ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্যের পৌরাণিক ঘাটতি || রবি চক্রবর্ত্তী

0

“… ভোগ্যবস্তুর উৎপাদনের কৃৎ-কৌশলে পরিবর্ত্তনের সূত্রে নিসর্গ প্রকৃতির ওপর মানুষের ক্ষমতা যত বৃদ্ধি পায়, ততই মানুষের সমাজ টুকরো টুকরো হয়ে যায়, মানুষের মানসিক সুস্থিতি নষ্ট হয়, এবং এক কথায় মহাভারতের মৌষল পর্ব্বে বর্ণিত ধ্বংসের দিকে মানুষের সমাজ এগিয়ে যায়। এবং শেষ পর্য্যন্ত এই পৃথিবী প্রাণের অযোগ্য হবার দিকে চলে যায়। ইতিহাস থেকে আমরা দেখছি যে, ভ্রান্তনীতির ফলে, তাদের প্রাণশক্তির বিপুল প্রাচুর্য্যের কারণে ঠিক এই ভাবেই ইউরোপ ও তার উত্তরসাধক মার্কিন দেশ তিন-চার শতাব্দী ধরে নেতৃত্ব দিয়ে মানবসভ্যতাকে সর্ব্বনাশের কিনারে নিয়ে আসে, ঠিক আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি। …” — [রবি চক্রবর্ত্তী]।

ইংরেজী, ফরাসী প্রমুখ সাহিত্যের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, তাঁদের অনেকের একটা জিনিস খেয়াল হয়ে থাকবে. গত তিন চার শতাব্দীর পাশ্চাত্য কাব্যে যখন পুরাণের প্রসঙ্গ আসে, তখন তা পাঠকের মনকে তেমন নাড়া দেয় না। গ্রীক পুরাণের দেবদেবী যথা জিউস (Zeus), আথেনী (Athene), আফ্রোদিতে (Aphrodite) বা রোমক পুরাণের জুপিটার (Jupiter), মিনার্ভা (Minerva), ভেনাস (Venus) প্রভৃতির উল্লেখ যখন হয়, তখন সেটি কৃত্রিম লাগে। মনে হয় সাহিত্যিক চাল বা ফ্যাশানের খাতিরে সেই উল্লেখ, তার বেশী কিছু নয়। আর বাইবেল থেকে আনা অ্যাডাম (Adam), ঈভ (Eve), নোআ (Noah), আব্রাহাম (Abraham) প্রভৃতি কাহিনীর কথাও যদি ধরা যায়, দেখা যাবে সেখানেও বেশ কিছু খামতি [সেটি ঠিক কী রকমের, সেই আলোচনায় পরে আসব]।

উপরে যা বলা হল তা বিশেষ করে বোঝেন ভারতীয় পাঠক। হিন্দীভাষী পাঠকরা তো বটেই, এমন-কি তাঁদের তুলনায় যাঁরা আরও দীর্ঘকাল ইংরেজী সাহিত্যের চর্চ্চা করেছেন, সেই বাঙালী পাঠকরাও এক রকমের কথাই বলবেন। এই সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে শিবের প্রসঙ্গের উল্লেখ করা যায়। ‘প্রলয় নাচন নাচলে যখন’, ‘নৃত্যের তালে তালে’ প্রভৃতি গান, এমনকি ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসে নায়কের মুখের ষ্টাইল ও ফ্যাশান প্রসঙ্গে শিবের উল্লেখ— এসবের মধ্যে মাত্র প্রথা পালন হয়নি, তার বেশী কিছু এখানে আছে। আবার তরুণ রবীন্দ্রনাথের কাব্যে কালিন্দীর কূলে রাধার প্রেমও কম জোরালো প্রসঙ্গ ছিল না। এ ছাড়াও দুর্গতিনাশিনী দুর্গা, বাগ্‌দেবী সরস্বতী, লক্ষ্মী, নারায়ণ প্রভৃতি দেবদেবীর উল্লেখ রবীন্দ্র-সমসাময়িক তথা প্রাক্-রবীন্দ্র সাহিত্যে আকছার পাওয়া যাবে। এমন-কি নজরুল ইসলামের মত কবি, যিনি ইসলামী ইতিহাস, সাম্যবাদী ধারণা সব কিছু নিয়ে কবিতা লিখেছেন, তিনিও শ্যামা বা কালীকে নিয়ে গান রচনা করেছেন, এবং সে গান হিন্দুর কাছে গ্রহণযোগ্যও হয়েছে।

তা হলে ইউরোপের বেলায় মুশকিলটা হয়েছে কোথায়? এর উত্তর খুঁজতে হবে ইউরোপের ইতিহাসের মধ্যে। নিঃসন্দেহে, যীশু খ্রীষ্টের বাণী ও আত্মবলিদানের কাহিনী ইউরোপের মানুষের মর্ম্মমূল ধরে নাড়া দিয়েছে কমবেশী দেড়-দুই হাজার বছর ধরে। কিন্তু যীশু যে জাতির মধ্যে জন্মেছিলেন, সেই ইহুদী জাতির পুরাণ (যার মধ্যে আদম, ঈভ, আব্রাহাম প্রভৃতির কাহিনী আছে), সেটি ছিল ইউরোপে বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত নানান পুরাণ কাহিনী থেকে ভিন্ন গোত্রের।১

          বক্ষটীকা— ১.

          প্রাচীন গ্রীস ও রোম এই দুই দেশের পুরাণ কথা বাদে আরও তিনটি বড় পুরাণধারা

          (mythology) ইউরোপে চালু ছিল, যথা (১) কেল্টিক বা সেল্টিক (Celtic); (২)

          টিউটনিক / জার্ম্মানিক / নর্স / ষ্ক্যাণ্ডিনেভীয় (Teutonic / Germanic / Norse /

          Scandinavian); আর (৩) শ্লাভ / শ্লাভিক / শ্লাভনিক (Slav / Slavic / Slavonic)।

          এই তিনটির মধ্যে সবচেয়ে পরিস্ফুট ভাবে আমরা পাচ্ছি কেল্টিক ধারাটিকে;

          কারণ তুলনামূলক ভাবে অন্যদের চেয়ে আগে সভ্যতার বৃত্তের মধ্যে এসে যায়

          কেলট্-রা (অর্থাৎ আইরিশ / ওয়েলশ / গেলিক = Irish, Welsh, Gaelic ছিল

          যাদের ভাষা)। আর রুশ, পোলিশ, চেক, সার্বিয়ান, বুলগারীয় (= Russian,

          Polish, Czech, Serbian, Bulgarian) প্রভৃতি ছিল যাদের ভাষা, সেই শ্লাভরা

          ইতিহাসে পিছিয়ে পড়ার জন্য তাদের পুরাণ কাহিনীগুলির সংবদ্ধতা কম।

          নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, আইসল্যাণ্ড, হল্যাণ্ড, জার্ম্মানী প্রভৃতি দেশের, অর্থাৎ

          টিউটনিক ধারার মানুষদের পুরাণকথার অবস্থা এই দুইয়ের মাঝামাঝি। তবে গ্রীক,

          রোমক, কেলটিক, টিউটনিক, শ্লাভ সব কয়টি পুরাণধারাই ছিল নিসর্গপ্রকৃতিমুখী

          এবং সব ক’টিতেই দেখি নানান দেবদেবী অবলম্বনে অতিপ্রাকৃত ঘটনার ছড়াছড়ি;

          যার ফলে স্বতঃই মনে হয় কাহিনীগুলি রূপকধর্ম্মী।

ইংরেজ ও ফরাসী এই দুই জাতির বিশেষভাবে মিশ্র চরিত্রের দরুণ তাদের ইতিহাসে কেল্টিক ও টিউটনিক দুটি পুরাণধারারই উত্তরাধিকার চোখে পড়ে।

প্রথম সহস্রাব্দে, বিশেষ করে তার দ্বিতীয়ার্দ্ধে, খ্রীষ্টীয় চার্চ্চ [যা ছিল আসলে খ্রীষ্টে বিশ্বাসী যাজক-সন্ন্যাসিদের মঠকেন্দ্রিক সঙ্গঠন] যীশুর বাণী ও আত্মবলিদানের কাহিনীর সাথে সাথে ধর্ম্মগ্রন্থ বাইবেলের মোড়কে ইহুদিদের পুরাণকাহিনীও মানুষের মনে চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ইহুদী পুরাণ কথিত ইডেন উদ্যানে আদম ও ঈভ-এর জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়ার কাহিনী বা জলপ্লাবনে শুধু নোআ (Noah) পরিবারের বেঁচে যাওয়ার গল্প তো আর খ্রীষ্টীয় ভাবধারার আসল শক্তি নয়; আসল শক্তি ছিল যীশুর বাণী ও আত্মবলিদানের কাহিনী। এর ফলে খ্রীষ্টান হওয়ার পরেও দেশের কৃষক গোষ্ঠীর মনে আগের পুরাণকথাগুলি ফল্গুধারার মত প্রবাহিত ছিল; যদিও দ্বিতীয় সহস্রাব্দে উঠতি শহরগুলির কারিগর ও বণিকদের মনে ইহুদী পুরাণ কিছুটা ঠাঁই পেয়েছিল।

সেই প্রাক্-খ্রীষ্টীয় পুরাণধারা প্রকাশ পেত পয়লা মে তারিখের বসন্তোৎসবে, এবং এমন-কি যীশুর জন্মদিন ও ক্রুশে যন্ত্রণাভোগ ও পরে পুনরুত্থান উদ্‌যাপনের মধ্যে সন্নিবিষ্ট নানা রকমের বৃক্ষসজ্জা ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে। প্রাচীন পুরাণভিত্তিক লোকসংস্কৃতির এই প্রচ্ছন্ন ধারাটিকে শেষ করে দেওয়ার কাজটি সম্পন্ন করেছিল বণিকপ্রশ্রয়ে ষোড়শ শতাব্দীতে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা প্রতিবাদী ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী প্রোটেষ্ট্যান্ট চার্চ্চের চরমপন্থী অংশ। আর যীশুর পুনরুত্থান নিয়ে যে আধা-পৌরাণিক কল্পকথা, একটু একটু করে গড়ে উঠেছিল, সেটিকে পর্য্যন্ত ধসিয়ে দেয় সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীর আলোকপ্রাপ্তি বা Enlightenment-এর পতাকাবাহীরা। মোটের উপর সকল পুরাণকথাকে মূঢ়তাজাত জঞ্জাল বলে মনে করাটাই রেওয়াজ হয়ে গেল ইংল্যাণ্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশের বিদগ্ধ নাগরিক সমাজে।

কিন্তু পুরাণকথা কি সত্যিই এত ফেলনা জিনিস? অর্থহীন জঞ্জালকে মাথায় বয়ে বেড়ানো কোন মানবগোষ্ঠীর পক্ষে কোন কালেই কি সম্ভব? তথাকথিত বিদগ্ধজনেরা যাই ভাবুন না কেন, বিংশ শতাব্দীর মধ্যকালেই বিশেষ সম্মানিত সাহিত্যশাস্ত্রী-যুগল Rene Wellek ও Austin Warren বলেছেন— ‘myth’, as like poetry, a kind of truth or equivalent of truth, not a competitor to historic or scientific truth but a supplement। এর কারণ এই যে myth বা পুরাণকথা হল narrative, story, as against the logical discourse, exposition; it is also the irrational or intuitive as against the systematically philosophical.

Myth সম্বন্ধে তাঁরা এও বলেছেন যে myth হচ্ছে আসলে story-telling of origins and destinies : the explanations a society offers its young of why the world is and why we do as we do, its pedagogic images of the nature and destiny of man.২

          বক্ষটীকা— ২.

          উদ্ধৃতি ক’টির উৎস হল ১৯৪৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম প্রকাশিত এবং

          ব্রিটেনে Penguin Books কর্ত্তৃক প্রথম ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত Theory of

          Lterature নামক গ্রন্থের Image, Metaphor, Symbol, Myth শীর্ষক Chapter 15।

কিন্তু এতদূর পর্য্যন্ত বোঝা সত্ত্বেও বৃহত্তর ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তাঁদের পৌরাণিক ঘাটতির তাৎপর্য্য পাশ্চাত্য মনীষার গোচরে আসেনি। যদিও ইতিহাসের আনুকূল্যে সে বিষয়ে একটি তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে। প্রথমত ‘অচলায়তন’ বলে নিন্দিত হলেও ভারতবর্ষ কোন একটা শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে তার ইতিহাসের সূত্রকে ছিন্ন হতে দেয়নি; যেটুকু ছিন্ন হয়েছিল সেটুকু জোড়া দিয়ে ফেলা গেছে। দ্বিতীয়ত সমাজবিকাশের যত পর্য্যায় তাকে পার হতে হয়েছে তার বিবরণ ধরে রাখতে পেরেছে তার স্মৃতিতে— তার পুরাণে, রামায়ণে, মহাভারতে।

আর সবশেষে আমাদের সৌভাগ্যসূত্রে ভারতবর্ষীয় সভ্যতা এবং ভারতীয় জ্ঞানচর্চ্চার ভিত্তিভূমির উপর দাঁড়াতে পারার সুবাদে কলিম খান এবং আমার instrumentality বা নৈমিত্তিকতায় ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থতত্ত্বের নতুনভাবে অবতারণা ও পরিস্ফুটনা হয়েছে; জোড়া দিয়ে ফেলা গেছে ইতিহাসের ছিন্ন সূত্রটুকুও। সেই তত্ত্বের আলোয় এক ধাক্কাতেই আমাদের দৃষ্টির দিগন্ত অনেক দূর বেড়ে গিয়েছে। তার ফলে শুধু আমাদের পুরাণ-রামায়ণ-মহাভারতে বিধৃত ইতিহাসটি ব্যাখ্যা করতে পারছি, তাই নয়। এর সঙ্গে মানবসভ্যতার বিকাশধারাটাও স্পষ্টতর হয়ে আমাদের গোচরে আসছে। এই সব কারণেই এই তত্ত্বের বিকাশে আমার প্রথম অবদানটি ছিল India Rediscovered নামের একটি গ্রন্থ। আমাদের যৌথ সক্রিয়তার সর্ব্বশেষ ফসল ‘বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান’ গ্রন্থে সেই উদ্ভাসন হয়েছে উজ্জ্বলতম।

ইউরোপের পৌরাণিক দুর্ব্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যদি আমরা, পুরাণকথার ক্ষেত্রে, ইউরোপ এবং ভারত পরিবর্ত্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে কে কীভাবে মোকাবিলা করেছে, তার তুলনা করি। ইউরোপের মানুষ বাইরের দেশ থেকে আসা খ্রীষ্টধর্ম্মে আশ্রয় নেওয়ার পর পুরানো পুরাণকাহিনিগুলি আস্তে আস্তে ভুলে যায়, আর সেই পুরাণভিত্তিক আচার-আচরণগুলি খ্রীষ্টীয় ধর্ম্মাচরণের নানা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে কোনমতে একটা জায়গা করে নেয়, যেখান থেকে পরবর্ত্তিকালে তাদের সহজেই হঠানো সম্ভব হয়। কিন্তু ভারতবর্ষ সমাজবাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুরাণকথাকে নানাভাবে সম্প্রসারিত করে ধারাবাহিকতা বজায় রাখে।৩

          বক্ষটীকা— ৩.

          প্রাচীন দেবতা রুদ্র থেকে শ্মশানচারী তথা নটরাজ শিব, আবার ঋক্‌বেদের বিষ্ণু

          থেকে নারায়ণ, বৃন্দাবনের মুরলীধর কৃষ্ণ, কুরুক্ষেত্রের ঈশ্বরপ্রতিম কৃষ্ণ— এক

          একটি মোড়কের মধ্যে এসে যাওয়া— এইগুলি হল সেই সম্প্রসারণ-ভিত্তিক

          বিবর্ত্তনের উদাহরণ। বলা বাহুল্য, ভারতভূমিতে মননে এবং ভাষায় ক্রিয়াভিত্তিক

          দৃষ্টিভঙ্গী সক্রিয় থাকার ফলেই এটি সম্ভব হয়েছিল।

এর ফলে শুধু পুরানো পুরাণকথা টিকে যায় তাই নয়। সমাজমনের গভীরে অব্যক্তের স্তরে শক্তিসঞ্চার হওয়ায় রীতিনীতিতে যুগোপযোগী পরিবর্ত্তন সহ সমাজও তার নিজের বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যকে ধরে রাখতে পারে।

ভারতবর্ষে যা সম্ভব হয়েছিল, ইউরোপে তা সম্ভব হল না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে বৃহত্তর ইতিহাসের মধ্যে। খ্রীষ্টপূর্ব্ব সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে ইউরোপের ইতিহাসে যবনিকা ওঠার সূচনাতেই আমরা দেখছি যোদ্ধা এবং বণিক এই দুই শ্রেণীর প্রাধান্য।৪

         বক্ষটীকা— ৪.

         খ্রীষ্টপূর্ব্ব পঞ্চম শতাব্দীর এথেন্সে পেরিক্লিসের ঘোষণা থেকে আমরা বুঝতে পারি

         গণতন্ত্রের আদর্শটি কত মহিমান্বিত হতে পারে। কিন্তু সেই পেরিক্লিসের এথেন্সে যে

         জ্ঞানীর প্রাধান্য না থেকে বণিকের প্রাধান্য ছিল তা বুঝতে কষ্ট হয় না। দার্শনিক-

         রাজা থাকা কাম্য, এ কথা প্লেটো যে ভাবে বলছেন তাঁর Republic নামের গ্রন্থে, তা

         থেকেই বোঝা যায়, বাস্তবে তার নমুনা পাওয়া যেত না। আবার সোফোক্লিসের

         রাজা অয়দিপাউস নাটকে জ্ঞানী টাইরেসিয়াসের লাঞ্ছনাতে কোরাসরূপী

         নগরবৃদ্ধদের নীরবতা থেকে বোঝা যায়, খ্রীষ্টপূর্ব্ব পঞ্চম কি চতুর্থ শতাব্দীর এথেন্সে

         সমাজের সর্বোচ্চ আসনে জ্ঞানীরা অধিষ্ঠিত ছিল না। সোফোক্লিসের নাটকে

         পুঁজির বিধ্বংসী চরিত্র নিয়ে ধিক্কারেও আমরা পাই সমাজে বণিকের প্রতিপত্তির

         প্রমাণ।

         Of all the foul growths current in the world, /

         The worst is money. Money drives men from home, /

         Plunders proud cities, and perverts honest mlnds, /

         To shameful practice, godlessness and crime. /

বণিকের আধিপত্য গ্রীসে বেশী, রোমে তার চেয়ে কম। আর সভ্যতার পথে তুলনায় পশ্চাৎপদ উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে ছিল যোদ্ধা শ্রেণীর আধিপত্য। ভারতীয় সমাজে যে মর্য্যাদা পেয়েছিল জ্ঞানী (= ভারতীয় পরিভাষায় যাকে বলতে হবে ব্রাহ্মণ), ইউরোপে সে তা পায়নি।৫

         বক্ষটীকা – ৫.

         সনাতন ভারতের তত্ত্ব অনুযায়ী সমস্ত ভূমির চূড়ান্ত অধিকারী ব্রাহ্মণ। কিন্তু প্রাক্-

         খ্রীষ্টীয় সভ্যতা বা অন্য কথায় গ্রীক-রোমক সভ্যতার পতনের পর যে ইউরোপ

         গড়ে ওঠে, সেখানে দেশের সমস্ত ভূমির উপর চূড়ান্ত অধিকারী হন রাজা, যিনি

         নিজে যোদ্ধাশ্রেণীর নেতৃস্থানীয়। সেই ইউরোপে জ্ঞানী বা ব্রাহ্মণের ভূমিকায় আছে

         চার্চ্চ, কিন্তু তার মর্য্যাদা ও অধিকার অনেক সীমিত। রাজাকে অভিষিক্ত করার

         দায়িত্ব ও অধিকার হল চার্চ্চের সর্ব্বোচ্চ যাজকের (= পোপের / আর্চ্চবিশপের),

         এবং চার্চ্চের খাস এলাকা রাজার এক্তিয়ারের বাইরে থাকছে বটে, কিন্তু বাকী সারা

         দেশের ভূসম্পদ, অর্থাৎ কৃষিজমি-অরণ্য ইত্যাদি, সবের অধিকারী রাজা।

জ্ঞানীর এই অবমূল্যায়নের ফলেই ইউরোপের মানুষের মনে পুরাণনিহিত বিশ্বাসগুলি দুর্ব্বল হয়ে গেল, নাকি মানুষের মনে পুরাণগত বিশ্বাসের দৃঢ়তা না থাকার ফলে জ্ঞানীর বা ব্রাহ্মণস্থানীয়ের প্রাধান্য হ্রাস পেয়েছিল, সে বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন নেই।৬

          বক্ষটীকা— ৬.

          অবশ্যই এই সমাজের ছিন্নমূল চরিত্র নিয়ে অনিবার্য্য ভাবে মনে একটা খটকা না

          এসে পারে না। এবং একথাও মনে আসে যে সমাজের ছিন্নমূল চরিত্রের জন্যই

          ইউরোপের মানবগোষ্ঠিগুলি বহিরাগত খ্রীষ্টধর্ম্মকে ঠেকাতে পারেনি।

তবে সমাজে জ্ঞানীর মর্য্যাদা হ্রাস এবং যোদ্ধা ও বণিকের আধিপত্য বৃদ্ধি একটা জিনিসের নিশ্চিত নির্দ্দেশক। তা হল ইউরোপে মানুষের মনন বা ভাবনার জগতে ঘটেছিল অধোগতি, এবং দেহবাদী জীবনদর্শন সমাজকে ক্রমে আচ্ছন্ন করতে থাকে। চেতনার গভীর স্তরে অব্যক্ত কিন্তু নিশ্চিতভাবে সক্রিয় যে সব বিশ্বাসের জোরে সমাজবদ্ধ মানুষ শক্তভাবে খাড়া থাকতে পারে, তেমন বিশ্বাসের জায়গায়, অন্য কথায় সমাজমনে অন্তর্লীন myth বা পুরাণের জগতে, ইউরোপ হয়ে যায় দুর্ব্বল, অন্যান্য ক্ষেত্রে তার যতই প্রাণপ্রাচুর্য্য থাকুক না কেন। খ্রীষ্টধর্ম্মের প্রসারের ফলে পুরাণ বা myth–এর জগতে ইউরোপ সত্যিই এক দেউলিয়া অবস্থায় পৌঁছে যায়।

তবে এই পৌরাণিক ঘাটতিই আবার ইউরোপের ভূমিতে এক নতুন পরিণাম যথা পুঁজির চরম বিকাশের রাস্তা খুলে দেয়। এবং সেটির ফলাফল শুধু পাশ্চাত্য দেশেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং বলা যায়, অন্তিমে এটি মনুষ্য জাতিকে দেয় এক কঠিন অভিজ্ঞতা, যেটার মূল্যেই মানবসভ্যতার নতুন পর্য্যায়ে উত্তরণ সম্ভব। স্থূলভাবে বললে সেটি এই যে, পুঁজির উপর যতক্ষণ শুভবুদ্ধিচালিত সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকে, ততক্ষণই সে কল্যাণসাধক লক্ষ্মীপুঁজি; আর যখন তার ওপর এই নিয়ন্ত্রণ থাকে না, তখন তার চেষ্টা হয় শুধু নিজেকে বাড়িয়ে চলা।

ভারতের প্রজ্ঞা অনেকটা অব্যক্ত ভাবেই বুঝে গিয়েছিল পুঁজির অন্তর্নিহিত এই বিধ্বংসী সম্ভাবনা। তাই সে কালাপানি বা সমুদ্র পার হওয়া নিষিদ্ধ করে, এবং সমাজে বণিকের স্থান নির্দ্দিষ্ট করে দেয় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের পরে, এবং বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস এই দুই আশ্রমে বণিকের অধিকার নেই, এমন ঘোষণা করে। এছাড়াও ভারতের সমাজপতিরা মানুষের কর্ত্তব্য-অকর্ত্তব্য নিয়ে অনেক নির্দ্দেশ দেয় যেগুলি আজকের ‘আধুনিক’ ভারতীয়ের কাছে দুর্ব্বোধ্য, যার মধ্যে পড়ে গোমাংস, গোবর, গোমূত্র নিয়ে নানান নিয়ম, যেগুলির ব্যাখ্যা কলিম খান আর আমি ইতোপূর্ব্বেই লিখেছি আমাদের নানা লেখায়। চীন এবং জাপানও সমাজে বণিককে সর্ব্বোচ্চ আসন দেয়নি। এমন-কি ইসলাম বাণিজ্যকে স্বাগত জানিয়েও সমাজের সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে এমন নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে যাতে পুঁজির পক্ষে লাগামছাড়া বিকাশ ইসলামের পতাকাতলে সম্ভব হতে পারে না।

পুঁজির বিকাশের আদ্যোপান্ত ইতিহাস সম্বন্ধে কলিম খান এবং আমার যৌথ রচনায় একাধিক জায়গায় বিস্তৃত আলোচনা করা আছে। এই নিবন্ধের স্বয়ংসম্পূর্ণতার জন্য শুধু কিছু মূল কথার পুনরুক্তি করছি। ভোগ্যবস্তুর উৎপাদনের কৃৎ-কৌশলে পরিবর্ত্তনের সূত্রে নিসর্গ প্রকৃতির ওপর মানুষের ক্ষমতা যত বৃদ্ধি পায়, ততই মানুষের সমাজ টুকরো টুকরো হয়ে যায়, মানুষের মানসিক সুস্থিতি নষ্ট হয়, এবং এক কথায় মহাভারতের মৌষল পর্ব্বে বর্ণিত ধ্বংসের দিকে মানুষের সমাজ এগিয়ে যায়। এবং শেষ পর্য্যন্ত এই পৃথিবী প্রাণের অযোগ্য হবার দিকে চলে যায়। ইতিহাস থেকে আমরা দেখছি যে, ভ্রান্তনীতির ফলে, তাদের প্রাণশক্তির বিপুল প্রাচুর্য্যের কারণে ঠিক এই ভাবেই ইউরোপ ও তার উত্তরসাধক মার্কিন দেশ তিন-চার শতাব্দী ধরে নেতৃত্ব দিয়ে মানবসভ্যতাকে সর্ব্বনাশের কিনারে নিয়ে আসে, ঠিক আজ আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি।

তাই, ইউরোপের পৌরাণিক ঘাটতিকে ব্যাধির কারণ না ভেবে ব্যাধির লক্ষণ বলে যদি ধরে নিই, তবেই আমাদের বিশ্ববীক্ষা পূর্ণতর হয়।

.

.

.

59988119_1370063993133849_5472995070590320640_nরবি চক্রবর্ত্তী
জন্ম: ২৪শে অক্টোবর ১৯২৯, কোন্নগর, হুগলী।

রবি চক্রবর্ত্তী’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:
১. India Rediscovered (2002)
২. দিগন্তের টানে : The Lure of Horizon (২০১২)

কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী’র প্রকাশিত গ্রন্থাবলী:

১. বাংলাভাষা : প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ (২০০৬)
২. অবিকল্পসন্ধান : বাংলা থেকে বিশ্বে (২০০৮)
৩. বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ১ম খণ্ড (২০০৯) ও বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ২য় খণ্ড (২০১১)
৪. সুন্দর হে সুন্দর (২০১১)
৫. বঙ্গযান (২০১২)
৬. সরল শব্দার্থকোষ (২০১৩)
৭. বাংলা বাঁচলে সভ্যতা বাঁচবে (২০১৩)
৮. বঙ্গতীর্থে মুক্তিস্নান : বাংলাভাষা থেকে সভ্যতার ভবিতব্যে (২০১৫)
৯. ভাষাই পরম আলো (২০১৭)

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার