বিশেষ মুহূর্ত্ত। টেবিলের একপাশ থেকে মার্বেলটি গড়িয়ে অন্যপাশ ছুঁয়ে মাটিতে পতিত হলেই মেয়েটি পোষাক খুলে টেবিলে বসবে। সামনের চেয়ারে বসে থাকা পুরুষটিও নগ্ন। সেক্সের পূর্ব্ববর্ত্তী দৃশ্যের সমান্তরাল একটি দৃশ্য। কিন্তু এখানে সেক্স সংঘটিত হয় না। সেক্স ছাড়া নারীপুরুষ নগ্ন বসে থাকলে যেমন অসহায় লাগে তাদের, তেমন অসহায়ত্বও কারো চেহারায় নেই। তারা একজন অন্যজনের লিঙ্গের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক। যেন দুগ্ধ পানের পর পরম তৃপ্তিতে বাচ্চারা মায়ের স্তনে মুখ রেখে পড়ে আছে। যেন বাচ্চারা গড। তৃপ্তির নেশায় নারীকে সৃষ্টি করে তার গর্ভে জন্ম নিয়ে স্তনে ঢেলেছে রাশি রাশি দুগ্ধ।
নগ্ন একজোড়া মানুষের মধ্যে একজনের নাম তুল-কালাম। নামের মাঝে হাইফেন বসায়। আসলে সে কৌশলে গ্যাপ রাখে। গ্যাপের মাঝখানে তার পাপ-অপাপ ডুবে যায়। আবার গ্যাপ থেকেই উঠে আসে নতুন প্রণোদনা। তার ধারণা: এভাবে একটা নির্ভেজাল ও নিষ্পাপ জীবনের অধিকারী সে।
নিজের জীবনকে নিষ্পাপ মনে করার আরো কারণ আছে। অন্যতম একটি কারণ হল: নির্ভেজাল সময়ে বাস করা ছাড়া কেউই নিষ্পাপ ও নির্ভেজাল জীবনধারী হতে পারে না। আর অতীতমুক্ত বর্ত্তমানই হল নির্ভেজাল সময়।
অন্যজন বলাকা। তিন বছর যাবৎ তুল-কালামের বিশেষ মুহূর্তের সঙ্গী। বছর তিনেক আগে তুল-কালামের কাছে দীক্ষা গ্রহণকালে তুল-কালাম তার স্তনের আকার দেখে নাম দিয়েছে বল-আঁকা। নামটুকু ছাড়া তার পরিচয় জানা যায়নি আজো। ধারণা করা যেতে পারে: বলাকা আগেও অনেক পুরুষের সাথে শুয়েছে। এজন্য সে জানে কামাসক্ত চোখের ভাষা ও অভাষা।
তুল-কালাম ও বলাকা যে ঘরে ঘুমায় সে ঘরে দুইটি বিছানা পাতা। বিছানা দুইটির মাঝের ফাঁকা জায়গায় বসানো একটা বেঞ্চ বিছানা দুইটিকে সংযুক্ত করেছে। দূর থেকে মনে হয় দুইটি বর্ণের মাঝে বসে আছে একটি হাইফেন। দিনের বেশীরভাগ সময় তুল-কালাম এ ঘরেই কাটায়। ঘরে ছাড়া যে অল্পকিছু সময় সে অন্যকোথাও কাটিয়ে দেয়, তা-ও এই বাড়ীতেই।
বেঞ্চে বসে-থাকা বলাকা বলছে: মাস্টারবেশন করতে করতে পুরুষদের শুকিয়ে যাওয়া চোখও ভয়ানক স্পর্শকাতর হয়। কাৎরায়। তুল-কালাম এই কথার রেশ ধরে বলে উঠল: প্রত্যেক পুরুষের চোখে নদী থাকে। নদীর পারে থাকে সেই পুরুষটির বাড়ী। সমস্ত সন্ধ্যাগুলো কাশফুলের পাশেই প্রথমে ল্যান্ড করে। এজন্য রাত্রির আগমন প্রথম টের পায় পুরুষ।
তুল-কালাম নিজেকে পুরুষ ভাবে কি না এটা ঠিকঠাকভাবে বলাকাও বলতে পারে কি না, সেটা লোকমুখে শোনা যায় না। পুরুষ মাত্রই পুংলিঙ্গের অধিকারী, এই বিচারে তুল-কালাম পুরুষ বটে। কিন্তু বলাকার যোনীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সে-ও তো ভুলে যায় রাতগুলো কীভাবে তাদের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। যেই রাত কোন সন্ধ্যার বর্দ্ধিত বৃক্ষ। যেহেতু বলাকার সাথে সে কখনো সেক্স করেনি তাই তাদের কোন সন্তান নেই। ফলে, বৃক্ষটার নিচে দাঁড়িয়ে প্রতিরাতে কেউ কাঁদে না। রাত গত হয়ে গেলে সে বৃক্ষের ছায়া দেখে না। কারণ বলাকার যোনী। যা তাকে রাত্রির কথা ভুলিয়ে দেয়। অতীতের কথা ভুলিয়ে দিয়ে অতীতমুক্ত রাখে।
তুল-কালাম যদি পুরুষ না হয়ে থাকে তবে বলাকা নারী কি না অথবা বলাকাই পুরুষ কি না, এটা বুঝে উঠাও পাড়াপড়শির জন্য কঠিন। নারী পুরুষ তো কিছু আচরণের নাম, যার ভিত্তিতে নির্দ্ধারণ করা হয় লৈঙ্গিক পরিচয়।
আঁটকুড়ে পুরুষেরা রাত্রি গভীর হলে চুপিচুপি স্ত্রীর পাশ থেকে ওঠে বৃক্ষটিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে। বন্ধ্যা নারীরা রাত্রি গভীর হলে চুপিচুপি স্বামীর পাশ থেকে ওঠে নদী থেকে তুলে নদীতে কলসী কলসী জল ঢালে। এসব আচরণের বিচারে তুল-কালাম ও বলাকার সন্তান জন্মদান ক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করা স্রেফ বোকামো হবে।
●
দুপুর। গত রাতের খোলা পোশাক ভোরবেলা পরে নিয়ে তারা দুজন দুই বিছানায় ঘুমাতে গেছে। সেই ঘুম এখনো ভাঙেনি তুল-কালামের। হয়ত স্বপ্ন দেখছে। ঘুম ভাঙলে সে স্বপ্ন গুনতে চেষ্টা করবে। আর আক্ষেপ করবে কেন প্রতি ঘণ্টায় একটি করে স্বপ্ন দেখে না। আক্ষেপে ছিঁড়ে ফেলবে ডায়েরীর প্রথম আস্ত পাতাটি। তারপর পুনরায় আক্ষেপ, আহা! ডায়েরি লেখা আর হল না।
ডায়েরির ছেঁড়া পাতা দিয়ে এরোপ্লেন বানিয়ে উড়িয়ে দিয়ে দেখবে— আয়না না কি আলনা, কোন্ দিকে যায়। আয়নার দিকে গেলে সে ঘড়ী দিয়ে ব্যাটারী চেক করবে আর আলনার দিকে গেলে সেদিন স্নান করবে। স্নান করুক বা না করুক, এই ঘরের ক্যালেন্ডারে সবসময় ভবিষ্যৎ ঝুলে থাকে। যে কোন মাসের ১ তারিখের আগেই ক্যালেন্ডার থেকে সেই মাসের পাতাটা ছিঁড়ে ফেলা হয়। অবশ্য এই কাজটা বলাকাই করে। কারণ মাস-তারিখ দূরে থাক, তুল-কালাম জানেও না এটা কোন সাল চলছে। এই ঘরের দেয়াল ঘড়ীটা ব্যবহার করা হয় ব্যাটারী চেক করার জন্য। সেসব পেনসিল ব্যাটারী দিয়ে টর্চ জ্বালানো হয়। সেই টর্চের আলো ফেলে তুল-কালাম চলতি মাসের ক্যালেন্ডারের পাতা খোঁজে। যদিও সে জানে না চলতি মাসের নাম। তার ভাবনা হল: ৩৬৫ দিনই কোন-না-কোন মাসে পড়েছে, তাই প্রতিদিনই খোঁজা যায় চলতি মাস। এই একটিমাত্র কাজ সে বলাকার থেকে লুকিয়ে করতে চায়। এজন্য বলাকাও জানে না, তুল-কালাম চলতি মাসের নামে নির্ভেজাল বর্ত্তমান খুঁজছে নাকি খুঁজছে মহাকালের শেষমাথা।
●
এই বাড়ীটার পাশেই একজন অপেশাদার অন্ধ ভায়োলিন-বাদকের বাড়ী। ভায়োলিন বাজানোর ব্যাপারে তার প্রসিদ্ধি অনেক। যেন তারই কৃষ্ণাঙ্গ ফেটে সুর বেরিয়ে আসে। এই সুর এতো মিষ্টি যে যারাই শুনেছে, তাদের নাম পর্য্যন্ত ভুলে গেছে। এতো ভয়ঙ্কর জেনেও কেউই সেই সুর না শুনে থাকতে পারেনি। অবশ্য তিন বছর যাবৎ অন্ধ লোকটা একঘরে হয়ে ভায়োলিন বাজানো নিজের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। এজন্য এই পাড়ার কারোরই তিন বছর আগের কোন স্মৃতি নেই। সম্পর্ক মনে নেই। যে যার পছন্দমত এরে ওরে বেছে নিয়ে সম্পর্ক তৈরি করেছে, বিয়েশাদী করেছে, সংসার, সেক্স করছে। বড় বড় ছেলেমেয়ে বেছে বেছে বলেছে, আজ থেকে তুই/তোরা আমার সন্তান, সেদিন থেকে তারা তাদের সন্তান হয়ে আছে।
অন্ধ ভায়োলিন বাদকের এই মিথের সাথে তুল-কালাম ও বলাকা প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে। অন্ধ লোকের একটা মেয়ে ছিল। এই পাড়ায় আসার প্রথমদিকে সে হারিয়ে গেছে। বলাকাই সেই মেয়ে কি না এটা কেউ না জানলেও তুল-কালাম ব্যাপারটা নিয়ে সন্দেহ করে। কারণ, বলাকাকে নগ্ন দেখলে তুল-কালাম অতীত ভুলে যায়। ভুলে যায় যৌনক্ষুধা। এমনকি অন্যসময়গুলোতে তার যৌনতা নারীঘেষা না কি পুরুষঘেষা, এটাও ভুলে যায় নগ্ন বলাকার সামনে।
অন্যদিকে বলাকা জানে না তুল-কালামের মনের এইসব গোপন কথা। এমনকি অন্ধ ভায়োলিন বাদক সম্পর্কে পাড়ার কারোরই যেমন কোন স্মৃতি নেই, তেমনি বলাকারও নেই।
একজন তুল-কালাম, দ্বিতীয়জন গল্পলেখক— এই দুইজন কেবল সুরের মায়া থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে। গল্পলেখক আসলে তুল-কালামের শিষ্য। তার লিঙ্গপরিচয় অজানা। কিন্তু তারা একে অপরকে উলঙ্গ দেখেছে, ঠিক বলাকার মত। অথবা, বলাকাই গল্পলেখকের মত তুল-কালামের সামনে পোশাক খুলে হাজির হয় আজকাল। যাহোক, তুল-কালাম ও গল্পলেখক সচেতনভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলো নির্ভেজাল জীবনে পৌঁছতে। এজন্য হয়ত সুরের মায়া এদের স্পর্শ করেনি। ঘটনা আরেকরকম হতে পারে: অন্ধ ভায়োলিনের গল্পটি সম্পূর্ণ বানোয়াট। কোন দুর্য্যোগের কবলে পড়ে পাড়ার সমস্ত লোক স্মৃতি হারালে গল্পলেখক অন্ধ ভায়োলিন বাদকের উদ্ভট গল্পটি ছড়িয়ে দিয়ে উধাও হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘদিন তুল-কালাম নিঃসঙ্গ ছিল।
নিঃসঙ্গ থাকাকালে তুল-কালাম আয়নার সামনে নগ্ন হয়ে বসত। সেসময় তার ঘরটিতে ছিল শত শত আয়না, পুরো দেয়াল জুড়ে। সে মনে করে, ওইসময় দেয়ালের দুইভাগে তার লিঙ্গের দুইরকম ছবি ভাসত। কিন্তু দুইরকম লিঙ্গ কেমন কেমন ছিল, তা মনে করতে পারে না।
●
তুল-কালাম যেই পাড়ায় থাকে একমাত্র সে ব্যতীত সেই পাড়ার সবাই ভোটার তালিকায় এসেছে, এমনকি বলাকাও। সবারই এনআইডি অথবা পাসপোর্ট আছে। কমবয়সীদের আছে জন্ম নিবন্ধন সার্টিফিকেট। তুল-কালামের কাছে এসব কিছুই নেই। রাষ্ট্রের নিকট তুল-কালাম বলে কেউ নেই। সে নিজের জন্মের সাল, তারিখ এমনকি জন্মের দিনটি কোন্ বার ছিল তাও জানে না। তার বাবা-মায়ের কাছ থেকেও শোনেনি।
যে-গল্পলেখক হারিয়ে গেছে তার একটা গল্পে দেখা যায়: একটি চরিত্র ক্রমাগত বন্ধু হারাচ্ছে নিজেরই মুদ্রাদোষে। হারাতে হারাতে সর্ব্বশেষ বন্ধুটিও যখন তাকে ত্যাগ করে চলে যায়, তারপর থেকে সে মার্বেল গণনা শুরু করে।
চরিত্রটির মুদ্রাদোষ ছিল: বন্ধুদের জন্মসাল, তারিখ, বার নিয়ে কটাক্ষ করা।
নাজমুল হোসাইন
জন্ম:
২৯ আগস্ট, লালমনিরহাট জেলায়।
দর্শন বিভাগে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। সম্পাদনা করছেন ‘আর কে রোড’ ওয়েবজিন।