Post-modernity বর্ত্তমান সময়ের বহুল পরিচিত শব্দ। ১৮৭০ সালে জন ওয়টকিন্স চ্যাপম্যান নামের এক শিল্পী এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন। মূলত ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ লিওতার এই ধারণার তাত্ত্বিক প্রথম প্রবক্তা, পরবর্ত্তীতে একে আরও সম্প্রসারিত করেন জ্যাঁ বদ্রিয়ার, জ্যাক দেরিদা, রোঁলা বার্থ ও জিল দল্যুজ…। ‘সাহিত্য এই ধারণাটিকে এনেছিলেন ইহাব হাসান’। এই শব্দটিকে একটি আন্দোলন বলা যেতে পারে আবার দর্শনও বলা যেতে পারে। মূলত এটি জ্ঞানচর্চ্চার বিভিন্ন শাখায় বহুল ব্যবহৃত একটি পরিভাষা। যা ক্ষমতার কেন্দ্রকে অস্বীকার করে উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যের পথ তৈরি করে, ঐক্যকে অস্বীকার করে, নৈরাজ্য বা বিশৃঙ্খলাকে স্বাগত জানায়, মহাআখ্যান বা ইউরোপীয় বয়ানকে বাতিল করে, বহুত্বের সমাবেশে, সাংঘর্ষিক পরিচয়কে সাদরে গ্রহণ করে, গণমধ্যমের ভেতর সমান্তরাল বাস্তবতা তৈরি করে, হাইপার রিয়েলিটিকে স্বীকার করে। Post-modernity গুরুত্ব দেয় ভাষার নিয়াবলীর সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক নির্ণয়ে। সাদা বনাম কালো, নারী বনাম পুরুষ, উপনিবেশক বনাম উপনিবেশিত-বৈপরীত্য তৈরি করার এই প্রক্রিয়াকে শুধু বিরোধিতাই করে না এর বদলে বহুধারণায় বিশ্বাস করে Post-modernity।
বিশ শতকের দিকে শিল্পকলায় এই Post-modernity-র প্রভাব ছিল বেশ লক্ষনীয়। Post-modern শিল্প আন্দোলন ছিল উদ্ভাবনী ও বেশ প্রভাবশালী আন্দোলন। যার ফলে এই শিল্প আন্দোলনটি অতি দ্রুত চার্দ্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
Post-modern শিল্প ধারাটি নারিবাদী শিল্পীদের একটি নতুন দ্বার উন্মোচন করে যা লিবারেল ও র্যাডিকেল নারিবাদী শিল্প তত্ত্বগুলো ভেঙে দিয়ে Post-modern ভাবনায় নারিবাদী শিল্পীদের শিল্পচর্চ্চার আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়।
Post-modern শিল্প ধারায় মোট ছয়টি শিল্পরীতির চর্চ্চা পরিলক্ষিত হয়। এই ছয়টি শিল্পরীতিগুলোর মধ্যে তিনটি নতুন তাত্ত্বিক ধারণা নিয়ে বিকশিত হয়, অপর তিনটি বিভিন্ন শিল্প-রূপের সমন্বয়ে গঠিত হয়। প্রথম রীতিগুলো হল— মিনিমালিজম, হাইপার রিয়েলিজম এবং পপ আর্ট এবং মিশ্ররীতির শিল্পগুলো হল— কনসেপচুয়াল আর্ট, ইনস্টলেশন আর্ট এবং পারফরমেন্স আর্ট।
১৯৬০ সালের দিকে সৃষ্টি হওয়া Post-modern শিল্পধারাটি নারিবাদী শিল্প আন্দোলনকে আরো বেশী তরান্বিত করতে সাহায্য করে। নারিবাদী শিল্পীরা শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় নিজেদের যুক্ত করে তাদেরো সামগ্রিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করার অধিকার প্রসঙ্গ নিয়ে তা শিল্পে প্রকাশ করেন।
১৯৬০ সালে এবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম শিল্প আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় মিনিমালিজম নামক একটি শিল্প আন্দোলন শুরু হয়। এর মূল কথা ‘Less is more’ অর্থাৎ কমই বেশী নাম দিয়ে স্থানের সর্ব্বোচ্চ ব্যবহার করে স্থাপত্য জগতে একটি নতুন ধারণা সৃষ্টি করে, চিত্র শিল্পেও এর প্রভাব লক্ষণীয়। ফ্লাঙ্ক স্টেলাকে মিনিমালিজমের জনক বলা হয়। আবার ১৯৬০ সালের শেষের দিকে পোস্ট-মিনিমালিজমের ধারা চালু হয়। এই শিল্পরীতিতে দৈনন্দিন ব্যবহার্য্য জিনিসপত্র, সরল, তুচ্ছ অবহেলিত উপকরণ ব্যবহার করে শিল্পকর্ম্ম করা হত। এ সময়কার নারিবাদী শিল্পীরা হলেন— ইভা হেসে, ভারজিনিয়া ওভারটন, ক্যাথি বাটিস্টা, কিকি স্মিথ প্রমুখ শিল্পীবৃন্দ। ইভা হেসে ছিলেন পোস্ট-মিনিমালিজমের অন্যতম নারিবাদী শিল্পী। তিনি নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার জন্য তার চিত্রকর্ম্মে, ভাস্কর্য্যে নারীদের নানা বিষয় নিয়ে শিল্পকর্ম্ম তৈরি করেন। তাঁর রিংগারাউন্ড(১৯৬৫) আঁকা শিল্প কর্ম্মটি পোস্ট মিনিমালিজম ধারায় এঁকেছিলেন।
১৯৬০ সালে পপ-আর্ট নামে আরেকটি শিল্প আন্দোলনের জন্ম হয়। পপ-আর্ট মূলত প্রতিদিনের ব্যবহার্য্য দ্রব্য নিয়ে শিল্পকর্ম্ম করা হত। বিশেষ করে অন-অভিজাত জনপ্রিয় সংস্কৃতি যেমন— টিভি, বিজ্ঞাপন, কমিক বই, পার্থিব ও মামুলি সাংস্কৃতিক উপাদান সংগ্রহ করে তা শিল্পে রূপ দেয়া হত। পপ-আর্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী নারিবাদী শিল্পী হলে এন্ডি ওয়ারহোল। তারঁ অত্যতম পপ ধারার চিত্র হল ‘১০ মারলিন'(১৯৬২)। এখানে তিনি দশজন নারী সেলিব্রেটির ছবি এক ফ্রেমে যোগ করে চিত্রটি এঁকেছেন। এছাড়াও পাউলিন বোটি, রোজালিন ড্রেক্সলার, সিস্টার ম্যারি কোরিটা কেন্ট, ইভেলিন এক্সেল প্রমুখ নারিবাদী শিল্পীরা এই ধারায় কাজ করেছেন।
১৯৬০ সালের পর পপ-আর্ট ধারা থেকে ফটোরিয়েলজম বা হাইপার-রিয়েলিজম ধারাটি বিকশিত। এই ধারার মূল কথা হল গতি ও পরিবর্ত্তনকে অবশ্যই স্থির করে রাখা যায়। অড্রি ফ্ল্যাক হলেন এই ধারার নারিবাদী প্রথম শিল্পী এবং তিনিই প্রথম ফটোগ্রাফ ব্যাবহার করে শিল্পকর্ম্ম তৈরি করেন। তাঁর একটি শিল্পকর্ম্ম হল ‘চ্যানেল'(১৯৭৪)। এখানে তিনি নারীদের প্রসাধনীর নানা জিনিস নিয়ে চিত্রকর্ম্মটি আঁকেন।
১৯৭০ সালের দিকে কনসেপচুয়াল আর্ট নামে শিল্পরীতির চর্চ্চা শুরু হয়। এই শিল্পরীতিতে বস্তুগত উপকরণের চেয়ে শিল্পীর সৃজনশীলতাকেই প্রাধান্য দেয়। এ সময়কার নারিবাদী শিল্পীরা হলেন— সুজানা ল্যাসি, সিন্ডি শ্যারম্যান, ম্যারি ক্যালি, মার্থা রোজার প্রমুখ শিল্পীবৃন্দ।
আবার এ সময় ইনস্টলেশন আর্ট নামে আরেকটি শিল্পরীতির চর্চ্চা শুরু হয়। এই শিল্পরীতিতে বস্তুর চেয়ে তার পরিবেশের ওপর প্রাধান্য দেয়া হয়। আরেক বিবেচনায় ইনস্টলেশন আর্ট বিশাল জমিনে প্রাকৃতিক পরিবেশকে ম্যানিপুলেট, পরিবর্ত্তন বা বিকৃত করে সৃষ্টি করা হয়, যা আর্থ আর্ট বা ল্যান্ড আর্ট হিসেবেও পরিচিত। এ সময় পৃথিবী ও প্রকৃতির প্রতি মমতা জানিয়ে শিল্প আন্দোলন শুরু হয়। এর মূল কথা ‘Landscape is the creation’। এই শিল্পাদর্শের বিশ্বাসীরা মনে করেন, খোলা আকাশের নীচে থাকা, সভ্যতা থেকে দূরে থাকা প্রকৃতির সান্নিধ্য শিল্প ও শিল্পীর জন্য জরুরী। এ সময়কার নারিবাদী শিল্পীরা হলেন— জুডি শিকাগো, ন্যান্সি হোল্ট প্রমুখ।
১৯৭০ সালের Post-modern শিল্পকলার আরেকটি শিল্পরীতি হল পারফরম্যান্স আর্ট। এই ধারায় শিল্পী নিজেই বিভিন্ন মাধ্যমের আশ্রয় নিয়ে সচল ক্রীড়া প্রদর্শন করে দৃশ্যকলার অন্তর্ভুক্ত থাকেন। এনা ম্যান্ডিয়েটা, ভ্যালি এক্সপোর্ট, জোয়ান জোনাস, মার্থা উইলসন ছিলেন এই শিল্পরীতির নারিবাদী শিল্পী।
রোলাঁ বার্থের ‘বার্থ অব দ্য রিডার’ গ্রন্থের প্রেরণায় ১৯৭৪-১৯৮৫ সালের দিকে ‘পিকচার জেনারেশন’ পরিচয় নিয়ে একদল শিল্পী আরেকটি শিল্পরীতির চর্চ্চা করেন। যা তরুণ শিল্পীদের মধ্যে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করে। চিত্রকল্পবাদী মুভি, টেলিভিশন, ম্যাগাজিন, বিলবোর্ড, ফ্যাশন সংগীতের উপাদান নিয়ে তারা শিল্পকর্ম্ম করা শুরু করে। তাদের এই কাজগুলোকে ‘কনসেপচুয়াল আর্ট’ হিসেবেও ধরা হয়।
এ সময়কার নারিবাদী শিল্পী বারবারা ক্রুগার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পিকচার জেনারেশন শিল্পরীতির ব্যবহার করে তিনি নারীদের দূরাবস্থা এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যেখানে আমেরিকান সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থানকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ক্রুগার প্রসঙ্গত সাংস্কৃতিক বিশ্বাসকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ছিলেন, বিশেষ করে লিঙ্গ বৈষ্যমের ধারণাকে।
সিন্ডি শেরম্যান ছিলেন এই শিল্পরীতির আরেকজন নারিবাদী শিল্পী। নারীময়তার ধারণাকে বিনির্ম্মাণ করার জন্য শেরম্যান তাঁর শরীরের ছবি ব্যবহার করেন চিত্রে। টিভি সিরিয়াল, ম্যাগাজিন, চিত্রকল্প ও চিত্র অনুষঙ্গ ধার করে তিনি সেখানে দৈনন্দিন জীবনে নারীর ভূমিকাগুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। সমাজে যেসব বস্তু বা ধারণা নারীদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল সেসব বিষয় ইচ্ছাকৃত ভাবে তুলে ধরেন।
জেনি হোলজার আরেকজন নারিবাদী শিল্পী যিনি মনে করেন, একজন শিল্পী টি-শার্টে, বিলবোর্ডে বিকল্প প্রদর্শনীর স্থান পান। সেজন্য তিনি টি-শার্ট, বিলবোর্ডে Post-structural অবস্থান থেকে টেক্সট প্রদর্শন করেন এবং সেখানে নারীদের জীবনের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
Post-modern শিল্প ধারাটি শিল্পকলার মাধ্যমে নারীরদের অস্তিত্ব এবং তাদের ভূমিকা তুলে ধরার একটি অভিনব কৌশল তৈরি করেছে। পূর্ব্বে শিল্পকলায় নারীদের অংশগ্রহণ খুবই কম ছিল। এই শিল্প ধারাটির সুবাদেই নারিবাদী শিল্পীরা সার্ব্বিক ক্ষেত্রে তাদের অধিকার সম্পর্কে নারিবাদী আন্দোলনটিকে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে।
তথ্যসূত্রঃ
১. উত্তর-আধুনিকতা, মামুন অর রশীদ, সংবেদ, ফেব্রুয়ারী ২০১৯
২. নৈতিকতা ও নারীবাদ : দার্শনিক প্রেক্ষিতের নান মাত্রা, শেফালী মৈত্র, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটে, ২০০৭।
৩. https://m.theartstory.org/movement/feminist-art
৪. https://artsandculture.google.com/theme/the-feminist-artists-whose-work-you-need-to-know
৫. http://Postmodern Feminist art: https://link.springer.com/chapter/10.1007/978-1-349-20843-2_7
জবা রায়
জন্মস্থান: ধোবাউড়া, মৈমনসিংহ।
অনার্স, চতুর্থ বর্ষ, চারুকলা বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, মৈমনসিংহ।