বাংলা শব্দের বহু অর্থবাচকতা || শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র

0

126287476_1904025643071012_4290121952254588956_n
বাংলা শব্দের বহুঅর্থবাচকতার (polysemy) বিষয়টি ব্যাখ্যা করব। এক একটি বাংলা শব্দের অনেকগুলি করে মানে হয়। কোন কোন শব্দের ১০টি, ২০টি, ৩০টি এমনকি ৫০টি বা তার বেশী অর্থও হয়। কেন এমন হয়? শব্দ কী নিয়মে অর্থকে ধারন করে? ব্যাকরণপ্রেমী কবি সুকুমার রায় বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তিনি বিষয়টিতে তেমন সাফল্য লাভ করেননি। তারপর হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে শব্দের বহুঅর্থবাচকতার বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। পরিশেষে কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তীর ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ গ্রন্থে বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেছে। বর্ত্তমান নিবন্ধে আমি এদের সকলের গবেষণার নির্য্যাস দিতে চেষ্টা করব।
127188002_1904026466404263_4931950603430736805_n
একটা উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। প্রথমে খাই শব্দটি ধরুন। সুকুমার রায়ের ‘খাই খাই’ ছড়ায় খাই শব্দের অনেকগুলি প্রয়োগ দেখানো হয়েছে এবং তার বাইরেও আরও নানা রকম খাওয়া আছে। ইংরেজীতে eating a cigarette বা eating water বলা যায় না। হিন্দীতেও পানি খাওয়ার কথা বলা যায় না। বাঙালীরা কিন্তু ভাত, মুড়ি, বেতন, ঘুষ… সবই খেতে পারেন। কেমন করে এটা হয় তা খুব আকর্ষণীয় ব্যপার। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে খাই শব্দের সমস্ত অর্থগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝে নেওয়া যায় এবং সাধারণভাবে বাংলা শব্দগুলির বহু অর্থবাচকতার রহস্য ভেদ করা যায়, সুকুমার রায়ের রচনায় ব্যাকরণ নিয়ে সেই পরীক্ষার সূত্রপাত আছে এবং কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তীর রচনায় তার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা আছে। বর্ত্তমান নিবন্ধে এই বিষয়ে খুব সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।

খাওয়া নানা রকমের হয়। যেমন ধরুণ চশমার খাপ চশমাকে খায়। অসির কোষ বা খাপ অসিকে খায়, যদি না তা বেখাপ্পা হয়। ‘খাই খাই’ ছড়ার এক জায়গায় সুকুমার বলেছেন ‘খাসা দেখ খাপ খায় চাপকানে দাড়িতে।’ খাপ খাওয়াকে খাওয়া বলে কেন? অসির কোষে অসি যেমন খাপে খাপে ঢুকে যায়, তেমনি চাপকান আর দাড়িও সুন্দর মিলে যেতে পারে (matching)। বাঙালীর ভাষায় সেটাও এক রকমের খাওয়া বটে।

সুকুমার বলেন, ”আকাশেতে কাৎ হয়ে গোঁৎ খায় ঘুড়িটা।” এখানে খাওয়ার ব্যাপারটা কোথায়? গোঁৎ শব্দে গ বর্ণে গতি এবং চন্দ্রবিন্দুতে রহস্যময়তা বুঝুন। গোঁৎ হল ঘুড়ির এক আশ্চর্য্য গতি, তখন ঘুড়িটি তলার দিকে (ও-কার) লাফিয়ে (ৎ-এ লম্ফন বুঝায়) যেন বায়ুসমুদ্রে একটি গর্ত্ত খনন করে। কোন কিছু খাওয়ার সময়েও আমরা দাঁত দিয়ে তাকে খনন করি। তার সঙ্গে তুলনা করলে ঘুড়ির গোঁৎ খাওয়াও একরকম খাওয়া বটে বইকি! একইভাবে হোঁচট খাওয়াও খাওয়া। খাদ্যকে খানা বলে কেন? এর কারণ খাদ্যকে দাঁত দিয়ে খনন করা হয়। ডোবাকে খানা বলে কেন? কারণ তা কোদাল দিয়ে খনন করা হয়। এই ভাবে পায়খানাও খানা বটে (মাটিতে গর্ত্ত করে dug hole latrine বানানো হয়)। এই ভাবে ক্রিয়া ধরে ভাবলে রকমারি খাই ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়।

যারা ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক নিয়মে শব্দার্থের খাই বুঝতে চান তাদের জন্য মৎপ্রণীত পদ্যাভিধান ‘বর্ণসঙ্গীত’ দ্রষ্টব্য। ‘শব্দার্থের খাই’ শব্দগুচ্ছে খাই কথার অর্থ সূত্র। প্রসঙ্গত, ‘ভাষার অত্যাচার’ প্রবন্ধে সুকুমার রায় জানিয়েছেন যে গন্ধর্ব্বরা শব্দ আহার করে বেঁচে থাকে। খান-চক্রবর্ত্তীর মতে আজকের দিনে কবি-সাহিত্যিকদের গন্ধর্ব্ব বলা চলে। তারা শব্দ আহার করে এবং শব্দের খাই না বুঝলে তাঁদের খুব অসুবিধা হতে পারে। এজন্য ‘বর্ণসঙ্গীত’ গ্রন্থে বাংলা শব্দগুলির খাই বলার চেষ্টা করা হয়েছে, যা কবিদের কথার খাই মেটাতে কিছু মাত্র সাহায্য করলে আমার শ্রম সার্থক হবে। এখন ‘বর্ণসঙ্গীত’ থেকে খাই শব্দের অর্থের আলোচনার প্রাসঙ্গিক কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করছি–
”খ-এর আধার খা মানে হইল অন্যকে খাত করা;
খা হল ভোজন, দংশন আর আত্মসাৎ করা।
খা-করণ যদি সক্রিয় হয়, তাহা হয়ে যায় খাই;
খাই মানে খাইবার অভিলাষ, সূত্র ও গড়খাই।
মোরা বাঙালিরা সুখে দুধ, ভাত এবং বেতন খাই;
কবি সুকুমার ‘খাই খাই’ লেখে বিস্মিত হয়ে তাই।
চশমার খাপ চশমাকে খায়, ‘খাপ খাওয়া’ বলি তায়;
চাপকান আর দাঁড়ি খাপ খেয়ে সুন্দর হয়ে যায়।
শব্দার্থের খাই অর্থাৎ সূত্রটি বুঝে নিলে,
ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মেতে দেখ সব খাওয়া যায় মিলে।
গন্ধর্ব্ব তো গান করে আর শব্দ খাইয়া রয়,
অর্থের খাই না বুঝিলে তার বড়ই বিপদ হয়।”

খাই শব্দের কথা ছেড়ে এখন পাকা শব্দে আসি। সুকুমার তাঁর ‘পাকাপাকি’ ছড়াতে পাকা শব্দের নানা বিচিত্র অর্থের প্রয়োগ দেখিয়েছেন। পাকা শব্দের নানা অর্থের মধ্যেও ক্রিয়াভিত্তিক সম্পর্ক আছে। যেমন দড়ি পাকালে তার ভিতরে পাক জমা হয়, কোন ঘুঁটি সব ঘর ঘুরে এলে তাকে পাকা ঘুঁটি বলে, জীবনচক্র পূর্ণ হলে আম পাকে– সব ক্ষেত্রেই দৃশ্য বা অদৃশ্য পাকের ব্যাপার রয়েছে। খাই বা পাকা শব্দের বিভিন্ন অর্থের ক্রিয়াভিত্তিক সম্পর্ক অবশ্য সুকুমারের রচনায় পরিষ্কার হয়নি। কিন্তু বাংলা শব্দগুলির বহু অর্থবাচকতার (polysemy-এর) রহস্য সুকুমারকে অবাক করেছিল এবং এইসব বিষয়ে সুকুমারের রচনাগুলি খুবই রসগ্রাহী। কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’-এ পাকা শব্দের সমস্ত অর্থগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক খুব সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে।
125866366_1904025503071026_4128032765727142774_n
গো শব্দের মানে শুধু গরু নয়। অমরকোষের গান্ত বর্গে গো শব্দের মানে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে; “স্বর্গেষু পশুবাগ্বজ্রদিঙ্নেত্রঘৃণিভূজলে”। এর অর্থ হল গো শব্দের অর্থ স্বর্গ, পশু, বাক, বজ্র, দিক, নেত্র, ঘৃণি (সূর্য্য), ভূ (পৃথিবী), জল ইত্যাদি। অমরকোষে প্রদত্ত গো শব্দের অনেকগুলি অর্থ সুকুমার রায়কে অবাক করেছিল। এই নিয়ে তিনি একটি ছড়াও লিখেছিলেন। ছড়াটি এইরকম :
”খণ্ডিত গোধন মণ্ডল ধরণী
শবদে শবদে মন্থিত অরণী,
ত্রিজগত যজ্ঞে শাশ্বত স্বাহা–
নন্দিত কল কল ক্রন্দিত হাহা
মৃত্যু ভয়াবহ হম্বা হম্বা
রৌরব তরনী তুহুঁ জগদম্বা
শ্যামল স্নিগ্ধা নন্দন বরণী।
খণ্ডিত গোধন মণ্ডল ধরণী।”

সুকুমার রায়ের ‘চলচ্চিত্ত চঞ্চরী’ নাটিকায় এই ছড়াটি আছে। এই ছড়ায় বলা হয়েছে যে গো শব্দের অর্থ বুঝলে বিশ্বরূপ দর্শন করা যায়। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ গো শব্দের ৩০টির অধিক অর্থ আছে। ক্রিয়াভিত্তিক নিয়মে সেগুলিকেও ব্যাখ্যা করা যায়, যা আমরা আগেই বলেছি। গো শব্দের যতগুলি অর্থ তারা সবাই কোন-না-কোন-ভাবে যাওয়া ক্রিয়াটির সাথে যুক্ত। এমনকী ইংরেজী go মানেও যাওয়া। নিম্নলিখিত লিঙ্ক খুললে গো শব্দের নানা অর্থের বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাবেন :
https://www.facebook.com/subhasis.patra.7771/posts/938383179635268)।

সুকুমার রায়ের ‘খাই খাই’, ‘পাকাপাকি’ ইত্যাদি ছড়াগুলি এবং খান-চক্রবর্ত্তীর ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধিকে অবলম্বন করে আমি ‘পুরাপুরি’, ‘ঢলাঢলি’, ‘পাকেচক্রে’, ‘গলাগলি’, ‘দাঁড়াদাঁড়ি’ ‘বাড়াবাড়ি’, ‘বাজাবাজি’, ‘ফুটিফাটা’ ইত্যাদি নামের কতকগুলি ছড়া রচনা করেছি। এগুলির মধ্য দিয়ে শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ বুঝার সিংহদুয়ার উন্মুক্ত হয়। ‘বর্ণসঙ্গীত’ গ্রন্থে এই ধরণের অনেকগুলি ছড়া পাবেন। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ গ্রন্থে এক একটি শব্দের ২০-৩০টি, এমন কী ৫০-৬০টি বা তার অধিক অর্থও আছে। খান-চক্রবর্ত্তী দেখিয়েছেন ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি সেগুলিকেও ব্যাখ্যা করতে পারে। আমার মতে এটি ওদের ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধির একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য সাফল্য। সঙ্গের ছবিতে গো, আম এবং পদ শব্দের বহু অর্থ দেখানো হয়েছে। আপনারা খান-চক্রবর্ত্তী এবং হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের অভিধান হাতে নিয়ে এই শব্দগুলির নানা অর্থের ব্যাখ্যার গভীরে প্রবেশ করতে পারেন।

সুকুমার রায়ের বহু আগে ভারত-অনুরাগী অলবিরুণী একটি সংস্কৃত শব্দের বহু অর্থ এবং বহু শব্দের এক অর্থ দেখে যারপরনাই বিস্মিত ও কিঞ্চিৎ বিরক্ত হয়েছিলেন। বিষয়টির রহস্য তিনি (অলবিরুণী) ভেদ করতে পারেননি। ভাষাবিদ কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তীর ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থবিধি এই রহস্যকে ভেদ করে বাংলা শব্দের অর্থ ব্যাখ্যায় এক নবযুগের সূচনা করেছে। বিষয়টি সম্যকরূপে বুঝতে পারলে শব্দার্থের দর্শন পরিষ্কার হয়ে যায়। বর্ত্তমান লেখকের ‘বর্ণসঙ্গীত’ গ্রন্থে খান-চক্রবর্ত্তীর গবেষণার সঙ্গে সুকুমার রায়ের শব্দার্থচিন্তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা আছে। যারা বাংলা শব্দগুলির বহু অর্থ বাচকতার আরও গভীরে ঢুকতে চান তারা পদ্যাভিধান ‘বর্ণসঙ্গীত’ পাঠ করতে পারেন।

.

.

54521119_1332838196856429_1415860690958155776_oশ্রী শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র
(বাঁকুড়া জেলার পাঁচাল গ্রামে আমার বাড়ী। আমি আকাশের তারা দেখতে ও ব্যাকরণ পড়তে ভালবাসি।)

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার