শব্দের উৎস কিংবা (ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক) অর্থ সন্ধান (পর্ব্ব-৩) || রুবি বিনতে মনোয়ার

0

[আলোচ্য শব্দ: ব্যাকরণ। কর্ত্তা । কারক । করণ । কর্ম্ম]

ব্যাকরণ—
পরিবার বা দেশ চালানোর জন্য যেমন প্রধান লাগে, তেমনি মানুষের নিজেকে চালানোর জন্য লাগে মাথা, যা শরীরের অন্যতম প্রধান অঙ্গ। সমাজ বা দেশ চালাতে কর্ম্মী লাগে; কর্ম্মী সচল হলেই সমাজ বা দেশ সচল, যেমন কারখানা বহু কর্ম্মচারী (করণ দ্বারা) সচল রাখে। মানুষের মাথাকে যদি নিজেকে পরিচালনার অন্যতম অঙ্গ ধরা হয়, তবে সেই মাথায় থাকে শব্দ তৈরীর কারখানা। পুরুষ, প্রকৃতি, প্রত্যয়, বিভক্তি, উপসর্গ, কারক, লিঙ্গ, বচন, কর্ত্তা, ক্রিয়া, কাল, সন্ধি, সমাস— ইত্যাদি করণ নিয়ে শব্দ তৈরীর যে কারখানা, সেটাই ব্যাকরণ। এই করণগুলির সাহায্যে অজস্র ধাতু ও শব্দকে কার্য্যকরী রূপে গড়ে তোলা হয়, তাদের অজস্র ধাতুরূপ শব্দরূপ উৎপাদন করা হয়। এটি কীরূপ কাজ করবে, একের সঙ্গে আরেকের বন্ধন কীরূপ হবে তাও ঠিক করা হয়। এই যে শব্দরূপ কারখানা, তার মতিগতি বুঝেই প্রাচীন বাংলার পণ্ডিতেরা লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন এগুলোর স্বভাবচরিত্র। সেই লিখিত রূপই হল ব্যাকরণ। বঙ্গীয় শব্দকোষ জানিয়েছেন, “যাহা দ্বারা বা যাহাতে প্রকৃতিপ্রত্যয়ভেদে শব্দ ব্যুৎপাদিত হয়” তাকে ব্যাকরণ বলে।

ব্যাকরণ: বি-আ + √কৃ + অন (ল্যুট) – ভাববাচ্যে। (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। বি (বিধ্) ক্রিয়ামূলের বংশে জাত শব্দ ব্যাকরণ; বি (বিধ্) = বাহী গতিশীল যাহাতে। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ যাকে বলছেন, “বিশেষ আকরণ (করণের আশ্রয়) সমূহ থাকে যাহাতে।” ভাষাতত্ত্ব চলে তার দুটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে, তার একটি ব্যাকরণ অন্যটি নিরুক্ত। “যে বিষয়ের জ্ঞান দ্বারা শব্দ তৈরি করার ও শব্দের পাশে শব্দ গেঁথে কথা বলার নিয়মগুলি জানা যায়, তাকে ব্যাকরণ বলে।” “শব্দের ভেতর থেকে অর্থ নিষ্কাশনের নিয়মগুলি যে শাস্ত্র শেখায়, তাকে বলে নিরুক্ত”। ব্যাকরণ অর্থ বঙ্গীয় শব্দকোষ এভাবে দিয়েছেন— ব্যাখ্যান, স-বিস্তর বর্ণন, ব্যক্তিভাব, সংশয়, নামরূপ দ্বারা জগতিবিকাশন, বেদাঙ্গবিশেষ, শব্দশাস্ত্র, শিল্পনৈপুণ্য।

কর্ত্তা—
কর্ত্তা— √কৃ + তৃ (তৃচ্ )— কর্তৃবাচ্যে, অথবা, √ কৃৎ + তৃচ্— কর্তৃবাচ্যে। ( ব.শ )। করণকে তারিত করে যে/যে করে। যে ছেদন বা কর্ত্তন করে।( ব.শ )। অর্থ— কারক, কার্য্যকারক, সম্পাদক, নির্ম্মাতা, স্রষ্ঠা, প্রণেতা, উৎপাদক, পালনকর্ত্তা, রচয়িতা, স্বামী, রচয়িতা, লেখক, প্রধান ব্যক্তি, মুরব্বী ইত্যাদি। কর্ত্তা বানানটি আধুনিক(?) বানানরীতিতে কর্তা লেখা হয়, দ্বিত্ব বর্জন করা হয়। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে এর ফলে বর্ণের ভেতরে রাখা যে অর্থ তা সরে গিয়ে অর্থসংকোচ ঘটায়, এর ফলে শব্দটি তার অর্থ হারিয়ে ফেলে। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে আমরা দেখি শব্দটি ছিল— কর্, ত্তা- কর, তরণের তরণ, আধার। এই তিনটি সত্তা নিয়ে কর্ত্তা।
আধার হল একজন ব্যক্তি যার কাজ হচ্ছে তরণ করা, তরণ করে কর্-তরণকারীদের বা কর্মচারীদের। অর্থাৎ কর্ত্তা হল সেই সত্তা যে নিজে কর্-তরণ করে না; যে কর্-তরণ করে তাকে তরণ করে। কাজেই কর্ত্তা যেখানে অন্যকে পরিচালনা করেন, কর্তা সেখানে নিজেই কাজটি করেন, নিজেই কর্মাচারী। কারণ কর্তা = যে কর্ তরণ করে; কর্ত্তা তখন কর্তা হয়ে কর্মচারী হন নিজেই।

কারক—
কারক— √ কৃ + অক। কার করে যে। কারক ছয় প্রকার— কর্ত্তা, কর্ম্ম, করণ, সম্প্রদান, অপাদান, অধিকরণ। কার— কর হতে জাত, কর— এর আধার, করণ থাকে যেখানে। কর— কারী রহে যাহাতে। ক্রিয়া (action) ও কারক (actor) মিলে এই জগৎসংসার। সমস্ত ক্রিয়ায় রয়েছে মাত্রা রূপে নানা রকমের কারক। ক্রিয়ায় কমপক্ষে চারটি মাত্রা হয়। এক) ক্রিয়াটি নিজে থেকে হয় না, কেউ একজন করে। (কর্ত্তৃকারক)। দুই) ক্রিয়াটি কোন না কোন ক্ষেত্রের উপর করা হয়। (করণকারক)। তিন) ক্রিয়াটি প্রায়শই করা হয় কোন কিছুর সাহায্যে। (করণকারক)। চার) ক্রিয়াটি অনুষ্ঠিত হতে খানিকটা সময় লাগে। (অধিকরণকারক)। ক্রিয়ার এই চতুর্থ মাত্রা হল তার স্থান ও কাল। রুমা লিখে। এখানে ক্রিয়াপদ ‘লিখে’, বিশেষ্যপদ ‘রুমা’। ক্রিয়াপদের সাথে বিশেষ্যপদের যে সম্পর্ক তাই কারক। এখানে action হল ‘লিখে’ actor হল ‘রুমা’। “রুমা বই পড়ে”। * ‘কে’ পড়ে? — ‘রুমা’। এটা কর্ত্তৃকারক। ক্রিয়া সম্পন্ন কারী রুমা। (কেউ করে)। * রুমা ‘কী’ পড়ে? — ‘বই’। ক্রিয়ার কাজটি হল “বই” পড়া, বইকে কেন্দ্র করে কাজটি সম্পন্ন হচ্ছে, তাই বই কর্ম্মকারক। (ক্ষেত্র) * যদি প্রশ্ন হয় “রুমা কী দিয়ে পড়ে?” উত্তর হবে: বই দিয়ে পড়ে। এখানে ক্রিয়া সম্পাদনের সহায়ক হিসেবে বই, কাজেই বই করণ কারক। (সাহায্যকারী) * রুমা বাড়ীতে বই পড়ে। কোথায় পড়ে? বাড়ীতে। বাড়ীতে অধিকরণ কারক। (স্থান)। রুমা সকালে বই পড়ে। কখন পড়ে? সকালে। সকালে অধিকরণ কারক।(কাল)।

করণ—
করণ শব্দটি অর্থ হল যন্ত্র, সহায়ক বা উপায়। ক্রিয়া নিষ্পাদনে প্রধান সহায়, কারক বিশেষ। করণ: √কৃ + অন্ (ল্যুট)— কর্ত্তৃবাচ্যে।; √কৃ + অন্— ভাববাচ্যে; √কৃ + অন্— কর্ম্মবাচ্যে; √কৃ + অন্— করণবাচ্যে; √কৃ + অন— অধিকরণে। (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। করণ-এর ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ “কর-এর রহস্যরূপ থাকে যাহাতে”। যাহা দ্বারা করা যায়; যার দ্বারা ক্রিয়া সাধিত হয়; যাহার বর্গমূলাদি নিষ্কাশিত করা যায় না। (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। করণ এবং উপকরণ এক বিষয় নয়। কর্ত্তা যদি মানবশরীরের আমি হয়, তবে করণ হল তার ইন্দ্রিয়সমূহ। শরীরের আমি কারক, সে করে দেহের ইন্দ্রিয়গুলির সাহায্যে সেগুলো করণ, আর উপকরণ হচ্ছে তার কাজের ক্ষেত্র অনুযায়ী; যেমন কেউ রান্না করবে, তার উপকরণ হবে হাঁড়িপাতিল, শাকসব্জি, চাল ডাল, হাতা, খুন্তি চুলা এসব। কর্ত্তা দেশের রাজা হলে করণ তার কর্ম্মচারীরা, উপকরণ হল কর্ম্মচারীরা যে সকল বস্তু দ্বারা তাদের কাজ সম্পন্ন করে। কর দ্বারা বহুকিছুকে বোঝায়, তাই কর এর রহস্যরূপ করণ সেই বহুকিছুর অর্থকে শনাক্ত করার যোগ্যতা রাখে। যে গাণিতিক রাশিগুলির বর্গমূলাদি নিষ্কাশন করা যায় না, তাদের বলে করণী। যে জাতিরগুলির মূল জানা যায় না তাদের বলে করণজাতি।

কর্ম্ম—
কর্ম্ম: √কৃ + মন্ (মনিন্) কর্ম্মবাচ্যে। (বঙ্গীয় শব্দকোষ)। ক্রিয়াভিত্তিক ভাষায় কর্ম্ম হল সীমায়িত মন কারিত হয় যাহাতে; অথবা, সীমায়িত মনকে (মনের পরিকল্পনাকে) করণে রূপায়িত করে যে; অর্থাৎ কর্ মিতি মিত যাহাতে। কর্ম্ম হল কাজ, মানুষ কোন কাজ করতে গেলে আগে মনে মনে সেই কাজের একটি ছক কাটে কীভাবে কাজটি করা যায়। উদাহরণস্বরূপ আমি আজ বাজারে গিয়ে মাছ কিনব, সেই অনুযায়ী মনে মনে পরিকল্পনা করব কী মাছ কিনব! ছোট নাকি বড়, মাছের দাম কত হতে পারে, সে অনুযায়ী টাকা নিয়ে যে সময়ে গেলে আমার সুবিধামত মাছ কিনতে পারব সে সময়টাকে বেছে নিব, টাকা ও থলে নিব। এই ভাবনা মনে মনে সাজিয়ে মাছ কিনব এই কেন্দ্রবিন্দুতে মনকে সীমায়িত করব। তারপর আমি কাজে নেমে পড়ব অর্থাৎ মাছ কিনব।
বিশেষ উদ্দেশ্য থাকবে মনে, সামনে থাকবে উপকরণ ও হাতিয়ার তাহলেই মননে স্থিরকৃত বিষয়টি বাস্তব রূপ লাভ করবে, যদি এরকম হয় তবেই তা কর্ম্ম। বিশেষ উদ্দেশ্য মাথায় নিয়ে হাতিয়ারের সাহায্যে তা বাস্তবে রূপ দান করতে পারলেই তা কর্ম্ম হবে। উদ্দেশ্য না থাকলে কর্ম্ম হয় না। মানুষের জীবনের সমস্ত কর্ম্মকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। নিত্যকর্ম্ম, নৈমিত্তিক কর্ম্ম ও কাম্যকর্ম্ম। নিত্যকর্ম্ম হল যা মানুষকে নিত্য নিত্য করতে হয়, যেমন খাদ্যগ্রহণ ও বর্জ্জ্যত্যাগ। নৈমিত্তিক কর্ম্ম হল, যে কাজ কারো নিমিত্তে করতে হয়, যেমন চাকরী করা। কাম্য কর্ম্ম হল যে কাজ নিজের ইচ্ছানুসারে করে, যেমন কেউ বাগান করে, কেউ জনসেবা করে, কেউ শিল্পচর্চ্চা করে, কেউ স্রষ্টাকে আরাধনা করে।

কৃতজ্ঞতা: বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ, অনলাইন ডিকশনারী।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার