মরণানন্দ দাশ, আগত নক্ষত্রদের প্রতি ও অন্যান্য কবিতা || অভিজিৎ চক্রবর্তী

0

মরণানন্দ দাশ

আজকের দিনটিকে টবে রোপণ করে জল দিয়েছি দিনের গোড়ায়
আর এক সমুদ্র নোনা মাছির জীবন নিয়ে
অনভিজ্ঞ সাপের মত খোলস পাল্টাচ্ছি প্রতিরাতে।
পৃথিবী এবং বিধাতার সঙ্গমকে সাক্ষী রেখে
বন্য ফুলের গা বেয়ে নেমে আসছি সন্ধ্যামালতীর দুঃখ হয়ে।
নিজেকে বৃক্ষ ভাবলেই রিক্ত হাতেও উপলদ্ধি করি অপার ভান্ডার
যদিও মস্তকহীন সমস্ত শরীরে শুধু ধানের মত দেনা!
সূর্য্যের নিরবিচ্ছিন্ন আলোর আদলে শুধু বাড়ছে।
পুরাতন মদিরার বোতলে বন্দী আমিও এক নিষিদ্ধ কন্ঠস্বর
যাকে সময়ের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে স্লোগান হিসেবে।

 

ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকাও

সমস্ত রাত সঙ্গমহীন বুড়ো পাখীর মত চোখ বুজে পড়ে থেকে ভোরে,
কে যায় মেঠো পথ ধরে?
সূর্য্যসন্তান!
হুরর… হুট-হুট, ষাঁড়ের কোমল চলনে পাখীরা মেলায় গান।
মাটির ব্রেসিয়ার খুলে কারা দেয় হানা?
স্তনগন্ধ্যা ফসলের মন্ত্র বল কার আছে জানা!
ভাগ্যের মত বর্ষায় জমিতে কেটে দিয়ে আইল
কে বল চাষ করা শেষে কিনে খায় চাইল?

গাছের ছায়ার নীচে ঘুমিয়েছে এ কোন দেবশিশু?
কৃষ্ণ, গৌতম হযরত না যীশু!
ঘুমন্ত এ দেহের বলেই ঘুরছে নাকি চাকাও
কী তার পরিচয়! একবার শুধু একবার, ঘর্মাক্ত এ মুখের দিকে তাকাও।

 

আগত নক্ষত্রদের প্রতি

অন্ধকার মুছে দিলে
থেমে যায় কান্নারত প্যাঁচার ডাক, আহত কোকিলের শোক।
কারো কারো পকেট থেকে বেড়িয়ে যায় দু-এক ফালি আকাশ, মেঘ বা প্রজ্বলিত বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ।
শূন্য থেকে মাথা চারা দিয়ে উঠলেই কেবল চুল ছেঁড়া বিশ্লেষণ বড্ড প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে! কী করছ,
কীসে পড়ছ কিংবা কোন ব্যক্তিগত দুঃখবোধ আছে কিনা?
রাষ্ট্রের সুনাগরিকের খাতা থেকে নাম উঠে গেলে হারিয়ে যায় প্রিয় ডাকনাম, প্রতিবেশীদের ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে ওঠে— বাড়িভর্ত্তি কথার ডালি সাজিয়ে ভেতরে পাঠানো হয় অসংখ্য গালির সমাহার।
পরচর্চ্চা করতে করতে অধিকাংশ সুশীলের গলা খরচার খাতার হিসেবে আসে, রকের আড্ডায়
তখন নতুন নক্ষত্র পড়ছে…
প্রেমিকার বিদায়ে আসে শেষ লিখিত সারমর্ম্ম,
ভবিষ্যতের কথায় সেখানে অসংখ্য তারার নাম উঠে আসে! অপেক্ষা মুছে গেলে,
নিঃসঙ্গতার গানে চাঁদ আলো মেলে!
শুধু জেগে থাকে ক্ষেপাটে প্রেমিক ও কুকুরের দল, চোখে ঠোঁটে নিয়ে ব্যথিত রক্তজবার জলছাপ্।

 

বিপ্লবী
(উৎসর্গ- নবারুণ ভট্টাচার্য’কে)

একজন কবি গলা অবধি মদে ডোবার পর পূর্ণিমার চাঁদ যখন টলতে শুরু করে
কোন এক বিষন্ন শুক্রবারে,
রাস্তার মাঝে উগলে দিতে থাকেন রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তার সচেতনতা,
বেরিয়ে আসে দু-একটি দেশের জাতীয় সংগীত আর তীক্ষ্ণ গলায় প্রতিবাদ করে বলে বসেন,
অনেক হয়েছে কবিতা, এবার অস্ত্রের চাষাবাদ শুরু কর।
মাগীপাড়ার ফাস্টগেটে দাঁড়িয়ে প্রবল নেশায় যখন সিগারেটের পাশাপাশি টেনে একটি হঠকারী রাষ্ট্রবব্যবস্থার খুলে ফেলেন কাপড়! অথবা নির্বোধ ফুলের দিকে ছুঁড়ে দেন কয়েকটি অকথ্য গালি, মৃত্যুর পর তো সেগুলোকেই কবিতা বলি!
অর্থের প্রশ্নে তার ছেঁড়া মানিব্যাগে একটি মানচিত্র ফুটে ওঠে আর অস্তগামী সূর্য্য হয়ে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে শেষ কয়েন। চায়ের কাপে তিনি ক্ষুধার সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিতে বসেন, বাজারের ব্যাগ হাতে এখানে-সেখানে খুঁজে বেড়ান প্রান্তিক চাষীদের ঠিকানা!
দুপুরে কোনকালে খাবার জুটে গেলে, দাঁত খিলিয়ে মিষ্টি হেসে বলেন, ফাক ইউর সিস্টেম…

আমি আসলে একজন খলনায়ককে চিনতাম, দিনশেষে অর্থের তাড়নায় যিনি কবি হয়ে উঠতেন।

 

ধরব ধরব করছি

একটি কলম পড়ে আছে অনাথ শিশুর মত চোখ বুজে,
তাকে ধরব ধরব করছি
যেমন জীবন,
প্রতিরাতে শূন্য হাতে তাকে ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করছি খুঁজে।
কতগুলো খয়েরী মলাট এক খাট যন্ত্রণায় অপেক্ষমাণ,
ধরব ধরব করছি
অপমান নয়,
অনীহায় জালে পেতে রেখেছি সমস্ত ঘ্রাণ।

মদের বোতল হাতে বন্ধুরা ডেকেছে অনেক,
চিত্রল হরিণের শিংয়ে ফুঁকেছে যারা মুক্তির স্বাদ
নিজের রক্ত নিজে খেয়ে আমি,
কাটিয়ে উঠেছি সেই অবসাদ।

গত শীতে শুরুর কবিতা
সেটি আবার ধরব ধরব করছি
নিজের কলমে শান দিয়ে রেখে
বহুবার রোজ মরছি।

ধরতে চেয়েছি বিলোল বনের হরিৎ টিয়ে পাখী
বুকে মেখে সবুজ রাঙা মাটি
শেয়ালের কাছে বর্গা দিয়ে চোখ, ধরতে চেয়েছি ভিক্ষাশূন্য বাটি।

ধরতে চেয়েছি করোটিবন্ধ স্নায়ু
নসিকারন্ধ্রে বাঁধতে চেয়েছি বায়ু
ধরব-লড়ব-মরব জেনেও
আক্ষেপ পুষেছি সাপের মত, কাটাচ্ছি এ আয়ু!

 

দূরন্ত লোকাল

এপাশে রোদের অভাব
পুরনো স্মৃতির এ্যালবামে পড়ে গেছে চশমার দাগ
অভাবে বিবর্ত্তিত স্বভাব
ব্যাথা-অপ্রাপ্তির খেয়ালে কত অনুরাগ।
উড়ন্ত পরযায়ী পাখী মেলে ধরেছে যেনো বহু পরিশ্রান্ত ডানা,
নষ্ট এ শহরে স্মৃতিচারণ মানা
পাথুরে দেয়ালে সেঁটে আছে নরম রোদের মত গভীর অসুখ
দূরন্ত এ লোকালে কত চেনা মুখ!
উৎসূক জনতার ভীড় ঠেলে
সে সব মুখে আজ চোখ যায় গেলে
সময় হারায় না, হারায় অধিকার
জীবন নিয়ে গেছে বহু আগেই
বেঁচে থাকা প্রতিদিন, আরেক হাহাকার
মস্তিষ্ক খোঁজে আজ একাল-সেকাল
শুধু পরিশ্রান্ত ডানায় ভর করে থেকে যায় দূরন্ত লোকাল।

 

দুঃখ, বল কী দিবে আর?

এ যেন শুধুই বয়ে যাওয়া
খালি পিস্তলের আর্ত্তনাদ নিয়ে
দুঃখ! বল কি দিবে আর?
আধ খাওয়া সিগারেটের দাম,
মেহনতি কৃষকের ঘাম?
মূল্যের বদলে আজ শূন্যের কবিতা লিখছি!
ফসল বিক্রির টাকায়
ফসিল যখন প্রতিটি পরিবার
বাজেয়াপ্ত ঘুঙুরের মত
কান্নার রোল যেহেতু উদরগত
দুঃখ! বল কি দিবে আর?
বাক্ স্বাধীনতার নামে মুখ ঢেকেছে অন্ডকোষ
রাষ্ট্রীয় কোষাগার যখন সমস্ত পাপের পাহাড়
সীমিত আকারে যেথায় গৃহীত হচ্ছে ঘুষ
সত্যের বুলিতে আজ নিষিদ্ধ আহার
আস আমরা বরং আলিঙ্গন করি!
সম্পর্কে সহোদর হয়ে ঘুমিয়ে পড়ি
গল্প করি উন্নয়নের, অনেক দূর হবে যেতে
দুঃখ, বল কী দিতে পার আর?
পেটে লাথি, বুকে শূলের আঘাত
জাতের জুতোর বাড়ী, ধর্ম্মের ভাগাড়!
অসভ্যের দেশে সভ্যের গলিত দেহের সৎকার।

 

পিনেটিভা-কে

উৎসর্গ : সেই সকল সুন্দর নার্সদের প্রতি যারা প্রতি সকালে পিপিই’এর আড়ালে একটা ছোট্ট বিন্দু কপালে দিয়ে সুস্থ ব্যক্তি ও রোগীকে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকতে ও হতে উদ্বুদ্ধ করেন।

ভালোবাসায় চার্জ কর না
দিয়ো না বিঁধিয়ে সূঁচ প্রেমিকের গায়
স্যালাইনের থেকেও তীব্র গতিতে দৌঁড়ে যাও শরীরে, মগজে, প্রতিটি অস্থি গ্রন্থিকায়
তুমি বরং প্রতিরোধী টীকার মত চামড়ায় বসে যাও গোপন জন্মদাগ।
একটি গোলাপী পোশাক আর কতটাই পারে বলো থামাতে চঞ্চলতা? তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন থামিয়ে দেয় সকল ব্যাকুলতা।
একটা কাপড়ের টুকরো মুখে বাঁধার নিয়ম করে ওরা একটা বসন্তকে আটকে রাখতে চাইছে!
অথচ এই গুমোট নিঃশ্বাসের প্রতিটি ঘরে ও দেয়ালে ঝুলে থাকতে পারতো তোমার ডাকনাম, যে নাম ধরে ডাকলে আমি মৃত্যুর পূর্ব্বে তোমাকে চাইতে পারতাম।

পিনেটিভা, জানি এটাও ছদ্মনাম
বদনাম নয়, বরং লহ প্রণাম
এমন অসুস্থতার ভীড়ে এরই বা কি কম দাম!
আপনি থেকে তুমিতে নামায় আরেকবার ক্ষমা চেয়ে নিলাম।

 

 

 

 

 

 

 

IMG_20201114_182755-01অভিজিৎ চক্রবর্তী
শেরপুর সদর, শেরপুর জেলা। ইমেইল: chakrabortyavijit03@gmail.com
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: কয়েকটি ঝিঁঝি পোকার আর্তনাদ, মধ্যাহ্ন মুখোশ, ভুল শব্দে আওড়ে গিয়েছি প্রার্থনা।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার