্ব্বিক শক্তিবিচ্ছুরণ) হচ্ছে, এই দৃশ থাকে যেখানে তাই দৃশ্য। আর দৃশ্য যেখানে নাই তাই অদৃশ্য। দৃশ্য যখন স্বচ্ছ হয়, পরিষ্কার দেখা যায় চোখ দিয়ে বা মানসচক্ষে তখনই দৃষ্ট হয়, আর যখন অসচ্ছ হয় তখন তা কোন ভাবেই দৃষ্ট হয় না, তখন তা হয় অদৃষ্ট।
অদৃষ্ট বলতে আমরা কপাল বলি, ভাগ্য বলি। কপালের লেখা না যায় দেখা। আবার ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন। কারণ অদৃষ্ট যে অজানা থাকে। আদিম যৌথযুগে ভাগে যা পাওয়া যেত তাকেই ভাগ্য বলা হত। কারণ তখন ভাগটা স্বচ্ছ হত, দেখা যেত। এখন সময় বদলেছে, ভাগের টা পাওয়া দূরের কথা, ভাগ আছে কিনা তাও বুঝা মুস্কিল। বরং ভাগটা চাইতে গেলে বলে, যা ভাগ! দূর হ! এজন্য ভাগ্য এখন অদৃষ্ট।
জল—
কিছু কিছু শব্দ আছে যেগুলো ভাল লাগে তেমন একটি শব্দ হচ্ছে জল।
কবিতায়, গানে জল শব্দটি খুব বেশীই ব্যবহৃত হয়। জল কী! জল = জন্য লালিত হয় যাহাতে। জন্য হল জনন থাকে যাহাতে; জ্ অন করে যে, জ বর্ণ।…
যেখানে জনন থাকে না তা হল অজ।
জল = বারি, অশ্রু, দ্রব, রস, চাকচিক্য, দীপ্তি, সুগন্ধী দ্রব্যবিশেষ, পূর্ব্বাষাঢ়ানক্ষত্র, বৃষ্টি, সুপ্রবেশ, জলবৎ তাপনাশক দ্রব্য। পুরাণাদিতে বহুস্থানে জল শব্দটি জনসাধারণ বুঝাতে ব্যবহার হয়েছে। এখনও আমরা তাই জনগণের জমায়েতকে সাথে তুলনা করে বলি জনসমুদ্র। জলে যেমন স্রোত থাকে তেমনি চলমান জনগণকে বলি জনস্রোত। আবার এই জলেই থাকে (জনসাধারণের মাঝে) টাকার কুমির, ঘোড়েল, রাঘববোয়াল, রুইকাতলা। জলে থাকা প্রাণীদের সাথে স্বভাব অনুযায়ী সমাজে বাস করা জনগণকে নামকরণ করা থেকে আমরা বুঝতে পারি জল শব্দের অর্থ। প্রাচীন কালে জল শব্দ দ্বারা জনগণের আবেগময় যৌথতা বুঝানো হত। জলের তিনটি রূপ— তরল বায়বীয় কঠিন। বায়বীয় রূপটি মেঘ হয়ে আকাশে ভাসে। প্রাচীনকালে যে নেতৃস্থানীয় লোকেরা সমাজের উপরের স্তরে উঠে সম্পদ বন্টন করত, শাসন করত, তাদের বলা হত গর্জ্জনকারী মেঘ।
আর যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা অপরিবর্ত্তনীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে জনগণের উপর চেপে বসে তাকে বলা হত হিমালয়। তাই জল বলতে যেমন জনন-লালনকারী শ্রমিক-কর্মী জনমজুর বোঝায়, তেমনি ইংরেজি water- কেও বোঝায়।
√জল (আচ্ছাদন) + অন্ = জল, ছাত্রবোধ অভিধান। সে অনুযায়ী জলের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হয়— “আচ্ছাদন করে যে”। জলের মাঝে হারায়— লোকটি জনসমুদ্রে হারিয়ে গেল,আর খুঁজে পাওয়া গেল না। মানুষ জলের ভিতর (জনসাধারণের) ভিতরে আত্মগোপন করে আত্মরক্ষা করে, যেভাবে রাজনৈতিক কর্মীরা অনেক সময় আন্ডারগ্রাউন্ডে যান। জল সমতা পছন্দ করে, শান্ত জলের উপরিভাগ তাই সমান থাকে। জনগণও সমতা পছন্দ করেন, সমান থাকা পছন্দ করেন। কিন্তু যারা ধনী, নিজেকে অভিজাত প্রমাণ করতে চান তারা সাম্যতা পছন্দ করেন না, নিজেকে জলের ঢেউয়ের মত একটু উপরে রাখতে সুখবোধ করেন, তাদের জলি বলে, জল যেখানে গতিশীল তাই জলি। ইংরেজি jolly শব্দটি হচ্ছে জলির উত্তরাধিকার।
জল হল জনগণ। গান আছে, ‘আমি জলের কাছে প্রশ্ন করি, হারিয়ে যাও কেন! জল বলে, আমার স্বভাব এই তো।” মানুষও তো জলের মতই হারিয়ে যায়, কারণ মানুষের স্বভাব-ও তাই, কারণ জলের স্বভাবের সাথে মানুষের স্বভাবের মিল রয়েছে। আদিম যৌথ সমাজে জনসাধারণকে ‘জল’ বলা হত।
সেই জনসাধারণের মধ্যে যাদের ব্যক্তিগত সম্পদ নিতান্তই কম ছিল, তাদের বলা হত চুনোপুঁটি। যাদের যথেষ্ট সম্পদ ছিল, তাদের বলা হত ‘রুই-কাৎলা।
যারা অন্যের সম্পদ হরণ করে সঞ্চয় করত তাদের বলা হত ‘রাঘব-বোয়াল’।
যাদের সম্পদ অন্যদের জন্য বিপজ্জনক ছিল, তাদের বলা হত ঘোড়েল বা ঘড়িয়াল। এবং যারা পুরো সমাজেরই (কুম্ভের) মালিক ছিল তাদের বলা কুম্ভীর বা কুমীর। নগদ-নারায়ণ বা পুঁজি হল মৎস্যাবতার। মৎস্য হল দু’রকম। ব্যক্তিমালিক-মৎস্য ও জলচর-মৎস্য। যখন ব্যক্তিমালিকানাধীন মৎস্যদের ব্যক্তিমালিকানা ভোগের উপর বাঁধা নিষেধ এল যে কোনও সম্পদ ব্যক্তিমালিকানায় ভোগ করা যাবে না, অর্থাৎ সম্পদ (মৎস্য) একা ভোগ করা যাবে না, তখন মৎস্যভক্ষণ নিষিদ্ধ হল। মানসিক ও দৈহিক উভয়প্রকারে মৎস্যভক্ষণ নিষিদ্ধ হয়ে মানুষ নিরামিষভোজী হল। পরবর্তীতে আবার কেউ বাহ্যিক মৎস্য ভক্ষণ করত, আবার মানসিকভাবেও মৎস্য (জ্ঞান সাধনা, ধন সম্পদের সাধনা) ভক্ষণ করত। মৎস্য— আমার অস্তিত্ব থাকে যাহাতে।
মালিকানাবোধ, এটি আমার— এই বোধ, আমার বোধ থাকে যে মানুষের।
মানুষ পরিশ্রম করে যা অর্জ্জন করে (জ্ঞান, ধনসম্পদ) তাতে তার মালিকানা জন্মায়। তখন আমিত্ববোধ সক্রিয় হয়। আবার অন্যের অর্জ্জন দেখলে যদি ‘কেউ’ নিজের মালিকানার বিষয়ে সচেতন হয়, যা সে অর্জ্জন করেনি বা তার মালিকানায় নেই— তখন সেই ‘কেউ’ মাৎসর্য্যে ভোগে। পরগুণ-দোষ খুঁজে।
যাই হোক আমরা বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ থেকেই পাই একটি মাত্র শব্দ ক্রিয়াকে ধারণ করে কত বিবিধ শব্দ আর অর্থ প্রকাশ করে। জলে যেমন চুনোপুঁটি বাস করে, তেমন কুমীরও বাস করে। কুমীরের দাপটে চুনোপুঁটিরা অসহায়, আবার কুমীর চুনোপুঁটিদের দিয়েই কাজ সারে, নিজেরা থাকে ধরাছোয়ার বাইরে।
জলজ্যান্ত—
জলে জীবন্ত থাকে যা, তাই জলজ্যান্ত। জল ছাড়া মরে যাবে তাই শিঙি, মাগুর, কই, টাকি, টেংরা… এসব মাছকে জলাশয় থেকে তুলে এনে জালার মাঝে রাখা হয়, যেন এগুলো জীবিত থাকে। সাধারণত এ মাছগুলি রুগীর পথ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কেন পথ্য? অন্য মাছ নয় কেন? এর কারণ কি এই যে এগুলো পথ্য হিসেবে খুব ভাল কিংবা এগুলো খেলে রক্ত বাড়বে!!
আসলে তা নয়। এই মাছগুলোর টিকে থাকার ক্ষমতা কিছুটা বেশী। তাই জল থেকে তুলে এনে এসব মাছকে জালায় রাখা হয় এবং এগুলো এভাবেও বেশিদিন বেঁচে থাকতে সক্ষম। সেজন্য সহজপ্রাপ্যতার সুবিধার জন্য এগুলো পথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু জালার জলে রাখা সত্ত্বেও এগুলোকে জলজ্যান্ত মাছ আমরা বলি না, বলি জিওল মাছ। তাহলে জলজ্যান্ত কথাটি কোথায় আছে? জলজ্যান্ত কথাটি জনসাধারণের মধ্যে জিওল মাছের মত জ্যান্ত আছে।জনসাধারণের মধ্যে জীবিত অর্থে জলজ্যান্ত কথাটি শব্দোৎপাদনকারীরা তৈরি করেছিলেন।
এজন্যই কেউ ডাহা মিথ্যে বললে বলা হয় জলজ্যান্ত মিথ্যে কথা। কেউ লাপাত্তা হলে বলে, “জলজ্যান্ত মানুষটা লাপাত্তা হয়ে গেল”। যে ঘটনা সবার চোখের সামনে ঘটেছিল এবং মনে আছে তা হল জলজ্যান্ত ঘটনা।
তেমনি জলজ্যান্ত সত্যি, জলজ্যান্ত ব্যাপার ইত্যাদি। শব্দের যাদু— জল থেকে জলজ্যান্ত, দুটো ভিন্ন হলেও মূলে গেলে কোথায় যেন সূক্ষ্ম মিল পাওয়া যায়।
সূত্র— বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ-এর আলোকে।