স্প্রিং, সামার, ফল, উইন্টার অ্যাণ্ড স্প্রিং (পরিচালকঃ কিম কি দুক) || পর্য্যালোচনা— ফাহমিনা নূর

0

মৃত্যু সংবাদের মাধ্যমে তাঁর নাম শোনা। তার আগে কোরিয়ান নির্ম্মাতা কিম কি দুকের চলচ্চিত্র আমি দেখিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর গুনগ্রাহীদের শোকের মাত্রা দেখে তাঁর কীর্ত্তি সম্পর্কে একটা প্রাক অনুমান করতে সক্ষম হই যা আমাকে তাঁর সৃষ্টিতে আগ্রহী করে তোলে। তালিকা সংগ্রহের পর যে সিনেমাটি প্রথমে দেখার জন্য বেছে নিলাম তার নাম ‘স্প্রিং সামার, ফল, উইন্টার অ্যান্ড স্প্রিং’। এটি সম্ভবত কিম পরিচালিত অন্যান্য মুভি থেকে ভিন্ন ধারার। ঋতুর নামে নাম রাখা এই চলচ্চিত্রের মূলে আছে একজন বৌদ্ধ মঙ্কের জীবনচক্র যা নির্ম্মাতা চারটি ঋতুকে ব্যবহার করে উন্মোচন করেছেন। এই চারটি ঋতুর প্রকাশ ঘটেছে প্রকৃতির রূপ পরিবর্ত্তনের সাথে সাথে চারটি প্রাণীর উপস্থাপনার মাধ্যমে। আমরা দেখতে পাই বসন্তকে প্রতিনিধিত্ব করেছে একটি কুকুর, মোরগ এসেছে গ্রীষ্মের প্রতীভূ হয়ে, হেমন্তে আমরা দেখা পাই একটি সাদা বেড়ালের যেখানে শীতের উপস্থাপনা নিয়ে এসেছে একটি সাপ। কোরিয়ান ভাষায় নির্ম্মিত মুভি, সাবটাইটেলও নেই। এই প্রথম ভাষাটি না জানার জন্য আফসোস হল। চলচ্চিত্রের নিজস্ব একটা ভাষা থাকে সেই ভরসায় দেখতে বসেছিলাম এবং ঠকিনি। মুভিটি বাচননির্ভর নয় তবে যে কয়টি ডায়ালগ আছে তা নিশ্চই বিশেষ গুরুত্ববহ। সেটুকু স্বাদ আস্বাদন করতে না পারার অতৃপ্তি থেকেই যাবে।

মুভিটির অনন্য আকর্ষণ হলো এর লোকেশান। শুধু লোকেশানের কারণেও এই মুভিটি মনে রাখা যায় বছরের পর বছর। লোকালয় নয়, মানুষের সমাগমহীন এক নৈসর্গিক পরিবেশ এর পটভূমি। পাহাড়ঘেরা এক অনিন্দ্য হ্রদের বুকে ভাসমান এক মন্দির। কাষ্ঠনির্ম্মিত সেই মন্দিরে থাকেন এক পুরোহীত আর তার শিষ্য এক শিশু এই চলচ্চিত্রের যে নায়ক, ভবিষ্যতের পুরোহীত। মনে করি শিশুটির নাম ড্যান, পূজাপাঠ আর ধ্যানের মাধ্যমে নির্ব্বাণলাভ যার অদৃষ্ট। নির্ব্বাণ কি এত সহজ প্রাপ্য! আমাদের সকল ভোগান্তির মূলে রয়েছে সংযুক্তি। যা কিছু আমাদের প্রিয় তার সাথে সংযুক্তি। যা কিছু আমাদের অপ্রিয়, অনাকাঙ্খিত তার সাথে আমাদের সংযুক্তি। তাই নির্ব্বাণলাভের পূর্ব্ব শর্ত্ত হল নিজের বিযুক্তিকরণ। আর এই বিযুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়াটিও হতে হবে আত্মা হতে উৎসারিত। এখানে আরোপ করার কিছু নেই। অর্থাৎ যা হওয়ার তা হতে দিতে হবে, জোর করে ঠেকিয়ে আর যাই হোক নির্ব্বাণপ্রাপ্তি ঘটে না। আত্মার সাথে তাই কোন জোরাজুরি নেই। এই মুভিতে কিম সম্ভবত সেই কথাটিরই বিন্যাস ঘটাতে চেয়েছেন।

মুভিটি শুরু হয় একটি তোরণের পাল্লাখোলার আওয়াজ দিয়ে অর্থাৎ দর্শককে তাঁর অজান্তেই পার্থিব জগত থেকে তোরণের ভেতর দিয়ে কিম পাঠিয়ে দিচ্ছেন আধ্যাত্মিক জগতের পথে। এছাড়া এখানে তোরণের উপস্থিতির আর কোন মানে নেই। মুভিতে দেখা যাচ্ছে তোরণের দুইপাশে কোনো প্রাচীর নেই আছে খাঁ খাঁ খোলা, উন্মুক্ততা।
শিশু মঙ্ক নির্ভিক, হিংস্রতার খোঁজ তার নেই। তাই বনজ পাতা সংগ্রহের সময় সাপের দেখা পেলে সে তাকে আলগোছে তুলে দূরে ছুঁড়ে দিতে পারে। কিন্ত সে মনুষ্য প্রবৃত্তি থেকে মুক্ত নয়। তাই জলের মাছ, ব্যাঙ ও সাপের দেহের সাথে সূতা দিয়ে পাথর বেঁধে আনন্দিত হয় যাকে আমরা বলি স্যাডিজম আক্রান্ত। তাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য রাতে ঘুমের ভেতর গুরু তার শরীরে বেঁধে দেন ভারী এক পাথর। পরদিন নিজ দেহের সাথে সেই পাথর টেনে তাকে চলতে হয়। একই দৃশ্য আমরা দেখতে পাই মুভির শেষাংশে সে যখন নির্ব্বাণ লাভের জন্য পাহাড়ের সর্ব্বোচ্চ চূড়ায় বুদ্ধমূর্ত্তি নিয়ে ওঠার চেষ্টা করে তখন নিজেই শরীরের সাথে বেঁধে নেয় এক ভারী পাথরের চাকতী। শৈশবে সে যে উচ্চতায় পৌঁছাতে পারত সেখান থেকে যতটুকু দেখা যায় তাতে সে তার এলাকার সামান্যই দেখতে পেত কিন্তু পাহাড়ে চূড়োয় যেদিন উঠল সেদিন তার দেখার এলাকা অনেকখানি বিস্তৃত। এ যেন জীবনকেই দেখার দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য।

আমরা তার জীবনের প্রথমাংশে দেখি বসন্ত। তারুণ্যে আাসে গ্রীষ্ম আর তখনই মন্দিরে এক অসুস্থ তরুণীকে নিয়ে আসেন তার মা। মেয়েকে মন্দিরে রেখে তিনি ফিরে যান সুস্থ হবে এ আাশায়। ছোট্ট একটা পরিসরে বিপরীত লিঙ্গের দুটি তরুণ প্রাণের অবস্থানের ফলে যা ঘটার তাই ঘটে। অবস্থা বেগতিক দেখে বুড়া পুরোহীত মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেন তোরণের ওপারে। এই বিচ্ছেদ সইতে পারে না ছেলেটি। নির্ব্বাণ আর প্রেমের অন্তর্গত দ্বন্দ্বে জয় হয় প্রেমিকের। একরাতে সে পালিয়ে যায়। প্রেমের সাথেই হয়তো হাত ধরাধরি করে আসে প্রতারণা। তাই জীবনের হেমন্তপর্ব্বে সে আবার ফিরে আসে মন্দিরে একজন পলাতক খুনের আসামী হিসেবে। এখানে যুবক পুরোহীত হিসেবে তার অভিনয়টি ছিলো চ্যালেঞ্জিং। পরিচালক এবং অভিনেতা দুজনই সাফল্যের সাথে সেটা মোকাবেলা করেছেন। চেহারায় একই সাথে ক্রোধ, প্রেম, বিরহ আর হতাশা ফুটিয়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়। বৈঠা সঞ্চালনের দৃশ্যে গতির সাথে নিঃসৃত হতে থাকে ক্রোধ। শুকনো রক্তের দাগ লেগে থাকা চাকু দিয়ে চুল কাটতে কাটতে নিঃসৃত হয় ক্রোধ। ক্রোধ অপসৃত হলে শরীর মন আত্মস্থ হতে থাকে। কিন্তু নির্ব্বাণতো এত সহজ নয়, নিজেকে অতিক্রম করা, বিযুক্ত করার পথ এখনও সুদীর্ঘ। তাই অক্ষর লিখে কাগজ দিয়ে নিজের শ্বাস নিজেই রুদ্ধ করার (আত্মহত্যা নয়) প্রক্রিয়া শুরু হয়। আমরা জানতে পারি, “Pain is inevitable but suffering is optional.”

এদিকে আসামীর সন্ধান করতে করতে পুলিশ এসে হাজির হয় মন্দিরে।তাদের কাছে সময় চাইলে সময় তারা দিয়েছেন। সময় দেয়ার জন্য পুলিশ মন্দিরে রাত্রিবাসও করেন। ওদিকে সারারাত কাঠের পাটাতনে কি যেন খোদাই করে লিখে চলে যুবক মঙ্ক। ভোরের আগে ক্লান্ত হয়ে সে মন্দিরের কাঠের প্রাঙ্গনেই ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরে ঘুম ভাঙে পুলিশের। আসামীর ঠান্ডা লাগছে তাই ঘুমন্ত আসামীকে নিজের গায়ের জ্যাকেট খুলে মুড়িয়ে দিচ্ছে পুলিশ, এরচেয়ে মানবিক দৃশ্য আর কী হতে পারে!

পুলিশ তাকে নিয়ে যায়। বিভিন্ন সময়ে আমাদেরকে যন্ত্রণার সাক্ষ্য দিতে আসে পাথর বাঁধা মাছ, ব্যাঙ আর সাপের যন্ত্রণাকাতর দৃশ্য। শাস্তিপর্ব্ব শেষ হলে সে আবার ফিরে আসে মন্দিরে। আসে শীত পর্ব্ব, বুড়ো মঙ্কের মৃত্যু ঘটে। এক যন্ত্রণা কাতর নারী আসে মন্দিরে। দুধের শিশুকে মন্দিরে সমর্পন করে পালিয়ে যাওয়ার সময় বরফ হয়ে যাওয়া হ্রদের মাঝে গর্তে পড়ে তার মৃত্যু হয়। শিশুর দায়িত্ব এসে পড়ে নতুন পুরোহীতের কাঁধে। এ যেন তারই অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটন। কারণ মুভির শুরুতে তাকে যে বয়সে দর্শকরা দেখতে পান সে বয়সে এ শিশুটি ঠিক তা-ই করছে যা সে করত। তাই বোধকরি মুভির নামে শীতের শেষে বসন্ত আবার ফিরে আসে।

মুভিটি আমার দেখা সেরা মুভিগুলোর তালিকায় উঠে গেলো। মুভির অনেক নান্দনিক দৃশ্যের বর্ণনা আমি সচেতন ভাবে এড়িয়ে গিয়েছি। কিছুটা থাকুক বাকি, দেখেই জানুন। নির্ম্মাতা প্রচুর মেটাফোর ব্যবহার করেছেন। তাঁর সৃষ্টিশীলতা অনবদ্য।

20200628_184729ফাহমিনা নূর
জন্ম: ১৯৭০, ঢাকা। শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ এম এস এস, লোক প্রশাসন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। পেশা: শিক্ষকতা, বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল। নিবাস: চট্টগ্রাম।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার