বাবা-মা কয়েক বছর আগেই প্রয়াত হয়েছেন ত-বাবুর। গত বছর গত হলেন শ্বশুরমশাইও। তারপর এই প্রথম মহালয়া আসছে। অতএব গৃহিণীর হুকুম এবছর তর্পণ করতেই হবে ত-বাবুকে। গিন্নির গনগনে আঁচে কে আর পুড়তে চাই বলুন! সুতরাং তর্পণে যেতে হবে।
— কবে যেতে হবে?
— মহালয়ার দিন।
— মহালয়ার দিন কেন? মহালয়ার অমাবস্যায় যে কৃষ্ণপক্ষের শেষ সেই পক্ষটি পুরোটাই তো পিতৃপক্ষ! তাহলে ওই ১৫ দিনের যে কোন একদিন গেলেই তো হয়?
— তোমাকে নিয়ে আর পারি না বাবা। মহালয়ার দিনেই তো সবাই যায়। তুমিও ওই দিনেই যাবে।
— যো হুকুম হাকিম সাহেবা, কিন্তু গঙ্গা তো এই বেলবনী থেকে অনেক দূর! অতদূর যেতে যেতে যদি আমারই গঙ্গাপ্রাপ্তি হয়ে যায়? তার চেয়ে আমাদের পাড়ার শুড়িপুকুরেই ভালো। কী বল?
— ওখানে তো হেঁজিপেঁজি সবাই যায়! আমাদের বংশের একটা ইয়ে আছে না?
— ও ইয়ে! তাহলে কোথায় যেতে হবে?
— আমরা যাব দামোদর। সে বিরাট নদ। জল গিয়ে পড়ছে গঙ্গায়। পুরুত ঠাকুর বলেছেন ওখানে তর্পণ করলে তা গঙ্গায় তর্পণ করার সমানই হয়। মায়ের মুখেও শুনেছি প্রচুর লোক সেখানে যায়।
— তোমার কিন্তু অনেক বুদ্ধি গিন্নী। হোম সায়েন্সটা ভালোই রপ্ত করেছ দেখছি। আমার অনেকগুলো টাকা আর ধকল বাঁচিয়ে দিলে। তাইতো বলে “সংসার সুখের হয়…”
— থাক থাক তোমাকে আর আদিখ্যেতা করতে হবে না। এবার টুকিটাকি কী কী আনতে হবে তা লিখে নাও। মহালয়া কিন্তু আর ছদিন পরেই। ওরে টুকটুকি একবার কাগজ-কলমটা নিয়ে আয় তো।
— সে তো বুঝলাম কিন্তু তর্পণ করতে হবে কেন?
— বা! সবাই করে যে। পিতৃপুরুষদের আত্মায় মন্ত্রপূত জল দিলে ওঁরা বড়ো তৃপ্ত হন। আশীর্বাদ করেন। তা না হলে তাঁরা অভিশাপ দেন।
— তা অভিশাপের কী টা বাকি আছে শুনি? বাবা-মা এক বছরের মধ্যেই চলে গেলেন; বোনটি বিধবা হল; শ্বশুরমশাই গতবছর দেহ রাখলেন; এখন শ্বাশুড়ি মাকে দুমাসে একটা করে ডায়ালিসিস লাগছে; এত পূজো আচ্চা করেও আমাদের ঐ একটি মাত্র মেয়ে। ছেলে হবার আগেই কর্কট রোগের কারণে তোমার জরায়ু কেটে বাদ দিতে হল। এখন তুমি বেতো আর আমি হেঁপো রোগী। বলি এসবই কি তোমার ওই পূর্ব্বপুরুষদের আশীর্বাদের ফল।
— যত্ত সব অলক্ষুণে কথা তোমার। বলি মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে দিতে হবে না! নাতির মুখ দেখব না?
বর্ত্তমান মেয়ে এবং ভাবী নাতি নামক ব্রহ্মাস্ত্রটির কাছে ত-বাবু একেবারে কুপোকাত। আর কিছু বলার উপায় নেই তাঁর। অতএব তর্পণই সই।
মহালয়ার দিন খুব ভোরেই গিন্নী ত-বাবুকে ঠেলা দিতে লাগলেন। “কই গো তাড়াতাড়ি ওঠো, দুর্গাপুর যেতে হবে না?”
ঘুম জড়ানো চোখে পাশবালিশটা আরো কাছে টেনে নিয়ে ত-বাবু বললেন, “তুমি চলে যাও, আমি যাব না।”
অমনি মুখ ঝামটা দিয়ে গিন্নি বললেন, “তুমি চলে যাও। ঐতো তোমার বুদ্ধি! বলি মেয়েমানুষের কি তর্পণ করতে আছে?”
তর্পণের কথা শুনেই ত-বাবুর ঘুমের ভিতর একটা তুরপুন চলে গেল। ধড়ফড় করে উঠে বসে রেডিওটা চালিয়ে দিলেন। তখন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মেঘমন্দ্র কণ্ঠে উচ্চারিত হয়ে চলেছে “যা দেবী সর্ব্বভূতেষু বিদ্যারূপেণ সংস্থিতা। নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ।”
ঠিক যে দেবী সর্ব্বভূতে বিভিন্ন রূপে বিরাজ করছেন তাঁর পূজা এসে গেল। আর ভূতেদের না তাড়িয়ে তাঁর পূজা হবে কী করে? অতএব তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে মিঞা-বিবি ভূতেদের উদ্দেশ্যে তর্পণের জন্য দামোদরের ঘাটে এসে হাজির হলেন।
কিন্তু দামোদর তো শুকিয়ে কাঠ! জল কই? একসময় যাকে “বাংলার দুঃখ” বলা হত আজ তার দুঃখ দেখে ত-বাবুর চোখে জল এসে গেল। বিশাল চরের মাঝে মাঝে যে খানা-খন্দগুলি রয়েছে সেখানে লোক গিজগিজ করছে। হঠাৎ পরিচিত একটা মুখ দেখে ত-বাবু তার দিকে এগিয়ে গেলেন। “আরে তপন না?”
হ্যাঁ চুড়ামণিপুরের তপনই তো। ওর দাদা চাকরী নিয়ে সেই যে দুবাইয়ে গিয়ে উঠেছে আর ঘরমুখো হয়নি। এই সুযোগে তপন ওর বাবাকে পুরো সম্পত্তি নিজের নামে লিখে দিতে বলেছিল। না দেওয়ায় নানারকম অমানুষিক অত্যাচার করে গলা টিপে মেরে গলায় দড়ী দিয়ে ঝুলিয়ে দিয়েছিল। অবশ্য তার আগে, আগে থেকেই তৈরি করে রাখা এক দলিলে বুড়োর হাতের টিপছাপ নিতে তপন ভুল করেনি।
কয়েক বছর পর ভাগের মায়ের ঠেলা একা বইতে পারবে না জানিয়ে মাকেও তাড়িয়ে দেয় তপন। তখন ওর মা চরম দুঃখ সইতে না পেরে এই দামোদরের জলে ঝাঁপ দিয়েই ভবলীলা সাঙ্গ করেছিলেন। তবে তপন দুবারই মড়াকান্না কেঁদেছিল বিস্তর। কুম্ভীরাশ্রুর বন্যা বইয়ে দিয়েছিল তপনের বউ। আর বাবা-মায়ের শ্রাদ্ধও তপন করেছিল বেশ জবরদস্ত করে। সারা গাঁয়ের দুদিন করে চারদিন হাড়ি বন্ধ ছিল। চর্ব্য-চুষ্য-লেহ্য-পেয়র কোন অভাব ছিল না। নিন্দুকেরা মানে গ্রামের যাঁরা মানুষ মরে যাবার উপলক্ষ্যে ভোজ সভাটাকে বয়কট করেন তাঁরা বলেছিলেন, “তপনের বাবা মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি না থাক শ্রাদ্ধভক্তি কিন্তু ষোলোআনার বদলে আঠারো আনা আছে।” এর আগে কেউই চুড়ামণিপুরের পুরো গ্রাম খাওয়াতে পারেনি কোন অনুষ্ঠানে। সেও হয়ে গেল বছর দশেক।
ত-বাবু তপনকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন ওর মা মারা যাবার পর থেকে প্রতিবছরই ও তর্পণ করতে দামোদরে আসে। ও গয়ায় গিয়ে পিণ্ডিও দিয়ে এসেছে।
আসবে না কেন? জীবিত মা বাপকে খাইয়ে পরিয়ে, ওষুধ পথ্য জুগিয়ে খুশি রাখা বড় কঠিন ও ব্যয়বহুল কাজ। তার ওপর আবার যদি ভাগের মা-বাপ হয়! অথচ মরে গেলে তিরিশ টাকার তিল, যব, আতপচাল, হরিতকী, তামা, তুলসী, কলা দিয়ে ওদের সাতপুরুষ নয় চৌদ্দপুরুষের এক বছর দিব্যি চলে যায়। আর ওগুলি ঠিক ঠিক বিলিবণ্টন করে দেওয়ার জন্য পুরুত ঠাকুরকে লাগে ১০১ টাকা সেলামী। এত সহজে চৌদ্দপুরুষের এক বছরের দানাপানির ব্যবস্থা করে দেবার পূণ্যলোভ কেউ ছাড়তে পারে? তপনও ছাড়েনি।
একটি বড়সড় খালের নিকট ত-বাবু ও তার গিন্নি গিয়ে দাঁড়ালেন। পুরুতের সঙ্গে দর দাম করে নতুন ধুতি পরে গামছা গলায় নিয়ে ত-বাবু চললেন জলের দিকে। জলাশয়টির অর্দ্ধেকের ওপর কচুরিপানা আর শৈবালদামে ভরা। সার্থক নাম দামোদর। দাম উদরে যাহার। ত-বাবুর মনে পড়ে গেল আরে আমাদের কেষ্টঠাকুরও তো দামোদর। ননী চুরি করা আটকাতে ওর মা যশোদা দাম বা দড়ী দিয়ে ওর উদর থামের সঙ্গে বেঁধে দিতেন তাই বোধহয় তিনি দামোদর।
তা যাই হোক জলের রং দেখে ত-বাবু তো থ। তার মা-বাবা, ঠাকুরদা, গিন্নির বাবা সবাই যে অ্যাকোয়াগার্ডের জল খেয়েছেন। তাঁদেরকে এই নোংরা জল তিনি দেবেন কেমন করে? কিন্তু সবাই তো দিচ্ছে। পুরুত মশাইয়ের মন্ত্র বোধ হয় নর্দ্দমার জলকেও নির্মল নর্মদা করে দিতে পারে!
“তাড়াতাড়ি ডুব দিয়ে আসুন।” পুরুতঠাকুরের কথায় ত-বাবুর হুঁশ হয়। বহু কষ্টে ময়লা জলে নাকে কানে আঙুল দিয়ে কোনরকমে ডুবে এসে ত-বাবু যখন তিল-যব-তুলসী হাতে দাঁড়ালেন তখন তাঁর সাত পুরুষের জন্য আনা সাতটি কলার মধ্যে ছটিই চলে গেছে ঠাকুর মশাইয়ের ঝুলিতে। তা যাক! ওই একটি কলাকেই তিনি ঠিক ঠিক ভাগ করে দেবেন তার পিতা, পিতামহ, পিতামহের পিতামহ, তস্য পিতামহ, তাঁর… তাঁর… তাঁর… সবার মধ্যে। না হলে এত বড় পৈতে কীসের! আর এত লম্বা তিলকই বা কীসের?
মন্ত্র বলতে বলতে একবার আকাশের দিকে তাকালেন ত-বাবু। দেখার চেষ্টা করলেন আত্মারা এসেছেন কিনা! নিশ্চয়ই এসেছেন। এত বড় বড় মন্ত্র, না এসে পারে! তাঁর টাকুদাদু, খাঁদুকাকু, পদিপিসি, ময়নামাসী, শ্যামামামা, হাঁদাদাদা সবাই হয়তো এসেছে, সব্বাই। শুধু অশরীরী বলে তাঁদের দেখতে পাচ্ছেন না। কেবল দেখতে পেলেন কয়েকটা বনা পাখী আর বক উড়ে গেল। চোখ নামালেন মাটিতে। দেখতে পেলেন কয়েকটি গোরু ছাগল চরে চরছে; আর তার দোক্তা দিয়ে পান খাওয়া গিন্নী একটি পান মুখে পুরছেন।
মন্ত্র পড়া শেষ হলে পুরুতঠাকুর হাতের বস্তুগুলি জলে ফেলে দিয়ে আবার ডুব দিয়ে আসতে বললেন। ডুব দিয়ে উঠতেই ত-বাবু দেখতে পেলেন তাঁর গৃহিণী ছটফট করছেন। প্রায় জ্ঞান হারাবার উপক্রম। দোক্তা দেওয়া পানের ঢোক গিলতে গিয়ে বিষম খেয়েছেন। পাশে থাকা লোকজনেরা কেউ মাথায় জল দিচ্ছেন কেউবা খবরের কাগজ দিয়ে বাতাস করছেন। ত-বাবু ভাবতে লাগলেন আত্মার উদ্দেশ্যে মন্ত্রপূত জল অঞ্জলি দিতেই কেন তাঁর গিন্নীর এরকম হল? তার মনে পড়ে গেল আত্মা সম্পর্কে গীতার বাণী।—
“বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরানি
তথা শরীরানি বিহায় জীর্ণ
ন্যন্যাতি সংযাতি নবানি দেহী।”
অর্থাৎ পুরাতন বস্ত্র ছেড়ে নতুন বস্ত্র পরিধানের মত আত্মাও শরীর পরিবর্ত্তন করে মাত্র। শরীর নষ্ট হলেও আত্মার কখনো মৃত্যু হয় না।
তাহলে যে পূর্ব্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে মন্ত্র পড়ে ত-বাবু তর্পণ করলেন তাঁদের অনেকেরই তো নতুন শরীর লাভ মানে পুনর্জ্জন্ম হয়ে গেছে। তবে সবারই যে মানুষের শরীর জুটেছে এমনটা নয়। তাহলে তো পৃথিবীর লোকসংখ্যা বাড়ত না। একজন মরলে আরেকজন জন্মাত। ফলে লোক সংখ্যা হয় এক থাকত, না হলে কমত। লোকসংখ্যা বাড়ছে মানে অন্য পশুপাখীর আত্মাও মানুষের শরীর লাভ করছে। আবার মানুষের আত্মাদের কারুর জুটেছে গোরুর বস্ত্র, কারো গাধার, কেউ ছাগলের জামা পেয়েছে, তো কেও ভেড়ার। এই প্রথম ত-বাবুর মনে হতে লাগল তাঁর স্ত্রীরত্নটিও তাঁর কোন পূর্ব্বপুরুষ নয়ত? ত-বাবুর স্ত্রীকে প্রণাম করতে ইচ্ছে হল। প্রণাম করতে চাইলেন চরে বেড়ানো গোরু ছাগলগুলিকে ও উড়ন্ত পাখীগুলিকে। কে কোন্ জন্মে কী ছিল বলা যায় না! স্বয়ং বিষ্ণুই তো জন্মেছেন কখনো মাছ, কখনো কচ্ছপ, কখনো বরাহ হয়ে। গৌতম বুদ্ধও তো নানা জন্মে নানা পশুপাখিরূপে জন্মেছেন। অতএব ঐ এঁড়েবাছুরটি যে ত-বাবুর দাদাঠাকুর নয় তা কে বলতে পারে!
“কই গো কাপড় ছেড়ে এবার তুমি কিছু খেয়ে নাও। সেই সকাল থেকে উপোস করে আছো।” গিন্নীর কথায় টনক নড়ল ত-বাবুর। সুস্থ হয়েছেন গিন্নি। কিন্তু ত-বাবুর এখন খাবারে রুচি নেই। ভাবলেন তিনিও তো কোন না কোন আত্মা যে পুনর্জ্জন্ম পেয়ে এ জন্মে ত-বাবু রূপে বিরাজ করছেন। হয়ত গত জন্মে বা তার আগের জন্মে বা তারও আগে তিনি ছিলেন কোন কৃমি, ব্যাং, গুপোকা, ফড়িং; কিংবা কারো বাবা, মা, মাসী, মামা, পিসশ্বশুর, মামিশ্বাশুড়ী, ভাইরা ভাইয়ের শালীর অমুকের অমুকের তমুক…। তাদের সবারই উত্তরসূরীরা আজ এই মহালয়ার পুণ্য লগ্নে পিতৃপক্ষের শেষ দিনে তর্পণ করতে নেমেছেন বিভিন্ন খানাখন্দে। এখন ওরা যদি সবাই ত-বাবুর উদ্দেশ্যেই মন্ত্র পড়েন তাহলে তিনিও তো বিষম খেয়ে শরীর ছেড়ে আবার আত্মা হয়ে যেতে পারেন। তাই বললেন, “গিন্নি তুমি আমায় বড় বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছো; আর একটা মস্ত বড় শিক্ষাও দিয়েছো। এরপর আর আমি এরকম তর্পণ করবো না। আর মহালয়ার দিন সকালে অন্তত কিচ্ছুটি খাবো না। আমিও না। তুমিও না। টুকটুকিকেও কিছু খেতে দেবো না।”
— কেন গো কী হল? তুমি পাগল হয়ে গেলে নাকি? — না গো, আমার দিব্যদৃষ্টি লাভ হল। কিন্তু ভাবছি কেন এত শত শত মানুষ মহালয়ার এই পূণ্য লগ্নে ঘাটে ঘাটে ঘটি নিয়ে নিষ্ফলা তর্পণ করতে ছুটছেন! কেনই বা আমাদের মহান জ্ঞানী পিতা-পিতামহ তুল্য মুনি-ঋষিরা শাস্ত্রে তর্পণের বিধান দিলেন? বোধহয় তর্পণের অন্য কোন মানে আছে বুঝলে! আমি এখনই একবার কোলকাতায় যাব। আমাকে কিছু বই কিনতে হবে। তুমি বাড়ি যাও আমি আগামীকালই ফিরব।
কোলকাতায় পুরো বইপাড়া ঘুরে ঘুরে ত-বাবু কিনলেন বাংলা ভাষার সমস্ত অভিধান, শব্দকোষ, চলন্তিকা ও পুরাণগুলি। বাড়ি ফিরে পরদিন থেকে খুঁজতে বসলেন ‘তর্পণ’ শব্দের অর্থ। সব অভিধানগুলি পড়লেন। দেখলেন অর্থ সবাই দিয়েছেন কিন্তু ব্যাখ্যা কেউ দেননি। ব্যাখ্যা দিয়েছেন একমাত্র “বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ”। যেটি লিখেছেন দুই প্রণম্য ভাষা বিশারদ কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী মহাশয়। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ পড়ে ‘তর্পণ’ শব্দের কী অর্থ পেলেন ত-বাবু, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ে?
পেলেন তৃপ্ + অন = তর্পণ। তৃপ্তি অন (on =চালু) থাকে যাতে বা যার দ্বারা কারো তৃপ্তি সাধিত হয় তাকেই তর্পণ বলে। আরো সহজ করে বললে কারো তৃপ্তি সাধনের জন্য কোন কিছু করলে তাকেই তর্পণ বলা হবে। তবে তার একটি বিশেষ শর্ত্ত আছে। এই তৃপ্তিবিধান করার ভিত্তিতে থাকতে হবে ঋণ। অর্পণ না থাকলে যেমন প্রত্যর্পণ হয় না তেমনি ঋণ না থাকলে তর্পণ হবে না। আবার সরাসরি ঋণ নিয়ে তা শোধ করে দিলে ঋণশোধ হবে কিন্তু তর্পণ হবে না। যে ঋণ অনিবার্য্য; জন্মিলে এবং বেঁচে থাকতে হলে মানুষ চাক বা না চাক যে ঋণ নেওয়া হয়ে যায় সেই ঋণ শোধ করার উপায়ই হল তর্পণ।
এ আবার কেমন ঋণ যা মানুষ জানতে পারে না অথচ নেওয়া হয়ে যায়? ভারতীয় শাস্ত্রে এরকম তিন ঋণের কথা রয়েছে। পিতৃঋণ, দেবঋণ ও ঋষিঋণ।
পিতৃঋণঃ
মানুষ তার জন্মের জন্য পিতা-মাতা, ঠাকুরদা-ঠাকুরমা, দাদু-দিদিমা বা তাঁদেরও পূর্ব্বসূরীদের কাছে ঋণী। তাঁদের কোনো একজন না থাকলে বর্ত্তমান মানুষটির জন্মই হত না। পূর্ব্বপুরুষ (নারীও) বা পিতৃ-পুরুষের কাছে মানুষের এই যে ঋণ তাই হল পিতৃঋণ।
দেবঋণঃ
যিনি দেবো দেব বলেন এবং দিয়ে দেন, আমাদের পূর্ব্বসূরীরা তাঁকেই দেব বা দেবতা বলতেন। যে বা যাঁরা মানুষকে কিছু দেয় তাঁদেরকে দেবতা বলার রীতি আমাদের দেশে সুপ্রাচীন। সমাজের সকল সদস্যদের দেবতারা নিজেদের শ্রম, মেধা এমনকি জীবন দিয়েও আগলে রাখতেন। বর্ত্তমান মানুষটিকে যা কিছু বাহ্যসম্পদ তাঁরা দিয়ে গেছেন যেমন জমিজমা, ঘরবাড়ী, ঘটিবাটী, বিদ্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি যেগুলি আমরা না জেনেই নিয়েছি তা সবই এই দেবঋণের মধ্যে পড়ে।
ঋষিঋণঃ
বর্ত্তমান মানুষটির জন্মানোর আগে মুহূর্ত্ত পর্য্যন্ত মানুষের অর্জ্জিত সমস্ত জ্ঞানের ঋণ হল উক্ত মানুষটির কাছে ঋষিঋণ। মানুষটি জন্মে যে জিনিসগুলি ব্যবহার করছে সেগুলি সে কোথায় পেল? তার জন্য কে সেগুলি তৈরি করেছিলেন? তা করেছিলেন তাঁর পূর্ব্বসূরী মহান জ্ঞানী ঋষিরা। আগুনের ব্যবহার, চাষবাস, খাদ্যাখাদ্যজ্ঞান, রোগ হলে চিকিৎসা পদ্ধতি, বাড়ী বানানোর কৌশল থেকে হাল আমলের ইণ্টারনেটের ব্যবহার পর্য্যন্ত এই ঋষিঋণের মধ্যে পড়ে।
নিজের অজান্তেই পূর্ব্বসূরীদের নিকট হতে এ ঋণ প্রত্যেকটি মানুষ গ্রহণ করে চলেছে। অর্থাৎ অগণিত মানুষের মহত্তম দানে গড়ে তোলা বাহ্যসম্পদ ও অসংখ্য মানুষের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ধার নিয়ে বর্ত্তমান মানুষটি তার বাবা-মায়ের দেওয়া জীবনটি যাপন করে চলেছে। এ যে কত বড় ঋণ মানুষ না জেনে নিয়ে ফেলেছে তার কূলকিনারা পর্য্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না! অথচ এই ঋণগুলিকে শোধ তো করতে হবে! কিন্তু শোধ করা যাবে কী করে?
ত-বাবু নাওয়া-খাওয়া ভুলে “বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ” পাঠ করে চলেছেন। এই ঋণ শোধ করার উপায়ই হচ্ছে তর্পণ। তবে এ ভারী সাবধানের কাজ। এই ঋণের সম তর্পণ ফিরিয়ে দেওয়া খুব সন্তর্পণে করতে হয়। তাই তো সন্তর্পণ কথার অর্থ হল সম তর্পণ। (সম + তর্পণ = সন্তর্পণ।) এবং চুপিচুপি। প্রথমত যিনি ঋণ দিয়েছেন তাঁর দেবার মধ্যে কোন অহংকার বা দেখনদারী ছিল না। ঢাক পিটিয়ে, পুরুষ সাক্ষী রেখে বা কোন অঙ্গীকার পত্রে সই করিয়েও তিনি তা দেননি যাতে কাউকে লজ্জিত হতে হয়। তিনি জানতেই দেননি যে তিনি দিয়েছেন এবং বাকীরা নিয়েছেন। আবার তাঁরা তা দিয়ে চুপচাপ সরে পড়েছেন। সুতরাং এ ঋণ শোধও করতে হবে চুপচাপ থেকে সাবধানে। এতে কোন লুকোচুরি নেই। রয়েছে কোমল মমতামাখা মান-সম্মানের পারস্পরিক বোধ। কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি পিতৃতর্পণ, দেবতর্পণ ও ঋষিতর্পণ করলেই সেই ঋণ শোধ হয়ে যায়।
পিতৃতর্পণঃ
প্রত্যেক জীবই সন্তান সৃষ্টি করে নিজের নিজের বংশধারা অক্ষুন্ন রাখতে চায়। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর সন্তানের বীজ বপনকারী বাপ বা বাবা বনে যান। বাংলায় দুটি ‘ব’। একটি বর্গীয় ব, আরেকটি অন্তঃস্থ ব। এক ‘ব’-এর অর্থ ‘বহন করা’; আর অন্য ‘ব’-এর অর্থ বিকল্প বা দুই বা দ্বিতীয় (bi)। বহনকারী বা বিকল্পের আধার বাহিত হয় যে আধারে তিনিই ‘বাবা’। আর বংশধারায় সন্তান (পুত্র বা কন্যা) যে পিতারই বিকল্প তা তো সবাই জানে। তাই তো লুইয়ের বেটা দ্বিতীয় লুই, তাঁর বেটা তৃতীয় লুই, তাঁর বেটা চতুর্থ লুই এমনি করেই নামকরণ চলত এককালে।
সন্তান উৎপাদন করে কেউ বংশগতির ধারাকে তরতর করে এগিয়ে দেবার পণ পালন করলে পিতৃ পুরুষেরা তৃপ্ত হবেনই। তখন পিতৃপুরুষেরা তাকে বাহবা না দিয়ে পারেন না। তারা এতটাই ভাল কাজ করেছেন যে দুবার বাহবা (বা বা) তাদের প্রাপ্য। তাই ভারতবর্ষে পিতাও পুত্রকে বাবা সম্বোধন করেন। সুতরাং সন্তানের জন্ম দিয়ে তাকে যত্নপূর্ব্বক লালন পালন করে বংশপ্রবাহ অক্ষুন্ন রাখলে এবং জীবিত বুড়ো বাবা-মা, দাদু-ঠাকুমা, পিসিমা-মাসিমাদের যত্নআত্তি ও সেবা-শুশ্রূষা করে তাঁদের তৃপ্তি বিধান করলেই মানুষের পিতৃতর্পণ হয়ে যায়। এর জন্য কোন সাক্ষী-সবুদ, পুরুত, অং-বং-চং লাগে না। ঋণ নেওয়া যেমন গোপনে গোপনে হয়েছিল ঋণশোধও হবে তেমনি গোপনে গোপনে, কাউকে না জানিয়ে। এই যে সন্তর্পণে জন্মগ্রহণ করে পিতৃঋণ নেওয়া এবং সন্তান জন্ম দিয়ে তা ফিরিয়ে দেওয়া এই হলো আমাদের পিতৃতর্পণ।
দেবতর্পণঃ
উত্তরাধিকারসূত্রে মানুষ যে বাহ্যসম্পদ যেমন জমিজমা, ঘরবাড়ী, বাসনকোসন, অলঙ্কার, আসবাবপত্র, পাঠশালা, বাগান, চিকিৎসালয় ইত্যাদি পেয়েছে তাকে নষ্ট না করে সুষ্ঠুভাবে ব্যবহার করে আরো বেশী যুগোপযোগী সম্পদ উত্তরসূরীদের জন্য রেখে গেলেই তা হবে দেবতর্পণ। যাতে ওই সম্পদের সাহায্যে উত্তরপ্রজন্ম সুস্থ ও সবল দেহ-মনে অনেকদিন দিনাতিপাত করতে পারে।
ঋষিতর্পণঃ
অগ্রজদের আবিষ্কৃত জ্ঞানসম্ভারের উপভোগ, রক্ষণাবেক্ষণ ও তার সাহায্যে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করে নতুন সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল তৈরীর নাম ঋষিতর্পণ। পরিবর্ত্তনশীল জগতে নবজ্ঞানের উন্মেষের সাহায্যে পৃথিবীকে আগামীর বাসযোগ্য করে তোলাই হল ঋষিতর্পণের মূল লক্ষ্য।
ত-বাবুর ঘোর কাটতে সময় লাগল। বারবার পড়লেন, মেয়ে টুকটুকিকে পড়ালেন। গিন্নিকে পড়ে শোনালেন তার সদ্য আবিষ্কৃত তর্পণের ইতিকথা। সিদ্ধান্ত নিলেন তাকেও তর্পণ করতে হবে। তবে লোক দেখানো ঘাটে ঘাটে ঘটি হাতে প্রতীকী তর্পণ নয়। আমাদের পিতা, দেবতা ও ঋষিদের মত মহাজ্ঞানী মহাজনদের দেখানো প্রকৃত তর্পণ।
এরপর থেকে ত-বাবু গ্রামের প্রত্যেকের খোঁজ খবর নিতে লাগলেন, কারো বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ানো, দুঃস্থদের সাহায্য করা, কেউ অসুস্থ হলে তার সেবা করা, প্রত্যেককে সুপরামর্শ দেওয়া তাঁর নিত্যকর্ম্ম হয়ে উঠল। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিতে সর্ব্ব সাধারণের ব্যবহার্য্যে খনন করলেন এক বিশাল পুকুর। পুকুর পাড়ে এবং বাকী জমিতে লাগালেন আম, জাম, কাঁঠাল, তাল, বেল, আমলকী, হরিতকী, বহেড়া, নারিকেল, জামরুল, তেঁতুল, পেঁপে, পেয়ারা, আমড়া, কলা প্রভৃতি ফলের গাছ। ঠিক করলেন এই বাগানের কোন ফল তিনি বিক্রি করবেন না; যে পারে পেড়ে খাবে। কারো বাধা নেই। আর না মরা পর্য্যন্ত বাগানের কোন গাছ তিনি কাটবেন না। দুই সত্যদ্রষ্টা ঋষি কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তী তাঁর জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছেন। ত-বাবু তাঁদের লেখা সব বই কিনে এনেছেন। নিজস্ব কাজ, পারিবারিক কাজ ও সামাজিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে বই পড়া, আর মেয়ের সঙ্গে পাড়ার ছেলেমেয়েদেরও পড়ানো তিনি বেশ আনন্দের সাথেই করে চলেছেন।
সম্প্রতি ত-বাবু তর্পণের মতো ভুল দিশায় পরিচালিত শব্দ যেমন শিব, ব্রহ্ম, আত্মা, পরমাত্মা, ধর্ম্ম, ভুত, দেবতা, দানব, আকাশ, অগ্নি, বায়ু, যক্ষ, অপ্সরা, বিশ্ব, পাদোদক, চরণামৃত, সুধা, হনুমান প্রভৃতি নিয়ে একটি বই লেখার কাজে হাত দিয়েছেন। বইয়ের নাম দিয়েছেন “পুরানো সেই দিনের কথা।”