যে ভদ্রমহিলা ঠিক ছ’টার সময় এসেছিল || গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ — অনুবাদ : চিরন্তন ভট্টাচার্য

0

                                                                   (ছবি আন্তর্জ্জাল থেকে)

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ
[1927 সালের 6 মার্চ দক্ষিন আমেরিকা মহাদেশের কলম্বিয়ার আরাকাটাকা নামের ছোট শহরে জন্মানো গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পরবর্ত্তী কালে সাহিত্যক্ষেত্রে মহিরুহপ্রতিম হয়ে ওঠেন। মার্কেজের লেখার বৈশিষ্ট্য তাঁর জাদু বাস্তবতা। শুধু স্প্যানিশ ভাষা সাহিত্য নয় বা শুধু লাতিন আমেরিকা নয় সমগ্র পৃথিবীতেই সাহিত্য লিখে ওনার চেয়ে বেশী যশ এবং অর্থ কেউ উপার্জ্জন করতে পারেননি। 1982 সালে সাহিত্যে অবদানের জন্য উনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। 17 এপ্রিল 2014 সালে মেক্সিকোর মেক্সিকো সিটিতে সাতাশি বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয়]

স্যুইং ডোরটা খুলে গেল। দিনের এই সময়টায় জোসের রেস্টুরেন্টে কোন খদ্দের থাকে না। ঘড়ীতে ঠিক সন্ধ্যা ছ’টা। সাড়ে ছ’টা বাজার আগে নিয়মিত খদ্দেররা কেউ আসতে শুরু করবে না। কিন্তু ওর এই মহিলা খদ্দেরটি এতটাই রক্ষণশীল এবং নিয়মিত যে ছ’টা বাজার ঘণ্টা শেষ হওয়ার আগেই এসে ঢুকল এবং একটা টুল টেনে বসল। ঠিক যেভাবে ও বছরের প্রতিটি দিন ঠিক এই সময়ে এখানে আসে। একটা না জ্বালানো সিগারেট মেয়েটার দুই ওষ্ঠের মাঝে শক্ত করে চেপে ধরে রাখা আছে।

“হ্যাল্লো রাণিসাহেবা” ওকে বসতে দেখে জোসে সম্ভাষণ করল। এরপরে ও কাউন্টারের অন্য প্রান্তে গিয়ে ভেজা জায়গাগুলো একটা শুকনো কাপড় দিয়ে মুছতে লাগল। যখনই রেস্টুরেন্টে কোন খদ্দের ঢোকে প্রতিবারেই জোসে এটা করে থাকে। এমনকি এই ভদ্রমহিলা যার সঙ্গে ওর রসিকতা করার মত ঘনিষ্ঠতা আছে। লালমুখো, মোটাসোটা চেহারার রেস্টুরেন্ট মালিক তার কাছে নিজের কঠিন পরিশ্রম করার গল্প ফাঁদে প্রতিদিন। কাউন্টারের অন্য প্রান্ত থেকেই ও জিজ্ঞাসা করল
“বল আজকে তোমার জন্য কি করতে পারি?”
“একদম প্রথমেই আমি তোমাকে শেখাতে চাই কীভাবে একজন ভদ্রলোকের মত আচরণ করতে হয়,” ভদ্রমহিলা বললেন। উনি একটা টুলের ওপরে বসে কাউন্টারের ওপরে কনুইটাকে ভর দিয়ে রেখেছিলেন। তার ঠোঁটে একটা গোটা সিগারেট। কথা বলবার সময় উনি মুখের ভঙ্গীটা এমনভাবে করলেন যাতে জোসে খেয়াল করে যে সিগারেটে এখনও আগুন দেওয়া হয়নি।
“ওহ আমি ঠিক খেয়াল করিনি,” জোসে বলল।
“কোন কিছু খেয়াল করার মত শিক্ষাদীক্ষা তোমার এখনও হয়নি,” ভদ্রমহিলা উত্তরে জানাল।

রেস্টুরেন্ট মালিক তাড়াতাড়ি কাপড়টাকে কাউন্টারে রেখে অন্ধকার কোনায় রাখা ময়লা আর সোঁদা গন্ধযুক্ত কাবার্ড থেকে একটা দেশলাই নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফিরে এল। ভদ্রমহিলা একটু ঝুঁকে লোকটার রুক্ষ, লোমশ হাতে জ্বালিয়ে রাখা আগুনটার দিকে এগিয়ে এল। জোসে খানিকটা সস্তা পেট্রোলিয়াম জেলি লাগিয়ে বিন্যস্ত করা ভদ্রমহিলার ঘন চুলগুলো দেখছিল। মহিলার ফুলছাপ ব্রেসিয়ারের ওপরে ভেসে থাকা খোলা কাঁধ। ঠোঁটে রাখা সিগারেটটাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়ে গেলে মেয়েটা মুখটা ওপরে তুলল আর তখনই জোসে ওর কৃত্রিমভাবে ফুলিয়ে রাখা স্তনের অগ্রভাগ দেখতে পেল।
“তোমাকে আজ ভীষণ সুন্দরী লাগছে, রাণিসাহেবা” জোসে বলল।
“তোমার এসব বেয়াড়া ইয়ার্কিগুলো বন্ধ কর তো,” ভদ্রমহিলা বলল “তুমি ভেব না যে এসব বললেই আমি তোমাকে খাবারের দাম দেব।”
“আরে আমি এসব ভেবে তো বলিনি রাণিসাহেবা,” জোসে বলল “আমি হলফ করে বলতে পারি আজ তোমাকে যা খাওয়াব তারপরে তুমি অন্য কিছু ভাবতেই পারবে না।”

ভদ্রমহিলা মুখ থেকে অনেকটা ধোঁয়া ছাড়লেন, হাতগুলো গুটিয়ে ক্রস করলেন, ওর কনুইটা তখনো কাউন্টারের ওপরে ভর দিয়ে রাখা, দৃষ্টি রেস্টুরেন্টের চওড়া খোলা জানালা বেয়ে রাস্তার দিকে। ভদ্রমহিলাকে বেশ বিষণ্ণ লাগছিল। বিরক্তি আর কামুকভাব মেশানো একটা বিষণ্ণতা।
“আমি তোমাকে দারুণ একটা স্টেক পরিবেশন করছি,” জোসে বলল।
“আমার কাছে কিন্তু কোন পয়সা নেই,” ভদ্রমহিলা জানালেন।
“গত তিন মাস ধরেই তো তোমার কাছে কোন টাকা-পয়সা থাকে না। কিন্তু তাও আমি সবসময় তোমার জন্য ভাল ব্যবস্থাই করি,” জোসে উত্তর দিল।
“আজকের দিনটা আলাদা,” ভদ্রমহিলা নিরাসক্তভাবে উত্তর দিলেন বাইরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে।
“প্রত্যেকটা দিনই তো এক,” জোসে বলল “প্রত্যেকদিন ঘড়ীর কাঁটা যখন ঠিক ছ’টার ঘর ছুঁয়ে ফেলে সেইসময় তুমি এসে বল যে তুমি একটা কুকুরের মত ক্ষুধার্ত্ত আর আমি তোমার জন্য তোমার পছন্দের কোন খাবার বানিয়ে আনি। একটাই পার্থক্য: আজকে তুমি এসে বলনি যে তুমি একটা কুকুরের মত ক্ষুধার্ত্ত। সেটাই আজকের দিনটাকে আলাদা করেছে।”
“এটাই সত্যি,” ভদ্রমহিলা বলল। ও ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল যে লোকটা এখন কাউন্টারের অন্যপ্রান্তে রেফ্রিজারেটরটাকে পর্য্যবেক্ষণ করছে। ওর দিকে সেকেন্ড দুই-তিন তাকিয়ে থাকল তারপর কাবার্ডের ওপরে থাকা ঘড়ীটার দিকে তাকাল। এখন ঠিক ছ’টা বেজে তিন মিনিট। “এটা সত্যি জোসে। আজকের দিনটা আলাদা,” ভদ্রমহিলা বলল। ও মুখনিঃসৃত ধোঁয়াটাকে নির্গত হতে দিল তারপরে নিরাসক্তভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল “আমি আজকে ছ’টার সময় আসিনি জোসে। সেজন্যই আজকের দিনটা আলাদা।”
লোকটা ঘড়ীর দিকে তাকাল।
“আমি আমার হাতটা কেটে ফেলে দেব যদি ঘড়ীটা এক মিনিটও স্লো চলে,” লোকটা বলল।
“কথাটা তা নয় জোসে। আমিই আজকে ছ’টার সময় আসিনি,” ভদ্রমহিলা বলল।
“সেই সময় ঘড়ীর কাঁটা ঠিক ছ’টার ঘর ছুঁয়েছিল রাণিসাহেবা,” জোসে বলল “তুমি যখন ভীতরে ঢুকে এলে তক্ষুনি ঘণ্টা বাজা বন্ধ হল।”
“আমি এখানে এসেছি সিকি ঘণ্টা হয়ে গেছে,” ভদ্রমহিলা বলল।
মহিলা যেখানে বসে আছে জোসে সেইদিকে এগিয়ে গেল। একটা চোখের পাতাকে তর্জ্জনী দিয়ে টেনে নিজের ফুলোফুলো মুখটাকে ওর মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল “আমার চোখে একটু ফুঁ দাও তো।”
ভদ্রমহিলা নিজের মাথাটাকে পিছিয়ে আনল। ভদ্রমহিলার মেদুর মুখের ওপরে বিষণ্ণতার একটা মেঘ খেলা করে বেড়াচ্ছিল “এইসব বোকা বোকা ভাঁড়ামোগুলো বন্ধ কর জোসে। তুমি ভাল করেই জানো গত ছ’মাস আমি মদ খাইনি।”
“ওসব ছেঁদো গপ্প তুমি অন্য কোথাও শুনিও,” ও বলল “আমাকে বলতে এস না। আমি হলফ করে বলতে পারি তুমি আজ অন্ততঃ এক কি দুই পাঁইট পান করেছ।”
“এক বন্ধুর সঙ্গে অল্প একটু পান করেছি,” ভদ্রমহিলা বলল।
“ওহ! এইবারে বুঝলাম,” জোসে বলল।
“হাতির মাথা বুঝেছ!” ভদ্রমহিলা বলল। “আমি এখানে সিকি ঘণ্টা ধরে উপস্থিত আছি।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে তুমি চাইছ যখন তখন আমি না হয় বলছি তুমি সিকি ঘণ্টা ধরেই এখানে আছ,” ও বলল “দশটা মিনিট এদিক-ওদিকে আর কী যায় আসে?”
“যায় আসে জোসে,” ভদ্রমহিলা বলল। এবং নিজের হাতটাকে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে কাঁচের কাউণ্টারের ওপরে ছড়িয়ে দিল। ভদ্রমহিলা বলল “আমি যে এটা তোমার কাছে শুনতে চাইছি তা না। আমি আদতেই সিকি ঘণ্টা ধরে এখানে আছি।” এরপরে একবার ঘড়ীটার দিকে তাকিয়ে বলল “আমি আসলে বলতে চাইছি আমি কুড়ি মিনিট ধরে এখানে আছি।”
“তথাস্তু রাণিসাহেবা,” জোসে বলল “আমি শুধু তোমাকে একটু সুখী দেখার জন্য পুরো দিন আর রাতটাও তোমাকে দিয়ে দিতে পারি”

এই পুরো সময়টা জুড়ে জোসে কাউন্টারের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ঘুরেছে, কিছু উপকরণ পাল্টেছে, কিছু উপকরণ এক জায়গা থেকে নিয়ে অন্য জায়গায় রেখেছে। ও ওর নিজের ভূমিকা পালন করে গেছে।
“আমি তোমাকে সুখী দেখতে চাই,” ও আবার বলল। হঠাৎ থেমে ভদ্রমহিলার কাছে এসে বলল “তুমি কি জানো যে আমি তোমাকে গভীরভাবে ভালবাসি?”
ভদ্রমহিলা ঠাণ্ডাভাবে ওর দিকে তাকাল “অ-ব-শ্য-ই জোসে। কি মারাত্মক আবিষ্কার। তুমি কি মনে কর এক মিলিয়ন পেসো* খরচ করার পরেও তুমি আমাকে জিতে নিতে পারবে?”
“আমি কথাটা ওভাবে বলিনি রাণিসাহেবা,” জোসে বলল “আমি হলফ করে বলতে পারি আমার দেওয়া খাবার তোমার পছন্দ হয়নি।”
“আমি ওই কারণে কথাটা বলিনি জোসে,” ভদ্রমহিলা বলল। এরপরে গলাটাকে খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল “কোন মেয়েই এমনকি এক মিলিয়ন পেসো পেলেও তোমার এই মোটকা চেহারার ভার নিতে পারবে না।”
জোসে লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মেয়েটার দিকে পিছন ফিরে তাক আর বোতলগুলোর ধুলো ঝাড়তে লাগল। মাথা না ঘুরিয়েই ও বলতে লাগল “আজ তোমার মেজাজ খুব গরম হয়ে আছে রাণিসাহেবা । আমার মনে হয় তোমার পক্ষে সবচেয়ে ভাল হবে এই স্টেকটা খেয়ে বাড়ী ফিরে সুন্দর একটা ঘুম দেওয়া।”
“আমার খিদে পায়নি,” ভদ্রমহিলা বলল। খোলা জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে গোধুলী লেগে যাওয়া ধূসর শহরের লোকজন দেখছিল। রেস্টুরেন্টের ভেতরের আবছায়া নিস্তব্ধতা শুধু জোসের কাবার্ডের ওপরে জিনিষপত্র রাখার শব্দে ভেঙে ভেঙে যাচ্ছিল। হঠাৎ ভদ্রমহিলা রাস্তার দিক থেকে মুখ ফেরাল আর খুব নরম আর মিষ্টি করে অন্যরকম গলায় জিজ্ঞাসা করল “তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালবাস পেপিলো*?”
“বাসি,” ওর দিকে মুখ না ফিরিয়েই খুব নিরাসক্ত ভাবে বলল জোসে।
“আমি তোমাকে অত কড়া কথা বললাম। তার পরেও?” ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করল।
“তুমি আমাকে এমন আর কিই বা বলেছ?” ওর দিকে ঘাড় না ঘুরিয়েই সেই নিরাসক্ত ভঙ্গীতেই প্রশ্ন করল জোসে।
“ওই যে মিলিয়ন পেসোর কথাটা বললাম,” ভদ্রমহিলা বলল।
“আমিতো ওটা ভুলেই গেছি,” জোসে বলল।
“তাহলে তুমি আমাকে সত্যিই ভালবাস?” ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করল।
“হ্যাঁ,” জোসে জানাল।
অল্প একটা নিস্তব্ধতা। জোসে এখনো মুখ না ঘুরিয়েই কাজ করে যাচ্ছিল। মেয়েটি আবার একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল, নিজের কনুইটাকে কাউন্টারের ওপরে ভর দিয়ে রাখল, তারপরে খুব সাবধানে, জিভটাকে কামড়ে ধরে সঙ্কোচের সঙ্গে বলল “আমার সঙ্গে বিছানায় না গিয়েও?
এতক্ষণে জোসে ওর দিকে ফিরল “আমি তোমাকে এতটাই ভালবাসি যে আমি তোমার সঙ্গে বিছানাতেও যাব না।” এরপরে ও মেয়েটির কাছে গেল। ওর দিকে তাকাল, নিজের পেশিবহুল হাতটাকে কাউন্টারের ওপর রেখে ওর চোখের ওপরে চোখ রেখে বলল “আমি তোমাকে এতটাই ভালবাসি যে প্রত্যেক রাতে যে লোকটা তোমার কাছে যায় আমি ওই তাকে খুন করি।”
প্রথম ধাক্কায় ভদ্রমহিলা বেশ হকচকিয়ে গেল। তারপরে অর্থপূর্ণ আর বিদ্রূপের দৃষ্টিতে তাকাল। তারপরে খানিকটা চুপ করে থাকল। তারপরে শব্দ করে হেসে উঠল “তুমি একটা হিংসুটে জোসে। বুনো আর হিংসুটে।”
জোসে বেশ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। মুখের ওপরে ভদ্রমহিলা যেভাবে সাহসের সঙ্গে গোপন সত্যটা বলে দিল। যেন একটা শিশুকে তার গোপন লজ্জ্বার কথা হাটের মাঝে বলা হয়ে গেছে। ও বলল “আজ সন্ধ্যায় তুমি যেন কোন কিছুকেই সহজভাবে নিতে পারছ না রাণিসাহেবা ।” শুকনো এক ফালি কাপড় দিয়ে নিজের শরীরটাকে মুছতে মুছতে বলল “জীবনের নিষ্ঠুরতা তোমাকে কঠিন করে তুলেছে।”
ভদ্রমহিলার মুখের ভাবে এখন একটা পরিবর্ত্তন এসেছে। “আচ্ছা,” অদ্ভুত একটা ঔজ্জ্বল্য তার চোখে, একইসঙ্গে স্থিতি আর দোদুল্যমানতা নিয়ে জোসের দিকে তাকিয়ে বলল “তাহলে তুমি ঈর্ষান্বিত নও।”
“একদিক থেকে তাইই,” জোসে বলল “কিন্তু তুমি যেভাবে ভাবছ সেভাবে নই।”
জামার কলারটাকে একটু তুলে কাপড়টা দিয়ে নিজের ঘাড় আর গলাটাকে একটু মুছে নিল।
“তাহলে?” ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করল।
“ঘটনা হল আমি তোমাকে এতটাই ভালবাসি যে আমি চাই না তুমি ওসব কর,” জোসে বলল।
“কী?” ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করল।
“প্রতিদিন আলাদা আলাদা পুরুষের সঙ্গে তোমার অভিযানগুলো,” জোসে বলল।
“তুমি কি সত্যিই ওকে খুন করতে চাও যাতে করে ও আমার সঙ্গে যেতে না পারে?” ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করল।
“না। তোমার সঙ্গে যাওয়া আটকাতে নয়,” জোসে বলল “তোমার সঙ্গে গিয়েছিল বলে আমি ওকে খুন করব।”
“ব্যাপারটা একই হল,” ভদ্রমহিলা বলল।
কথোপকথনটা একটা উত্তেজক জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। ভদ্রমহিলা কথা বলছিল নিচু, কোমল আর মন্দ্রিত স্বরে। ওর চোখগুলো আটকে ছিল লোকটার নরম মুখের ওপরে। আর লোকটি দাঁড়িয়ে ছিল নিস্পন্দভাবে। যেন সুন্দর কথার মায়াজালে সে সম্মোহিত হয়ে গিয়েছে।
“এটা সত্যি,” জোসে বলল।
“তাহলে,” ভদ্রমহিলা বলল। তার একটা হাত দিয়ে লোকটার পুরুষালি কঠিন হাতের ওপর টোকা দিতে দিতে এবং অন্য হাতটা দিয়ে ওর নিতম্বে একটা চাপড় দিয়ে বলল “তাহলে তুমি কোন মানুষকে খুনও করতে পার?”
“তোমাকে আমি যা বললাম, হ্যাঁ,” জোসে নিজের গলাটাকে নাটকীয়ভাবে খাদে নামিয়ে বলল।
ভদ্রমহিলা দুলে দুলে হাসতে লাগল “কি ভয়ঙ্কর কথা জোসে, কি ভয়ঙ্কর,” ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতেই বলতে লাগল “জোসে একটা লোককে খুন করছে! কেউ ভাবতেই পারবে না এমন মোটা আর থলথলে চেহারার একটা মানুষ যে আমার জন্য প্রতিদিন একটা করে স্টেক রান্না করে অথচ আমার কাছে তার দাম হিসেবে একটা পয়সাও নেয় না আর মজার মজার কথা বলে, তার মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর খুনি লুকিয়ে আছে। কি মারাত্মক জোসে! তুমি তো আমাকে ভয় পাইয়ে দিলে!”
জোসে বাকরুদ্ধ। হয়ত ওর নিজেকে কিছুটা অপমানিত লাগছিল। হতে পারে যখন ভদ্রমহিলা হেসে ওঠেছিল তখন ওর নিজেকে চোর বলে মনে হচ্ছিল।
“তুমি আজকে পেঁচি মাতাল হয়ে গেছ,” ও বলল “যাও বাড়ী ফিরে একটা ঘুম দাও। মনে হচ্ছে আজ তুমি কিছু খাওয়ার অবস্থাতেও নেই।”
কিন্তু ভদ্রমহিলা এবারে হাসি থামিয়ে দিল। আবার বেশ গম্ভীর আর বেদনার্ত্ত। কাউন্টারের ওপরে ঝুঁকে ও লোকটার চলে যাওয়া দেখল। অনাবশ্যক রেফ্রিজারেটরের দরজাটা খোলা আর বন্ধ করা দেখল। তারপরে কাউন্টারের অন্যপ্রান্তে চলে যাওয়া দেখল। দেখল ঝকঝকে কাঁচটাকে পালিশ করতে এবং আবার সেই কাজগুলোই আবার নতুন করে শুরু করতে। তারপরে ভদ্রমহিলা মায়াবী আর নিচু স্বরে বলল “তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালবাস পেপিলো?”
“জোসে,” ভদ্রমহিলা বলল।
লোকটা ওর দিকে তাকাচ্ছিল না।
“জোসে!”
“বাড়ী ফিরে একটা ঘুম দাও।” জোসে বলল “আর ঘুমোতে যাওয়ার আগে স্নান সেরে নিও তাতে ঘুমটা ভাল হবে।”
“সত্যি বলছি জোসে,” ভদ্রমহিলা বলল “আমি মাতাল হইনি”
“তাহলে খুবই বোকা বোকা কথা বলছ,” জোসে বলল।
“এখানে এস, তোমার সঙ্গে কথা আছে,” ভদ্রমহিলা বলল।
কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে আনন্দ আর অবিশ্বাস মিশিয়ে লোকটা কিছুটা এগিয়ে এল।
“কাছে এস!”
ও এসে মেয়েটার সামনে দাঁড়াল আবার। মেয়েটা একটু ঝুঁকে ওর চুলের গোছা ধরে আদুরে ভঙ্গিতে নিজের কাছে টানল।
“তুমি ওই কথাটা আরেকবার বলত। যেটা প্রথমে আমাকে বললে,” ভদ্রমহিলা বলল।
“তুমি কি জানতে চাইছ বল তো?” জোসে জিজ্ঞাসা করল। ও ভদ্রমহিলার দিকে মুণ্ডুটাকে ঘুরিয়ে তাকাবার চেষ্টা করছিল, যেটা ওর চুলের সঙ্গে মেয়েটার হাতে বন্দী ছিল।
“ওই যে তুমি বললে না, যে আমার সঙ্গে বিছানায় যাবে তুমি সেই লোকটাকে খুন করবে,” মেয়েটা বলল।
“একদম ঠিক। যে তোমার সঙ্গে বিছানায় যাবে আমি তাকে খুন করব রাণিসাহেবা,” জোসে বলল।
ভদ্রমহিলা ওর চুলগুলো ছেড়ে দিল।
“এইক্ষেত্রে যদি আমি নিজেই ওই লোকটাকে খুন করি তাহলে তুমি আমাকে বাঁচাবে, তাই না?” ভদ্রমহিলা সম্মতিসূচক প্রত্যাশা নিয়েই জিজ্ঞাসা করল কথাটা আর জোসের বিরাট হাঁড়ীর মত মাথাটাকে যৌনতা মাখানো একটা ঠ্যালা দিল। লোকটা কোন উত্তর দিল না। শুধু একটু হাসল।
“উত্তর দাও জোসে,” ভদ্রমহিলা বলল “তুমি কি আমাকে বাঁচাবে যদি আমি লোকটাকে খুন করি?”
“জানি না,” জোসে বলল। “তুমিও জানো কাজটা অত সোজা নয় যা তুমি চাইছ।”
“পুলিশ কিন্তু তোমার থেকে বেশী কাউকে বিশ্বাস করবে না,” ভদ্রমহিলা বলল।
জোসে বেশ প্রত্যয়ের সঙ্গে হাসল। সম্মানিত। ভদ্রমহিলা কাউন্টারের ওপর ওর দিকে ঝুঁকে পড়ল।
“এটা সত্যি জোসে। আমি হলফ করে বলতে পারি তুমি জীবনে কখনো মিথ্যা কথা বলনি,” ভদ্রমহিলা বলল।
“তাতে করে তোমার তো কোন সুবিধা হবে না কোনদিক থেকেই,” জোসে বলল।
“হবে,” ভদ্রমহিলা বলল “পুলিশ তোমাকে জানে তাই আর কোন প্রশ্ন না করেই ওরা তোমার কথা বিশ্বাস করবে।”
জোসে কাউন্টারটাকে ঠুকতে লাগল কি বলবে বুঝতে না পেরে। মেয়েটা আবার রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল। গলার স্বরটাকে এমনভাবে পরিবর্ত্তন করল যেন প্রথম খদ্দের চলে আসার আগেই এই কথোপকথনটা শেষ হয় “তুমি কি আমার জন্য মিথ্যে কথা বলতে পারবে জোসে?” ও জিজ্ঞাসা করল “আমি মজা করছি না।”
জোসে আবার ওর দিকে তাকাল, খুব তীক্ষ্ণ আর গভীর, যেন একটা আইডিয়া ওর মাথার মধ্যে ঠুকঠুক করে চলেছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। একটা কান দিয়ে ঢুকছে, মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে আর ওকে একটা আতঙ্কের মধ্যে রেখে অন্য কানটা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।
“তুমি কি করেছ বল তো রাণিসাহেবা?” জোসে জিজ্ঞাসা করল। কাউন্টারের ওপরে হাতগুলো ভাঁজ করে ও আবার ঝুঁকে গেল। ওর তীব্র অ্যামোনিয়া গন্ধযুক্ত নিশ্বাস ভদ্রমহিলার নাকে এসে লাগল ।
“সত্যি করে বল তো রাণিসাহেবা তুমি কি কাজ করে এসেছ?” লোকটা জিজ্ঞাসা করল।
“কিছুই না,” দুইদিকে মাথা নাড়িয়ে মেয়েটা উত্তর দিল “আমি তো শুধু নিজের বাঁচবার জন্য বলছিলাম।”
তারপরে আবার লোকটার দিকে তাকাল।
“তুমি কি ভাবতে পারছ যে তোমাকে আর কাউকে খুন করতে হবে না?”
“আমি কোনদিন কাউকে খুন করার কথা চিন্তাও করতে পারি না,” জোসে বিরক্ত হয়ে বলল।
“আরে না রে লোকটা,” ভদ্রমহিলা বলল “আমি বলতে চাইছি আর কেউ আমার সঙ্গে কোনদিন বিছানায় যাবে না।”
“ওহ!” জোসে বলল “এতক্ষণে তুমি ঠিকঠাক একটা কথা বললে। আমি ভালভাবে জানি যে এভাবে শিকারের আশায় তোমার ঘোরাঘুরি করার কোন দরকার নেই। আমি শপথ করে বলছি তুমি যদি এই কাজ ছেড়ে দাও আমি প্রতিদিন বিনা পয়সায় তোমাকে আমার দোকানের সেরা স্টেকটা খাওয়াব।”
“অনেক ধন্যবাদ জোসে,” ভদ্রমহিলা বলল “তার জন্য নয়। আমি আর কারোর সঙ্গে কোনদিন বিছানায় যেতে পারব না।”
“তুমি আবার সব কিছুকে গুলিয়ে দিচ্ছ,” জোসে অধৈর্য্য হয়ে উঠছিল।
“আমি কিছুই গুলিয়ে দিচ্ছি না,” ভদ্রমহিলা চেয়ারের ওপরে টানটান হল আর জোসে ওর ব্রেসিয়ারের তলায় বিমর্ষ ছোট ছোট স্তনগুলোকে দেখতে পেল।
“কাল আমি চলে যাচ্ছি। আমি কথা দিচ্ছি আমি আর ফিরে আসব না এবং তোমাকে আর বিরক্ত করব না। আমি কথা দিচ্ছি আমি আর কারোর সঙ্গে বিছানায় যাব না।”
“এই বোধটা তোমার কোথা থেকে এল?” জোসে জিজ্ঞাসা করল।
“এই তো মিনিট খানেক আগে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম,” ভদ্রমহিলা বলল “মিনিট খানেক আগে আমি বুঝতে পারলাম যে এটা ভীষণ নোংরা কাজ।”
জোসে মোছার কাপড়টাকে আবার তুলে নিয়ে ওর সামনেই কাঁচটা মুছতে লাগল। মেয়েটার দিকে না তাকিয়েই ও কথা বলছিল “নিঃসন্দেহে তুমি যেভাবে চলছ সেটা একটা নোংরা কাজ। তোমার অনেকদিন আগেই বোঝা উচিৎ ছিল।”
“আরে বুঝেছি তো অনেক আগেই,” ভদ্রমহিলা বলল “কিন্তু মাত্র কিছুক্ষণ আগেই বুঝতে পারলাম লোকগুলোকে আমার জঘন্য লাগছে।”
জোসে হাসল। হাসিটা মুখে নিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে ওর দিকে তাকাল। কিন্তু ও দেখল ভীত, বিবর্ণ একটা মেয়ে, কাঁধটাকে উঁচু করে হতাশ ভঙ্গিমায় কথা বলছে আর তার সমস্ত মুখাবয়ব জুড়ে নেমে আসছে হেমন্তের কুয়াশা।
“তোমার কি মনে হয়? ওই লোকগুলো ওই মেয়েটাকে বিদায় করে দিতে চাইবে না? যে মেয়েটা একটা লোকের সাথে ছিল অথচ তাকেই কুচ্ছিত ভেবে খুন করে এসেছে আর ওই মেয়েটার কাছে যতজন পুরুষ এসেছে তাদের প্রত্যেককে এখন মেয়েটার জঘন্য লাগছে?”
“আরে অত ভাবার কিছু নেই,” জোসে মেয়েটাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বলল।
“কী হবে যদি একটা মেয়ে একটা লোকের সঙ্গে সারা বিকেল খেলা করার পরে লোকটাকে জামা-কাপড় পরতে দেখার সময় তাকে কদাকার মনে হয় এবং মেয়েটার মনে হয় পৃথিবীতে এমন কোন সাবান, এমন কোন স্পঞ্জ নেই যা ওই কদাকার লোকটার গন্ধ ওর শরীর থেকে ঘষে তুলে দেবে?”
“সেসব তো হয়ে গেছে রাণিসাহেবা,” জোসে কাউন্টারটা পরিষ্কার করতে করতে নির্ব্বিকারভাবে বলল “এর জন্য লোকটাকে খুন করার দরকার নেই। ওকে চলে যেতে বললেই হয়ে যেত।”
কিন্তু মেয়েটা বলেই যেতে লাগল। ওর স্বর ছিল আবেগপূর্ণ “কিন্তু কী হবে যদি মেয়েটা লোকটাকে হতকুচ্ছিত বলে আর লোকটা সেটা শুনে জামাকাপড় পরা বন্ধ রেখে দৌড়ে এসে মেয়েটাকে চুমু খায়?”
“কোন ভদ্রলোক এমন কাজ করবে না,” জোসে বলল।
“কী হবে যদি করে?” ভদ্রমহিলা এক অদম্য কৌতূহল নিয়ে বলা যাচ্ছে “কী হবে যদি লোকটা ভদ্র না হয় আর মেয়েটা যদি অনুভব করতে পারে যে এর থেকে মরে যাওয়াও ভাল, আর সে মনে করে যে এর থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় একটা ছুরি লোকটার তলপেটে গুঁজে দেওয়া?”
“এটা ভয়ঙ্কর,” জোসে বলল “কপাল ভাল যে তুমি যেমন বললে এমন ধরণের কোন লোক নেই।”
“আচ্ছা,” মেয়েটাকে এখন ভীষণ অবসন্ন লাগছিল “যদি এমন কাজ করে? ধরে নাও লোকটা এমন কাজ করেছিল।”
“যাই করুক এটা ততটাও খারাপ কাজ নয়,” জোসে বলল। নিজের অবস্থানের পরিবর্ত্তন না ঘটিয়েই ও অন্য দিকের কাউন্টারটা মুছতে লাগল।
ভদ্রমহিলা আঙুলের গিঁটগুলোকে কাউন্টারের ওপর ঠুকতে লাগল। ও এখন বেশ আশাবাদী, জোর ফিরে পেয়েছে “তুমি একটা মুর্খ জোসে,” ভদ্রমহিলা বলল “তুমি কিছুই বুঝতে পার না!” জোসের হাত ধরে জোরে একটা টান দিল “এই শোন তোমাকে বলতে হবে যে মেয়েটার ওই লোকটাকে খুন করাই উচিৎ।”
“ঠিক আছে,” জোসে বলল “সম্ভবত তুমি যা বলছ সেটাই হবে।”
“এটা কি নিজেকে আড়াল করা হয়ে গেল না?” মেয়েটা জোসের হাত ধরে টেনে জিজ্ঞাসা করল।
জোসে ওর দিকে একটা উষ্ণ আর রোমান্টিক দৃষ্টিতে তাকাল।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে,” ও বলল আর মেয়েটার দিকে ফিরে মেনে নেওয়ার ভঙ্গিতে একবার চোখ মারল। কিন্তু ভদ্রমহিলা যথেষ্ট গম্ভীর। ওর এই রসিকতা পাত্তাই দিল না।
“যে এমন একটা কাজ করেছে সেই মেয়েটাকে বাঁচানোর স্বার্থে তুমি কি মিথ্যাকথা বলতে পারবে?” ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করল।
“সেটা নির্ভর করছে,” জোসে বলল।
“কিসের ওপরে নির্ভর করছে?” ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করল।
“নির্ভর করছে যে সেই মেয়েটা কে তার ওপরে,” জোসে বলল।
“ধরে নাও এমন একটা মেয়ে যাকে তুমি খুবই ভালবাস,” ভদ্রমহিলা বলল “তুমি তার সঙ্গে থাক না কিন্তু তোমার কথা অনুযায়ী তুমি তাকে অসম্ভব ভালবাস।”
“আচ্ছা, যেমনটা তুমি বলবে রাণিসাহেবা,” জোসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
লোকটা আবার চলে গেল। ও ঘড়ীর দিকে তাকাল। সাড়ে ছ’টা বাজতে চলল। খদ্দেররা এখুনি আসতে শুরু করবে যার জন্য ও কাঁচটাকে আরও ভালভাবে পরিষ্কার করতে লাগল। মেয়েটা টুলের ওপরে বসে বিষাদমাখানো মুখ নিয়ে লোকটার চালচলন দেখতে লাগল। যদি এক্ষুনি আলোটা নিভে যায়। হঠাৎই যেন এক ডুবে যাওয়া মানুষের গলায় বলে উঠল “জোসে!”
একটা গভীর, কোমল দুঃখের ভাব নিয়ে লোকটা একটা মাদী ভেড়ার মত দৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকাল। ওর দৃষ্টিতে শোনার আগ্রহ ছিল না। শূন্যতা নিয়ে তাকিয়েছিল।
“আমি তোমাকে বললাম যে আমি কাল চলে যাব। অথচ তুমি তো কিছু বললে না,” ভদ্রমহিলা বলল।
“হ্যাঁ,” জোসে বলল “কিন্তু তুমি তো আমাকে বলনি তুমি কোথায় যাচ্ছ।”
“অনেক দূরে,” ভদ্রমহিলা বলল “এমন একটা জায়গা যেখানে কোন লোক আমার সঙ্গে শুতে চাইবে না।”
জোসে আবার হাসল।
“তুমি কি সত্যিই চলে যাচ্ছ?” ও জিজ্ঞাসা করল, যেন এইমাত্র ও জীবনে ফিরে এল, সেভাবেই মুখের ভাবটা পরিবর্ত্তন করে নিল।
“সেটা তোমার ওপরে নির্ভর করছে,” ভদ্রমহিলা বলল “যদি তুমি ঠিকঠাক বলতে পার যে ঠিক ক’টার সময়ে আমি এখানে এসেছিলাম। আমি তাহলে আগামী কাল চলে যাব এবং আর কোনদিন এই জীবনে ফিরব না। তুমি কি সেটা চাইছ?”
জোসে ইতিবাচক একটা হাসি দিয়ে মাথাটা নাড়াল। মেয়েটা ও যেখানে ছিল সেইদিকে ঝুঁকে পড়ল “যদি কোনদিন আমি ফিরে এসে দেখি বিকেলের ঠিক এই সময়ে, ঠিক এই টুলটার ওপরে বসে অন্য একটি মেয়ে তোমার সঙ্গে এইভাবে কথা বলছে তাহলে কিন্তু আমার খুব হিংসে হবে।”
“যদি তুমি ফিরে আস তাহলে আমার জন্য কিছু এনো,” জোসে বলল।
“আমি কথা দিচ্ছি আমি সব জায়গা খুঁজে তোমার জন্য একটা লালুভুলু ভালুকছানা নিয়ে আসব,” ভদ্রমহিলা বলল।
জোসে হেসে হাতের কাপড়টাকে এমনভাবে উড়িয়ে দিল যেন অদৃশ্য কোন কাঁচ ও মুছে চলেছে। ভদ্রমহিলাও একটা সৌজন্যের হাসি মুখে আনল। লোকটা কাউন্টারের অন্য দিকে মুছতে চলে গেল।
“আর কি?” জোসে ওর দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞাসা করল।
“যদি কেউ জিজ্ঞাসা করে তখন তুমি তাহলে সত্যিই বলবে তো যে আমি পৌনে ছ’টার সময়ে এসেছিলাম?” ভদ্রমহিলা জানতে চাইল।
“কিসের জন্য?” জোসে ওর দিকে না তাকিয়েই কথাটা বলল যেন মেয়েটার কথাগুলো ও শুনতেই পায়নি।
“ওটা তোমার ভাবার বিষয় না,” ভদ্রমহিলা বলল “আমি যেটা বলছি তুমি ঠিক সেটাই বলবে।”
জোসে দেখতে পেল ওর প্রথম খদ্দের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকছে, ঘড়ীতে এখন ঠিক কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে ছ’টা।
“আচ্ছা রাণিসাহেবা,” জোসে আনমনা ভাবে বলল “তুমি যা বলেছ আমি ঠিক সেভাবেই বলব সবসময়।”
“আচ্ছা,” ভদ্রমহিলা বলল “আমার জন্য স্টেকটা রান্না করা শুরু করে দাও তাহলে।”
লোকটা রেফ্রিজারেটর থেকে কিছুটা মাংস বার করে এনে টেবিলে রাখল। তারপরে স্টোভটা জ্বালাল।
“আজকে তোমার জন্য খুব সুন্দর একটা ফেয়ারওয়েল স্টেক বানাচ্ছি রাণিসাহেবা,” ও বলল।
“অনেক ধন্যবাদ পেপিলো,” ভদ্রমহিলা বলল।

ভদ্রমহিলা চিত্রার্পিত হয়ে বসে রইল। যেন থকথকে কাদার একটা সুড়ঙ্গের গভীরে ডুবে গেছে আর ওর চেহারাটা অদ্ভুতুড়ে রকমের হয়ে গেছে। কাউন্টারের ওপাশে উনুনের শিখার ওপরে তেল মাখানো কাঁচা মাংস পোড়ানোর শব্দ ওর কানে আসছিল না। ফ্রাইং প্যানের ওপর মাংস ঝলসানোর কটকট আওয়াজ ওর কানে ঢুকছিল না। ঝলসানো মাংসের গন্ধে ভারী হয়ে যাওয়া বাতাস ওর নাকে এসে ঢুকছিল না। ও ওভাবেই রয়ে গেছে, গভীর থেকে গভীরতর চিন্তার মধ্যে ডুবে যতক্ষণ না আবার মাথাটা নাড়াল যেন এইমাত্র তাৎক্ষনিক মৃত্যুর অন্ধকার থেকে ফিরে এল। তখনই লোকটাকে দেখতে পেল। আগুনের উদ্ভাসিত শিখায় উজ্জ্বল, সুখী।
“পেপিলো।”
“কি হল!”
“কি ভাবছো তুমি?”, ভদ্রমহিলা জিজ্ঞাসা করল।
“আমি ভাবছি একটা ছোট্ট সুখী সুখী ভালুক তুমি কোথায় খুঁজে পাবে?” জোসে বলল।
“সে আমি ঠিক পেয়ে যাব,” ভদ্রমহিলা বলল “কিন্তু আমি তোমার কাছে যেটা চাইছি সেটা হল একটা বিদায়ী উপহার।”
জোসে স্টোভের আগুনের শিখার ওপর থেকে ওকে দেখল।
“আমি কী বলব বুঝতে পারছি না,” ও বলল “খুব সুন্দর একটা স্টেকের বাইরেও তুমি কি অন্য আর কিছু চাইছ?”
“হ্যাঁ,” ভদ্রমহিলা বলল।
“বল কী চাও?” জোসে জিজ্ঞাসা করল।
“আমি তোমার কাছে আর একটা সিকি ঘণ্টা চাই।”
জোসে পিছনের দিকে ফিরে ঘড়ী দেখল। তারপরে কোনের দিকে নীরবে বসে থাকা খদ্দেরের দিকে তাকাল। এরমধ্যে মাংসটা ঝলসানো সম্পূর্ণ হয়ে গেল এবং তারপরেই ও মুখ খুলল “তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না রাণিসাহেবা।”
“বোকা বোকা কথা বল না জোসে,” ভদ্রমহিলা বলল “শুধু এটাই মনে রেখ আমি ঠিক সাড়ে পাঁচটা থেকে এখানে আছি।”

* পেসো– দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশগুলিতে চালু অর্থ-মুদ্রা
* পেপিলো – জোসে নামের লোকেদের আদরের ডাক

মূল গল্প La mujer que llegaba a las seis (লা মুজের কিউ লেগাবা আ লাস সিস) লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

 

 

 

 

চিরন্তন ভট্টাচার্য
জন্ম তারিখ : ০৭, ১২, ১৯৭১ ইংরেজী। পেশা : চাকুরিজীবী। নিবাস : যাদবপুর, কলিকেতা, ইণ্ডিয়া।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার