বাবা, ভঙ্গী শাহ্!
কী এমন ভঙ্গিমায় দর্শন করিলা, রহস্যপৃথিবী? ….
বটতলী জংশনে রয়েছ দাঁড়িয়ে, ঠাই।
ঝিক্ঝিক্, ঝিক্ ঝিক্, ঝিকিঝিকি, ঝিক্ ঝিক্…. রেলগাড়ী চলে যায়! …
রেললাইনটি মিশেছে রেললাইনটির মাঝে,
আরেকটি রেললাইন চেয়ে আছে! রেলগাড়ী চলে যায় দিগন্তের দিকে………….
সময়ের পটভূমিকায় কেবলই জংশন, পথে পথে
নামে পুরোনো মানুষ,
নতুন মানুষে, নতুন যাত্রায়, নতুন মাত্রায়, …
বাবা,
যাহা দেখলাম
ফুল ফোটার সৌন্দর্য্যে দেখলাম, …
সকল সৌন্দর্য্য তাহাদের, যারা, অজস্র সৌন্দর্য্যে ফুটছেন,
আর
যারা দেখছেন, …
জীবন— দেখার ও ফোটার, ফোটার ও দেখার ভঙ্গিমা— ধারণার সংঘাত!
গাজীর উদ্যানে
ধারণা লড়ছে, ধারণার সাথে, ফোটার সৌন্দর্য্যে!
কোন্ জনা
কী এমন ভঙ্গিমার ইশ্কুলে
দেখছে আমাকে?
ফুটুক ফুটুক মনে। আমার, এবেলা ফুটিতে নেই! কলি ফুটিতে চাহে ফুটে না! …….— গাজী ভঙ্গী শাহ্ / আরণ্যক টিটো
একটি আধ্যাত্মিক মরমী দর্শনের নাম সুফিবাদ। প্রেমে… ভাবে… সদা সর্ব্বদা উদ্বেলিত সুফী দরবেশদের অন্তরাত্মা। ভারতীয় অন্যান্য তান্ত্রিক যোগীদের মত সুফী দরবেশদেরও রয়েছে ধ্যান, ন্যাস, প্রাণায়ামসহ সাধন পদ্ধতির নানা ধাপ ও ধরণ। যেগুলো যিকির, ফিকির, মুরাকাবা, মুশাহেদা, কাশফ, জজবাসহ নানা নামে পরিচিত। … বাহির থেকে সুফী দরবেশদের জীবনকে সাধন পদ্ধতির নির্দ্দিষ্ট বেড়াজালে আবদ্ধ এবং একঘেঁয়ে মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে জীবনের পূর্ণ বিকাশের প্রশ্নে তারা একেবারে উদার। প্রেম এবং ভাব তাদের দৃষ্টিভঙ্গীকে যেমন উদার ও মানবিক করে তোলে তেমনি নানা মত ও চেতনার প্রতি করে তোলে সহনশীল। সাধনার কঠোর রীতি দ্বারা সংযত হলেও জীবন ও জগৎকে দেখার ক্ষেত্রে সুফী দরবেশরা বরাবরই প্রেমময়, উদার। …
এমনই একজন সুফী দরবেশ ‘গাজী ভঙ্গী শাহ্’। চট্টগ্রামের বটতলী রেলওয়ে জংশন সংলগ্ন তার মাজার। এই সুফী দরবেশকে নিয়েই ‘গাজী ভঙ্গী শাহ্’ নামক কবিতা।
শুরুতেই একেবারে দরবারী ধাঁচের সম্বোধন, ‘বাবা ভঙ্গী শাহ্’ বলে। তারপর লোকজ রিদমে বিষ্ময় প্রকাশ করা হয়েছে— সাধু পুরুষ কী এমন ভঙ্গিমায় এ রহস্যময় জগৎকে অবলোকন করেছেন! …
আমরা জেনেছি, সাধু দরবেশের নাম ‘ভঙ্গী শাহ্’। অবশ্যই জীবন ও জগৎকে দেখবার ক্ষেত্রে তার একটি ভঙ্গী/স্টাইল/মতবাদ ছিল। কিন্তু কৌতুহলের ব্যাপার হচ্ছে, ভঙ্গী শব্দের সাথে তার কী এমন সম্পর্ক ছিল যার কারণে দরবেশের নাম হয়েছে সরাসরি ‘ভঙ্গী’?!…
বটতলী জংশনে ভঙ্গী শাহ দাঁড়িয়ে আছেন। প্রকৃতপক্ষে ভঙ্গী শাহ নন, তার মাজার দাঁড়িয়ে আছে। আবার তিনিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। কারণ মারেফত সাধকদের মতে, সাধনার এক পর্য্যায়ে মৃত্যু সাধকের অধীন হয়ে যায়। যখন ইচ্ছা সাধক সমাধি অভ্যন্তর হতে সুক্ষ্ম দেহ ধারণ করতে পারেন। ভারতীয় তান্ত্রিক যোগীদের অষ্টসিদ্ধি ধারণা মতেও এমনটি সম্ভব।…
বহুবিধ অর্থময় দারুণ একটি চিত্রকল্প— ঝিক্ ঝিক্ ঝিকিঝিকি শব্দ তোলে রেল চলে যাচ্ছে। একটি রেললাইনের সাথে আরেকটি রেললাইন মিশে গেছে— আরেকটি রেললাইন চেয়ে আছে— রেলগাড়ী চেয়ে আছে দিগন্তের দিকে।…
যদি চিত্রকল্পটি এভাবে ভাবা হয়, রেললাইনরূপী মানুষ মিলছে মানুষের সাথে। আবার মানুষকে ছেড়ে মানুষ একা হয়ে যাচ্ছে। সময়ের রেল মানুষের সাথে মানুষকে মিলিয়ে দিচ্ছে আর মানুষের কাছ থেকে মানুষকে নিয়ে যাচ্ছে দূর থেকে দূরে। না, এভাবে হচ্ছে না।…
ভাবা যায়, মহাকালের রেলপথে জংশনটা একটা নির্দ্দিষ্ট কালপর্ব্ব। সে কালপর্ব্বে বিভিন্ন চিন্তা ও মতবাদের সমাহার। তার মধ্যে দুটি মতবাদ একে অপরের মধ্যে লীন হয়ে সমন্বয়বাদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আরেকটি মতবাদ একা হয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর এসব মতবাদ দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে রেলগাড়ীরূপী মানুষের জীবন— পুরাতন চিন্তা ও পুরাতন মানুষ তো আছেই, নতুন চিন্তায় নতুন মানুষরাও নতুন মাত্রায় নতুন যাত্রাভিমুখে চলছে। …
এমনও ভাবতে পারি, একটার সাথে একটা মিশে যাওয়া রেললাইনের একটি মানবাত্মা, অপরটি পরমাত্মা আর তৃতীয় রেললাইনটি স্থুল দেহ। রেলগাড়ীটি সত্ত্বার অনুভূতি আর জংশন হচ্ছে পূর্ণসত্তা। স্থুল দেহের বন্ধন ছিন্ন করে মানবাত্মা পরমাত্মার সাথে মিলিত হওয়ায় পুরাতন মানুষই পরিণত হচ্ছে নতুন মানুষে, কাঁচা আমি থেকে পাকা আমিতে, পাচ্ছে নতুন মাত্রা। রেললাইনগুলোকে চাইলে আমরা মারেফত কিংবা তন্ত্রযোগের ভাষায় তিনটি নাড়ীও মনে করতে পারি। না, এদিকে যাওয়া ঠিক হবে না হয়ত।…
এবার কথক নিজের দেখার ব্যাপারে সাধক পুরুষকে জানাচ্ছে— (কথক) যা দেখেছে, ফুল ফোটার সৌন্দর্য্যে দেখেছে। … ফুল ফোটার সৌন্দর্য্যে দেখা ব্যাপারটি এখানে বহুরৈখিক ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি করে। আমাদের ভাবতে হবে, ফুল ফোটার সৌন্দর্য্যে দেখার তাৎপর্য্যটা কী?! এটা কি নিছক দেখার জন্য দেখা?! অর্থাৎ জীবন আছে বলে, যাপন করার মত দৃষ্টি আছে বলে দেখা, নাকি এ দেখার সাথে জড়িয়ে আছে উপভোগ উপলব্ধির ব্যাপারও। এ কি নিষ্কাম কর্ম্মের মত দেখা, নাকি আবার বিশ্লেষণবাদী দর্শনের আত্মতৃপ্তির জন্য দেখা?! মনে হয়, এখানে দৃষ্টিভঙ্গীর বিকাশের বিষয়টি ইঙ্গিত করা হচ্ছে। কারণ একটু পরে সকল সৌন্দর্য্য তাদের বলে স্বীকার করা হচ্ছে যারা অজস্র সৌন্দর্য্যে বিকশিত হচ্ছে। অর্থাৎ যাদের চিন্তা ও জীবন সর্ব্বদা ফুলের ন্যায় বিকশিত।… সৌন্দর্য্য তাদেরও, যারা দেখছেন কিংবা উপলব্ধি করছেন— জীবনটা আসলে দেখার ও ফোটার, ফোটার ও দেখার ভঙ্গিমা আর ধারণার সংঘাত।…
সুন্দর এবং সৌন্দর্য্য নিয়ে প্রাচ্যে-প্রতীচ্যে অনেক তর্ক-বিতর্ক চলে আসছে সুদূর অতীত থেকে। কারো কারো মতে সুন্দর এবং সৌন্দর্য্য আসলে আপেক্ষিক।… কিন্তু তাতেই বিষয়টির একেবারে শেষ সুরাহা হয়ে যায় না।… সুন্দর এবং সৌন্দর্য্য যদি সরাসরি আপেক্ষিক হয় তাহলে যে কোন মানুষ নিজের কোন অসুন্দর জিনিসকে সুন্দর নাম জুড়ে দিয়ে তাকে সুন্দর বলে গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু আসলে তা কি সম্ভব?! তাহলে সুন্দর এবং সৌন্দর্য্যের সাথে মানব কিংবা মানবাত্মার কী এমন ঐন্দ্রজালিক সম্পর্ক তা আবিষ্কারের অপেক্ষা রাখে। তার আগে আমরা একেবারে যুক্তিবাদী যান্ত্রিক মানব হয়ে যেতে পারি না। যন্ত্রের মত জীবনটাকে আমরা শুধু শুধু যাপন করতে পারি না, দরকার হয় ভাবাবেগের। তাই চিন্তাশীল মাত্রই মানবেন, জীবনটা যেমন উপলব্ধির তেমনি বিকাশের আবার তেমনি জীবন সম্পর্কিত নানা চিন্তা বা ধারণার, সংঘাতেরও।… গাজীর উদ্যানে নানান জাতের পুষ্প যেমন নিজ নিজ সৌন্দর্য্য নিয়ে প্রস্ফুটিত হচ্ছে তেমনি তাতে নানান চিন্তা মতবাদ কিংবা ধারণা নিজ সৌন্দর্য্যে একে অন্যের প্রতিপক্ষ হয়ে বিকশিত হচ্ছে। …
এখানে গাজীর উদ্যানটা গাজী ভঙ্গী শাহের মাজার প্রাঙ্গন হতে পারে, তার মানস জগৎও হতে পারে। আবার এটাকে যে কোন মানবের চিন্তাজগৎও ভাবা যায়। ভাবা যায় সমগ্র মানব সমাজকেও। একজন মানুষের মানসজগতে যেমন প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চিন্তা বা ধারণার জন্ম হয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের উদ্ভব হয় তেমনি মানব সমাজেও নানা জনের নানা চিন্তা বা ধারণার সাথে চলছে প্রতিনিয়ত প্রতিষ্ঠার সংঘাত। সংঘাতে যে চিন্তা বা ধারণা বিজয়ী/গাজী হয়, তার উদ্যান বিজয়ীর উদ্যান/গাজীর উদ্যান!… গাজীর উদ্যান কি কোন খাদ্যশৃঙ্খল, যেখানে খাদ্য খাদকের মধ্যে চলছে প্রতিনিয়ত অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম, বিকাশের ধারা, টিকে থাকার যুদ্ধ যুদ্ধ আগ্রহ!? আর যে বা যারা টিকে থাকে, সে বা তারা গাজী। না, গাজীর উদ্যানটা আসলে দ্বন্দ্ব সংঘাতময় বিশ্ব। এখানে নানা মতবাদ মতাদর্শে দীক্ষিত হয়ে মানুষ জোটবদ্ধ/বিচ্ছিন্ন— মতাদর্শীর সাথে চলছে মতাদর্শীর সংঘাত। যেমন শান্তিবাদীরা লড়ছে সন্ত্রাসবাদীদের সাথে, প্রগতিবাদীরা লড়ছে মৌলবাদীদের সাথে, উদারবাদীরা লড়ছে কট্টরবাদীদের সাথে, সমাজতন্ত্রবাদীরা লড়ছে ধনতন্ত্রবাদীদের সাথে, বিকেন্দ্রবাদীরা লড়ছে কেন্দ্রবাদীদের সাথে। এভাবে চলছে নানান মতবাদের সাথে মতবাদের সংঘর্ষ, মানুষের সাথে মানুষের বিকাশের/প্রতিষ্ঠার সংঘাত। এখানে নিজের মতাদর্শ যার যার কাছে শ্রেয়। এখানে সংঘাতে বিজয়ীরা গাজী, বিজয়ীর মতাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয় ধর্ম্ম, রীতি, নীতি, বিধান, সংবিধান হিসাবে!…
সমাজে একজন মানুষ সম্পর্কে কি আর অন্য সব মানুষের ধারণা এক হয়?! যে যার দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে একজন মানুষকে দেখে। তাই একজন মানুষ সম্পর্কে নানা জনের নানান ধারণা হতে পারে।… সমাজে কে কোন ভঙ্গিমায় আমাদের দেখছে তা আমাদের পক্ষে জানা হয়ত সম্ভব হয় না। কথকেরও একই অবস্থা— কোন্ জনা তাকে কোন্ ভঙ্গিমার মাপকাঠীতে বিবেচনা করছে তা জানার অবকাশ নাই তার। কথকও চায়, সব ফুল ফুটুক সব ধারণা বিকশিত হোক। … কিন্তু কথক নিজে এ বেলায় ফুটবে না। রবীন্দ্রনাথের আন্তর্ব্বয়ানে কলি(?) ফুটতে চায় কিন্তু ফুটে না। তবে কেন, কোন্ সংশয়ে, সঙ্কোচে তা আমাদের জানা মুশকিল। …
.
.
.
দ্বীপ দিদার
জন্ম: ০৭ ডিসেম্বর ১৯৯১, মাতারবাড়ী, মহেশখালী, কক্সবাজার। প্রকাশিত গ্রন্থ: সহপাঠ গুপি গাইন, বাঘা বাইন…