প্রসঙ্গ : মৌলবাদ || আশিক সরকার

0

গোড়ার কথা—
এই শতাব্দীর সবথেকে সাড়াজাগানো পরিভাষাগুলোর মধ্যে একটি হল ‘মৌলবাদ’। এ যবে থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তবে থেকেই ধিক্কৃত-অপমানিত-লাঞ্ছিত হয়ে আসছে। এর কথা শুনলেই বিষ্ণু শর্মার লোকেরা মুখ ভেঙচিয়ে বলে, ‘না না, আমরা তো ওর পূজো করি না, আর আমরা কোন দায়েই বা ওকে ‘নমঃ নমঃ’ করব; ও যে আধিপত্যের লালসায় দিবানিশি রক্ত ঝড়ায়, কিন্তু রক্তে যে আমাদের বড় ভয়, রক্ত দেখলে আমাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়; আমরা ওর পূজো করি না; ওর বিনাশ কামনা করি। ওর আরাধনা করে জব্বার শেখের লোকেরা।’

জব্বার শেখের অনুগামীরা এ কথা শুনে প্রথমে নয়ন-যুগল রক্তবর্ণ করে, পরক্ষণে গম্ভীর হয়ে বলে, ‘ওরা তাই বলেছে বুঝি?’ এরপর একটু হেসে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে, ‘আরে, ওরাই তো ওর খাস ভক্ত, আর বলে কিনা আমরা!’ অতঃপর আরো দশ গোষ্ঠীর নাম শুনিয়ে দেয় ওরা এবং ও যে ওদেরই পরম পূজ্য তার সহস্রটি প্রমাণ পেশ করে।

এরূপে প্রত্যেক গোষ্ঠীই বিঘোষণ দেয় যে, এর সাথে ওদের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু সত্য তো এটাই, এ সকলের কাছেই আদৃত।
— সকলের কাছে আদৃত?
হ্যাঁ।
— তবে, তবে…?
না না, মোটেই উদগ্রীব হবেন না, আমরা এর ভেদ তত্ত্ব হাসিল করব; আপনারা একটু ধৈর্য্য ধরুন, আর হেঁইয়ো বলে আমাদের সাথে যাত্রা আরম্ভ করুন।

মৌলবাদ এবং মৌলবাদীর জন্মকথা—
এক—
ভাইসব! মৌলবাদ এবং ‘মৌলবাদীর জন্মকথা জানার পূর্ব্বে, অগ্রে আমাদের মৌলবাদের গাঠনিক উপাদান এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সম্যক অবগত হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি; চলুন, আগে আমরা এসব জেনে নেই।

‘মৌল’ ও ‘বাদ’ এই দু’য়ের সম্মিলনে ‘মৌলবাদ’। (এখানে ‘মৌল’ আদিম বা মূল সম্বন্ধীয়। আর ‘বাদ’ মত কে নির্দ্দেশ করছে।)

এখন আমরা যদি এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নিতে চাই, তবে আমাদের প্রথমেই ব্রুস লরেন্স এর বরাতে বলতে হচ্ছে : মৌলবাদ হচ্ছে এমন এক ধরনের আদর্শবাদী ফর্ম্মেশন, যা আধুনিকতার পরিপন্থী এবং তাঁর সমস্ত শক্তি আধুনিকতার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। এটি বুদ্ধিবৃত্তিবিরোধী, আধুনিকতার পরিপন্থী এবং শ্রেণী বা প্রজন্মের যুদ্ধ। (Fundamentalism is a kind of ideological formation, affirmation the modern world not only by opposing it but also by using it’s means against it’s purposes. It is a anti-Intellectual, anti-modernist and class or generational struggle.)

তাহলে আমরা নির্দ্বিধায় বলতেই পারছি, মৌলবাদ মূলের আবাদ করে। এখানে আদি শক্তির বিরাজমান অত্যাবশ্যকীয়, নতুন শক্তির অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অর্থাৎ মৌলবাদকে ‘মৌলবাদ’ হতে হলে, প্রথমত এবং প্রধানত যে শর্ত্ত পূরণ করতে হবে, তা হল, যে গঠনতন্ত্রের ওপর এ দণ্ডায়মান হবে ওতে অটল-অনঢ় থাকা, ওকে ধারণ করে, লালন করে পুষ্ট হওয়া। কারণ, নতুনকে গ্রহণ করার না এর মন-মানসিকতা আছে, আর বহন করার মত শক্তিও নেই। নতুন কিছু মৌলবাদে প্রবেশ করলে এর চলৎশক্তি শ্লথ হয়, ময়দানে মুখ থুবড়ে পড়ে দম আটকে মারা যায়।

এবার আসা যাক মৌলবাদী প্রসঙ্গে। সহজ কথায় বলতে কি, যারা কিনা মৌলবাদকে হুজুর হুজুর করে, দেবতাজ্ঞানে পূজো করে, অর্ঘ্য দেয়, যারা মৌলবাদের একান্ত অনুগামী, মৌলবাদের আদর্শকে অভ্রান্ত মনে করে, সর্ব্বান্তকরণে বিশ্বাস করে এবং উচ্চরবে ঘোষণা দেয়, বিকাশ কেবল মৌলবাদের দ্বারাই সম্ভব— এরাই মৌলবাদী।

দুই—
‘মৌলবাদ’ শতাব্দীকাল আগে খ্রীষ্ট জগৎ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এর উৎপত্তিস্থল বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মার্কিন প্রোটেস্ট্যান্টরাই সর্ব্বপ্রথম একে পুষ্পমাল্য দ্বারা স্বাগত জানায়। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, এরা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মৌলবাদের নামাবলী কণ্ঠে ধারণ করে। আর তখন মৌলবাদী বলতে এদের দিকেই অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করা হত; কারণ এদের অভিমত ছিল, বাইবেলকে আক্ষরিক অর্থে গ্রহণ করতে হবে, মার্কিন সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ডারউইনের ‘বিবর্ত্তনবাদ’ পড়ানো চলবে না; কারণ প্রোটেস্ট্যান্টরা যে আদি বিশ্বাস বা মৌল শক্তির উপর দৃঢ়ভাবে দণ্ডায়মান [১. ঐশি বাণীর অভ্রান্ততা (Inerrancy of scripture.) ২. কুমারী মাতার গর্ভে যীশুর জন্ম (The virgin birth of christ.) ৩. পরিবর্ত্তক প্রায়শ্চিত্ত ব্যবস্থা (Substitutionary atonement.) ৪. যীশুর শারীরিক পুনরুত্থান (The bodily resurrection of chirst.) ৫. অলৌকিক ঘটনার সত্যতা (The authenticity of miracles)] তাঁর সাথে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার দন্ধ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু তাঁরা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েও সফলকাম হতে পারেনি; পরিশেষে তাঁদেরকে দেয়া হয়েছিল ‘মৌলবাদী’ অভিধা। কিছু বিখ্যাত বই এর সত্যতা আজো ধরে আছে। আপনাদের চোখের তুষ্টি প্রদান হেতু তা নিম্নে প্রদত্ত হল।

১. দ্য এনসাক্লোপিডিয়া এমেরিকানের মতে, মৌলবাদ হচ্ছে একটি জঙ্গী রক্ষণশীল প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন, যেটা ১৯২০ এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।

২. এনসাক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মতে, মৌলবাদ প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানদের একটি গোঁড়া ধর্মীয় বিশ্বাস।

৩. নিউ ওয়ার্ল্ড ডিকশনারির ভাষ্য মতে, 1. Religious beliefs based on literal interpretation of everything in the Bible and regarded as fundamentalism told Christian faith and morals. 2. The twentieth century movement among some American Protestants based on this belief. ( ১. মৌলবাদ বলতে খ্রিষ্টানদের বাইবেলে প্রদত্ত যাবতীয় বিষয়াদি আক্ষরিকভাবে গ্রহণকেই বুঝায়। ২. মৌলবাদ বিশ শতকের একটি আন্দোলন, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিষ্টানদের একাংশের গোঁড়া বিশ্বাসমালার আন্দোলন।)

মৌলবাদের রূপরেখা—
প্রোটেস্ট্যান্টদের কর্ম্মনীতি বিশ্লেষণ করে সেদিন তাঁদেরকে মৌলবাদী বিশেষণে ভূষিত করা হয়েছিল। আজ মুসলিমদেরকেও মৌলবাদী বিশেষণে সম্বোধন করা হচ্ছে। কিন্তু মুসলিমদেরকে মৌলবাদী বলার পেছনে কোন যৌক্তিক কারণ আছে কিনা, ইসলামকে আদৌ মৌলবাদ বলা যায় কিনা তা অবশ্যই আলোচনা সাপেক্ষ। কিন্তু বিষয়টি এখানে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে বলে আমরা এখানে ঐ আলোচনায় প্রবৃত্ত হচ্ছি না। আমরা যেটা বলতে চাচ্ছি তা হল, যাঁরা মৌলবাদ এবং মৌলবাদী বলতে কেবল খ্রীষ্টানদের ধর্মীয় আন্দোলন (প্রোটেস্ট্যান্টদের), খ্রীষ্টান, ইসলাম এবং মুসলিমদেরকে বোঝেন তাঁরা খুব একটা গলদের মধ্যে আছেন। মৌলবাদ এতটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়; মৌলবাদ আমাদের সমাজের প্রতিটি কোণে কোণে অবস্থান করছে। আমরা সবাই কোন না কোনভাবে মৌলবাদী, আমরা মৌলবাদের পূজার্চনা করছি।
— কেমন করে?
এক্ষেত্রে রবি বাবুর কথা প্রণিধানযোগ্য। রবি বাবু বলেছেন, ‘আগে যেভাবে সফলকাম হওয়া গিয়েছিল পরে ঠিক তেমনটি করার যে নীতি তাকে ‘মৌলবাদ’ বলে। অর্থাৎ সফলকাম হতে গেলে যেন পূর্ব্ব কর্ম্ম-পন্থার পুনরাবৃত্তি ছাড়া কোন গত্যন্তর নেই। সমস্ত কল্যাণ যেন পূর্ব্ব আচার-ব্যবস্থার অনুসরণের মাঝেই নিহিত। কিন্তু সত্য কি কেবল অতীতেই ছিল, ভবিষ্যতে সত্যের অস্তিত্ব নেই এমনটি কল্পনা করা বা স্বীকার করা কি কস্মিনকালেও যুক্তিযুক্ত? পাঁচশত বছর পূর্ব্বে আমার পূর্ব্বপুরুষরা পায়ে হাঁটা-চলা করত, তাই জন্যে আজ আমার মোটরসাইকেলে চড়া যাবে না, এর কি কোন যৌক্তিকতা আছে? এরমানে কিন্তু এটা নয় যে, পুরাতনকে ঢালাওভাবে উচ্ছেদ করলেই মৌলবাদের বাহু ভঙ্গ করা সম্ভব; বরং এর মাধ্যমেও মৌলবাদের জেঁকে বসা অসম্ভব কিছু নয়। কারণ, এখানেও কিন্তু একটা মৌল নীতি থাকে, যেটা ঘোষণা দেয়, প্রগতি অতীতকে বর্জ্জন করার মধ্যেই নিহিত; অতীতের কর্ম্মপন্থায় বিকাশ সম্ভব নয়। কিন্তু অতীত আচারে কোন ন্যায় নেই এটাও কি কখনো সম্ভব? এখন যদি পূর্ব্বপুরুষদের প্রধান খাবার ভাত-এর প্রতি অবজ্ঞা পোষণ করে, বিরুদ্ধাচরণ করে ঘোষণা দেয়া হয়, ‘ভাইসব! অদ্য আমরা ভাতকে বর্জ্জন করলাম, এখন থেকে ভাত নয়, কলা হবে আমাদের জীবন ধারণের পাথেয়। বাপ-দাদাদের গোঁড়া বিশ্বাসের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার সময় এসেছে যে, শুধু ভাত নয়, কলা খেয়েও বেঁচে থাকা যায়, তাই আমরা আজ থেকে ভাতকে বর্জ্জন করলাম।’ এমন কর্ম্মনীতির বেলায় কী বলা যায়? এখানে যাঁরা ভাত খেত তাঁরা যদি হয় মৌলবাদী, তবে যাঁরা ভাত ত্যাগ করে কলাকে প্রধান খাবার হিসেবে গ্রহণ করার ঘোষণা দিচ্ছে, তাঁরা কি মৌলবাদী নয়? এখানে মনে রাখা প্রয়োজন, নিয়ম ভাঙলে নিয়মের তৈরি হবে- এটাই স্বতসিদ্ধ। আর অধিক কি বলব? আশা করি, বিজ্ঞ পাঠকমণ্ডলী উপরোক্ত আলোচনায় মৌলবাদের স্বরূপ করায়ত্ত করেছেন। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, ‘এর থেকে উত্তরণের উপায় কী?’ আমরা সামনের আলোচনায় এর থেকে মুক্তির পথ অনুসন্ধানের প্রয়াস করব। চলুন, আবার যাত্রা আরম্ভ করা যাক।

উপসংহার—
সত্য তো এটাই আমরা বামপক্ষে না থাকলে ডানপক্ষে অবস্থান নিশ্চিত হচ্ছে, ডানপক্ষে না থাকলে বামপক্ষে। আর উভয় পক্ষকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করলে অথবা বিনয়ের সাথে এড়িয়ে গেলেও এখানে আমাদের হতে হচ্ছে নিরপেক্ষ। আর নিরপেক্ষ যে পক্ষ বৈ অন্য কিছু নয়, এটা তো সুনিশ্চিত। যাইহোক, এভাবেই আমরা কোন না কোন আদর্শের অনুচারী হচ্ছি, আর নিজেদের অজান্তেই মৌলবাদের তিলক ললাটে লাগাচ্ছি।
— তবে কি মৌলবাদী না হয়ে জীবন যাপন করা একেবারে অসম্ভব?
না, মোটেই নয়। তবে পরিবেশের সাথে সঙ্গতি রেখে সর্ব্বপন্থার সমন্বয়ে একটি জীবন-ব্যবস্থা পরিগ্রহ করা যেতেই পারে— এটা জীবনের ক্ষেত্রে ন্যায়সঙ্গত, আর এটাই হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্ত কোন একটির (বাম কিংবা ডান) চূড়ান্ত অনুগামী হওয়ার কোন সুযোগ নেই। …

 

 

 

 

 

আশিক সরকার
জন্ম :
৬ অক্টোবর ১৯৯৭, নেওয়াশী, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম।
সম্পাদক : কাঁটা।
ইমেইল : ar6226113@gmail.com

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার