ঝাড়ুউউউ… ঝাআআড়ুউউউ… লেইইইস ফিতাআআআ…
কী ভাবছেন? লেইসফিতাওয়ালা আর ঝাড়ুওয়ালা যাচ্ছে? না, কেউ কোথাও যাচ্ছে না। রাস্তা ফাঁকা। ঐ হাঁক মিমিক্রি করে শোনাচ্ছে কিঙ্করী। কিঙ্করী কথা বলা ময়না পাখী। সেটা আশির দশকের শুরু। পায়ের আঙ্গুল দিয়ে দোলনার শিক পেঁচিয়ে কিঙ্করী দুলে দুলে নিজেকেও ডাকে, “কিঙ্করী ও কিঙ্করী, ও আমার ময়না পাখী।” “ময়নাআআআ ময়য়নাহ্ ময়না” এমনি নানান সুরে। কিঙ্করী যখন ডাকছে, তার মানে লেইসফিতাওয়ালা আর ঝাড়ু ফেরি করা বিক্রেতারা আছে। মানে সে সময় ছিল। আরো ছিল চুড়িওয়ালা, হাওয়াই মিঠাওয়ালা, শন্পাপড়িওয়ালা, নেমকসলমানী আর হাঁড়িপাতিলওয়ালা। ঝাড়ুওয়ালা আর লেইসফিতাওয়ালাকে ডাকতে ডাকতে ক্লান্ত হয়ে গেলে বৈচিত্রের খোঁজে এদেরও পালা করে ডাকতে শুরু করে কিঙ্করী। কিঙ্করীর প্রিয় খাবার বাটা মরিচ মাখানো ভাত। মাঝে বড় অসময়ে, মানে মাত্র খেয়ে উঠেই বা সামনে বাটি ভর্ত্তি ভাত রেখেই গীত গেয়ে ওঠে, “ভাত দাও গো, ভাত, মরিচ মাখা ভাত।” “ভাত খাবো গো ভাত।” কিঙ্করীর আরেকটা প্রিয় উচ্চারণ “দোলন”। দোলন এ বাড়ীর ছোট ছেলে, বয়স দু’বছর এগারো মাস। দোলনকে কিঙ্করী খুব ভালবাসে। তাই দোলনের সারাদিনের কর্ম্মকাণ্ডের একটা রানিং কমেন্ট্রি সে থেকে থেকে দিতে থাকে। দোলনের খাওয়া, ঘুম, গোসল, খেলা কিছুই তার বৃত্তান্ত থেকে বাদ যায় না। তবে তার টাইমিং ঠিক থাকে না। এই যেমন এখন সে সবাইকে, বিশেষ করে বাড়ীর একটু বড় বাচ্চাদের শাসিয়ে বলছে, “দোলন ঘুমাচ্ছে, তোমরা গোলমাল করো না।” “দূরে গিয়ে খেল।” এ’দুটো বাক্য সে টিভির স্ক্রলের মত বার বার আউড়ে যাচ্ছে। অথচ বাস্তবতা হল দোলন এ মুহুর্ত্তে বাড়ী নেই। নেই মানে নেই। কোথাও নেই, তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিন বছরের একটা বাচ্চা বাড়ী থেকে জাস্ট উধাও হয়ে গেল। হন্যে হয়ে তাকে সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছে। ঘরের এই অস্বাভাবিক অবস্থায় কিঙ্করীকে ভাত খেতে দেয়ার কথা সবাই ভুলে গেল। তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বলেই যাচ্ছে “দোলন ঘুমাচ্ছে, তোমরা গোলমাল কর না, দূরে গিয়ে খেল।”
গল্পের এ পর্য্যায়ে আপনারা চাইলে কিঙ্করীকে ময়নার পরিবর্ত্তে এ বাড়ীর একমাত্র কন্যাশিশু হিসেবেও ভেবে নিতে পারেন, যার বয়স সাত। খাঁচার পরিবর্ত্তে ভেবে নিতে পারেন তার হুইলচেয়ারটিকে। অটিস্টিক এ বাচ্চাটির প্রিয় খাবার বলে কিছু নেই।
কিঙ্করী ও দোলনের মায়ের অবস্থা উদভ্রান্তের মত। সকাল বেলা দোলন বারান্দাতেই খেলছিল। কখন নাই হয়ে গেল! ইদানিং বাচ্চাটার একটা নতুন অভ্যাস বা আচরণ দেখা দিয়েছিল। মনেই হচ্ছিল এই আচরণ একদিন বিপদ বয়ে আনবে। নিশ্চই তাই হয়েছে। ফকির (পড়ুন ভিক্ষুক) দেখলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। যেন খুব আপন কারো দেখা পেয়েছে। ঝাঁপিয়ে প্রায় কোলেই উঠে বসতে চায়। কতবার যে এ অবস্থায় একরকম ছোঁ মেরেই ফকিরের কাছ থেকে ওকে সরিয়ে আনতে হয়েছে! একবার হল কি, ভিখিরী ভাত খেতে চাইল। ঘরে ছিল ভাত আর কিছু বাসিতরকারী। আমেনার মা তাকে খেতে দিয়ে ভেতরে চলে গেল। তারে শুকাতে দেয়া কাপড় নেড়ে দিতে এসে দেখে সেই অবাক কাণ্ড। ফকিরের সাথে বসে একপাতে দিব্যি ভাত খাচ্ছেন দোলন বাবু। এমনিতে তাকে খাওয়ানো এক মহাযজ্ঞ। পাতের ভাত ঠাণ্ডা হিম হয়ে গেলেও গালের ভাত নড়ে না। কিন্তু ফকিরদের সাথে যে তার এক্সট্রা খাতির! তারই মাশুল দিল কি না কে জানে! নিশ্চই কেউ বগলদাবা করে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এই কেউ কি দেখেছো কোনো ফকির এসেছিল কি, বাড়ীতে? কেউ দেখেছ? জনে জনে যখন জিজ্ঞেস করা হচ্ছিল তখন খাঁচার কিঙ্করী বলে ওঠে, “ভাত দাও গো, ভাত, মরিচ মাখা ভাত।” হুইল চেয়ারে বসা কিঙ্করীও সুর মিলিয়ে বলে, “ভাত খাবো, ভাত”। ঐ শুনে বাড়ীর কারো সন্দেহ থাকে না যে বাড়ীতে সকালবেলা নিশ্চিত কোন ফকির এসে ভাত চেয়েছিল। তবু কারো মনে হয় না ক্ষুধার্থ পাখীটাকে দুটো মরিচমাখাভাত দেবার কথা। তাদের এ-ও মনে আসে না হুইল চেয়ারে বসা কিঙ্করী অথবা বলা যায় এ বাড়ীর একমাত্র রাজকুমারীটি সকাল থেকে কিছু খায়নি।
থানা পুলিশ, মাইকিং এদিক ওদিক ছোটাছুটি সবই যখন চলছে তখন দোলন সত্যিই ঘুমিয়ে আছে একটা টিনের ঘরের বিছানায়। একপাশ হয়ে শুয়ে আছে আলতো করে বুকরে কাছে থাকা একটা ছোট্ট বালিশে হাত রেখে। পরম নিশ্চিন্তের, প্রশান্তির এক ঘুম। বিছানার পাশে এ বাড়ীর একমাত্র বিলাসী দ্রব্য একটা ব্যাটারী চালিত পাখার তিন ডানা ঘুরছে ঘুমপাড়ানি গান গাইতে গাইতে। তাকে গোসল দেয়া হয়েছে, গোসলের পর চুল আঁচড়ে একপাশে সিঁথি আঁকা হয়েছে। কপালের একপাশে কাজল দিয়ে গোল টিপও আঁকা হয়েছে। এ এক অন্যরকম দেখতে দোলন, যেন সে এ বাড়ীরই দোলন। ভাত খাওয়ানোর সময় লক্ষী বাবুটার মত হয়েছিল, এতটুকু জ্বালায়নি। যেন যে বাড়ীতে সে জন্মেছিল সে বাড়ীটা তার নয়। যেন যে মায়ের সে জঠরজাত তার বাইরে অন্য কোনো জীবনে অন্য এক মায়ের কাছে তার ফিরে আসা। যেন কোন্ দূর অনন্তে এ মায়ের সাথে তার অদৃশ্যমান নাড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল সে। আজ সে নাড়ি ধরে টান মেরে অদৃশ্য কোন শক্তি তাকে টেনে এনেছে এখানে।
খাঁচার কিঙ্করী অস্থির হয়ে উঠেছে, তার ভাতের বাটী খালি। গতকালের ময়লা আজ এ বেলাতেও সাফ করা হয়নি। খিদে পেয়েছে খুব, তাই সে দুলে দুলে গায়, “দোল দোল দুলুনি, দোলনের মাথায় চিরুনি।” লজিকের অভাব আছে। পাখিমস্তিষ্কে লজিকের অভাব তাই পেটের খিদের সাথে গানের সাদৃশ্য টানা যাচ্ছে না। গতকালে বাসিভাতের কিছু খাঁচার ভেতর বাটির বাইরে বিষ্ঠায় মাখামাখি হয়ে আছে। খিদের জ্বালায় ওতে দু’চারটা ঠোকর দেয়া সারা। তবে পোষাল না। খেতে ভাল না, সে বিষ্ঠার কারণে না টকে যাওয়া ভাতের কারণে সে-ও বোঝা গেল না। আনন্দে বা বেদনায় নয়, এক অর্থহীন অভ্যাসের দাসত্বে পাখী তবু গায়— ‘দোল দোল দুলুনি…’।
হুইল চেয়ারে বসা কিঙ্করীর অবশ্য খিদের তীব্র সমস্যা নেই। বেলা একটার দিকে আমেনার মা তার মুখে কিছু গুঁজে দিয়ে গিয়েছে। মা হলে সত্যিই খাইয়ে দিত। খাওয়ার সময় মা অনেক কথা বলে। রূপকথার গল্প বলে, খাঁচার পাখী ছেড়ে বনের পাখীর কথা বলে। আরো কী কী সব গল্প, কিঙ্করী বলতে গেলে তার কিছুই বোঝে না। তবু তার ভাল লাগে। গল্প বলার সময় মায়ের চোখ নড়ে, চোখ হাসে, চোখ কাঁদে। গলার স্বরটা তুলতুলে নরম আর রুমঝুম আওয়াজ তোলে। কিঙ্করীর এসব ভাল লাগে। ওর তখন শরীরের ভেতর কী যেন হয়, হুইল চেয়ার ছেড়ে ছুটতে ইচ্ছে করে। মায়ের গা ঘেঁষে সামনের ঐ বকুল তলায় দাঁড়াতে ইচ্ছে করে। খামচি দিয়ে রোদ ধরতে ইচ্ছে করে। সে তখন চামচ দিয়ে হুইল চেয়ারের হাতলে তুমুল পেটাতে থাকে। আনন্দে তার গা শিরশির করে। কিন্তু আজ সারাদিন মা একবারও তার কাছে এল না।
কিঙ্করীর অস্থির লাগে। আজ তাকে কেউ… সেই যে ভোরে একবার গেল এরপর একবারের জন্যও বাথরুমে নিয়ে যায়নি। দু’বার পিসু করে সারা। হুইল চেয়ার গড়িয়ে প্রস্রাবের ধারা ফ্লোরের উপর এঁকে বেঁকে সাপের মত চলতে থাকলে কিঙ্করী একটু ঝুঁকে তাকিয়ে থাকে ধারাটি না-থামা পর্য্যন্ত। যে কোন গতি তাকে আকর্ষণ করে তাই ঘরে কেউ না থাকলেও সে মাথার উপর ঘুরতে থাকা পাখার দিকে তাকিয়ে দিন পার করতে পারে। কিন্তু আজকের বিষয়টি ভিন্ন। কাপড় ভিজে এখন আধ শুকনো হয়ে গিয়েছে। বিশ্রি একটা গন্ধ বেরুচ্ছে। তার অস্বস্তি হচ্ছে, এখন বড় চাপ এসেছে। কী করবে বুঝতে না পেরে ‘মাম্ মাম্’ ডাকল কয়েকবার। কিন্তু মায়ের দেখা পেল না। এতক্ষণ শুধু আধভেজা কটা গন্ধের প্রস্রাবের ভেতর ছিল এখন হাগুতে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে। বার কয়েক শরীর মুচড়ে কিঙ্করী দুলে দুলে গাইতে শুরু করে… “দোল দোল দুলুনি দোলনের মাথার চিরুনি… দোল দোল…। “তার শব্দোচ্চারণ খাঁচার কিঙ্করীর চাইতে অস্পষ্ট। অনভ্যস্ত কান শব্দগুলো ধরতে পারবে না। আধ-খাওয়া আধা-খিদের যন্ত্রণা, পিপাসা কাতরতা, হাগুতে পিসুতে মাখামাখি কিঙ্করীর কন্ঠ নিঃসৃত অস্ফুট বেদনার সকরুণ রাগিনী ফ্যানের বাতাসে কামরার ভেতর খানিক ঘুরপাক খেয়ে একটা অভিসম্পাতের রূপ নিয়ে জানালা গলে বেরিয়ে গেল।
সকালে যখন খেলনাওয়ালা ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল তখন বাড়ীর গেইটটা খোলাই ছিল। বারান্দা থেকে নীচে নামতে দুটো সিঁড়ির ধাপ মাত্র, সে দোলন অনায়াসে পাড়ি দিতে জানে। তারপর পনের কদম হাঁটলেই গেইট, সে তো খোলাই আছে। দোলন যখন গেইট পেরিয়ে রাস্তায় পা রাখল সেই আশঙ্কাময় দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে থাকল দুই কিঙ্করী। জানালা দিয়ে দৃশ্যটি দেখতে দেখতে দোলনের সাত বছর বয়সী আপুটা ঠোঁট গোল করে তার ভেতর দিয়ে থুতুর বাবলস বের করছিল। সাত মাস বয়সে দোলন যা করতো। এ এক মজার খেলা শঙ্কাবিহীন। আর খাঁচার কিঙ্করী বলেছিল, “দোলন ঘুমাচ্ছে, তোমরা গোলমাল কর না।”
রাস্তায় নেমে দোলন গুটিগুটি পায়ে এগুতে থাকে। ঐ যে দূরে ডুগডুগিওয়ালা ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে হাঁটছে। তার হাতে লম্বা বাঁশের সাথে থরে থরে তাকে সাজানো প্লাস্টিকের বাঘ, সিংহ, রাজহাঁস, এ্যারোপ্লেইন, ও মা! বেলুনও আছে! কিন্তু ও’দিকে দোলনের নজর বেশিক্ষণ আটকে থাকে না। নব নব আবিষ্কারে উন্মত্ত, চঞ্চল দোলনের দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে দুটো ছাগল। তাদের কানগুলো অনেক বড় আর কলাপাতার মত ঝুলে আছে। তার পেছনে ছড়ী হাতে চলছে বছর দশেকের এক বালক। দোলনের ঘোর কাটে না। আজ একদিনেই এত এত বিস্ময় জমা পড়ছে চোখের ব্যাংকে! এই তো ইট বিছানো রাস্তার পাশেই ডানদিকে একটু খানি ফাঁকা মাঠ পেয়ে তাতে মার্বেল খেলছে কিছু ছেলে। দোলন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে এক খুদে জীবনানন্দ কে বুকের ভেতর আগলে ধরে। তার চোখের পলক পড়ে না। ততক্ষণে ডুগডুগিওয়ালা দৃষ্টিসীমানার বাইরে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে দূর দূরান্তে। দোলনেরও মনে নেই কেন বা কী দেখতে সে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েছিল। এবার নজর টানল উল্টো হয়ে ঝুলে থাকা একজোড়া মুরগী। ঠোঁটগুলো হা হয়ে আছে। তাদের ধরে আছে যে হাত তার মালিকের অন্যহাতে আছে একটা বাজারের ব্যাগ। মুরগী দেখা শেষ না হতেই পাশ দিয়ে সাঁই করে চলে গেল একটি বাইসাইকেল। সাইকেলটা কোথায় যাচ্ছে সেটাওতো দেখা দরকার। সাইকেল দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে, দোলনের ছোট ছোট পা দুটো আরো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। এইতো আরেকটু সামনে একটা ছোট ঢাল বেয়ে নামলেই মেইন রোড।
বেলা গড়িয়ে ঘড়িতে চারটার ঘন্টা বাজলে দোলনের শোকে মৃতপ্রায় মায়ের বুকের ভেতর দামামা বাজিয়ে জেগে ওঠে কিঙ্করীর মা। কলিজা মুচড়ে অন্তরে একটা প্রশ্ন উত্থিত হয়, ‘বাচ্চাটা কী করছে?’ সারাদিন দেখা নাই, খবর নেয়া হয়নি। মনে হতেই তার কামরায় ছুটে যায়। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই বিশ্রি গন্ধটা নাকে ঠেকল। তাকে ছাপিয়ে আতঙ্ক ভর করে চোখে, মাথায় এবং অন্তরে, হুইল চেয়ারে নেতিয়ে পড়া ছোট্ট শরীরটা দেখতে পেয়ে। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরতেই কন্যা মুখ তুলে চাইল, তন্দ্রায় ছিল, সেটা কেটে গিয়েছে। তন্দ্রায় প্রাথমিক রেশ কেটে উঠতেই কী তীব্র অভিমান আর অভিযোগের মিশ্রণ ফুটে উঠল ঐ অবোধ চোখে। কী তীব্র সে জিজ্ঞাসা মায়ের কাছে! অবোধ আত্মবেদনের মত সুতীব্র যন্ত্রণা আর কী থাকতে পারে! ওর চোখের দৃষ্টির সামনে ভেঙে খানখান হয়ে যেতে থাকে শবনম, কিঙ্করী আর দোলনের মা। বাচ্চাটাকে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে ওঠে সে। দু’হাতের তালুত মুখটা তুলে চুমুতে ভরিয়ে দিতে দিতে কেবল বলতে থাকে, “মা-রে, মাফ করে দিস মাকে, দোলনের চিন্তায় পাগল হয়ে গিয়েছি, তোর খোঁজ নিতে পারি নাই।” বাচ্চা কি বুঝল কে জানে। “আঁ আঁ আঁঙগ” গোঙানির সাথে সাথে তারও যে চোখের দু’পাশ দিয়ে জলধারা নেমে এল সুতীব্র ভাষার অনুবাদ হয়ে। বাচ্চার মাথা বুকের সাথে চেপে ধরে আমেনার মাকে ডাক দেয়ার সাথে সাথে এসে হাজির হল। বাচ্চাটাকে যে অবহেলা করা হল তার কারণে বকুনি দেবার সময় এটা নয়।
কিঙ্করীকে গোসল করিয়ে নিজেও সেটা করে অনেক আদর করে খাইয়ে বুকের কাছে নিয়ে বিছানায় এলিয়ে ছিল যখন, তখন আরেক প্রস্থ হাহাকারে বালিশ ভিজিয়ে দিল দোলনের মা। আকাশে চতুর্দশী চাঁদ, জানালায় বকুলের গন্ধ, শবনমের চোখে জলোচ্ছ্বাস, অন্তরে সিডরের ধ্বংসযজ্ঞ। বুকের কাছে কিঙ্করীর জন্য মমতা আর ভেতরে দোলনের শূণ্যতা শবনমকে একবার মর্ত্যে আরেকবার পাতালে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছিল, তাতে চূর্ণ বিচূর্ণ হতে হতে শবনম যখন গভীর অবসাদে তলিয়ে যাচ্ছে তখনই সুখবরটা এল। দোলনের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। দোতলার বাসিন্দা দোলনের চাচ্চুই খোঁজটা পেলেন। সেটা সেলফোনের যুগ নয়, ল্যান্ডফোনেই খবরটা জানাল দোলনের বাবা। বাবা আর চাচা যাচ্ছেন দোলনকে আনতে। শবনম ঘরে থাকে কি করে! তারও তো ছুটে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু কোথায় যাবে! টেলিফোনে লাইনটা খুব তাড়াহুড়ো করে কেটে দিল যে সে!
মেইনরোডে নেমেও বেশ কিছুক্ষণ উৎসাহ উদ্দীপনায় ভাটা পড়েনি দোলনের। এত এত দোকান, এত এত গাড়ি সব কেমন হতবিহ্বল করে তুলছে ছোট্ট দোলনকে। পৃথিবীতে এত কিছু দেখার আছে! দেখে দেখে আশ মেটে না। কিন্তু চলতে বেশ অসুবিধেই হচ্ছে। ফুটপাতে চলতি মানুষজনের দিলে রহম নেই, প্রায় মাড়িয়েই দিচ্ছিল বলতে গেলে। সেই তুলনায় রাস্তাটাই ভাল। মানুষ কম, সেই বিচারে ছোট্ট দোলন রাস্তাতেই নেমে পড়ল। দু’কদম চলল বোধয় পেছন থেকে এক রিক্সা ধাক্কা দিতে দিতেই শেষ মুহুর্ত্তে সামলে নিল। রিক্সাওয়ালা সামলে নিল বটে কিন্তু খিস্তি খেউড় করতে ছাড়ল না। তার কন্ঠ নিঃসৃত অশ্রাব্য শব্দগুলোর মর্ম্মার্থ দোলন বোঝেনি। কিন্তু তাকে যে বকুনি দেয়া হচ্ছে এটুকু বুঝতে তো অসুবিধে হয়নি।
এই প্রথম সে উপলব্ধি করল এই জনারণ্যে সে একা এবং অরক্ষিত। একটা তীব্র ভয় আর অপমাননোধ একসাথে আক্রমণ করে বসল তার শিশু আত্মাকে। আক্রান্ত আত্মা পরিত্রাণ চাইল। চিৎকার সহকারে কান্না যুগযুগ ধরে শিশুদের জন্য উপায় হাজির করেছে এমন সঙ্কটকালে। দোলন ব্যতিক্রম নয়। চরাচর বিদীর্ণ করা সেই কান্নাই টেনে বের করে আনল রফিক সিদ্দিকীকে। তিনি স্থানীয় এক হোটেলের বাবুর্চী। সস্তার এ হোটেল নিম্ন মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের কর্ম্মজীবী মানুষের আহারস্থল। হোটেলে সকালের নাস্তার পর্ব্ব শেষ। দুপুরের রান্না শুরু হয়নি প্রস্তুতিপর্ব্বে কাটাকুটি চলছে। সেটা করার জন্য সাহায্যকারী আছে। তাই এ সময় তার কাজের চাপ কম। বেরিয়ে এসে দোলনকে কাছে টেনে নিল। নাম, বাবার নাম, বাসা কোথায় ইত্যাদি তদন্ত শেষে কেবল নামটাই জানা গেল। বুঝতে অসুবিধে হল না ভদ্রঘরের হারানো এ শিশুর ভবিষ্যত এখন অনেকটাই তার নিজের হাতে।
আন্তরিকভাবেই কিছুক্ষণ খোঁজ-খবর করল, ঘুরে ফিরে বাসা কোনদিকে জানতে চাইল, লাভ হল না। বাবার নাম জিজ্ঞেস করলে বলল ‘হাসান’। তো এ শহরে কত হাজারো ‘হাসান’ আছে! আশেপাশের দোকানগুলোতেও খোঁজ নিল, যদি কেউ চিনতে পারে এ আশায়। কেউ কোন সাহায্য করতে পারল না। এদিকে রান্নার জোগাড় হয়ে গিয়েছে এখন চুলো ঠেলতে হবে কিন্তু বাচ্চাটাকে কী করা যায়! ফেলে যেতে মন সায় দিচ্ছে না। তখনই মনে এল একে বাড়ী নিয়ে যাওয়ার কথা। নিজের বাচ্চাটাতো প্রায় এরকম বয়সীই ছিল। গত বছর ম্যালেরিয়ার জ্বরে চলে গেল। বউ বরং খুশি হবে, যেমন ভাবনা তেমন কাজ। এখান থেকে বাড়ী মিনিট পনেরোর পথ। বউয়ের কাছে বাচ্চাটাকে হাওয়ালা করে দিয়ে এসে কাজে লেগে গেল রফিক বাবুর্চী। সারাদিন কাজের চাপে কিছু ভাবার অবকাশ পায়নি। তবে তার হোটেলের সব কর্ম্মচারী জানল সে আজ একটা বাচ্চা কুড়িয়ে পেয়েছে। তাই রাত প্রায় আটটা নাগাদ যখন ম্যানেজারের ডাক পড়ল তখন অনুমানও করতে পারেনি কারণ কী হতে পারে। হোটেলে তখন পুলিশ এসেছে বাচ্চাটার ছবি হাতে। রফিক কিছুই লুকায়নি। লুকোনোর কারণ ছিল না। তার হিসেব মতে সে কোন অন্যায় করেনি। যদিও পুলিশ বলছে বাচ্চাকে থানায় না নিয়ে বাড়ী নিয়ে যাওয়াটা অন্যায় হয়েছে। যাহোক বাচ্চার বাবার কারণেই পুলিশ বেশি হেনস্তা করল না। তা না হলে পুলিশের করাল থাবা থেকে কে কবে সহজে মুক্তি পেয়েছে! না বউটা ঝামেলা করেনি, করবেই বা কেন, বাচ্চা তার পরিবারের কাছে ফিরে যাবে এর চেয়ে আনন্দের বিষয় আর কী হতে পারে! সারাদিন যে বাচ্চাটাকে নিয়ে অন্যরকম একটা দিন গেল সে বরং উপরিপাওনা। হাসিমুখেই বাচ্চা হস্তান্তর হল। রফিক আরেকটু মনোযোগী হলে হয়ত বউয়ের ঠোঁটের হাসি আর শুকনো চোখের পেছেনে অতল গর্তটা দেখতে পেত।
দোলন ফিরলে ঘরে আনন্দের বান ডেকে যায়। ‘কি একটা দিন গেল!’ এমন একটা মন্তব্য প্রায় সবার মুখে মুখে ফেরে। সবাইকে হয়রান করা শেষে দোলনের মুখে রাজ্য জয়ের হাসি। সব খেলা সারা হলে বাড়ীর বাতিগুলো নিভে যায়, যে যার মত ঘুমিয়ে পড়ে। এমন কি খাঁচার ভেতর একটা কথা বলা ময়না পাখীর কথা বন্ধ হয়ে যায়। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল অনেকক্ষণ ধরে, পরে নিস্তেজ হতে থাকল। দুটো ঝাঁকি খেয়ে এখন চিরকালের মত থেমে গেছে। এ কেমন অভিমান! একদিন দানাপানি না পড়লে কি মরে যেতে হয়! পাখীদের কি অতর্কিতে হার্ট অ্যাটাক হয়? পাখীর হত্যাকারী কে ক্ষুধা-তেষ্টা না অবহেলা? এমন সব প্রশ্নে জর্জ্জরিত রাত্রি পালিয়ে গেলে সকাল হয়। বারান্দার গাছে পানি দিতে এসে আমেনার মায়ের চোখ সারি ধরে ছুটে চলা পিঁপড়ের ব্যস্ততা অনুসরণের মাধ্যমে আবিষ্কার করে খাঁচার ভেতর শক্ত হয়ে যাওয়া কিঙ্করীকে।
ফাহমিনা নূর
জন্ম: ১৯৭০, ঢাকা। শিক্ষা: এম এস এস, লোক প্রশাসন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
পেশা: শিক্ষকতা, বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল। নিবাস: চট্টগ্রাম।