ঝিলমিল ঝিলমিল করে রে ময়ূরপঙ্খী নায় || রুবি বিনতে মনোয়ার

0

বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের এই গানটি কে না শুনেছে! আবহমান ভাটি বাংলার জীবনযাত্রা এই গানের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে।

একটি নৌকা— নদী বেয়ে চলে, সেই নৌকার শুরু থেকে শেষ পর্য্যন্ত যেন একটি জনপদেরই জীবনযাত্রার কাহিনী।

ছোটবেলা আমরা রচনা লেখেছি নৌকা ভ্রমণ। না বুঝেই লিখেছি, মুখস্ত লিখেছি। নৌকায় ভ্রমণ না করলে, খোলা হাওরের বাতাস না খেলে নৌকায় ভ্রমণের আনন্দ বোঝা যাবে না।

আমাদের গ্রামের বাড়ীতে বর্ষায় নৌকা তৈরি হত, নৌকা বানানোর মিস্ত্রি বাড়ী আসত, দিনকয়েক থাকত, আর নৌকা বানাত। লোহার সাথে হাতুড়ীর বাড়ি, সাথে গুণগুণ গান, সব মিলিয়ে দেখার মত বিষয়।

সব গাছের কাঠ দিয়ে নৌকা হয় না। শক্ত গাছের কাঠ লাগে। চামল, কাঠাল আরও কত নাম চাচা বলতেন, ভুলে গেছি। বড় গাছে কাঠের গুড়ি তোলা হত, রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে, তারপর কড়াত দিয়ে কাটা হত। কাঠের গুড়াগুলো সংগ্রহ করতাম কোঁচড় ভরে, কেন যে বকা খেয়েও করতাম! ওটাই তখন অমূল্য সম্পদ ছিল, কে কত বেশী গুড়া জমাতে পারে।

পাতলা করে চেরা হত কাঠ, তারপর বিশেষ ধরনের লোহা দিয়ে আটকে দিত একটার পর একটা।

ছিদ্রগুলো বন্ধের জন্য গাবগাছের কষ দেওয়া হত, আলকাতরা, তারপিন তেল, উফ্ কী গন্ধ! এখনও চোখ বন্ধ করে কল্পনায় নাকে পাই সেই মধুর ঘ্রাণ।

এ তো গেল ছেলেবেলার কথা।

বড় হয়েও নৌকা বানানো দেখেছি। সেই স্কুল আর সংলগ্ন মসজিদের মাঠটি ছাড়া বর্ষায় ওই হাওরের গ্রামে আর কোনও উঁচু জায়গা ছিল না। বর্ষায় মিস্ত্রিরা তাই ওখানেই নৌকা বানাত। আমি অবাক চোখে ওদের কাজগুলো গিলতাম, কী যে ভাল লাগত।

অনেক ধরনের নৌকা চলে, আগে বেশী চলত, এখন কম। আগে মানুষ বৈঠা লগি দিয়ে বাইত, এখন ইঞ্জিন দিয়ে চালায়।

নৌকা বাওয়া শিখেছিলাম, দাঁড় টানা, বৈঠা বাওয়া, লগি দিয়ে নৌকা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। নৌকা নিয়ে অনেক কবিতা হয়েছে, সাহিত্য হয়েছে, গান হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে নৌকার অবদান অনস্বীকার্য্য। যেমন বাহারী নাম ছিল, নৌকা ছিলও তেমনি বাহারী। নৌকার নামকরণে আবহমান বাংলার প্রকৃতি ও মানুষের জীবনাচরণ বিশেষ প্রভাব ফেলেছে।

এখন দেখে নিই নৌকা কত ধরনের ছিল—

ভেলা:
ভল্ল ক্রিয়ামূল থেকে জাত শব্দ ভেলা। ভেলা = দিশাগ্রস্ত ভ (প্রকাশিত যে) এর লালন-লয়নের আধার যে। বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ যাকে বলেছেন ভল্লা, যার মাধ্যমে ভ-এর লালন লালিত বা সুরক্ষিত থাকে।

কয়েকটি বাঁশ একত্র করে কিংবা কলাগাছের কাটা টুকরো জড়ো করে ভেলা তৈরি হয়। ভেলা দিয়ে হাওরের মানুষ কমদূরত্ব জায়গায় যাতায়াত করে। ছোটবেলা দেখতাম মেয়েরা কলস নিয়ে হাওরে অনেক দূর গিয়ে খাবার পানি সংগ্রহ করত। তখন পানির কল বা টিউবওয়েল ছিল না। কেউ ভেলা দিয়ে মাছ শিকারে যেত। সাঁতার শিখতেও ভেলা ব্যবহার হত।

সংসার নামক সমুদ্র আমরা জীবন নামক ভেলা দিয়ে পার হই। রবিঠাকুরের ভাষায়—

“এই দেহটির ভেলা নিয়ে দিয়েছি সাঁতার গো
এই দু-দিনের নদী হব পার-গো।”

ডিঙ্গী:
ডং ক্রিয়ামূল থেকে জাত শব্দ ডিঙ্গ, ডিঙ্গি। ডিঙ্গ = গতিশীল ডয়নীর রহস্যরূপ গমন করে যাহাতে, অথবা উড়িয়া গমন থাকে যাহাতে। ডিঙ্গি = ডিঙ্গ গতিশীল যাহাতে, ডিঙ্গি এর আধার ডিঙ্গী। ডিঙ্গী এক ধরনের ছোট নৌকা, যা ঢেউকে ডিঙ্গিয়ে ডিঙ্গিয়ে যায়।

এই নৌকাটি একদম হালকা পাতলা তন্বী মেয়ের মত। যখন হাওরাঞ্চলে খাল বিল ভরে যায়, এ বাড়ী থেকে ও বাড়ী কিংবা হাটে যাওয়া দায় হয়, তখন এই নৌকায় করে যাতায়াত হয়। ভারী কিছু বহন করা যায় না। গ্রামের ছেলে বুড়ো এমনকি মেয়েছেলেরাও অনায়াসে এই নৌকা বাইতে পারে। বড়শী দিয়ে মাছ ধরা, গেরস্থালী কাজে ও যাতায়াতে এটি আজও জনপ্রিয় বাহন।

রবিঠাকুরের কবিতায় আমরা তারই প্রতিচ্ছবি দেখি যখন শিশুটি বলে—

“আমার যেতে ইচ্ছে করে নদীটির ওই পারে, যেথায় ধারে ধারে
বাঁশের খোঁটায় ডিঙ্গী নৌকা বাঁধা সারে সারে।’

পিনিশ:
পিনিশ শব্দটি আমরা পাই এন্ড্রু কিশোর এর বিখ্যাত “হায়রে মানুষ রঙীন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস” এই গানটিতে।
এই গানে এরকম কথা আছে—

“পূর্ণিমাতে ভাইসা গেছে নীল দরিয়া
সোনার পিনিশ বানাইছিলা যতন করিয়া
চেলচেলাইয়া চলে পিনিশ, ডুইবা গেলেই ভুস!”

এটাও ডিঙ্গীর মত ছোট নৌকা, ডিঙ্গীর মতই এর ব্যবহার।

ডোঙা:
তালগাছ যেখানে সহজলভ্য সেখানে তালগাছের কাণ্ড দিয়ে ডোঙা বানানো হয়। ডোঙা, ভেলা এসব যান সাবধানে ব্যবহার না করলে সমস্যা হতে পারে উল্টে গিয়ে।

কোষা:
আগের দিনে রণতরীকে কোষা বলা হত। এখন চরাঞ্চল বা বিল এলাকায় কোষা নৌকা বেশী চলে। ডিঙ্গীর চেয়ে একটু বড়, কিন্তু এটিতেও বেশি লোক একসাথে ধরে না। পারিবারিক কাজে ব্যবহার হয়, এতে ছই থাকে না।

ঘাসী:
কোষার চেয়ে বড় আকারের নৌকা যা আকারে বড় ও ভারী। মাল বহনে ব্যবহার হয়।

সাম্পান:
সাম অর্থ তিন, পান অর্থ কাঠের টুকরা। বিশেষ আকৃতির এ নৌকা অগভীর সমুদ্রে চলে উত্তাল ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। এ নৌকার সামনের দিক উঁচু ও বাকানো এবং পিছনের দিকটা বাঁকানো থাকে। চট্রগ্রাম ও কুতুবদিয়ায় এ নৌকা দেখা যায়, আগে বড় বড় আকারের সাম্পান দেখা যেত। লোকসাহিত্য ও গানে সাম্পানের কথা উল্লেখ আছে। শেফালী ঘোষ এর সেই বিখ্যাত গান—

“ওরে সাম্পানওলা তুই আমারে করলি দিওয়ানা” এর কথা একসময় লোকের মুখে মুখে ফিরত, এখনও।

গয়না:
গুহ্ ক্রিয়ামূল থেকে জাত। গহনা থেকে গয়না। গুহ্ এর হ মূলতঃ ভ। এটি গভীরতা গহীনতা, অগাধ বোঝায়। হয়ত গভীর জলে চলত বলেই এরকম নাম করণ নৌকার।

না, গায়ে দেওয়ার গয়না নয়। গয়না নামে এক প্রকার নৌকা ছিল হাওরাঞ্চলে, যা এখন বিলুপ্ত। গয়না নৌকায় একসাথে প্রচুর লোক ধরত, বর্ষায় এই নৌকা মানুষের যাতায়াতে ব্যবহৃত হত।

বজরা:
বজ্ ক্রিয়ামূল থেকে জাত শব্দ বজ্র, √বজ্ + র, বজ্র > বজর, বাহীর জনন রহে যাহাতে। আকাশে বজ্রপাত হয়, বজ্রকে সাধারণ ভাষায় বাজ বলে। বাজের সময়ও নৌকা চলে, হয়ত শখ করেই এই নাম।

এটি ধনী ও অভিজাত শ্রেণীর লোকজনের বাহন ছিল। তারা শখ করে বজরায় চরে নৌকা ভ্রমণ করতেন, নৌকায় বাড়িঘরের মত সুযোগ সুবিধা ছিল। দিনের পর দিন বজরায় করে তারা প্রমোদভ্রমণ করতেন।

বাইচের নৌকা:
দেড়শ থেকে দুইশ ফুট পর্য্যন্ত লম্বা এ নৌকা ‘নৌকা-বাইচ’ প্রতিযোগিতার জন্য তৈরি হয়। পাঁচশতের মত মানুষ এতে ধরে। গ্রামাঞ্চলে নৌকাবাইচ এখনও জনপ্রিয় খেলা। বাইচের নৌকার সুন্দর সুন্দর নাম থাকে।

বাইচের গান আছে—

“ঝিলমিল ঝিলমিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নাও।”

বাতনাই/পদি:
বাত শব্দের অর্থ বাতাস, গতি। বা (গতি) + ত (তারিত)। বা ক্রিয়ামূল থেকে জাত বাত। বাতলা অর্থ নির্দ্দেশ দেওয়া। নামকরণের পিছনে এরকম কিছু হতে পারে যে যা বাতাসের গতিকে নির্দ্দেশ দিচ্ছে, বা নিয়ন্ত্রণ করছে।

এটি মালবাহী বজরা। বিরাটাকৃতির এই বজরায় ১৭ থেকে ১৮ জন মাঝী লাগত। এই নৌকা এখন দেখা যায় না।

ময়ূরপঙ্খী:
রাজা বাদশাহদের আমলের শৌখিন নৌকা। সামনের দিকটা ছিল ময়ূরের মত। বিলাসবহুল এ নৌকা আর নেই। গানে আছে—

“আমি ময়ুর পঙ্খী নাও ভিড়িয়ে,
তোমায় দেখেছি,
আর প্রবাল দীপের পান্না ভেবে,
চেয়ে থেকেছি..।”

বালার:
বালাম নামে চালবাহী নৌকা ছিল, যার মাধ্যমে অভিজাতদের জন্য দূর দূরান্তে চিকন চাল সরবরাহ করা হত। হয়ত এ কারণেই নাম ছিল বালাম, যা পরে বালার হয়েছে। পরবর্ত্তীতে এটি মালবাহী নৌকা হিসেবে পরিচিত হয়েছিল।

পানসী:
ভাটিয়ালি, মুর্শিদী আর মারফতি গানসহ লোকগানের সুরে সুরে মাঝিরা এই নৌকা বেয়ে যেত। দূরাঞ্চলে যাওয়ার একমাত্র বাহন ছিল ছইওলা এই নৌকা। নৌকায় থাকত পাল, অনুকূল বাতাস না থাকলে গুণ। টেনে বয়ে নিয়ে যাওয়া হত। পানসী নৌকাও এখন আর দেখা যায় না। গানের কথা—

“তুমি বেশ বদলে গেছো— পুরনো সৈকতে আর পানসী ভিড়াও না,
জানি না কোন সাগরের ঝিনুক থেকে
একটুবারও পলক ফেরাও না।”

পাতাম:
যুগল নৌকা। দুটি নৌকাকে পাশাপাশি ‘পাতাম’ নামক লোহার কাঠাটা দিয়ে যুক্ত করে এ নৌকা তৈরি হত। এটি মাল পরিবহনে ব্যবহার হত। ছোটবেলা অনেক পাতাম নৌকা দেখেছি, এখন আর এই নৌকা দেখা যায় না। হাওরাঞ্চলের নৌকা ছিল এই জোড়া নৌকা। পাতাম হল নৌকা তৈরীর তক্তা জুড়িবার পাতলোহার পেরেক।

শ্যালো :
নব্বই দশক থেকে এই নৌকার শুরু। শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে চালানো হয়। দ্রুতগামী এ বাহনই এখন বেশী দেখা যায় নৌ-পথে।

আজকের দিনে বর্ষায় স্বল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়, অকালবন্যা হয়ে বাড়িঘর ডুবে যায়। খালবিল এমনকি সব ভরাট হয়ে গেছে। অথচ একসময় এই দেশটিকে বলা হত নদীমেখলা। নদী খাল বিছিয়ে ছিল, সেই নদী খাল বিল জুড়ে চলত নানা ধরণের নৌকা। এতে পরিবেশদূষণ হত না। খাল দিয়ে নদীতে নদীতে যোগাযোগ হত, নৌকা চলত জলের বুক চিড়ে।

শহরাঞ্চলে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলেও অনেক খাল ভরাট হয়ে গেছে। সেজন্যই বৃষ্টির পানি নামতে পারে না, জমে থাকে। যদি এমন হত, শহরাঞ্চলের ভরাট করা খালগুলো উদ্ধার করে ওখানে যাতায়াতের জন্য নৌকা চলত, সড়কপথে চলত গাড়ী, বৃষ্টির পানি চলে যেত খাল দিয়ে, জলাবদ্ধতা হত না, তবে কেমন হত! আমার মনে হয় ভাল হত। সড়কপথে যে ভীড়, জনসমাগমের চাপ কমত, এটা নগরবাসীর জন্য ভিন্ন আমেজ এনে দিত। ইটপাথরের দেওয়ালে বন্দী নগরবাসী প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে পারত। সবচেয়ে বড়কথা এটা পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাত। হারিয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধার করে সে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।

নদী মাতৃক এদেশে যতদিন নৌকাগুলো ছিল যাতায়াত ও মাল পরিবহনের মাধ্যম ততদিন পরিবেশদূষণ ছিল না। নৌকা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, সেই সাথে বিলুপ্ত হচ্ছে জীবনাচার। জনপদ হারাতে বসেছে তার পরিচিত ঐতিহ্য।

এখন আর নৌকা বেয়ে বেয়ে কেউ গায় না “নাইয়ারে নায়ের বাদাম তুইলা, কোন্ দূরে যাও চইলা” বা এর মত প্রাণকাড়া সুরের, কথার অনেক গান।

তথ্যসূত্র:
উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া, আন্তর্জ্জাল/ইন্টারনেট, বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ।

72469444_102263624522598_5389132054564700160_nরুবি বিনতে মনোয়ার
জন্ম সিলেট শহরে, ১৯৬৭সালে।
বেড়ে ওঠা ও পড়াশোনা বলতে গেলে সারাদেশ জুড়ে,
কারণ বাবার সরকারি চাকুরী।
লেখালেখি নেশার মত, প্রিয় বিষয় ব্যাকরণ।
এ পর্য্যন্ত যে বইগুলো প্রকাশ হয়েছে—
নীল প্রজাপতি ও খসে যাওয়া তারা (কাব্যগ্রন্থ), নীলগিরি যাবো আমি (কাব্যগ্রন্থ),
বর্ণের ফসলি চাদর (কাব্যগ্রন্থ), একজন মুনিয়ার চলে যাওয়া (গল্পগ্রন্থ) ও মৃদঙ্গ নামের মেয়েটি (উপন্যাস)।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার