ডিসিপ্লিন এ্যান্ড পানিশঃ দ্যা বার্থ অব দ্যা প্রিজন — মিশেল ফুকো || পাঠ পর্য্যালোচনা — মাহবুবুল ইসলাম

0

download download (1)

বেকন যখন বলেন “knowledge is power” ফুকোই বলেন “না, power is knowledge” ক্ষমতা জড়িয়ে আছে প্রতিটি সামাজিক সম্পর্কের পরতে পরতে। ক্ষমতা শুধু রাষ্ট্রযন্ত্রে বা রাজনৈতিক অঙ্গনে নয়, এটা বিস্তৃত হয়ে আছে হাসপাতালে, ফ্যাক্টরীতে, স্কুলে, উপসনালয়ে, পরিবারে। এবং প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান কারাগারের মত আচরণ করে এবং মানুষকে বন্দি করা হয়।

ফুকোর ভাষায় মধ্যযুগে রাজা ছিল সকল ক্ষমতার উৎস। রাজার ইচ্ছেকে লঙ্ঘন করা ছিল পাপ। পাপের শাস্তি ছিল ভয়াবহ এবং নির্ম্মম। চাবুক, অগ্নি দহন, ফাঁসি, গিলোটিন, প্রস্তর নিক্ষেপ, অন্ধকূপে নিক্ষেপ, মাটিতে অর্দ্ধেক শরীর পুতে তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করানোর মত কৌশল অবলম্বন করত।

তবে আধুনিক যুগে ক্ষমতার উৎস হল রাষ্ট্র, আইন-আদালত ইত্যাদি। তারা বিভিন্ন অপরাধের জন্য বিভিন্ন ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা করে।
একালের শাস্তির বিষয়বস্তু শরীর নয়, আত্মার সংশোধন।
সৃষ্টি হল কারাগার। অপরাধীদের সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হবে।
এভাবে অপরাধ থেকে বিরত থেকে ধীরে ধীরে সংশোধন হলে তাকে মুক্তি দেয়া হবে।

তবে ফুকোর উদ্দেশ্য শুধু কারাগারের উৎপত্তি বর্ণনা করা নেয়। বরং সামাজিক জীবনের অন্যায্য সংঘটন যেমনঃ পরিবার, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, ফ্যাক্টরী, সেনা ব্যারাক, সবগুলোই যে কারাগারের মত আচরণ করে তা দেখানোর প্রয়াস করেন। এটা তিনি disciplinary society নাম দেন।

এসব প্রতিষ্ঠানে প্রত্যেকে প্রত্যেককে পাহারা দিচ্ছে। আমার উর্ধ্বতন কর্ত্তৃপক্ষ আমাকে পাহারা দিচ্ছে। আমি আবার পুনরায় আমার অধস্তন কর্ম্মচারীকে পাহারা দিচ্ছি। এ কালে পাহারাদাররা আগের মত বেত বা কারাগারে বন্দি করে অর্থদন্ড দেয় না। তবে কর্ত্তার মর্জির উপর নির্ভর করে অধীনস্থদের বেতন, ভাতা, চাকরি থাকবে কি-না।

ফুকোর বিশ্লেষণে আধুনিক যুগের সমাজের এই অসম ক্ষমতা বন্টনের রয়েছে এক বিরাট প্রহসন। কেননা, একদিকে রেনেসাঁ পরবর্ত্তী শ্লোগান হল ব্যক্তির সার্ব্বভৌমত্বে বিশ্বাস, অন্যদিকে তার উপর চাপিয়ে দেয়া হয় মানসিক বোঝা। এটা pan-optic সমাজ বলে চিহ্নিত করেছেন।

আগেরকার মানুষ অত্যাচার, শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত। এখন আধুনিক ক্ষমতা মানুষকে এমনভাবে ব্যবহার করে যে সে ভুলে যায় সে পরাধীন ও পদদলিত। ক্ষমতা ঠিক করে কোন্টা সত্য কোন্টা মিথ্যা কোন্টা করা উচিত কোনটা অনুচিত প্রতিষ্ঠান ক্ষমতা বলে নির্দ্ধারণ করে দেয়।

আধুনিক কালের এই কারাগারে বন্দী থাকা মানুষ অবশ্য প্রতিবাদ করে না।

নিয়ত অনুশীলনের দ্বারা কতগুলো standard কে normalize করার মাধ্যমে যে কোন শৃঙ্খলকে শৃঙ্খলায় রূপান্তর করা হয়। তখন ব্যক্তি অবচেতনভাবেই ক্ষমতার ক্রীড়নকে পরিনত হয়।

ফুকোর বর্ণিত সবকিছুই ‘play of forces’ (ক্ষমতার খেলা), এটা মেনে নিলে প্রশ্ন জাগে ক্ষমতার এই বলয় থেকে কি মুক্তি পাওয়া সম্ভব?

ফুকো নিজেই উত্তরে বলেন, ‘ক্ষমতা খেলা’ সর্ব্বত্রই বিদ্যমান। তবে খেলায় যেহেতু দু’পক্ষ বিদ্যমান। প্রভু আর চাকর। উর্ধ্বতন আর অধস্তন। ফুকো বিশ্বাস করেন “মানুষের ধর্ম্ম যেখানেই প্রভুত্ব সেখানেই বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। বিদ্রোহের পরাজয় অনিবার্য্য নয় “are not doomed to defeat always” শোষণের বিরুদ্ধে চির বিদ্রোহী ও সমালোচকই ইতিহাসের প্রকৃত নায়ক।

মূলতঃ ফুকো পশ্চিমা সভ্যতার বিশেষ করে enlightenment এর হাত ধরে যন্ত্রযুগের যে সভ্যতার বিকাশ ঘটে তার ফাঁকফোকর বের করেন।

তাদের সমাজচিন্তায় কীভাবে কর্ত্তৃত্ব ও আধিপত্যের প্রবণতাগুলো প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক বিভিন্ন সংঘটনে, সে বিষয়টার ওপর আলোকপাত করেন।
উঁনার ভাষায়:
“পূঁজিবাদের বিকাশ, যেটা প্রয়োগ করা হয় মানুষের দেহে ও তার সকল কর্ম্মনিয়ন্ত্রণের জন্য। এমনকি যৌনতার মাঝেও ক্ষমতার ছায়া বিরাজ করে।”

বস্তুত যেসব যুক্তি আর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, প্রযুক্তির উন্নয়ন, নীতিমালার উপর ভিত্তি করে পশ্চিমা সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে এবং অবশিষ্ট পৃথিবীর উপর ছাপিয়ে দিচ্ছে সেটা যে আপামর মানুষের মঙ্গলময় নয় ফুকো বিশদভাবে তুলে ধরেন।

ফুকোর নিজেকে কোন দলের মুখাপাত্র ভাবেন না। যদিও তিনি মার্ক্সবাদী দলে যোগ দিয়েছিলেন পরে বের হয়ে আসেন। কারণ কোন চিন্ডার প্রাতিষ্ঠানিকরণ তিনি পছন্দ করতেন না।

মার্ক্স, ফ্রয়েডসহ অনেকে যখন গর্ব্বের সাথে নিজেদের ইউরোপীয় আলোকদীপ্ত যুগের ধারক, বাহক ভাবেন তখন ফুকো, নিটশে, গ্রামশি, দ্যেলুজ, আলথুজার প্রমুখরা নিওক্লাসিক্যাল এইজের রীজন এর আত্মগরিমার অন্তঃসারশূন্যতা বের করেন।

ফুকো এই বইয়ে প্রিজন বলতে চিন্তার জগতকে যে কীভাবে গ্রাস করা হয় তা দেখিয়েছেন। ফুকো তার নিজের বইয়ের ব্যাপারে বলেন,
“আমার বইগুলো হবে মলোটভ ককটেলের মত । তা ফাটবে, আগুন ছড়িয়ে দিয়ে শেষ হয়ে যাবে, থেকে যাবে তার সূচিত আগুন, তা কিছু আলোকিত করবে, কিছু পোড়াবে, নতুন আলোকায়নের সম্ভাবনা জিইয়ে রাখবে।”

83067205_4140171295993843_1014302642014257152_nমাহবুবুল ইসলাম
জন্ম: ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৮১। পৈতৃক নিবাস— মাধবপুর, হবিগঞ্জ। প্রকাশিত গ্রন্থ: জল ও জলোচ্ছ্বাস (কবিতা) (প্রকাশ সাল— ২০১৯, প্রকাশক— চয়ন)। শিশির-হরফ (কবিতা) (প্রকাশ সাল— ২০২০, প্রকাশক— চারবাক)।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার