অনলাইন লিটলম্যাগ : লিটলম্যাগ এর পরবর্ত্তী ফর্ম এবং একটি জবাব || রাফাতুল আরাফাত

0

অনেকে নানাভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে অথবা প্রকাশ্যেই বলার চেষ্টা করছেন, লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে কি না বা আদৌও এ সময়ে লিটল ম্যাগাজিন প্রয়োজন আছে কি না। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রধান যুক্তি হল— যেকোনই আনদোলনই সকল সময়ের আন্দোলন নয়। এ ব্যাপারে আলোচনায় যাবার আগে লিটল ম্যাগাজিনের ধারণা নিয়ে একটু কথা বলা যাক।

লিটল ম্যাগাজিন ডিফাইন-এর ক্ষেত্রে আমি ১৯৫৩ সালে দেশ পত্রিকার মে সংখ্যায় ‘সাহিত্যপত্র’ প্রবন্ধে লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু-র আলোচনাকেই টেনে আনি—

“এক রকমের পত্রিকা আছে যা আমরা রেলগাড়িতে সময় কাটাবার জন্য কিনি, আর গন্তব্য স্টেশনে নামার সময় ইচ্ছে করে গাড়িতে ফেলে যাই— যদি না কোনো সতর্ক সহযাত্রী সেটি আবার আমাদের হাতে তুলে দিয়ে বাধিত এবং বিব্রত করেন আমাদের। আর এক রকমের পত্রিকা আছে যা স্টেশনে পাওয়া যায় না, ফুটপাতে কিনতে হলেও বিস্তর ঘুরতে হয়, কিন্তু যা একবার হাতে এলে আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি না, চেয়ে-চেয়ে আস্তে আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ন্যাপথলিন-গন্ধী তোরঙ্গে তুলে রাখি— জল, পোকা, আর অপহারকের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য। যে সব পত্রিকা এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অন্তর্গত হতে চায়— কৃতিত্ব যেইটুকুই হোক, অন্ততপে নজরটা যাদের উঁচুর দিকে, তাদের জন্য নতুন একটা নাম বেরিয়েছে মার্কিন দেশে; চলতি কালের ইংরেজী বুলিতে এদের বলা হয়ে থাকে লিটল ম্যাগাজিন।”

বুদ্ধদেব বসুর উল্লেখ করা দ্বিতীয় রকমের কাগজ হতে হলে অবশ্যই সুনির্দ্দিষ্ট কিছু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জ্জন করতে হয়। লিটল ম্যাগাজিন-এর প্রাথমিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল— অপ্রাতিষ্ঠানিকতা বা প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। অর্থাৎ বাজারে প্রচলিত বিগ হাউজ এর বিপরীতে অবস্থান লিটল ম্যাগাজিন এর। এ বিগ হাউজ বা প্রতিষ্ঠান যেকোন কিছু হতে পারে— ছোট অথবা বড় হতে পারে। কোন কাগজ হতে পারে, অথবা কোন মূল্যবোধ হতে পারে। সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করে পুঁজিবাদ। প্রতিষ্ঠানগুলো উদ্দেশ্য প্রচার এবং মুনাফা। আর লিটল ম্যাগাজিনগুলোর উদ্দেশ্য বিকল্প চিন্তা ও মূল্যবোধ যা প্রচলিত মূল্যবোধকে নাড়িয়ে দেয়। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখক সুবিমল মিশ্র এর উদ্ধৃতি চয়ন করা যেতে পারে—

“আমি ব্যক্তিগতভাবে লিটল ম্যাগাজিন থেকে আরো বেশী চাই— এ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট মানসিকতা। প্রচন্ড রাগী চেহারা হবে তার, কোনোরকম কম্প্রোমাইজের মধ্যে নেই সে। গতানুগতিকতার বিরুদ্ধে তার বিতৃষ্ণা হবে আন্তরিক, ব্যবসায়িক স্বার্থে যে সব আধমরা লেখককে প্রতিষ্ঠান তুলে ধরতে চায়, দেখাতে চায় এরাই লেখক, এদের লেখাই ১নং, আগ-মার্কা এবং বাজারের সেরা মাল— তাদের, সেইসব যশ-কাঙালদের মুখোশ খুলে দেওয়ার দায়িত্বও লিটল ম্যাগাজিনের। প্রচলিত দৈনিক সাপ্তাহিকগুলোতে সাহিত্যের নামে কুচো চিংড়ির যে রগরগে ঝালচচ্চড়ি চালাবার চেষ্টা হয়, তা সুস্বাদু হতে পারে কিন্তু স্বাস্থ্যের পক্ষে তা মারাত্মক, সেখান থেকে কলেরা ছড়াবার সম্ভাবনা প্রবল। এ সম্পর্কে পাঠককে সতর্ক করে দেবার দায়িত্বও লিটল ম্যাগাজিনের।”

লিটল ম্যাগাজিন এর স্পষ্ট অবস্থান হবে বাজারে প্রচলিত ধারণা ও স্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে। প্রসঙ্গত, প্রতিষ্ঠানগুলো এই প্রচলিত ধ্যান ধারণা ও স্থিতিশীলতা ভেঙে যাক চায় না— অবশ্যই নিজেদের স্বার্থে। লিটল ম্যাগাজিনগুলো সৃজনশীল ও বিপ্লবী চেতনার হয়। কোন রকম প্রতিষ্ঠা ও বাণিজ্যের লোভ তাদের স্পর্শ করে না। প্রচলিত বাজারি কাগজগুলো যেসব লেখা ছাপতে ভয় পায়, সেগুলো ছাপে লিটল ম্যাগাজিন। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠান বিরোধী লেখক সুবিমল মিশ্র-এর আরো একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা প্রয়োজন—
“তথাকথিত জনপ্রিয় সাহিত্য পত্রিকাগুলোর প্রথম কথা হচ্ছে বাণিজ্য, দ্বিতীয় কথাও বাণিজ্য, এমনকি তৃতীয় কথাও বাণিজ্য। সৃষ্টিশীলতার প্রশ্ন সেখানে হয় অবান্তর, না হলে অত্যন্ত গৌণ। রুচিশীল পাঠক-সৃষ্টির দায়বদ্ধতা সে স্বীকার করে না, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রচলিত স্রোতে তাকে গা ভাসাতে হয়, ভাসাতে হয় তার নিজের বাণিজ্যিক স্বার্থেই। যা ছাপলে কমার্স হবে না, বিক্রি হবে না, তার পৃষ্ঠপোষকতা তারা সচরাচর করে না, করতে পারে না, কশ্চিৎ কখনো যখন করে করার ভান করে, মনে রাখতে হবে করে অবশ্যই তার শ্রেণী স্বার্থে।

অন্য ক্ষেত্রে লিটল ম্যগাজিনের মূলধন হচ্ছে সমস্ত রকম স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে তার বিপ্লবাত্মক দৃষ্টিভঙ্গী ও সাহস। বড় কাগজ, সাহিত্যের বাণিজ্য সফল কাগজ, যা যেসব ছাপতে ভয় পায় তাই ছাপবে লিটল ম্যাগাজিন, যা কখনোই এই আর্থ-সামাজিক পরিবেশে বাণিজ্যিক নয়, বরং মৌলিক, একগুঁয়ে যা পরীক্ষা নির্ভর। কখনো কখনো উস্কানিমূলকও। খ্যাতিমানের অনুগ্রহের এক-আধ পৃষ্ঠার এঁটোর সে তোয়াক্কা করে না। পুরনো কালের সৃষ্টিশীল বিষয়গুলির পুনরাবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে সমসাময়িককালে নতুন কে কী লিখছে তার একটা ধারণা তুলে ধরার দায়িত্ব লিটল ম্যাগাজিনের। প্রচলিত ধ্যান-ধারনাগুলোর ফাঁপা জায়গাটা সে দেখিয়ে দেবে, সমস্ত রকম ভাঙচুর আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করার দায়িত্ব তার, সাহিত্যের সবরকম আর সবদিকের সম্ভাবনাগুলি খতিয়ে দেখার— আর সেই সূত্রেই একধরনের বেপরোয়া আর বেহিসেবী তার ভঙ্গী। আগামী প্রজন্মের সমস্ত রকম প্রশ্ন-চিহ্নের প্রতি তার থাকবে পিতৃ-প্রতীম সহানুভূতি।”

মোদ্দাকথা, লিটল ম্যাগাজিনগুলো বিকল্প চিন্তার এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা এবং প্রতিবাদী চরিত্র তার গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। (প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা লিটল ম্যাগাজিন এর প্রধান চরিত্র কিনা তা তর্ক সাপেক্ষ। তবে আমি মনে করি, প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা লিটল ম্যাগাজিন এর প্রাথমিক চরিত্র।)

লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে আরও অনেক আলোচনাই করা যায়, তবে বিষয়বস্তু থেকে পাঠকের মনযোগ সরিয়ে নেয়া কোন ভাবেই কাম্য নয়। এবার একটা দিকে নজর দেয়া যাক— ঠিক কোন্ প্রেক্ষাপটে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ শুরু হয়েছিল।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রচার বেড়ে যাওয়ায় সাহিত্য এবং সমাজ বন্দী হয়ে পড়ছিল কিছু প্রচার ও মুনাফা সর্ব্বস্ব প্রতিষ্ঠানের কাছে। তারা তাদের ইচ্ছেমতো সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে মানুষকে দাস করে রাখার পায়তারা করছিল। স্থিতিশীলতার দেয়াল এমনভাবে ঘিরে ধরেছিল— যেখান থেকে নতুন কিছু বেরুবার সম্ভাবনা ছিল না। এমন এক পরিস্থিতিতে সকল স্থিতিশীলতা ভেঙে পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্ম্মী লেখা প্রকাশের মাধ্যমে নতুন সাহিত্যের সূচনা করতে লিটল ম্যাগাজিন এর সূচনা হয়েছিল।। বিংশ শতাব্দীর লিটল ম্যাগাজিনগুলোর সূচনা হয়েছিল Ralph Waldo Emerson এবং Margaret Fuller সম্পাদিত The Dial (1896) এর মাধ্যমে যারা শুরুতেই ভিক্টোরিয়ান প্রকৃতিবাদ-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মাধ্যমে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ শুরু করেছিল। শুরুর দিকের লিটল ম্যাগাজিনগুলোর ক্ষেত্র — The Little Review (1924), Poetry ( 1912), The Egoist (1914-1919), New Masses (1926-48), The Anvel (1931-39), Creterion(1922-39) এর নাম নেয়া যায়। T. S. Eliot, Robert Frost, Ezra Pound, Edgar Lee Masters, Hart Crane, and Wallace Stevens সহ সমকালীন অনেক লেখকই লিটল ম্যাগাজিন এর মাধ্যমে নিজেদের পরীক্ষা-নিরীক্ষাধর্ম্মী বিচিত্র লেখা প্রকাশ করেছেন।

বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রথম স্বার্থক লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে ধরা হয় প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’কে যা মননশীল গদ্যের মাধ্যমে চলিত ভাষারীতি প্রবর্ত্তনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। তাছাড়া উল্লেখযোগ্য বাংলা সাহিত্যের লিটল ম্যাগাজিনগুলোর মধ্যে কল্লোল, সওগাত, শিখা, কালি কলম, প্রগতি, পূর্বাশা, কবিতা, শনিবারের চিঠি-র নাম নেয়া যায়। বলতে গেলে বাংলা সাহিত্যের সকল রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং ভাঙচুর লিটল ম্যাগাজিনগুলোকে ঘিরেই হয়েছে।

এখন কথা হচ্ছে— বিংশ শতাব্দীর যে সংকটগুলোকে সামনে রেখে লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশ শুরু হয়েছিল, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আমরা কি সে সংকটগুলো কাঁটিয়ে উঠতে পেরেছি? পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্যে পর্য্যাপ্ত(!) কাগজ কি আছে? উত্তর— না!

সংকটগুলো ক্রমে গাঢ় হচ্ছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌরাত্ম বেড়েই চলেছে। পুঁজিবাদ আমাদের অর্দ্ধেক গিলে নিয়েছে। মধ্যবিত্ত চিৎকার করতে চেয়ে গিলে নিচ্ছে চিৎকার। মধ্যরাতে টেলিভিশনে টকশোর নামে ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মূলা। সোস্যাল মিডিয়াতে উচ্চবিত্তীয় সন্তানগুলোর মশকরা, মিমস দেখতে দেখতে ক্লান্তি নয়, ঘৃণা আসছে। পুঁজিবাদী মিডিয়ার ছড়ানো জালে ক্রমে বন্দী হয়ে পড়ছি আমরা— বেরুতে চাইছি, পারছি না। বিনোদনধর্ম্মী সংবাদের রমরমা বাজারে বিশ্লেষণধর্ম্মী লেখার মানুষের আগ্রহের জায়গা বেনামী কোন পোর্টালে প্রকাশিত সেলিব্রিটির স্ক্যান্ডাল অথবা ব্রেসিয়ারের সাইজ অথবা কয়টা আম খাচ্ছেন অথবা কীভাবে ডায়েট করছেন— ব্লা ব্লা। নিরাপত্তা বিঘ্নিত শঙ্কায় বিকল্প চিন্তার নিবন্ধ ছাপা বন্ধ করেছে জাতীয় দৈনিকগুলো। নতুন করে জন্ম নিচ্ছে না কোন বিকল্পধর্ম্মী কাগজ। দুই একটা জন্ম নিলে তারাও বিক্রি হয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট লোভের কাছে৷ কমার্শিয়াল বিজ্ঞাপনের ফাঁদে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমের মায়াবী কথায় বিক্রি হয়ে যাচ্ছেন সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকগণ। এমন সংকটে— যেখানে বিকল্প চিন্তার বদলে সস্তা সংবাদে মুদে আছে মিডলক্লাস থেকে শুরু করে ইয়থ, সেখানে লিটল ম্যাগাজিন এর প্রয়োজনীয়তা কোনভাবেই ফুরাচ্ছে না বরং আরও বাজেভাবে উপলব্ধি হচ্ছে। (যদি না আপনার মগজ কোন কর্পোরেশনের কাছে বিক্রি হয়ে যায়। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন— বিকল্প চিন্তার মানুষ সবসময়ই কম— এবং তারচেয়ে কম সে চিন্তাকে গ্রহন করতে পারার মতন মগজ। স্বভাবতই লিটল ম্যাগাজিন এর পাঠক কম। কিন্তু সে কম(!) পাঠক নিয়েই লিটল ম্যাগাজিন বড় বিপ্লব আনে এবং বিপ্লবের জন্য লিটলম্যাগ-এর জন্ম।)

লিটলম্যাগের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি— বরং আরও বাজেভাবে উপলব্ধি হচ্ছে— তবে প্রতিষ্ঠান যেভাবে রূপ বদলাচ্ছে— বেডরুম থেকে শুরু করে বাথরুম সবখানে নিজেদের কাঠী ঘুরাচ্ছে— বুঝিয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানের গোলামী করতেই মানুষের জন্ম— লিটলম্যাগ এর রূপ বদলানো (চরিত্র নয়) জরুরী হয়ে পড়েছে।

ইন্টারনেটের দ্রুত প্রসার জীবনকে গতি এনে দিয়েছে। মানুষ সবকিছুতে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে৷ মানুষ সংবাদের তাৎক্ষণিক আলোচনায় অংশ নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে— প্রচলিত ছাপা কাগজে যেটা সম্ভব নয়। প্রয়োজন ও বাজার বুঝে বাজারি পত্রিকাগুলো অনলাইনে শিফট্ করেছে— শ’য়ে শ’য়ে অনলাইন সাহিত্য (!) পত্রিকা বেরিয়েছে (যা আসলে এক সময়ের চেনা দৈনিকের চরিত্রকেই প্রতিফলিত করে যাচ্ছে) যারা প্রতিনিয়ত রসালো কন্টেন্ট পরিবেশনের মাধ্যমে মানুষকে বন্দী করে রাখছে তাদের কমার্শিয়াল ফাঁদে। অনেক আলোচনার বিষয়কে আলোচনায় না এনে, কোন বিশেষ সেলিব্রেটির অন্তর্বাস নিয়ে মাতিয়ে রাখছে নেটিজেনদের, তাদের নিজেদের স্বার্থে। বাণিজ্যিক সস্তা কাগজগুলোর ভণ্ডামি এবং মুখোশ খুলে ফেলার জন্যে— লিটল ম্যাগাজিনগুলোকে অনলাইনে আসা এবং নতুন করে শুধুমাত্র অনলাইন ভিত্তিক লিটলম্যাগ প্রকাশ করে প্যারালাল ইউনিভার্স তৈরি করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। এখানে একটা তথ্য যোগ করা প্রয়োজন—

২০১২ সালে জয়পুরে অনুষ্ঠিত সাহিত্য উৎসবে আলোচনার বিষয় ছিল ‘Little Magazine : Voice from Below’। আলোচকেরা মত্ প্রকাশ করেছিলেন ভবিষ্যতে লিটল ম্যাগাজিন-এর অবতারণা হবে অনলাইন রূপে। অসমীয় লিটল ম্যাগাজিন ‘কাফিলা’ নিজের সম্পর্কে বলেছিল— তারা লেখক, সাংবাদিক, সমাজ-কর্ম্মী, গবেষকদের একটা মিছিল যারা এই সমসাময়িক পৃথিবীতে বিশাল বিতর্কগুলির জন্য একটা জায়গা তৈরি করতে চায়। মিডিয়া যেভাবে গোটা জ্ঞ্যান ও তথ্যের জগতটা নিয়ন্ত্রণ করে নিজের ইচ্ছায় তথ্য ও জ্ঞ্যান দুনিয়াকে প্রেরণ করছে, সেটা রোধ করতে হলে নিজেকে ‘মিডিয়ায় পরিনত’ করে একটা সমান্তরাল প্রতি-মিডিয়া তৈরীতে তারা বিশ্বাসী। কাফিলা বলে—

“though this activity we hope to facilitate critical public engagement with contemporary issue that we consider essential for radicalising democracy.”

এখন অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে চলে আসে। অনলাইন লিটলম্যাগ এর ফর্ম কেমন হবে? তাদের চরিত্র কেমন হবে?

আগেই বলেছি— রূপ বদল করে, চরিত্র বদল করে নয়। তার মানে অনলাইন লিটলম্যাগগুলোও হবে অপ্রাতিষ্ঠানিক, প্রতিবাদী, বিকল্প চিন্তার, এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। তবে কিছু ব্যাপারে অনলাইন লিটলম্যাগ প্রথাগত লিটলম্যাগের চরিত্রে নাও চলতে পারে। লিটলম্যাগের আকারের ক্ষেত্রে যে ‘লিটল’ ব্যাপারটা সেটা অনলাইন লিটলম্যাগের ক্ষেত্রে রক্ষা না করলে বিশেষ ক্ষতি হবে না যেহেতু অনলাইন এর ক্ষেত্রে কাগজের খরচের ব্যাপারটি নেই। (তাই বলে বস্তাপঁচা লেখা দিয়ে ঢাউস সাইজের সংখ্যা কখনোই নয়। কন্টেন্টের ব্যাপারে আপোষ লিটলম্যাগের মেনিফেস্টোতে নেই।)

অনলাইন লিটলম্যাগগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশের দিকে অবশ্যই মনযোগী হবে। তবে এ সময়ের নিষিদ্ধ কথাগুলো, আলোচনার যে বিষয়গুলো আলোচনার বিষয় হয়ে আসছে না, গুরুত্বপূর্ণ যে কথাগুলো গুরুত্বহীন, যে কথাগুলো বলতে কেউ সাহস পায় না— প্রতিষ্ঠান যেগুলোকে সচেতনভাবে অগ্রাহ্য করে, সে বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করে তাৎক্ষণিক লেখা প্রকাশ ও পাঠককে চিন্তা করতে বাধ্য করবে অনলাইন লিটলম্যাগ। (যে সুযোগ স্বভাবতই প্রিন্ট লিটলম্যাগের নেই)

লিটলম্যাগের ব্যাপারে প্রচলিত মিথ— লিটলম্যাগের স্বল্প আয়ু— দীর্ঘস্থায়ীত্বের লিটলম্যাগও আছে। লিটলম্যাগের স্বল্প আয়ু এই মিথকে গুড়িয়ে দিতে পারে অনলাইন লিটলম্যাগ। যেহেতু লিটলম্যাগ প্রকাশনার ক্ষেত্রে আর্থিক দিক একটা বড় বিষয় এবং অনলাইনের ক্ষেত্রে বাৎসরিক চার্জ ছাড়া তেমন কোন চার্জ নেই। তাছাড়া পাব্লিক ডোমেইন ব্যাবহারের সুযোগ তো আছেই, যা সম্পুর্ন ফ্রী।

আরও একটা বড় প্রশ্ন! অনলাইন লিটলম্যাগগুলো গুগল এডসেন্স এর বিজ্ঞাপন গ্রহন করবে কিনা! গুগল নেটিজেনদের পুঁজিবাদের ফাঁদে আটকে রেখেছে। চোখের সামনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখাচ্ছে রঙবেরঙের বাহারী কনটেন্ট। আর তাদের বাহারী বিজ্ঞাপনগুলো পরিবেশনের জন্যে ওয়েবসাইটগুলোকে করেছে আউটলেট। লিটলম্যাগ কখনোই পুঁজিবাদী কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেদেরকে আউটলেট হিসেবে ভাড়া দিতে পারে না। আর লিটলম্যাগ কখনো মুনাফা, কমার্সের দিকে মনযোগী নয়।

অনলাইন লিটলম্যাগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ সামনে চলে আসে। অনলাইনের ক্ষেত্রে প্রথম চ্যালেঞ্জ হবে— সাইবার সিকিউরিটি। বুর্জোয়া বাজারী প্রতিষ্ঠানগুলো লিটলম্যাগকে ভয় পায়। নতুন লিটলম্যাগ বেরুলেই তারা ইনসিকিউরিটিতে ভোগে। সাইবার সিকিউরিটিতে কোন ধরনের ত্রুটি থাকলে তার সুযোগ নিবে বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলো।

আরও যে চ্যালেঞ্জগুলো আসবে— অধিকাংশ লিটলম্যাগ প্রকাশিত হয় প্রান্তিক এলাকা থেকে যেসব এলাকায় ইন্টারনেট সহজলভ্য নয় এমনকি কোথাও বিদুৎও নয়। তাছাড়া কাগজের লিটলম্যাগ-এর ক্ষেত্রে প্রকাশের ব্যাপারগুলিতে দায়িত্ব ভাগ হয়ে যায় যেমন—ম্যাক-আপ, সেট-আপ-এর দায়িত্ব আলাদা, প্রেসের দায়িত্ব আলাদা কিন্তু অনলাইনের ক্ষেত্রে পুরো দায়িত্বটা সম্পাদকের উপর বর্ত্তাবে।

লিটলম্যাগের যাত্রা প্রতি-স্রোতের যাত্রা। সকল বাধা-বিপত্তিকে পায়ে ঠেলেই লিটলম্যাগের যাত্রা। বুর্জোয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বাওতাবাজি ও ভন্ডামির মুখোশ খুলে দিতে আরও একটা বিপ্লবে লিটলম্যাগ আসছে।

যারা নানাভাবে ইনিয়ে বিনিয়ে অথবা প্রকাশ্যে বলতে চান অথবা বলছেন লিটলম্যাগ এর প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে— সাবধান করে যাই! লিটলম্যাগ একটা বিশ্বাসের নাম। কমিটমেন্ট-এর নাম। যতোদিন পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে মূলা দেখিয়ে, মানুষকে তাদের দাস করে রাখতে চাইবে— ততোদিন প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের ভন্ডামি ও মুখোশ খুলে দিতে লিটলম্যাগ বারবার আসবে— ভিন্ন-ভিন্ন অবয়বে। লিটলম্যাগ এর মৃত্যু নেই। যদি কোথাও একটা লিটলম্যাগ বন্ধ হয়— অন্য কোথাও আবার তার বীজ বপণ হয়। শেষ হয়না লিটলম্যাগ এর যাত্রাপথ। ….

তথ্যসুত্র:
১. বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিন চর্চা অতীত ও বর্তমান /সম্পাদক মিজান রহমান
২. অসমীয় লিটল ম্যাগাজিন সংকলন (পঞ্চম অধ্যায়)
৩. সুবিমল মিশ্র-র সাথে কামরুল হুদা পথিকের কথোপকথন

.

.

131462142_437843013897775_8416535123653615415_nরাফাতুল আরাফাত
জন্ম ১৯৯৮ সালের ২৮ জুন গাজীপুরে। সম্পাদনা করেন, অনলাইন লিটলম্যাগ— মিহিন্দা।

[‘অনলাইন লিটলম্যাগ : লিটলম্যাগ এর পরবর্ত্তী ফর্ম এবং একটি জবাব’ এ নিবন্ধটি পূর্ব্বে https://dibyak.blogspot.com/এ প্রকাশিত… চারবাক তাহা পুনঃপ্রকাশ করল… পূর্ব্বে প্রকাশিত নিবন্ধটি পাঠ করতে চাইলে, ক্লিক— https://dibyak.blogspot.com/2020/09/blog-post_89.html 

— সম্পাদকীয়]

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার