করোনা নিয়ে যে হারে ‘গুজব’ ছড়াচ্ছে তা দেখে ক্লাসে এসেই খান সাহেব বলে বসলেন, “তোরা কেউ কোন গুজব ছড়াবি না, গুজবে কান দিবি না, গুজব ছড়ানো মস্ত অপরাধ।”
“গুজব শব্দে ‘গু’ কেন?” আচার্য্য খানমশাইকে প্রশ্ন করে বসলেন বাংলা এম.এ. শ্রেণীর ছাত্রী মহিমা।
সদালাপী, মিষ্টভাষী অধ্যাপক খান মশাই বললেন, “মা এই প্রথম বেলা মানে ফার্ষ্ট পিরিয়ডেই আমাকে ‘গু’ ঘাঁটা করাবি? তোদের তো বলেছি বাংলা ভাষার মতো এত বিজ্ঞানভিত্তিক, যুক্তিসম্মত ভাষা বর্ত্তমানে আর দ্বিতীয়টি নেই। যারা ছিল সংস্কৃত, ল্যাটিন, গ্রীক, হিব্রু তারা প্রায় বিলুপ্ত হতে বসেছে। ঠিক জিনিসের ঠিক নামকরণ বাংলাভাষার এক দারুণ বৈশিষ্ট্য। বাঙালী কখনো কানা ছেলেকে পদ্মলোচন বলত না। নামের সঙ্গে নামীর একটা সম্পর্ক প্রাচীন বাংলায় বরাবরই ছিল। বর্ত্তমানে ইংরেজী শব্দের আদলে আমরা বাংলা শব্দকে বুঝতে গিয়ে বাংলার সেই পরম্পরাগত জ্ঞানকে হারিয়ে ফেলছি।
তোরা তো জানিস প্রাচীন বাংলা ছিল ক্রিয়াভিত্তিক ভাষা। যে যেমন কাজ করবে তার তেমন নামকরণ হবে। এছাড়া বাংলার প্রতিটি বর্ণও এক একটি ক্রিয়াকে সূচিত করে। সেই হিসেবে ‘গুজব’ শব্দটি যে চারটি বর্ণ নিয়ে তৈরী তারা কী কী বলত?”
— আচার্য্যদেব তারা হল গ, উ, জ আর ব বলল মহিমা।
— এবার বলত মা বাংলা ‘গ’ বর্ণের অর্থ কী?
— “গমন করা” গুরুদেব।
— ‘উ’ বর্ণের অর্থ?
— ঊর্ধ্বে উঠে আমূল পরিবর্ত্তন করা বা নবরূপে উত্তীর্ণ হওয়া।
— তাহলে গ + উ = গু শব্দের অর্থ কী দাঁড়ালো?
— গমনকারী বা গামী নবরূপে উত্তীর্ণ যাতে।
— ঠিক বলেছিস মা। আমাদের শরীরে খাবারের গমন মূলত শক্তি তৈরীর জন্য। কিন্তু তার পুরোটা শক্তি উৎপাদন না করে কিছুটা নতুন রূপ পেয়ে ‘গু’ হয়ে যায়। শরীর একে বর্জ্জন করে শান্তি পায়। কিন্তু খাবার তো শুধু শরীরেরই লাগে না, মনেরও লাগে, সমাজেরও লাগে। মনের ক্ষেত্রে এই খাবার বা খোরাক হলো ‘খবর’। খবরও এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। তাই সেও গামী। কিন্তু সেই খবরও যদি ঠিকঠিকভাবে না গিয়ে অন্য রূপ পেয়ে যায় তখন তা ‘গু’ হয়ে যায়।
এবার বলতো বাংলায় ‘জ’ বর্ণের অর্থ কী?
— জনন বা উৎপাদন করা আচার্য্যদেব।।
— তাহলে ‘গুজ’ শব্দের অর্থ কী দাঁড়াল?
— গু জনন করে যে বা গু জনিত/ উৎপাদিত হয় যাতে।
— হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছিস মা। কেউ গুজগুজ করে বা ফিসফিস করে কানে কানে কিছু বললেই আমরা বুঝতে পারি ও ফুসুর গুজুর করে মানসিক ‘গু’ জনন করছে।
এবার পূবালী মা বলতো ‘ব’ বর্ণের অর্থ কী?
— ‘বহন করা’ গুরুদেব।
— তাহলে ‘গুজব’ শব্দের অর্থ কী দাঁড়াল?
— গুজ বহন করে যে। বা যার দ্বারা গু জনিত হয়ে বাহিত হয় তাই গুজব।
— তাহলে ‘গুজব’ শব্দে ‘গু’ কেন তা বুঝা গেছে তো?
সবাই সমস্বরে বলল, “হ্যাঁ আচার্য্যদেব।”
এবার প্রকাশ প্রশ্ন করল, “আচার্য্যদেব আপনি যে বললেন খাবার শরীরের লাগে, মনের লাগে, আবার সমাজেরও লাগে। আলোচনা প্রসঙ্গে আমরা দেখলাম এই খাবার ও খবর রূপ গামীর কিছুটা ‘উ’ হয়ে মানে নতুনরূপ পেয়ে শারীরিক গু ও মানসিক গু হয়ে গেল। তাহলে তো ‘সামাজিক গু’ ও থাকার কথা আচার্য্যদেব! সেটা কী রকম জানতে বড় ইচ্ছে হচ্ছে।”
— খুব সুন্দর প্রশ্ন করেছিস বাবা প্রকাশ। দেখ সমাজ প্রয়োজনের তাগিদেই বিভিন্ন বস্তুর উৎপাদন করে। ধান, গম, যব, পাট, হাড়ী, কলসী, জামা, পাজামা, গাড়ী, বাড়ী, বই সবই। যতটা দরকার সমাজ যদি ততটা জনন করে তাহলে তাকে বলে উৎপন্ন। কিন্তু তা যদি প্রয়োজনের বেশী হয়ে যায় তাহলে তার অবশেষ জমতে থাকে পুঁজ রূপে, মল রূপে, গু রূপে। তখন তা আর উৎপন্ন থাকে না, হয়ে যায় পণ্য। এই অবশেষ বা উদ্বৃত্ত নিয়ে ঝগড়ার জেরে আদিম যৌথ সমাজ ভেঙ্গে যায়। পুঁজ থেকে জন্ম নেয় পুঁজির, মল থেকে মালের, আর গু থেকে গুডসের। উৎপন্ন যখন পণ্য হয়ে গেল প্রাচীন ভারত তখন তাকে ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করেছিল। কতটা ঘৃণা তা আজও হিন্দু রমণীদের প্রায় উলঙ্গ হয়ে পায়খানা যাওয়া ও তৎক্ষণাৎ স্নান করে অন্য কাপড় পরা দেখেই বুঝা যায়। চিনে নিতে অসুবিধে হয় না আমাদের পরম্পরাগত জ্ঞান কৃষ্টি ও সৃষ্টিকে। প্রথম যারা এই মাল নিয়ে কারবার শুরু করেছিল অনেক পরে তাদের মাল, মালাকার, মল্লিক, মালিক, মালিনী, মল্ল, মাল্লা, মল্লা, মালাকর, মালী, মাল্য প্রভৃতি পদবী দিয়ে সমাজ অস্পৃশ্য করে দিয়েছিল। আজও এঁদের অনেকেই দলিত, অন্ত্যজ, হরিজন, তপশিলী জাতির পর্য্যায়ে পড়েন। যদিও বেওসাটা উচ্চবর্ণীয়রা সবাই এঁদের নিকট হতে ভালোমতই বুঝে নিয়েছেন।
কিন্তু ইংরেজ এই গুকে গায়ে মেখে নিল। শিল্পবিপ্লব ঘটিয়ে তারা বলল ওরে এরা গু নয়, গুড (good)। বহুবচনে তাই গুডস্ (goods)। মালে মালে মালামাল। এই গু রাখার জন্য তারা গুদামঘর মানে godown বানাল। তাতেও শেষ রক্ষা হল না। এই মলজাত মালকে সরাতে তারা সারা পৃথিবীতে উপনিবেশ গড়ল। যুদ্ধ দাঙ্গা-হাঙ্গামায় সেই মালের সদ্গতি করতে সারা পৃথিবীকে অশান্ত করে তুলল। কারণ মলত্যাগ না করলে কিছুতেই তাদের শান্তি হচ্ছে না। যার পরিণতি দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ এবং আজকের এই অশান্ত দুনিয়া।
তবে মল (mal) যে খারাপ একথা তারাও তাদের ভাষায় ধরে রেখেছেন। mal-practice, mal-nutrition, mal-function, mal-formation প্রভৃতি শব্দগুলি তারই সাক্ষ্য দেয়।
আজ আমরা আমাদের উত্তরাধিকার ভুলে সাহেবদের দেখানো পথে মলের সদ্গতি করার জন্য শপিং মল গড়ে তুলেছি; আর সেই মলের মল গায়ে-হাতে-পায়ে-মুখে মেখে ভাবছি কত না সভ্য হলাম? এটা কিন্তু গুজব নয় বাবা প্রকাশ। কী আজব এই দুনিয়া তাই না!
— বাংলা ভাষায় নামকরণের উৎস যে এত গভীর এবং স্পষ্ট তা আপনার সান্নিধ্য না পেলে আমরা জানতেই পারতাম না আচার্য্যদেব।
— ঠিক আছে বাবা। তোরা সবাই বাংলার ধারায় স্নান করে স্নাতক হয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে এসেছিস। বাংলার এই বিশুদ্ধ ধারাতে আরো সকলে স্নাত হোক। তাই তোরা গুজগুজ, ফিসফাস করে নয়, মধু কবির মতো উদাত্ত গলায় বল—
“হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে অবোধ আমি। অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত।”
.
.
.
বরুণ ঘোষ
নিবাস : বাঁকুড়া, পশ্চিম বাঙ্লা, ইণ্ডিয়া।