ফাল্গুনী শূন্যতা
পলাশের দিন শেষ হয়, আর দেখি এক শূন্য গগন শিরীষ আঙুলগুলো বাড়িয়ে রাখে আকাশের গায়! অমন অজস্র শূন্য আঙুল নিয়ে মানুষেরাও বসে থাকে, তাদের মাথার ওপর শুকনো পাতার ঝড়। এইসব দিনে আমার ক্রমাগত একা হতে থাকা পা জড়িয়ে যায় ঝরা পাতার বাতাসে। সোনালী, গাঢ় সোনালী, খয়েরী রঙের পাতারা পায়ের সাথে গড়িয়ে চলে কিছুদূর। রোদের গন্ধে নেশা হবার দিনগুলোতে এই মর্ম্মরকে আমরা পৃথিবীর অসমাপ্ত কবিতাদের কান্না বলে জানতাম। আমরা মানে আসলে আমি আর অসংলগ্ন কিছু ছায়া কিংবা হারানো বৃক্ষের স্মৃতি! খুব বড় কোন দুঃখ নেই যেদিন থেকে জেনেছি স্থায়ীত্ব একটা ছেলেভুলানো শব্দ। পৃথিবীতে কোন কিছু টিকে থাকে না, না বন্ধগেটের কড়ই গাছ, না মানুষের সাথে বাঁধা সুতা। কেবলই এক মহাসমুদ্রের স্রোত বয়ে চলেছে, শুকিয়ে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে তারপর কোথাও আবার জন্ম নেবে বলে।
পূর্ব্বাপর জন্মকথা
বাঁধভাঙা বৃষ্টি হচ্ছে এবার। বড় বাঁকাচোরা আকাশ থেকে ছুটে আসছে অজস্র আদিম আদিবাসী তীর, শূলবেদনায় নেচে নেচে উঠছে পৃথিবীর আপামর কংক্রিটের দেয়াল। আমাদের রক্তে যে প্রাচীন মানুষদের গুহাচিত্র আঁকা আছে দুর্ব্বোধ্য সুরেলা বর্ণমালায়, তার ডাকে আজও বৃষ্টি হলে কেশবতী নদী হাত বাড়ায় একমাত্র জানালা দিয়ে। মেপে নেয়, এই বর্ষার তীরের ধার, কতখানি ভাঙবে তার বন্দিশালা।
জলের বাণ সারারাত ধরে আছড়ে পড়তে থাকে। ধনুকের টঙ্কারের মত গর্জ্জে ওঠে আকাশ। নাগিনীর মত ঢেউ এসে শুয়ে থাকে নগরীর পথে পথে। আমরা হেঁটে যাব বলে বাস্তুসাপের বিষদাঁত জন্মাতে দিয়েছি, ছোবলে ছোবলে ক্ষতবিক্ষত হয় এখনকার রাজপথ। বহু পদ্মাবতীর মৃত্যু লাগে একটা পদ্মার।
নেশা কাটে না, আমাদের দ্রুতগামী মৃত্যুর নেশা কাটে না তবুও।
এতশত বাঁধ পেরিয়ে স্বর্গগত পূর্ব্বপুরুষ স্মৃতির মত নেমে আসে অবিরল পলিমাটি, পূর্ব্বনারীর চুলের মত মসৃণ, স্নিগ্ধ। আমার পা গেঁথে গেছিল সে কোন্ শৈশবে, তার বুকের নরম স্পর্শ এখনও আমার আঙুলের ফাঁকে আটকে আছে। এখনও আমার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে শব্দের ছাই লিখে গেছে সমুদ্র পেরোনোর পথ। সেইসব পথ বেয়ে আদিম বাস্তসাপের মত আমরা আজও পেঁচিয়ে ধরি আমাদের রাত্রির রূপ।
অকালস্মৃতি
এখানে সন্ধ্যা হলেই জড়ায়ে নিতে ইচ্ছা হয়।
সন্ধ্যা হলেই দুপুরের রোদ আর সবগুলা পথ ধূলামাখা পা আর রুক্ষ চুল নিয়ে কড়ই গাছের স্মৃতি হয়ে মাঝরাস্তায় হতবাক দাঁড়ায়ে থাকতে ইচ্ছা হয়।
কেমন জানি একটা বাতাস আসে, মাথার মধ্যে নদীর পাড়ের মত ভাইঙ্গা পড়ে। এত শব্দ! এত ব্যাপক শব্দে আমি কথার খেই হারাই ফেলি।
আমাকে কে জানি সরিষা ক্ষেতের স্বপ্ন দেখাইছিল
সরিষা ক্ষেত মনে পড়ে, তার নাম মনে পড়ে না
আমাকে কে জানি চাঁদনী আলোর গল্প শুনাইছিল
চাঁদনী আলো মনে পড়ে, গল্পটা মনে পড়ে না
আমাকে কতবার মরতে দিয়েছিল চোখ
মরণ থেকে গেছে কই চোখ তো মনে পড়ে না।
কত গল্পের নাম মনে পড়ে না!
কত নামের গল্প মনে পড়ে না!
এত মনে না পড়ার লাশ নিয়ে আমি কড়ই গাছ ছাড়া আর কার কাছে যাব?
আর কার বুকে হাত রেখে বলব আমার ভুলে যাওয়া ঘুমের কথা?
সন্ধ্যার অসুখ নিয়ে আমি আর কোন্ শেকড়ে বসবো?
জন্ম-মৃত্যু–বিষাদ
উড়ন্ত জলের দিকে তাকালে বুকের মাঝে অযথাই হাহাকার করে ওঠে। তখন আমি ধ্রুপদী সংগীত হয়ে ভেসে আসা দূরতম স্মৃতির মত অস্পষ্ট হতে চাই। একলা একটা সিঁড়ি পাতালঘর ছুঁলে দেখি ছায়া হতে চাওয়া মানুষেরা পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছে। আমি আজও দুহাত প্রসারিত এক আকাশমুখী বালককে ভালবাসি।
বহুকাল আগের এক মায়ানগরে এসব গল্প লেখা আছে। এক স্নিগ্ধ ছায়ার কাছে একটি ফুরিয়ে যাওয়া ঘড়ীর মত সত্ত্বাটি কখনও বিকেলবেলা হয়ে ভর করে। ওখানে গোপন থাকে একটি অসমাপ্ত জন্মের সমীকরণ। আলো এবং আঁধারের এমন খেলা একসময় নেশায় পরিণত হলে তাতে বরং আনন্দ খুঁজে পাই।
আনন্দ তখন উদ্বাস্তু।
আনন্দ তখন বেপরোয়া।
আনন্দ তখন সর্ব্বহারা, সর্ব্বগ্রাসী রূপ নিয়ে আমাদের বুকে, চোখে, মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
আমাদের আনন্দিত অন্তরে জমা রাখি এক বিশুদ্ধ বিষাদ।
হঠাৎ একদিন অনন্ত গোপন খুলে জন্মের স্বীকারোক্তি দিতে বসি। ফিরে আসি এক নতুন মৃত্যু নিয়ে। বুঝতে পারি মৃত্যু ভয়ংকর আকর্ষণীয় এক সত্ত্বা। যাকে উপেক্ষা করার মত দৃঢ় বৃক্ষ হব বলে তারপরও আজন্ম মৌনতায় অঞ্জলী দেই। তারপরও শব্দ চেয়ে হাত পাতি।
হাতের রেখায় কেবল একটি শীতের সকাল পুরোনো হতে থাকে প্রতিদিন।
পুরাতন খুঁড়ে দেখি জমে আছে বৃক্ষের বিষাদ।
নুসরাত জাহান
জন্ম : ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে। পদ্মাপাড়ের রাজশাহী জেলায়। বর্ত্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়নরত।