ওরিগ্যামি পাখী, কোয়্যারেন্টিনের সন্ধ্যে ও অন্যান্য কবিতা || লুবনা ইয়াসমিন

0

ওরিগ্যামি পাখী

ওরিগ্যামি পাখী, নভোনীলে ভেসে ভেসে দূর পাড়ি, ইচ্ছেপূরণ!
আনকোরা সন্ধ্যায় চাঁদের কক্ষপথ ছুঁয়ে যায় প্রণয়ী ভেনাস
শুধু এক পলক, তারপর অযুত আলোকবর্ষ দূর আবছায়ায়
যে ভাবে দূরে চলে যায় এক একটা বিরহকামী প্রেম!
কাগজের নৌকো, সমুদ্রযাত্রায় একান্ত দ্বীপ, নিজস্ব পাহাড়
বৃষ্টিজলে ভিজে ভিজে ঝাউতলে নোঙর,
দৃষ্টি কি পেরোয় বলো গোচরের সীমানা?
সেইসব নিশিডাক ডেকে যাবে, যেমনটা বরাবর!

শিয়রে জ্বলবে নিহিত সলতে, রেইন ফরেস্ট এর উষ্ণ আর্দ্রতা
বাব্ল্ বাথটাবে নিবিড় বুদবুদ, মোরিংগা সুবাসে সজনে ফুল আশ্লেষ!
নিজেকে আঁকলে পাহাড়, আমার প্রিয়ংবদা নদী, পাহাড়ের প্রিয়তমা!
নিঃশ্বাসের লু উড়িয়ে নিচ্ছে কোথায়, তৃষ্ণা-নীল ফটিকজল বেলাভূমি…
গাংচিল মেঘ, সন্ধ্যে ছায়ায় জল উতরোল কাব্য ক্যানভাস…
নদী, পাহাড়, চোখ, চেনা অচেনা স্কাইলাইন, আমরা দু’জন।

 

কোয়্যারেন্টিনের সন্ধ্যে

পুরনো রেকর্ড চাপালে প্লেয়ারে, কাভারে
হাসছে অলিভিয়া নিউটন জন, বিছানায়!
ঘুরে এলে এক পাক, মন চাইছে নেচে যাবে
যতক্ষণ না ক্লান্ত হচ্ছ, করোনা-পরিসংখ্যান
দূরে থাক কিছুক্ষণ, ঘর-বন্দী সন্ধ্যেবেলায়।
অলিভিয়ার সমুদ্র নীল চোখে চোখ, চুম্বক!
অস্ফুটে বলে ফেল, ‘ঠিক যেন ভাস্কর্য্য’!
আজ সন্ধ্যে হোক কিছু স্কেচিং, অলিভিয়ার…
চারকোল এর সাথে রঙ মেশাও, ফিউশন
হচ্ছে চমৎকার, অলিভিয়া আর দূরের পাখীটার!
কোয়্যারেন্টিনের সন্ধ্যে, দূরকে কাছে টানছে,
মার্কেজের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’
তোমার বরাবরের ঘোর, ভালোবাসতে চাইছ অমন
কোয়্যারেন্টিন শেষে মুক্ত বাতাসে বলবে ‘ভালবাসি’,
নাকি দেরী হয়ে যাবে, মুঠোফোনে তোমার আঙুল!

 

এ ভ্রমণ (আর কিছু নয়)

এ ভ্রমণ টাইম জোন পেরিয়ে তোমার সময় ছোঁয়া, আর কিছু নয়!
রুটিন ছেঁড়া অন্য ভোরের সপ্রেম আলিঙ্গন এবং আবুল হাসান।
এক একটা সর্ষেদানা ছুটির চম্পট, ধীর বালুঘড়ী বালুকাবেলা…
মন ডোবানো স্বীকারোক্তি, আর কী অনায়াসে বলে ফেলা
হয়ে উঠেনি কখনো যেসব উচ্চারণ, অনবদ্য সমর্পণ!
স্মার্ট ফোনের চতুর স্ক্রিনে লাইভ আড়মোড়া ভাঙা ভোরের শিয়র!
স্থাপত্য মনোরম প্রাচীন পাইনের পথ বেঁকে যায় পানশালা বরাবর,
লাইভ সঙ্গীতে সন্ধ্যে ঘনায়, ভ্যানিলা আকাশ নিয়ন আলোয়…

অতঃপর অবধারিত গোছগাছ পর্ব্ব, সাবলীল লাইট ট্রাভেলার
ট্রলি ব্যাগ, মোকাসিন, চাবি রেখে লবিতে স্মার্ট হেঁটে চলে যাওয়া…
কিছু কি ফেলে রেখে গেলে? পড়ে রইল অদেখায়?
সম্ভবতঃ তাই, এমন নিগূঢ় নিকট, প্রচ্ছন্ন ছিল কোন প্রত্নবেলায়?
হয়ত অলীক এই সান্দ্র সন্নিকট… দূর পরিব্রাজনায় কাছে আসবার প্রশ্রয়!
দূর সুদূর, মধ্যমা ছুঁয়ে যায়, ফের সেই টাইম জোন মেঘের ডানায়…

 

বেভুল

কাল রাতে পথ চিনেই তো বাড়ী ফিরেছি ঠিকঠাক
ঘুম ভাঙা সকাল তবু ষড়যন্ত্রের কণ্ঠে বলে, ‘হারিয়ে গেছ তুমি’
অদৃশ্য কারুর নজরবন্দী, আর দরজায় তালা।
বাইরে যে বেরোয়, সে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে
আমার ছদ্মবেশে গাড়ীতে আলগোছে চাবি ঘুরিয়ে হাওয়া,
নাকি আমিই হাওয়া, ঘুমিয়ে যে সে তবে কে?

চাবির রিং এর মেটালিক ডাইনোসরটাও অবিকল একই
অথচ দরজা খুললেই একেক দিন একেক অন্দর…
এ-ঘর ও-ঘর, আসবাব, এক চিলতে ক্লোরোফিল কোণা,
আরো কী কী যেন আপন ছিল, ছিল চেনা, খুঁজে পাই না,
কার বাড়ী কে জানে, এলামই বা কী করে এখানে?

এক একদিন ঘরের ভেতর নদী, সমুদ্র,
কোনদিন মরুভূমি, প্রান্তর, এত অচেনা!
সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে ওপরে আসি, ছাদ খুলে কে যেন নিয়ে গেছে
এইখানে হাওয়ার বাড়ী, মেঘের আড্ডা, মুঠো মুঠো চাঁদের আলো

স্মৃতিতে কার যেন মুখ…স্পষ্ট হয় না মোটেই
চেনা অচেনায়, জানা অজানায় বেভুল ভেসে যাই…

 

কাল রাতে নীল গ্রামে

একটা ছবি, চোখে লেগে আছে দেখার পর থেকে
উজ্জ্বল, ফ্যাকাশে, আকাশী, সমুদ্রজল টলটলে
নীল দরজাগুলো, নীল দেয়ালে দেয়ালে।
পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ঝলমলে নীল গ্রাম
কাল রাতে স্বপ্নে নীল রঙা সেই শেফশ্যাউয়েন গ্রামে!
সে গ্রামের মেয়েরা নীল রঙ ভালোবাসে বড়,
উঠোন বারান্দা নীলে নিকোয় খুব সযতনে
নীল কাফতানে ঢেউ তুলে তারা হেঁটে যায়
গোলাপী গোধূলি আলোয় নীল গোলাপ ফোটায়!

স্বপ্নে পাহাড়ের চূড়া থেকে নেমে এলো অঝোর বৃষ্টি
সারা গ্রাম তার সোঁদা ঘ্রাণের নেশায় মাতাল
গ্রামের বাড়ীগুলো সব এক একটা নীল নদী
পথগুলোয় ঝিলের জল ছলাত ছলাত
সাঁতার কেটে বেড়ালাম অলস বেলা জুড়ে।

হিটলার পারেনি, পায়ে দলে তার সন্ত্রাস
উদ্বাস্তু মানুষগুলো মর্ত্যে নামিয়ে এনেছিলো
অনঘ আকাশ, আর অবারিত স্বর্গের আশ্বাস,
নীল রঙে রাঙিয়ে পথ ঘাট ফুটপাত দেয়াল
কার্নিশের নীচে আকাশী জানালা, দরজার কপাট!

সেই থেকে কারো মন চাইলেই নীল পথ পেরিয়ে
নীল সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে দোতলা তেতলা
ডানায় ধরে নীল আকাশ, তারপর স্বর্গের কার্নিশ।
প্রতি বসন্তে নীল লহরে লহরে আনন্দ অর্চনা
এক আকাশ মুক্তি আর এক প্রতীতি স্বর্গ সেঁচেই
বুঝি এমন নিকষিত নীল, সারারাত স্বপ্নে সেই ঢেউ!

 

সেই দরোজা

সিঁড়ি থেকে দরোজায়
বন্ধুতায়
বৈরিতায়
গল্পে এবং কবিতায়
পথের শুরু আর শেষটায়
তোমায় আমায়
কাছে টানায়, দূরে ঠেলায়…
সেই দরোজায়
একটা টোকায়,
শুধু মাত্র একটা টোকায়
কিংবা ফিরে চলে যাওয়ায়!

 

এই তুষার এই নদী

হেমস্পর্শে বদলে যায় দিনান্তের বুনন,
জানালায় জমে থাকা তুষারকণারা
গলে জল হলো সূর্য্যের ভালোবাসায়!
ক্লান্তি ক্লেদ মুছে ফেলি রুমালের রমণীয়তায়!

পূবের জানালাটা পুরোটাই আকাশের গাঢ় নীল
চোখের নীলিমায় ছায়া পড়ে তার,
গাঢ় কাজলরেখা ছুঁয়েছে চোখের কিনার
আয়নায় স্মিত হাসি চিরন্তনী

যত মনস্তাপ, অভিমান উড়িয়ে দেই নিঃশ্বাস বাষ্পে।
শীত রাত্তিরে বসন্ত নামে পরীর ডানায়
অভিলাষী খই ফুল ইচ্ছেরা ফোটে
ধবল তুষারে, বর্ণিল উচ্ছ্বাসে ভেসে ভেসে!

তুষার গলে শীতঘুম ভাঙে উষ্ণ তন্বী নদীটার
বসন্ত বার্ত্তায় গ্রীষ্মের অঙ্কুর, মোহে অপরূপ
বহমান জল ছুঁয়ে দেয় প্রতিমার চরণ,
নৈবেদ্য বয়ে আনে পুষ্পাঞ্জলী প্রদীপে,

টকটকে রক্তজবার সন্তরণে প্রাণ পায় জল
এইখানে জীবন, এইখানেই অপার প্রেম!

 

থাক আজ মূলতবী সেই সাক্ষাৎ

শ্রী-কল্যাণে হু হু বাজে অ্যাস্পেন সঙ্গীত
খাম খোলা নীল চিঠি শরৎ হাওয়ায়!
শর বনে সূর্য্য পাঠাল সন্ধ্যের এত্তেলা ,
শহর সীমানা পেরুল দূরগামী রেল।
তোমার সাথে আমার দেখা হলেই
বনে বনে দাবানল, আকাশ জুড়ে ঝড়

তবে নয় থাক আজ মূলতবী সেই সাক্ষাৎ!
সাঁকো পেরুতে গিয়েও কী যেন কী ভেবে,
ফিরে চলি, ফিরে চলে যাই,
পায়ে ভেঙে ভেঙে বিষণ্ণ বালুতট
ডুবো কাঠ মাথা তুলে চেয়ে দেখে বার কয়,
সোনালী ঢেউয়ে ভাসছে তখন গাংচিল সময়…

 

ছায়া-বাজি

চৌরাস্তার মোড় বরাবর নো ম্যানস ল্যান্ড,
খেয়ালী জি পি এস এই মোড়েই অনড়, পথ হারাবে।
জমাট প্রতীতি বিম্ব, আলগোছে ঝরে পড়ে
অহমের মসৃণ খোলস,
শীতঘুম-কাতর পাতাদের দলে ভীড়ে।
বিকেলের নিভু নিভু একলা রোদ্দুরে
নিজের ছায়ার সাথে বাজি ধরি,
পথভ্রষ্ট পথের সাথে পথ হারাব, ভাবছি…

ছায়া পাহারায় কে কবে পেরেছে হারাতে, বাজি?
ডানার বিস্তারে শীত-পাখীর ফিসফিস, ‘চললাম’
আমিও পিছু পিছু অন্বেষে
ছায়ার বিপরীতে হেঁটে হেঁটে ঐদিকে
ছায়ার গাঢ় বুনন ছিঁড়ে খুঁড়ে আঙ্গুল তোলে অন্তর্লীন আয়না,
রাত-পাখী তখন ডেকেছিলো ‘নির্জনতা’ বলে…

 

ডায়মন্ডস অ্যান্ড রাস্ট এখন

অতঃপর আসবাব, তৈজস, প্রাণহীন স্টিল লাইফ,
একদিন প্রাণ ছিল, ফটো ফ্রেম, পুঁতির মালাদের
কথা ছিল, কবিতাও, সংলাপ, এবং মুগ্ধতা
এক একটা পট প্ল্যান্টের গালভরা সব নাম ছিল
এক একটা এক্সেসরিজ এর এক একটা উপলক্ষ্য।
তখনও জোয়ান বায়েজ গাইত ‘ডায়মন্ডস অ্যান্ড রাস্ট’!

কারুকাজের ভেতর গল্প ছিল, ক্লিশেও কি নয়?
তাও ছিল, কিন্তু ভাববার ছিল না সময়…
আর ছিল নার্সিসাসদের গল্প, সেই নিয়ে কটাক্ষও
গতানুগতিকতা ছিল না এমন নয়,
সেখানেও কিছু নিয়ম করা অনিয়ম
আর অনিয়মের ফাঁকিজুঁকি চলছিল টুকটাক
ছিল বৈকি, যেমন থেকে থাকে হরহামেশাই।

তারপর আরেকটা শীতকাল, যেমন গেলবার।
সেইতো শুরু, নাকি শেষ, ফিরিয়ে দেখলেই চুকেবুকে যায়
শুরু আর শেষের গোলযোগ, অসুবিধে নেই সেসব কিচ্ছুতেই
এই ফাঁকে অনায়াস আয়ত্বে সেইসব কৌশল, ভেবেছিলে
শুধু তোমার অথবা তোমাদের একার,
নীরবে হেসেছিল কেউ কোথাও, তুমি তখন রোদ চশমায়!
জোয়ান বায়েজ এখনো গাইছে, ‘ডায়মন্ডস অ্যান্ড রাস্ট’,
সম্ভবত আরো একটু মায়া ভরা গলায়!

.

.

.

121318987_10223626981640994_2801582541244016423_oলুবনা ইয়াসমিন
কবিতা লেখা হয়ত কখনো কখনো নিজের সাথে কথা বলা, হৃদয়ের কথা বলা, আর কখনো কখনো শব্দ, ছন্দের বিন্যাসে একটা সৃষ্টিশীল ভাষার কোলাজ বোনা। কবিতা যাপন কিছুটা এরকম। সাম্প্রতিক এক যুগ বাদ দিলে জীবনের প্রায় পুরোটাই কেটেছে ঢাকা শহরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। বাংলা এবং ইংরেজী দুই ভাষাতেই লেখেন। প্রিয় কবি আবুল হাসান, প্রিয় লেখক পাওলো কোয়েলো। বর্ত্তমান আবাস কানাডার অন্টারিও প্রভিন্সের টরণ্টো শহরে। সবচে’ প্রিয় বন্ধু প্রকৃতির নিবিড় সাহচর্য্য প্রাণ ভরে উপভোগ করেন, উদ্যাপন করেন নিয়ত। …………

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার