ইসলাম, সংস্কৃতি ও নববর্ষ || মোকাররম হোসাইন

0

প্রতিবছর নববর্ষের আগমনে ‘ইসলাম ও সংস্কৃতি’-প্রশ্ন মোটা দাগে হাজির হয়। বাঙালী মুসলমানের দুই শিবিরে বিভাজন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নববর্ষের এই দিনে তাই আলাপ করা যাক ইসলামে সংস্কৃতি প্রশ্নের মোকাবেলা কীভাবে হতে পারে এবং নববর্ষ ইস্যুতে বাঙালী মুসলমানের অবস্থান কী হতে পারে।

আরব সীমানায় যখন ইসলামের বিকাশ হচ্ছিল, তখন ইসলাম আরব সংস্কৃতির মিমাংসা করেই এগিয়েছিল। পয়গম্বর মুহাম্মদ ইসলামের মুলনীতির সাথে যেসব সংস্কৃতি সাংঘর্ষিক না, সেসব রেখা দিয়েছিলেন। আর যেসব সংস্কৃতিতে পৌত্তলিক উপাদান ছিল সেইসব থেকে পৌত্তলিক উপাদান পরিশ্রুত করে গ্রহণ করছেন। আবার ইসলাম যখন আরবের সীমানা ছেড়ে আমাদের বাঙলা মূলুকের মত অনারব বিশ্বে প্রসারিত হল তখন ইসলাম ও অনারব সংস্কৃতির মিমাংসা কেমন হবে সে প্রশ্ন হাজির হয়। হাজার বছরে বিকশিত বাঙালী সংস্কৃতি বাদ দিয়ে আরব সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করে যে ইসলামের বিকাশ তা কোন পরিবর্ত্তন ছাড়াই গ্রহণ করতে হবে, না রাসূলের পদ্ধতি অনুসরণ করে বাঙালী সংস্কৃতি থেকে পৌত্তলিক উপাদান বাদ দিয়ে ইসলামের বিকাশ এগিয়ে নিতে হবে?

সংস্কৃতি প্রশ্নে রাসূলের কর্ম্মপদ্ধতি অনুসরন একটা সমাধান হতে পারে। আর এবাদতের ক্ষেত্রে কর্ম্ম। এবাদত ও সংস্কৃতি এই দুই বিষয়ে একটার গুন আরেকটাতে হাজির থাকলেও এসেন্সের দিক থেকে দুইটা আলাদা প্রকরণ। নমায যেভাবে রাসূল পড়তেন, বাঙালী মুসলমান সেভাবেই পড়ে। কিন্তু তিনি সকাল-দুপুর-রাতে যা খেতেন মুসলমান বাঙালীরা ঠিক তা খায় না। যদিও হালাল খাবর খাওয়াকে এবাদত বলা হয়, কিন্তু খাবার খাওয়া নামাজ যে অর্থে এবাদত সে অর্থে এবাদত না। এবাদত হলে সব মুসলমানকেই খেজুর, যবের রুটি, দুম্বার গোস্ত খেতে হত। তো বাঙালী হিন্দুর সাথে মিলে গেলেই কোন কিছু বাতিল হয় না, যেমন বাতিল হয় নাই ভাত, মাছ খাওয়া। মাটির ঘরে থাকা। মেয়েদের শাড়ী। কিংবা ছেলেদের পাঞ্জাবী।

এমন কি অনেক এবাদত অন্য ধর্ম্মের সাথে মিলে যায় বলে ইসলামে বাতিল হয়ে যায় নাই। ইহুদিরা মহররমের রোজা রাখত বলে রাসুল সেটা বাদ দেন নাই। বরং বাড়িয়ে দুইটা রাখতে বলেছেন। ইহুদিদের পবিত্র রজনী ছিল। তেমনি ইসলামে আসছে শবে কদর। ইহুদিদের আযান, নমায, রোজার সাথে মিল আছে মুসলমানদের। অন্য ধর্ম্মের সাথে মিলে গেলেই বর্জ্জন ধারণাতে সুখ্যভাবে বর্ণবাদ লুকিয়ে থাকে। আর বর্ণবাদের যেকোন সম্ভাবনা ইসলাম বাতিল করে। ইসলাম যেসব ক্ষেত্রে অন্য ধর্ম্ম থেকে আলাদা হয়েছে, সেটা অন্য ধর্ম্ম থেকে সতন্ত্র হতে নয়। অন্য ধর্ম্মের বিরোধিতা করতেও নয়। বরং পৌত্তলিকতা, অপরিচ্ছন্নতা, কদর্য্যতা, নিষ্ঠুরতা সহ আরো বহুবিদ নেতিবাচক কারণ থাকে। এসব ক্ষেত্রে ইসলাম সব সময় পুরো বিষয়টাই বাতিল করে দেয় নাই বরং সংস্কার করে নিয়েছে।

এখন নববর্ষ উৎসব কি বাঙালী মুসলমান বর্জ্জন করবে? অবশ্যই না। যদি এ উৎসবে ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক কোন উপাদান থাকে তা পরিশ্রুত করেই নববর্ষ উদ্‌যাপনের নতুন ধারা পত্তন করা যেতে পারে। নববর্ষ উদ্‌যাপনে কোন পৌত্তলিক উপাদান আছে কিনা দেখতে হবে অবশ্যই।

সবচেয়ে বড় আপত্তিটা আসে মঙ্গল শোভাযাত্রা নিয়ে। এই শোভাযাত্রায় প্রাচীন পৌত্তলিক ধর্ম্মের প্রভাব আছে। অশুভ শক্তি যেন অমঙ্গল না করে, তাই পৌত্তলিক ধর্ম্মের অনুসারিগণ অশুভ শক্তির উপাসনা করত। এমনকি মানব বলিও দেয়া হত। আবার শুভ শক্তির উপাসনাও ছিল অশুভ শক্তি থেকে রক্ষা পাইতে। মঙ্গল শোভাযাত্রায় যে প্রতীকগুলা প্রদর্শন করা হয় সেইগুলার বেশীরভাগ অসুর, দেবতা ও তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট কিছু প্রাণীর অবয়ব। অমঙ্গল থেকে রক্ষা পাওয়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রায়। প্রশ্ন হল কিসের অমঙ্গলের আশঙ্কা? কে অমঙ্গল করবে? কেইবা রক্ষা করবে? আপনি কোন উত্তর পাবেন না। কারণ এই প্রশ্নের উত্তর পৌত্তলিক ধর্ম্মের শুভ/অশুভ ধারণা ছাড়া সম্ভব না। যারা মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে চায় তাদের সেই অধিকার অবশ্যই আছে। তাদের শোভাযাত্রা পালনে বাধা প্রধান অবশ্যই জুলুম।

যারা মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ গ্রহণ করবে না তারা চাইলে তাদের মত শোভাযাত্রা আয়োজন করতে পারে। শোভাযাত্রার নাম নবযাত্রা বা অন্যকোনো নাম দেয়া যেতে পারে। মঙ্গল প্রতীক সমূহের পরিবর্ত্তে বাঙালীর যাপিত জীবনের চিরায়ত প্রতীক যেমন লাঙ্গল, কুলা, ধান, ঢেঁকি, নৌকা, পালকী ইত্যাদি থাকতে পারে। বাঙালীর বিভিন্ন ধর্ম্মের উপস্থাপনাও থাকতে পারে। নতুন বছরে আল্লাহ বা ইশ্বরের কাছে অশুভ শক্তি থেকে মুক্তির আকাঙ্খা থাকতে পারে। এভাবে শোভাযাত্রাকে করে সর্ব্বজনীন, অসাম্প্রদায়িক করে তোলা যেতে পারে।

বাঙালী মুসলমান কট্টরপন্থার বারণ শুনে নববর্ষ উদ্‌যাপন যেমন ত্যাগ করে নায় তেমনি তার বৃহত্তর অংশ মঙ্গল শোভাযাত্রার মত পৌত্তলিক সংস্কৃতিতে তারা অংশগ্রহণ করে নায়। এতে বাঙালী মুসলমানের প্রজ্ঞার পরিচয় আছে।

সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।

 

 

 

 


মোকাররম হোসাইন
চিন্তক, কবি, শিক্ষক।
ইংরেজী বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। জন্ম: সন্দ্বীপ। নিবাস: চট্টগ্রাম, বাঙলাদেশ।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার