উপনিবেশ, ভদ্রলোক ও হরপ্রসাদ || বিশ্বেন্দু নন্দ

0

(আমি যেকজনকে গুরু মানি, তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। প্রাতিষ্ঠানিক বামীয় ইওরোপমন্য রাজনীতি ছেড়ে দেশ খুঁজতে যখন বেরোই, এবং জানার কাজে যখন তথ্য তত্ত্ব হাতড়াচ্ছি, তখন হাতে আসে হরপ্রসাদ রচনাবলী। যে বামীয় পচাগলা মায়োপিক সমাজতত্ত্বের মধ্যে আমরা বেড়েছি আজন্মকাল, সেই তত্ত্ব সৌধ নিমেষে চুরচুর হয়ে পড়ল। পরের দিকে তাঁর অনেক তত্ত্বের সংগে একমত হতে পারিনি, অনেক তথ্যই ভুল প্রমান হয়েছে কিন্তু এই মানুষটাই আমার হাত ধরে সস্নেহে হেঁটমুণ্ডঊর্ধ্বপদ অবস্থা থেকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে দেশকে, দেশের মানুষের চোখে দেখতে শিখিয়েছিলেন। প্রথমজীবনের ইওরোপমন্যতা, শেষ জীবনে এসে ব্রিটিশ রাজত্ব আর বিদ্যাসাগরের মত ভদ্রস্বরূপ বোঝার বুঝভুম্বুলকে বুঝতে পারি নিজের জীবন দিয়ে আমরা অনেকেই। আজ যদি কিছু দেশ দেখতে সদর্থক কিছুটা বিন্দুমাত্রও কোনও অবদান পেশ থাকি, সেই পথে আমায় হাঁটতে শেখানোর অগ্রপথিক তিনি যদিও আজকের কাজে তিনি ততটা অপরিহার্য্য থাকেন না। তাঁকে প্রণাম জানাই।)

নীহার(রঞ্জন রায়)বাবুদের লেখার তত্ত্ব আর ভঙ্গী অনেকটা গৌতম ভদ্রের ভাষায় ইওরোপীয় জাতি রাষ্ট্রীয় স্টেটিস্ট ধরণের। রাষ্ট্র আর ক্ষমতার দেহে গোটা সমাজের বিলয় ঘটা উচিত এটা ছিল নীহারবাবু, সুনীতিকুমার, নির্মল বসু, নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহ ইত্যাদি অসাধারণ পথভাঙ্গা সব মানুষের ভাবনা। ঔপনিবেশিক জাতিরাষ্ট্রবাদী ইওরোপমন্য আধুনিক ইতিহাসের চলনটা তাই। তাই এই ইতিহাসে কোথাও সিপাহী স্বাধীনতা সংগ্রামের আগের বিপুল পরিমানের কৃষক আর গ্রামীন লড়াইয়ের (আমরা বলি স্বাধীনতা সংগ্রামের) কোন উতসাহিত বর্ণনা নেই— মার্ক্সীয়রাও এই পথের পথিক— তাঁদের তত্ত্বে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম সিপাহী যুদ্ধ— প্রথম এই বেড়া ভাঙ্গেন মার্ক্সীয় সুপ্রকাশ রায়— তারপরে অনেকেই। মার্ক্স স্বয়ং প্রথমজীবনের কাজকে অস্বীকার না করে শেষ জীবনে নতুন করে ভাবছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা বা রাষ্ট্র, উচ্চবর্ণের শাস্ত্রীয় ফরমান কতটা আজ থেকে দুশ আড়াইশ বছর আগের গ্রামীনদের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলত? এই প্রশ্নটা আমরা করতে শুরু করি। এই বাংলা বা পূর্ব্ব ভারত এমনকি গোটা ভারতবর্ষ (রাষ্ট্র নয়, সমাজগুলি নিয়ে গড়া প্রত্যেকের চরিত্র আলাদা আলাদা করে বজায় রাখা সমবায়িক দেশ) যদি বৈশ্য-শূদ্র-মুসলমান এবং পরম্পরার সমাজের তৈরি হয়, এবং সামগ্রিকভাবে যদি জাত প্রথা সব মানুষকেই পেড়ে ফেলে— যা ট্রেভলিয়ান ম্যাক্সমুলারের মত ঔপনিবেশিকদের তত্ত্ব, তাহলে ব্রিটিশ আসার আগে কেন শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান প্রযোজিত বাংলা উদ্বৃত্ত অর্থনীতি ছিল— কেন বাংলার পাঠশালা ব্যবস্থাকে বৈশ্য-শূদ্র-মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার সমাজ পৃষ্ঠপোষকতা করত— মাত্র ১৫% ছিল ব্রাহ্মণ আর কায়স্থ ছাত্র আর শিক্ষক। তাদের পক্ষে স্বাভাবিক ছিল না কি এই উচ্চবর্ণের ‘প্রবল’ চাপের তলায় মাথা নীচু করে অনিশ্চয় হয়ে বসে থাকা! কিন্তু শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং পরম্পরার সমাজ এমন একটা উৎপাদন ব্যবস্থা তৈরি করলেন, যা ক্ষমতা কেন্দ্রিক নয়, রাষ্ট্র কেন্দ্রিক বা উচ্চবর্ণ কেন্দ্রিক নয়— মূলত ছোটলোক সমাজ ভিত্তিক। সেখানে উচ্চবর্ণের শাস্ত্রীয় নিদানের প্রভাব কোথায়?

যতদূর সম্ভব বাংলার ইতিহাসে প্রথম হরপ্রসাদ শাস্ত্রী উচ্চবর্ণিক হিন্দুত্বের মোকাবিলায় বৌদ্ধ তত্ত্বের আমদানী করলেন। বিনয় ঘোষের ভাষায় তার স্পষ্টতই বৌদ্ধ বাই ছিল— যেমন নিজের ছোটলোক বাই ছিল বলে বিনয়বাবু নিজে জানিয়েছেন। ফলে হরপ্রসাদ পড়তে গিয়ে বাংলার ক্ষমতাকে নতুন নতুন দেখার দৃষ্টি পাই প্রথম— তা হয়ত পালটে গেছে রাস্তায় নেমে— কিন্তু ভাবনার ক্ষমতা আর দৃষ্টি তৈরি করেদিচ্ছেন তিনি।

তাঁর লেখাতেই বুঝি মধ্যবিত্তর কেন এত বৌদ্ধ বাই। আসলে পুরো ব্যাপারটা ক্ষমতা আর রাষ্ট্র পোষিত অহিংস মতবাদের ঔপনিবেশিকতা— গৌতমে আর তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের উত্তরাধিকারীদের ঔপনিবেশিকতা— ইংরেজী শিক্ষিত বাঙ্গালীর জীবন চরম রাষ্ট্রবাদী কোম্পানী বাংলায় স্বাভাবিক ছিল— তার আশেপাশে সব কিছুই রাষ্ট্র প্রযোজিত— চাকরি, দালালি, ব্যবসা, ভাবনা, দর্শন, জীবনধারণ সবই রাষ্ট্রের মদতের ফলে উভুত— ফলে বামরাষ্ট্রবাদে ঔপনিবেশিকদের উত্তরপুরুষদের থাকতে কোন অসুবিধে হয়নি। কোম্পানির উপনিবেশে বৌদ্ধ রাষ্ট্রীয় সময়ে মানিয়ে নেওয়া ভদ্র শিক্ষিত বাঙ্গালী উপনিবেশ পরিবেশে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে— উপনিবেশ শব্দটা তার কাছে বর্জ্জ্যনীয় নয়— বিজয় সিংহ যে সিংহলে উপনিবেশ স্থাপন করছেন এবং সেটা ভদ্র বাঙ্গালীরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন।

বেনের মেয়ে উপন্যাস নয় বাংলা ইতিহাসের একটা নির্দ্দিষ্ট সময়ের কাব্যিক ভাষ্য। সেখানে তিনি ডোম, বাগদীদের ক্ষমতায় থাকার কথা জোর গলায় বললেন। বললেন কিভাবে নেড়েদের উদ্ভব হল, কিভাবে বৈশ্যরা পতিত হয়ে সনাতনী ব্যবস্থায় ফিরে এলেন, বললেন মষ্করী অর্থাৎ পটুয়াদের গৌরবময় অতীতের কথা। কীভাবে ধর্ম্ম পুজায় ডোম পুরোহিত থাকেন সেটা জানলাম— জানলাম ব্রাহ্মণ আর পুরোহিত দুটু আলাদা কম্ম— যা ঔপনিবেশিক ভদ্র বাঙ্গালীরা ভুলিয়ে দিয়েছিলেন ব্রিটিশদের প্রভাবে।

হরপ্রসাদ রবীবাবুদের গোষ্ঠীর বাইরে বাংলা বাঙ্গালীর গৌরবময় অতীতের প্রথম তাত্ত্বিক, এবং শান্তিনিকেতনের যত লেখক পুরোনো বাংলা ভারত নিয়ে লিখেছেন তারা সযত্নে তাঁকে এড়িয়ে গিয়েছেন— কেননা তিনি ১৯০০র প্রথম দশকে রবিবাবুকে চুটকি লেখক বলেছিলেন— তাতে সেই সময় মধ্যাহ্ন গগণে থাকা রবিবাবুর ভক্তরা হরপ্রসাদকে ত্যাজ্য করেন।

ফলে বাংলা সাহিত্য জগতে তাই হরপ্রসাদ একটু আলাদা। অবশ্যই স্টেটিস্ট— কিন্তু একটু অন্য রকম। রবীন্দ্রনাথ আর রবীন্দ্রানুসারী নামক কিছু প্রাণীর বিরোধিতায় বাংলায় কল্কে পেয়েছেন হরপ্রসাদ ছাড়া একমাত্র দ্বারকানাথ।

এখানেই পূর্ণচ্ছেদ। তারপরে শূন্য।

.

.

89599705_10221399769494569_8971971670986194944_nবিশ্বেন্দু নন্দ
লেখক, গবেষক, সংগঠক। উপনিবেশপূর্ব্ব সময়ের সমাজ অর্থনীতিতে কারিগরদের ইতিহাসের খোঁজে সর্ব্বক্ষণের কর্ম্মী। হকার, কারিগর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছেন প্রায় তিন দশক। বাংলায় পরম্পরার উৎপাদন বিক্রেতাদের বিষয়ে লিখেছেন নিরন্তর। বাংলার উপনিবেশপূর্ব্ব সময়ের পরম্পরার চাষী-হকার-কারিগর-ব্যবস্থা বিষয়ে খোঁজ করছেন। দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়াও দেশীয় প্রযুক্তি বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে। ‘পরম’ পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। অড্রে ট্রুস্কের আওরঙ্গজেব, ম্যান এন্ড দ্য মিথ, স্বেন বেকার্ট এম্পায়ার অব কটন, যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেসন, আহকমই আলমগিরি অনুবাদ করেছেন। পলাশীপূর্ব্বের বাংলার ৫০ বছর, পলাশীপূর্ব্বের বাংলার বাণিজ্য দুটি মৌলিক পুস্তকের রচয়িতা। খুব সম্প্রতি কলকাতার কলাবতী মুদ্রা, খড়ি প্রকাশনী, রংপুরের ডাকঘর আর গ্রন্থিক প্রকাশনী থেকে অনুবাদ এবং মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এবং হতে যাচ্ছে। নিবাস—পশ্চিমবঙ্গ, ইণ্ডিয়া।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার