[ আলোচ্য শব্দ: ভাস্কর্য্য। মূর্ত্তি। ভীম, রাগ ভীমপলশ্রী, ভীমরতি। সন্ধ্যা। টিকটিকি। ]
ভাস্কর্য্য—
কবি কল্পনা করেন তারপর কল্পনার ছবি আঁকেন বর্ণ দিয়ে কাগজের পাতায়। কেবল কবি-ই যে কল্পনা করেন, তা কিন্তু নয়। কল্পনা সবাই করে, কিন্তু কবিতা সবাই লিখতে পারেন না। তেমনি মনে মনে আমরা কত আকাশকুসুম ভাবি, এরকম একটা জিনিস যদি হত, সেই জিনিসটা যে কী তা আমরা নিজেই হয়ত ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। যেমন এরোপ্লেন আবিষ্কারের আগে মানুষ ভেবেছে যদি পাখীর মত উড়তে পারতাম! সেই ভাবনাকেই বাস্তবে রূপ দিয়েছেন রাইট ব্রাদার্স, এরোপ্লেন আবিষ্কার করে। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, তা আমরা দেখি, আবার অনেক কিছু আছে যা আমরা দেখি না। কিছু বিষয় মূর্ত্ত, কিছু বিষয় বিমূর্ত্ত। বিমূর্ত্ত বিষয়গুলো আমাদের সাথে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু সেগুলো অদৃশ্য। সেগুলোকে হয়ত কোন শিল্পী তার কল্পনার রঙ ছড়িয়ে মূর্ত্ত করার চেষ্টা করেন।
প্রাচীনকালের মানুষেরা দৃশ্যমান বিষয়কে শব্দে-ভাষায়, ছবিতে-আঁকায়, মূর্ত্তিতে-প্রতিমায় মূর্ত্ত করার কথা ভাবতেও পারতেন না। যা কিছু অদৃশ্য কেবল সেগুলোকেই তাঁরা কোন মাধ্যমে মূর্ত্তমান করার কথা ভাবতেন, এবং রূপ দিতেন। কাজেই যা কিছু অদৃশ্য কিন্তু আমাদের সাথে গভীরভাবে জড়িত, আমাদের আবেগ-অনুভূতির সাথে সম্পর্কযুক্ত তাকেই খোদাই করে সকলের সামনে প্রকাশিত করে দেওয়ার জন্য, উদ্ভাসিত করে দেওয়ার জন্য, বিভাসিত করে দেওয়ার জন্য, ভাসিত করার জন্য, ভাস্ করার জন্য— মানুষের সমাজে ভাস্কর-এর জন্ম হয়েছিল। কোন অদৃশ্য কিন্তু সক্রিয় সত্তাকে ভাস্ করাই ভাস্করের কাজ। ভাস্করের কাজ ভাস্কর্য্য নির্ম্মাণ, যার মাধ্যমে অদৃশ্য ভাস্বর হয়ে থাকে মনে।
ইংরেজীতে Flowervase এর vase আর আমাদের ভাস-এর একই উত্তরাধিকার, একই ক্রিয়ামূলের বংশে জাত। পাশ্চাত্যে vase ছিল ফুলদানীর মত পাত্র, যার মধ্যে মৃত ব্যক্তির চিতাভস্ম রাখা হত, গ্রীসেও এই রীতি ছিল। সেই vase এর গায়ে নানা পৌরাণিককাহিনীর চরিত্র খোদাই করা থাকত।
ভাস্কর (ভাস্কর্য্য): ভাস্ + √কৃ + অ (ট) – কর্ত্তৃবাচ্যে। (ব.শ)। ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ: “ভাস্কর = ভাস্ (ভা-এর বা ভবাধারের প্রকাশন) করে যে; অথবা, অদৃশ্য-সক্রিয় সত্তাকে ভাস্ (প্রকাশ) করে যে। ভাস্কর্য্য = ভাস্কর গত যে আধারে; যাহাতে ভাস্কর-এর ভাস্-কর্ম্ম কৃত হইয়াছে”। “ভাস্কর = পাথরে চিত্রাদি খোদে যে”। (ব.শব্দকোষ)। ভাস্কর = দীপ্তিকর, উজ্বল, সূর্য্য, প্রতিবিম্বিত সূর্য্য, শিব, অগ্নি, বীর, ভাস্করাচার্য্য— ইত্যাদি। ভাস্কর্য্য = ভাস্করকর্ম্ম, খোদাই-এর কাজ। (ব. শব্দকোষ)।
কৃতজ্ঞতা: বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ।
মূর্ত্তি—
মূর্ত্তি শব্দটি মূর্ত্ত হতে জাত, মূর্ত্ত গতিশীল হলে মূর্ত্তি হয়। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ অনুযায়ী এর ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল মূর্-কে (নবরূপী সীমায়িতের আবর্ত্তমানকে) তারণ করে যে; এবং, মূর্ত্তি হল মূর্ত্ত গতিশীল থাকে যাহাতে।
মূর্ত্ত “মূর্চ্ছ” ক্রিয়ামূলের বংশে জাত। মূর্চ্ছ = নবরূপী সীমায়িতের আধারের রক্ষণ চয়ন ছাদিত যাহাতে। সেকালে বাংলাভাষীরা মূর্ত্তিকে এভাবে ভেবেছিলেন— যে কিনা ভিতরে ভিতরে প্রাণবন্ত, যে বাড়ে কিংবা কমে।
মানুষ যখম মূর্চ্ছা যায় কোন কারণবশতঃ তখন সে মূর্চ্ছিত হয়, কিন্তু তার ভেতর প্রাণ থাকে। কাজেই মূর্চ্ছিত হলে বা মূর্চ্ছা গেলেই মৃত নয়। মূর্ত্তিকেও এমনভাবেই কল্পনা করা হয় যেন তার ভেতর প্রাণ লুকিয়ে আছে ছাদিত হয়ে। মূর্ত্ত মূর্ত্তিমান হয় কারণ তার অবয়ব থাকে। অমূর্ত্ত হল অবয়বহীন। বঙ্গীয় শব্দকোষ জানাচ্ছেন, “মূর্ত্ত হল পরিচ্ছিন্ন, এবং অমূর্ত্ত হল অবচ্ছিন্ন-পরিমাণ”। পরিচ্ছিন্ন > খণ্ডিত, বিভাজিত, পরিমিত, সসীম; পরি + ছিদ্ + ত।
এই বিশ্বজগৎ ছিল, আছে, থাকে অনবচ্ছিন্ন এক সামগ্রিক রূপে; তার থেকে কিছু কিছু অংশ পরিচ্ছিন্ন বা অবচ্ছিন্ন হয়ে পৃথক দেহধারণ করে, সেটাই মূর্ত্ত। অবচ্ছিন্ন > বিভক্ত, বিচ্ছিন্ন, নিরবচ্ছিন্ন, মিশ্রিত দুঃখাবচ্ছিন্ন সুখ, সীমাবদ্ধ। বিশ্বের সকল মূর্ত্তিমান সত্তাই সেভাবেই অস্তিত্ব লাভ করেছে; একদিন তারা প্রত্যেকেই অনবচ্ছিন্নতাতে মিলে যাবে। অনবচ্ছিন্ন > বিরামহীন একটানা।
যখন তারা আবার অনবচ্ছিন্ন-পরিমাণে মিলে যাবে তখন আবার খণ্ডিতরূপগুলোই অখণ্ডতে পরিণত হবে, সামগ্রিক রূপে মিলে যাবে, তখন তা অমূর্ত্ত হয়ে যাবে পুনরায়, মূর্ত্ত থাকবে না কারণ তা অবয়বহীন হবে।
মূর্ত্ত: মূর্চ্ছ্ + ত (ক্ত) – কর্ত্তৃবাচ্যে। (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। মূর্ত্ত = মোহপ্রাপ্ত, মূর্চ্ছিত, মূঢ়, মূর্ত্তিমান, শরীরী, পরিচ্ছিন্ন, কঠিন, ভূতাত্মক, ভৌতিক। মূর্ত্তি = তনু, দেহ, শরীর, শরীরাবয়ব, আকৃতি, স্বরূপ, শরীরপার্থিবভাগ— ইত্যাদি। মূর্ত্তি = যাহা বাড়ে। (বঙ্গীয় শব্দকোষ)।
যা পরিবর্তনশীল, যা বাড়ে বা কমে তাই মূর্ত্তি, এটির অবয়ব থাকে, এবং একদিন সকল মূর্ত্তিই মিশে যাবে বিশ্বজগতের অখণ্ডতায়।
সূত্র: বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, অনলাইন ডিকশনারী।
ভীম, রাগ ভীমপলশ্রী, ভীমরতি—
ভীম শব্দের অর্থ হচ্ছে ভয়, ভয়ঙ্কর, ভীষণ— ইত্যাদি। √ভী + ম (মক্) – অপাদানে। (ব.শ)। ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ হল ভী (পূর্ণরূপে সীমায়িত যাহাতে। (ভ হল শোভা পায় যে, দীপ্ত যে; ভ গতিশীল হলে ভি, ভি এর আধার ভী)। বঙ্গীয় শব্দকোষ বলেছেন যাহা হইতে ভয়। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে ভীম হল এমনই এক বস্তু যা ভীষণ ভয়ের বটে।
তবে ভীম থেকে ভীমপলশ্রী হয়ে যখন গানের রাগ হয়, তখন তা ভয়ের নয়। ভীমপলশ্রী হচ্ছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একটি রাগ। ধীরগতিসম্পন্ন, শান্ত সৌম্য ভাব এর। এর আরোহনে থাকে পাঁচটি স্বর, অবরোহনে থাকে সাতটি স্বর, এর সময় হল বিকাল। পান্নালাল ভট্টাচার্য গেয়েছিলেন ভীমপলশ্রী রাগে “আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিল সকলই ফুরায়ে যায় মা” — গান শুনে মন জুড়িয়ে যায়। নজরুলের অনেক গান আছে ভীমপলশ্রী রাগের উপর, “কেন আনো ফুল ডোর, আজি বিদায় বেলায়”। ভীমপলশ্রী রাগকে ভীমপলাশি রাগও বলা হয়।
ভীমরতি বলে একটি শব্দ কথা আছে। বয়স্ক কেউ উল্টাপাল্টা আচরণ করলে বলা হয় তাকে ভীমরতিতে পেয়েছে।
মানুষ জীবনে দশকের এক একটি ঘাট পেরোলে একেক অভিধা পায় মনে হয়। যেমন চল্লিশে পড়লে বলে চালশে। তখন চোখে চশমা লাগাতে হয়। পঞ্চাশের আগে উনপঞ্চাশ হলে উল্টাপাল্টা আচরণ করলে বলে মাথায় উনপঞ্চাশ বায়ু চড়েছে, এর মানে হল মাথায় ভয়ানক গণ্ডগোল। ষাটে পড়লে বলে ষাইটা উলি(কলরব)। ষাইটা উলি লাগলে ষাট বছরে নাকি ফের যৌবন ফিরে আসে। সত্তর পার হলে বাহাত্তুরে। বয়স যখন সাতাত্তর হয়, তখন নাকি ভীমরতি ধরে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন তাঁর বাঙ্গালা ভাষার অভিধানে ‘ভীমরথী’ এভাবে লিখেছেন। ৭৭ বৎসর ৭মাস ৭রাত্রি পূর্ণ হলে মানুষের ভীমরতি দশা হয়। তখন নাকি সকল কাজই সুখপ্রদ। হিন্দুশাস্ত্রমতে এ সময় কথা বললে মন্ত্রজপের মত সুখ, নিদ্রা করলে ধ্যান, অন্নগ্রহণ সুধাতুল্য।
আসল কথা অতিশয় বার্দ্ধক্যহেতু বুদ্ধিভ্রংশ হয়, কিছু খেয়াল থাকে না, উল্টাপাল্টা আচরণ করে। ভীম হল ভীষণ, রতি হল রাত্রি, কাজেই ভীমরতির আরেক মানে ভীষণ রাত্রি। মানব জীবনে তখন হয়ত ঘোর অমানিশা নেমে আসে। অনেক বুড়ো এই বয়সে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়, এর বৈজ্ঞানিক কারণও আছে।
মহাভারতে ভীম এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ভীমকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনার বিবরণ আছে মহাভারতে।
আপাতত ভীমপলশ্রী আর ভীমরতি নিয়ে আলোচনা, এ পর্য্যন্তই।
কৃতজ্ঞতা: বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, ইন্টারনেট।
সন্ধ্যা—
সন্ধ্যা নামে একটি নদী আছে, জানেন তো! আমার এক দিদি ছিলেন সন্ধ্যা নামে। আমাদের গ্রামের স্কুলের সমাবেশে উনি জাতীয় সঙ্গীত গাইতেন। তখন এই অংশটুকুও গাওয়া হত—
“তোমার এই খেলাঘরে শিশুকাল কাটিলে রে,
তোমারি ধুলামাটি অঙ্গে মাখি ধন্য জীবন মানি।
তুই দিন ফুরালে সন্ধ্যাকালে কী দীপ জ্বালিস ঘরে,
মরি হায়, হায় রে—
তখন খেলাধুলা সকল ফেলে, ও মা, তোমার কোলে ছুটে আসি॥”
— আর গ্রামের বাড়ীর যে গরুর রাখাল সে ওই সন্ধ্যাবেলাটাতেই গরুর পাল নিয়ে বাড়ী আসত, গরুগুলোকে বাড়ির ভেতরে আনার পর আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত না, একেকটা একেক দিকে দৌড়াত, মাগরিবের আজান পড়ত, বাড়ির পুকুর ঘাটে হাত পা ধুয়ে ঘরে যাবার আয়োজন, ঘরে ঘরে হারিকেন বা ল্যাম বাতি জ্বালিয়ে দেওয়া হত। ঘরের বাইরে বের হওয়া সেই সময়টায় নিষেধ, চুল খোলা রাখা নিষেধ। মুরব্বীরা এইসময়ে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করেন, বলেন “দু’সমা সময়ে বাইরে যেতে হয় না, এসময় বাইরে গেলে ভূতে ধরে”।
যাইহোক, এই যে দু’সমা সময় এ নিয়ে আমার প্রচুর কৌতুহল ছিল, কী এই সময়টা, যাকে দু’সমা সময় বলে! আসলে দু’সমা হল দুয়ের সংযোগ। এক যাচ্ছে আরেক আসছে, এই যাওয়া আসার পথে দুয়ের দেখা হল যেখানে, মিলন হল বা সন্ধি হল যেখানে, সেই সময়টাই হল সন্ধিকাল বা সন্ধ্যা। সন্ধ্যা হল তিনপ্রকার, প্রাতঃসন্ধ্যা, সায়ংসন্ধ্যা, ঠিক মধ্যাহ্নকাল। আমরা বলি সান্ধ্যকালীন আসর। এই সান্ধ্য হল সন্ধ্যাকালীন বা সন্ধ্যা সমন্ধীয়।
সন্ধি হল সংযোগ, দেহের অস্থির জোড় বা সংযোগস্থানকেও সন্ধি বলে, সন্ধি হয় শত্রুতে শত্রুতে, যুদ্ধকালে এমনকি ব্যাকরণেও সন্ধি আছে। সন্ধিচৌর হল সিঁদেল চোর। দিবারাত্রির মিলনকাল হল সন্ধিবেলা। সন্ধ্যামনি ফুল সন্ধ্যাকালে ফোটে।
বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন চর্যাপদের ভাষা হল সন্ধ্যাভাষা। কারণ সেটা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। সন্ধ্যার ভাষা আলো-আঁধারির ভাষা, কতক আলো কতক অন্ধকার; কিছু বোঝা যায়, কিছু বোঝা যায় না। এ যেন,
“ভুবনজোড়া ফাঁদ পেতেছ
কেমনে দিই ফাঁকি
আধেক ধরা পড়েছি গো
আধেক আছে বাকি।”
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই ভাষাকেই সন্ধ্যাভাষা বলেছেন।
সান্ধ্যক্ষরও আছে, পাশাপাশি দু’টি স্বরধ্বনি একটি স্বরধ্বনি রূপে উচ্চারিত হলে মিলিত স্বরধ্বনিটিকে বলা হয় সান্ধ্যক্ষর বা দ্বি-স্বর।
সন্ধ্যা: সম্ + ধ্যৈ + অ (অঙ্) — ভাববাচ্যে + স্ত্রী আ (টাপ্), সন্ধিস্থানে জন্মায় যে— (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ যাকে বলেছেন ক্রিয়াভিত্তিক শব্দার্থবিধি অনুযায়ী “সমান ধ্যান থাকে যাহাতে; অথবা, সমান ধ্যান করে যে”।
যুগসন্ধ্যা: যুগ পরিমাণের দশমাংশ কাল, অর্থাৎ “সত্যযুগ চারি সহস্র দৈববর্ষ, তাহার সন্ধ্যা চারি শত দৈববৎসর; ত্রেতা তিন সহস্র দৈববর্ষ, তাহার সন্ধ্যা তিন শত দৈববৎসর; দ্বাপর দুই সহস্র দৈববর্ষ, তাহার সন্ধ্যা দুই শত দৈববর্ষ; কলি এক সহস্র দৈববর্ষ, তাহার সন্ধ্যা এক শত দৈববৎসর (— বঙ্গীয় শব্দকোষ)। ( দৈববর্ষ = পৌরাণিক দেবতাদের ১ দিন সমান মানুষ্যের বা সৌরবছরের হিসেবে ৩৬০ দিন)
রাত্রি ও দিনের বা অন্ধকার ও আলোর সমান ধ্যান করে যে, তাকে বলে সন্ধ্যা। দুই রকম পরিস্থিতিতে উভয়ের প্রতি সমান ধ্যানকারী স্থান-কাল-পাত্রকে বলে সন্ধ্যা।
হিন্দীতে সন্ধ্যা বোঝাতে সাম কথাটি ব্যবহার হয়, যা সমান ধ্যানকারী বোঝায়। ইংরেজীতে evening এর even এর অর্থ সমান, কেন সমান সেটি আমরা কখনও ভেবে দেখিনি। আসলে এমনটি কি নয় যে সকল ভাষার আদি উত্তরাধিকার আসলে এক!
কৃতজ্ঞতা: বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, বঙ্গীয় শব্দকোষ, বাঙ্গালা ভাষার অভিধান, ইন্টারনেট, উইকিপিডিয়া।
টিকটিকি—
কথা বলার সময় টিকটিকি ডেকে উঠলে ছোটবেলা আমরা বলতাম, ওই দেখ টিকটিকি ডেকে উঠেছে, টিক টিক করছে কাজেই আমার কথা ঠিক। বড়রাও এমন করেন। টিকটিকি নিয়ে আমাদের সমাজে বহু কথা চালু আছে।
টিকটিকির পরিচয় হল এটি কর্ডাটা পর্ব্বের সরীসৃপ শ্রেণীর মেরুদণ্ডী প্রাণী। এটি আমাদের বাড়িঘরেই আমাদের সাথে বাস করে, দেওয়াল ছাদ বেয়ে পোকামাকড় খুঁজে বেড়ায়। এটি সাধারণত নিশাচর নিরীহগোছের প্রাণী, কারও তেমন ক্ষতি করে না। টিকটিকি নিয়ে অনেক কথা, অনেক বিশ্বাস প্রচলিত আছে।
আমি একটা নাটকে দেখেছিলাম টিকটিকির মল বা লেজ খাবারে পড়ে খাবার বিষাক্ত হয়েছে, সে খাবার খেয়ে স্কুলের কিছু বাচ্চা অসুস্থ হয়েছে। আসলে ওটা নাটক, আর নাটকে প্রচলিত কুসংস্কারটিকেই তুলে ধরা হয়েছে। আসলে টিকটিকির মল খাবারে পড়লে খাবারটিকে খেতে ঘৃণা হতে পারে, জোর করে খেলে শরীর অসুস্থ হতে পারে। এক্ষেত্রে বনের নয়, মনের বাঘেই খায়। টিকটিকির মলের সাদা অংশে ইউরিক এসিড থাকে, সেটা খেলে মানুষের মৃত্যু হবে, এমন কোনও কারণ নেই। টিকটিকির শরীরে যদি অন্যান্য সরীসৃপের মত সালমোনেলা জাতীয় ব্যাকটেরিয়া থাকে তবে তা খাবারের সাথে কোনও ভাবে মিশে গেলে, এবং তা কেউ খেলে ডায়রিয়া বা বমি বমি ভাব হতে পারে।
টিকটিকি টিক টিক করে সতর্ক সঙ্কেত পাঠায় অন্যান্য টিকটিকিদের, এটার সাথে কারও কথার ঠিক বেঠিক হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। ফিলিপাইনের লোকজন বিশ্বাস করে টিকটিকি টিক টিক ডাকলে অতিথি আসবে বা চিঠি আসবে। দক্ষিণপূর্ব্ব এশিয়ায় টিকটিকিকে শুভলক্ষণের প্রতীক ভাবা হয়। ভারতবর্ষে টিকটিকিকে শুভ অশুভ লক্ষণ তথা ভবিষ্যতের কথা বলে দিতে পারে এমন ভাবা হয়। কারও গায়ে টিকটিকি পড়লে তিনি সম্মানিত হবেন, টিকটিকি বাম কাঁধে পড়লে আয়ু বৃদ্ধি পাবে, মরা টিকটিকি স্বপ্নে দেখলে ক্ষতি হবে, খেতে বসলে টিকটিকির ডাক শোনা ভাল, পায়ের উপর টিকটিকি পড়লে শরীর খারাপ হবে— এ ধরণের অসংখ্য কুসংস্কার প্রচলিত আছে।
আমাদের বাসগৃহে যেসব টিকটিকি বাস করে, সেগুলো আকারে ছোট। এগুলো পাঁচ বছরের মত বাঁচতে পারে।
টিকটিকির লেজ খসে, কেন খসে পড়ে এটি বৈজ্ঞানিকদের কৌতুহলের বিষয়। কোনও টিকটিকিকে তাড়া করলে সে লেজ খসিয়ে পালায়। টিকটিকির লেজ দেহ থেকে খসে পড়েও বেশ কিছুক্ষণ নড়াচড়া করে। আসলে কোন প্রাণী টিকটিকিকে তাড়া করলে সে লেজ খসিয়ে ওই প্রাণীকে বিভ্রান্ত করে, এবং সেই সুযোগে পালায়। অনেক রহস্য উপন্যাসে কারও পিছনে লাগা ফেউকে টিকটিকি বলা হয়।
টিকটিকি টিক টিক করলে কথা সত্য হবে এমন নয়, আবার টিকটিকি বিষয়ে কুসংস্কারগুলো বিশ্বাস করারও কোন যুক্তি নেই, টিকটিকিকে ভয় পাবারও কিছু নেই। তবে টিকটিকির মল দেখতে বিরক্তিকর ও ঘৃণার উদ্রেক করে। কাজেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য টিকটিকি বা অন্য পোকামাকড় খাবারের উপর বসে যাতে মলত্যাগ করে বা অন্য উপায়ে খাবারকে দুষিত ও বিষাক্ত করতে না পারে, সেজন্য খাবার ঢেকে রাখতে হবে।
টিকটিকি তাড়ানোর ঘরোয়া উপায়:
১। টিকটিকির উৎপাত যেখানে বেশী, সেখানে ডিমের খোসা রাখলে এর গন্ধে অল্প সময়েই টিকটিকি মুক্ত হবে জায়গাটি।
২। জানালার কোণে বা ভেন্টিলেটরে রেখে দিন রসুনের কোয়া। রসুনের কোয়ায় গন্ধে বাড়ি টিকটিকি মুক্ত হবে সহজেই।
৩। পেঁয়াজের মধ্যে থাকা সালফারের গন্ধ টিকটিকি সহ্য করতে পারে না। তাই টিকটিকির চলাচলের পথে বা জানালার কোণে কয়েক টুকরা পেঁয়াজ কিছু সময়ের জন্য রেখে দিলে সহজেই জব্দ হবে টিকটিকি।
৪। গোলমরিচ বা শুকনো মরিচের গুঁড়ার গন্ধ টিকিটির মস্তিষ্ককে অবশ করে দেয়। শরীরের অস্বস্তি এড়াতে এই গন্ধ থেকে দূরে থাকে টিকটিকি। তাই গোলমরিচের গুঁড়া বা মরিচের গুঁড়া পানিতে মিশিয়ে টিকটিকি উপদ্রুত এলাকায় স্প্রে করলে ঘরে টিকটিকি আসে না। তবে বাড়িতে শিশু থাকলে এই উপায় অবলম্বনে বাড়তি সতর্কতা নিন। কোনওভাবেই এই স্প্রে যেন তাদের নাগালের মধ্যে না যায়।
৫। তামাকের কড়া গন্ধ টিকটিকি সহ্য করতে পারে না। কিছুটা কফি পাউডারের সঙ্গে তামাকের গুঁড়া মিশিয়ে ছোট ছোট গুলি আকারের বল তৈরি করে নিন। তার পর সেগুলো টিকটিকির চলাচলের পথে রেখে দিন। এতে সহজেই সরবে টিকটিকি।
এবার বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ ও বঙ্গীয় শব্দকোষের আলোকে টিকটিকি ও তৎসংক্রান্ত বিষয়ে কিছু জানা যাক—
টিকটিকি: টিকটিক গতিশীল যাহাতে। টিক = গতিশীল টঙ্কার (টঙ্কার = টঙ্কা রহে যাহাতে, টঙ্কা = টঙ্ক এর আধার যে, টঙ্ক = টং করে যে, টং হল ট-এর রহস্যরূপ, কোন কিছু গিয়ে অন্য বস্তুতে আঘাত করলে যে প্রতিক্রিয়ার প্রকাশ হয়।) করে যে। টিকি = টিক গতিশীল যাহাতে।
ছোট ঘড়ি টিকটিক টিকটিক করে মৃদু শব্দ করে, টিকটিকিও তাই করে। টিক হল স্থায়ী হওয়া, অবিকৃত থাকা, সুস্থ বা কার্য্যক্ষম থাকা, নষ্ট না হওয়া, টেকা (to last)। কোন কিছু দীর্ঘস্থায়ী হলে আমরা বলি টিকে আছে। দীর্ঘ রোগভোগের পর কেউ সুস্থ হলে আমরা বলি, এ যাত্রায় টিকে গেল। করোনার ভ্যাকসিন বলে আমরা যা বলি তা হল টিকা, যেমন বসন্ত রোগের টিকা আমরা ছোটবেলা দিয়েছি, টিকা দিলে শরীরে সূঁচ ফোটানো হয়, তাতে ক্ষত সৃষ্টি হয়। তিলক, ফোঁটা, রাজফোঁটা, কয়লা-গুড়ার চাকতি, মৃত্তিকাচন্দনাদিরচিত গোল চিহ্ন, রাজার কপালের তিলক সবই টিকা। টিকি হল শিখা, চূড়া।
টিক শব্দের মূল অর্থ হল ‘টি করে যে’ অর্থাৎ সে বলে আমি টিকে আছি, টিকে আছি; টিকটিকি কিংবা ঘড়ি টিকটিক করে এ কথাই বলে যায়। টিকটিক করা মানেই টিকে থাকা, যে টঙ্কার করে নিজেকে জানান দেয়, সে তো অস্তিত্ববান বটেই। সেগুন কাঠ দীর্ঘস্থায়ী বলেই সে teak। মাথার কেশ যখন জন্মায় তখন টিক করে সে গতিশীল হতে থাকে, এজন্য তা টিকি, আর কেশ যখন নাই হতে থাকে তখন তা মনের মধ্যে বিরূপ ভাব সৃষ্টি করে, কেমন টক টক লাগে। এই টক হতেই জাত শব্দ টাক। টাক কে ধারণ করে টাকা। এজন্যই বুঝি লোকে বলে টাক থাকা টাকার লক্ষণ। এই হল টিকটিকি, টিকি, টিক, টাক, টক এর গল্প।
সূত্র: বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, বঙ্গীয় শব্দকোষ, উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট, একুশে টিভি।