উইলসন, বসন্তবাউরি, রেলপথ ও বৃক্ষের লাগি || ফাহমিনা নূর

0

বসন্তবাউরি
~~~~~~~~~~~~~~~~~

একটি বসন্তবাউরি জানালার কাঁচে
ধাক্কা খেয়ে ভীষণ আহত।
তার চঞ্চুতে বেদনার ঢল, ডানায় ক্লান্তি,
কুঁকড়ে গিয়েছে ধারালো নখর।

জীবন এত ছোট,
তবুও ফ্ল্যাশ লাইটে কিছুটা দৃশ্যমান
অজস্র পায়ের শব্দে কাঁপছে কাঁচের সোপান
চোখে লাগছে ধাঁ ধাঁ, সূর্য্যটা প্রখর।

সরোদ বাজিয়ে শোনাচ্ছে
এক স্বল্প পরিচিত সুর
হয়ত ঢেউয়েরও থাকে ক্লান্তিকর গতি
কোথাও বইছে অসফল স্রোত,
আরেকটি বসন্তবাউরি ছটফট করছে
আড়ালে কোথাও;

এত এত চাওয়া,
অরণ্য ভেবে ফিরে আসে মানুষের মন
আরেক মানুষের কাছে
ঘন, অস্পষ্ট, অরণ্য দাঁড়িয়ে আছে
বসন্তবাউরি মানুষের কাছে।

বৃক্ষের লাগি
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

সে—
এক ঋজু মানুষ
হেঁটে গেছে বিজয়ের পথে
বহু বিনিদ্র রাত আর অন্ধকার কেটে
রেখে তার নিজস্ব ভোর তোমার নামে;
তুমি সেই মরুবৃক্ষ, ঝাঁঝালো রোদে—
ভাঁজ করে রাখা
মানচিত্রে
এক রাষ্ট্রহারা নাগরিকের মত।
দানা নেই, পানি নেই, বিশদ দহনে
ক্লান্ত, অনশন রত এক নির্বাক ম্যানিকিন।
ভাঁজ খোলো, খোলো পোষাকী নাম,
দেখাও পাঁজরের হাড়
কন্ঠ অবরোধকারী বাহারী মালা, অনঘ
বিশ্বাসের ধ্বস আর অতুলন মৃত্যুর পয়গাম ।
হে বৃক্ষ
এবং বৃক্ষের আড়ালে—
যাবতীয় সাধনা-সৌধরাজি, ক্ষ্যাপা তারুণ্য
তোমরা জড়ো হও, দীঘল হও আমাদের
আয়ুর চেয়ে,
আয়ুর সাথে আয়ু জুড়ে দিয়ে
শতাব্দীর মেইলট্রেনে পাড়ি দাও অসীম
শূন্যতা
নতুন গ্যালাক্সি।
বিলাপ কুসুমের ক্ষুধা মন্দা
ভুলে
রূদালী মাতম, সব ছেড়ে-ছূঁড়ে
হাতের তালু ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে যে শেকড়
তারে রুয়ে দাও, রুয়ে দাও বাত্যাবিক্ষুব্ধ
পোড়া মানচিত্রে।
দিয়েছ?
হ্যাঁ, তবে বল এবার,
এত জলধারা কোথা পাবে!
কোথায় এমন অগ্নি, জল ও মাতাল একাকার
এমন পিপাসিত চিত্তের অম্বুর স্বাদ!
শোন তবে, শোন ধীমান, তরুণ পর্ব্বত, লীন
বাৎসল্য—
শেকড় চাইছে শূন্যতায় এক জলদ গম্ভীর নাদ।

উইলসন
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
উইলসন! উইলসন!
তোমাকে ডাকছে শেষ বেঞ্চে বসে থাকা
চুপচাপ ছেলেটা
উইলসন! উইলসন!
তোমাকে ডাকছে দাবার বোর্ড
ঘোড়ার আড়াই চাল আর
বান্দ্রা লেকের ধারে নীল গাভীটা
উইলসন! উইলসন!
তোমাকে ডাকছে খ্রাইস্ট চার্চ প্লে
সেন্টার
পাহাড়ের ঢালে নুয়ে থাকা ছাতিম গাছটা
বরিশালগামী লঞ্চে তোমার মা
যে তোমাকে রেখে গিয়েছিল এদের জিম্মায়,
সমাধিস্থলে অসীম নীরবতায়।
শেষ বেঞ্চের চুপচাপ ছেলেটা, যার নাম উইলসন।

রেলপথ
~~~~~~~~~~~~~

এই শহরে এখন কুকুর ডাকছে না
নীলরঙবাহী এক রেলপথ আছে
শহরের সাথে
সেখানে আত্মহননের অসহনীয় গল্প বলে
বিখ্যাত হয়ে গেছে পাথরগুলো
পাগড়ী মাথায় হেঁটে গেছেন আমার বাবা
একটা কাশবন উইল করে গেছেন
মায়ের আঁচল জুড়ে।

রেনু উড়ছে কাশবন থেকে,
তুলার মত রেণু! তুষার কণার মত রেণু!
আমার চোখে ঢুকে যায় তুষার কণা
তারা কী চায় আমার কাছে! আমি তো বলেছি
আমার চোখে আর সমুদ্র অবশিষ্ট নেই।

শীতকাল এলে
আমার দুই ভাই পায়রার ডানা হয়ে উড়ে যায়
আকাশটা বিশাল নয়, যতটা ভেবেছিলাম।
লাল দরজায় কড়াঘাত— ঘন্টা বাজে ঢং ঢং ঢং—
কোথা হতে আসে এত ঘন্টাধ্বনি!
শিঙ্গার ফুঃ! ড্রামের তালে দ্রিম দ্রিম হুঙ্কার!
তীব্র অভিঘাতে পালক ঝরে পড়ে
ওড়ে
বাতাসে তুষারের মত ঝরে,
রূপালী রঙের অযুত তারা দখল নেয়
মায়ের আঁচলে। আমার মা আঁচল জড় করে
গন্ধ শুঁকেন, গন্ধ না পেয়ে আরও জোরে
চেপে ধরেন দুমড়ানো আঁচল।
কুকুরগুলো বাবার গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে
হেঁটে গেছে রেলপথ ধরে
এই শহরে আর কোনদিন কুকুর ডাকবে না।

20200628_184729ফাহমিনা নূর
জন্ম: ১৯৭০, ঢাকা। শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ এম এস এস, লোক প্রশাসন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা: শিক্ষকতা, বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল। নিবাস: চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার