বটতলার বয়ান : নারীবাদ বনাম নারিবাদ অথবা নারীবাদ শব্দটির বানান কেন নারিবাদ হবে তাহার প্রতিবেদন || আরণ্যক টিটো

0

ফেমিনিজম, মতবাদের নাম।
নন্দনতত্ত্বের উদ্যানে এই নিয়ে নানান বাহাস আছে পোষ্ট মডার্ণ ভাবনাবিশ্বে!
বাঙ্লার ফেমিনিষ্টরা যাকে বঙ্গীয়করণে বলে নারীবাদ।
ফেমিনিজম কিংবা নারীবাদের তাৎপর্য্য ও পর্য্য বিশ্লেষণের কাজ জগতের সকল নারীবাদীদের! …

প্রতিবেদনকারী ভাবছেন,
ভাষার বিজ্ঞানে
নারীবাদ শব্দটির বানান ব্যাকরণসম্মত কি না … নাকি অন্যথা …

ভাষার বিজ্ঞান বলছে,
নারীবাদ শব্দটির বানান হবে “নারিবাদ” …
যেমন— কালী + দাস = কালিদাস, গুণী + জন = গুণিজন… তদ্রুপ, নারী + বাদ = নারিবাদ…

ইংরেজী বর্ণমালায় I(ng)
এবং বাঙ্লা বর্ণমালায় হ্রস্ব-ই হল গতিশীলতা, দীর্ঘ-ঈ হল গতিশীলতার স্থিতি,
যাহা আধারবাচক।
নারীর সাথে যখন বাদ যুক্ত হয় তখন নারী শব্দের দীর্ঘ-ঈ-মূলক স্থিতির দায় বাদ শব্দের প্রণয়কাব্যে
হ্রস্ব-ই-মূলক গতিশীলতায় ফানা হয়ে যায় …
অর্থাৎ সন্ধিবদ্ধ বা সমাসবদ্ধ শব্দে
প্রথম শব্দের স্থিতিমুলক বর্ণের দায়িত্ব দ্বিতীয় শব্দের ঘাড়ে চলে যায়, সে হিসাবে নারী + বাদ = নারিবাদ।

এ বিষয়ে শরণ নেওয়া যাক, (কলিম খান-রবি চক্রবর্ত্তীর) ভাষিক প্রবর্ত্তনার—

“গুণী ও গুণিজন প্রভৃতি শব্দগুলির সন্ধি বা সমাস হলেই এরকম দীর্ঘ-ঈ-কারের হ্রস্ব-ই-কারে বদলে যাওয়ার কারণ কী? এক্ষেত্রে অবশ্যই সংস্কৃত ব্যাকরণের নির্দ্দেশ আছে; কিন্তু সেই নির্দ্দেশের প্রকৃত যুক্তিগত ভিত্তি কী? গুণের সক্রিয়তার আধারই তো গুণী। তার সঙ্গে জন যোগ হলে সেটি গুণিজন হয়ে যায় এই কারণে যে, ‘গুণী’ শব্দে গুণের সক্রিয়তার আধারস্বরূপ একটি অশনাক্ত কারী-সত্তা (ী-কার) তো ছিলই। তার সঙ্গে সক্রিয়তার অপর একটি শনাক্ত আধার ‘জন’ কে যোগ করে দিলে অশনাক্ত সত্তাটি স্বভাবতই থাকবার সুযোগ পায় না। পিতৃমাতৃহীন আইবুড়ো চাকুরিজীবী যে কোন হোটেল-রেষ্টুরেণ্টের রাঁধুনীর রান্না খেয়ে কাটিয়ে দেয়, কিন্তু তার বিয়ের পর গৃহিণী ঘরে এলে তার আর কোন অশনাক্ত রাঁধুনীর দরকার পড়ে না। রান্নার কাজ তখন তার সুনির্দ্দিষ্ট রাঁধুনী গৃহিণীতে বর্ত্তায়।

একই ভাবে ‘গুণী’র পাশে ‘জন’ এসে গেলে ‘গুণ’-এর সক্রিয়তা তখন ‘জন’-এ বর্ত্তায়। তখন গুণের সক্রিয়তার আধারস্বরূপ অশনাক্ত ঈ-কারের প্রয়োজন আর থাকে না। তখন গুণিজন তেমন জনকে বোঝায়, যাঁর গুণ আছে। কিন্তু তখনও ‘গুণীজন’ লিখলে সেটি দুটি সত্তা হয়ে যায়। ‘গুণী’ যদি এক সুধী বয়স্ক মানুষ হন, তাহলে ‘গুণীজন’ হবে সেই বয়স্ক মানুষ ও তার মজুর। তার মানে, বাস্তবে ক্রিয়ার জগতে যেমন যেমন বদল হয়, সন্ধি সমাসের নিয়মগুলির দ্বারা শব্দেরও সেইরকম বদল হয়। বর্ণভিত্তিক বানান সংস্কার সূত্র তাকে স্বভাবতই সমর্থন করে।”
(সূত্র: বাংলাভাষার বানান-সমস্যা সমাধানের পথ (১ম খসড়া) || রবি চক্রবর্ত্তী ও কলিম খান)

যদি কোন সভাজন বলেন,
“তবে ‘নারিবাদ’ শব্দটি ভিন্নার্থে নারি অর্থাৎ না-পারি-বাদ অর্থাৎ inability theoryও বোঝাতে পারে, সে কারণেই হয়তো দীর্ঘ-ঈ-কার।”

এর উত্তরে, উত্তরণে বলা যায়—
বিষয়টি
এই ভাবে দেখা যেতে পারে— এখানে নারি শব্দের সাথে বাদ শব্দের বন্ধন হয়নি,
নারী শব্দের সাথে বাদ শব্দের বন্ধন হয়েছে …
সন্ধিকৃত বা সমাসবদ্ধ শব্দে প্রথম শব্দের স্থিতি থাকে না …
প্রথম শব্দ দ্বিতীয় শব্দে লীন হয়ে (উভয় শব্দের একক অর্থ হারিয়ে) সমবায়ী আলাদা অর্থ তৈরি করে …
যাহা প্রকৃতিপুরুষময় …
(অন্যদিকে,
নারী শব্দটিকে আলাদাভাবে নারি লেখা যাবে না।)

আলাদাভাবে নারী শব্দটিকে নারি লিখলে নারী শব্দের অর্থ হারিয়ে যাবে। …

কী ভাবে হারিয়ে যাবে?
এ বিষয়ে
শোনা যাক, রুবি বিনতে মনোয়ারের বয়ান—

নর:
নৃ (নৃ + ৃ) ক্রিয়ামূলের বংশে জাত।
√নৃ + ৃ (প্রাপণ) + অ (অচ্)— কর্ত্তৃবাচ্যে, (বঙ্গীয় শব্দকোষ— হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়।)
ক্রিয়াভিত্তিক অর্থানুসারে নর হল ন-কে রক্ষণ-ভক্ষণ করে যে।
(নৃ + ৃ = নী-এর আবর্ত্তন যাহাতে। নৃ + ৃ = নৃ + ৃ = নৃ-এর আধার যে)
নর ন কে রক্ষা করে আবার খেয়েও ফেলে।
ন হল সেই সত্তা যা ‘অন’ করে আবার ‘না’ করে। সে অপ্রয়োজনীয়কে বাদ দেয়, না করে;
প্রয়োজনীয়কে অন করে বা সক্রিয় করে বা আনয়ন করে।
প্রয়োজনীয়কে আনতে গিয়ে জ্ঞানসম্পদ, ধনসম্পদ আহরিত হয়, কাজেই এই সম্পদগুলিকে ন বলা যায়।
বঙ্গীয় শব্দকোষ এজন্য ন-কে বিত্ত বলেছেন।
এই বিত্ত রক্ষা করে নর, আবার এই বিত্ত খেয়ে ফেলে নর।
যারা কেবল খায় তারা হল সেই নর, যারা বেকার।
যারা খায় এবং উৎপাদনও করে তারা হল সেই নর, হল নৃ, এবং তাদের পতি বা রাজা হল নৃপতি।
যারা (নর) রাজার জন্য সম্পদ বহন করে আনত তাদের বলা হত বানর/ বা(হক)+নর।
একালের ভাষায় এরাই আমলা।
যারা (নর) রাজার আদেশানুসারে কাজ করত এবং রাজসম্পদে ভাগ বসাত
তাদের বলা হত কিন্নর।
যারা কাঁচামাল দিয়ে নিজের শ্রম ও মেধা দিয়ে কারুপণ্য উৎপাদন করতেন তাদের বলা হত বিশ্বানর।

নারী: ন-কে রক্ষণ-ভক্ষণ করে যে তার আধার।— নর হতে জাত নার (ন + আ + র = নার), নার সক্রিয় নারীতে।
নার অর্থ জল।
— কৃতজ্ঞতা : বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ।

নর ও নারী শব্দযুগলের বিশ্লেষন থেকে দেখা যাচ্ছে—
‘নারী’ শব্দটিকে আলাদা ‘নারি’ লিখলে ন-কে রক্ষণ-ভক্ষণ করে যে নর তার আধার না হয়ে আধেয় (নার + ই = নারের গতিশীলতা) হয়ে যায় … নারী মূলত আধারবাচক শব্দ। ‘নারী’ নারি বা আধেয় হয় তখন, যখন বাদ বা ইজম আধাররূপে নারিকে বরণ করে, নারিবাদে …

কথা ভাষা নয়। কথা ভাষায় রূপ পায়, বিজ্ঞানে …
আর
শব্দের বিজ্ঞানকে … ব্যাকরণকে … গুরুত্ব না দিলে,
(ল্যাটিন mode/সম্প্রতি থেকে জাত … মডার্ণ না, মডার্ণ নামধারী অধিপত্যবাদী ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গীর) মীনিং ইজ আরবিটারি ভাবে যে কোন বানানে লেখা যায়! … যাহা সিদ্ধ হতে পারে, নিপাতনে! …

প্রতিবেদনকারী বরণ করছে, “নারিবাদ” নামক শব্দই পরম ব্রহ্মকে …

পাঠক,
এই বিষয়ে
আপনাদের ভাব ও ভাবনার অবতারণা করুন …

 

10639619_1050326421685388_1336824167648158240_n 1আরণ্যক টিটো
জন্ম : জুন, ০৬, ১৯৭৭।
জন্মস্থান : উত্তর গোবীন্দর খীল, হাঁদু চৌধুরী বাড়ী, পটিয়া, চট্টগ্রাম।
(শৈশব কৈশোর ও তারুণ্যের সময়যাপন)
বেড়ে ওঠা (পূর্ব্ব বালিয়াদী, মীরশ্বরাই, চট্টগ্রাম) নানার বাড়ীতে…।
প্রকাশিত কবিতার বই : ফুলেরা পোষাক পরে না (সাল: ২০১৮, প্রকাশক : মনফকিরা, কলিকেতা)।
সম্পাদক : চারবাক।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার