রামায়ণে আছে যে, রামচন্দ্র মিথিলার জনক রাজার গৃহে অবস্থিত হরধনুতে গুণ পরান ও সেই ধনু ভেঙ্গে দেন। তারপর জনকরাজার পালিতাকন্যা সীতার সঙ্গে রামের বিবাহ হয়। এখানে কেউ মনে করতে পারেন যে রামচন্দ্র বুঝি একটি বড় ধনুক ভেঙেছিলেন। আসলে ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। কাহিনীর বাইরের অর্থ একরকম, ভিতরের অর্থ অন্যরকম। এখানে কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তীর ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’ থেকে হরধনু ভঙ্গের প্রকৃত তাৎপর্য্য নিম্নে বর্ণনা করছি, অবশ্যই আমার যোগ্যতা অনুসারে।
হর মানে শিব। আমাদের দেশটিকে শিব ঠাকুরের দেশ বলে। হরধনু মানে সনাতন রীতি। হরধনুতে গুণ পরানো মানে সমাজের আইনকে বোঝা এবং তাকে ব্যবহার করার ক্ষমতা বলে বুঝতে হবে। রাম হরধনুতে শুধু গুণই পরাননি, তিনি সেই ধনু ভেঙে দিয়ে জনক রাজার ‘ধনুক ভাঙা পণ’ রক্ষা করেছিলেন। আজকের ভাষায় ‘ধনুক ভাঙা পণ’ মানে ‘আইন অমান্য আন্দোলন’ বলে বুঝতে হবে। হরি রামচন্দ্ররূপে অবতার হয়ে হরের আইন অমান্য করে নতুন যুগের সূচনা করেন।
কলিম খান ও রবি চক্রবর্ত্তীর মতে ঐতিহাসিক দিক থেকে বিচার করলে রামচন্দ্রের এই প্রগতিশীল কর্ম্ম বৌদ্ধভারতের প্রগতির সঙ্গে তুলনীয়। রামায়ণ হল পুরোহিতশ্রেষ্ঠ ‘রব কারয়িতা’ রাবণের রাজত্ব গিয়ে বৌদ্ধযুগের আগমন কাহিনী। সমাজের উৎপাদন কর্ম্মযজ্ঞ তখন কৃষি থেকে কুটীর শিল্পের দিকে ঝুঁকছে— জনক দুহিতা পাইকারী চাষী জনককে ছেড়ে কৌশল্যাপুত্র রামের বাড়ীতে আসছেন। এই প্রেক্ষিতে হরধনু ভঙ্গের ও রামায়ণের তাৎপর্য্যকে বুঝতে হবে।
রাম ও সীতার আসল পরিচয় কী? ঋগ্বেদে সীতাকে কৃষির দেবতা বলা হয়েছে। রামায়ণে আছে লাঙলের ফালের আগায় (শিরালে) সীতার জন্ম হয়েছিল। এসবের প্রকৃত মর্ম্ম হল সীতা বলতে অন্নদাতা কৃষিমজুরদের বুঝতে হবে। ওরাই লক্ষ্মী। সীতা তাই লক্ষ্মীর অবতার রূপে বর্ণিত। বিষ্ণুর অবতার রামচন্দ্র আসলে ক্রীড়াকারী পুঁজির (যে টাকা বাজারে খেলে, তার) প্রতিভু। কবিতার খাতিরে ক্রীড়াকারী পুঁজি ও অন্নদাতা কৃষকদের মানব-মানবী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। রামায়ণে ক্রিয়াগুলিই প্রধান, ব্যক্তিগুলি নয়। সীতার পিতা জনক। জনক মানে যে জন করে বা কৃষিমজুর করে পাইকারী চাষ করে। বিষ্ণু পুরাণে ৫২ জন জনক রাজার কথা আছে। মিথি তাদের মধ্যে প্রথম জনক। মিথি থেকে জনক রাজাদের রাজ্যের নাম মিথিলা হয়েছে। রাম ও সীতার বিবাহ কাজের যুক্তির প্রতীক।
কৃত্তিবাসী রামায়ণে আছে যে হরধনু ভেঙে দেওয়ার জন্য হর (শিব) রামের উপর মোটেই রাগ করেননি। এখানে হর বা শিব বলতে আমরা জ্ঞানের শিখা বাহক উদ্ভাবক ও আবিষ্কারক মানুষদের বুঝতে পারি। প্রাচীন সমাজকে গতি দেওয়ার জন্যই হরি (বিষ্ণু) রাম অবতার হয়ে হরধনু (সনাতন আইন) ভঙ্গ করেছিলেন। এই কাজ কবিদের দ্বারা প্রশংসিত হয়েছে।
এখন মৎপ্রণীত ও অপ্রকাশিত ‘ক্রিয়াভিত্তিক রামায়ণ’ গ্রন্থ থেকে বিষয়টির বর্ণনা করছি :
হরধনু এক সুবিশাল ধনু, হর তা ধরিতে পারে;
সে ধনুর্দ্ধর হরধনু দিয়ে রাজ্যশাসন করে।
হরধনু দিয়ে হর করিতেন দেশের শত্রু নাশ,
হর সেই প্রিয় ধনু রেখেছিল পরশুরামের পাশ।
সে পরশুরাম জনকদুহিতা সীতাকে করেন আশ,
সেই কথা শুনে জনক রাজা তো দেখিল সর্ব্বনাশ।
হরধনুখানি জমা করে দিয়ে জনক রাজার ঘরে,
জামদগ্ন্য চলিয়া গেলেন জপ করিবার তরে।
সে ধনুতে গুণ পরাইতে পারে যে আছে এমন জন,
তার হাতে সীতা তুলে দেব বলে ছিল জনকের পণ।
সীতা দেবী যবে মাল্যহস্তে হলেন স্বয়ংবরা,
কেহ হরধনু নড়াইতে নারে, বীরহীন বুঝি ধরা!
পরিশেষে রাম হরধনু ভেঙ্গে করে সীতা পরিণয়;
হরের আইন ভাঙিয়া যাইল, হইল হরির জয়।
রাম ও সীতার বিবাহ আসলে কর্ম্মের বন্ধন;
কৃষি মজুরেরা শিল্পে লাগিল, বাড়িল উৎপাদন।
হরধনুখানি ভাঙা গেল বলে হর তো অখুশী নন;
কিন্তু জামদগ্ন্য রাগিল, তিনি জাতে ব্রাহ্মণ।
রাম আর সীতা মিলে গেলে পরে সকলেই খুশী হয়,
পরশুরামের ব্রহ্মতেজের হয়ে গেল পরাজয়।
যুগ বদলায়, তাহার সহিত আইন বদল হয়;
বাদপ্রতিবাদ ঘটে কিছু, তবে শ্রেণীসংগ্রাম নয়।
হরি আর হরে হয় না বিরোধ, নাই বেশী গোলমাল;
ভেঙে সনাতন আইনকানুন, আসিল নতুন কাল।
এখন হরধনু ভঙ্গের ঐতিহাসিক তাৎপর্য্য সম্বন্ধে আপনাদের মতামত কাম্য। ধন্যবাদ।
শ্রী শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র
(বাঁকুড়া জেলার পাঁচাল গ্রামে আমার বাড়ী। আমি আকাশের তারা দেখতে ও ব্যাকরণ পড়তে ভালবাসি।)