অভিসার
সঞ্চরদধরসুধামধুরধ্বনিমুখরিতমোহনবংশম্
— জয়দেব (গীতগোবিন্দ/দ্বিতীয় সর্গ)এবার মলাট খুলে আমাকে পড় হে তুমি
এমন উলট-পালট, দুনিয়া কাঁপানো সে এক
প্রকট রাগিনী সুরে, আমাকেই উঠ গেয়ে।বাজো লো বাঁশির সুর বাজো তার ঠোঁটে,
অধর অমৃত তার সুরে সুরে আলোড়িত
আকাশে বাতাসে হায় ছুটে।একি অনটন, অনিশ স্বপন গেল টুটে,
কী এক শূন্যতা ভরা বুকে!
নিভে গেল প্রদীপের শিখা, নিষুপ্ত রজনী হায়
চুপি চুপি ছোটে পায়
কে গো বনপথে।চারিদিকে অন্ধকার, বিটপীর ফাঁকে ফাঁকে
বাসুকির ন্যায় যেন উঠে আছে ফুঁসে।কে গো ডাকে, ডাকে ঐ দূরে,
যতই আগায়ে যায় কী এক কুহকিজালে
আরও দূরে সরে যায়, বাঁশির সুরের ধ্বনি
ধায় পথে পথে,
বাজো লো বাঁশির সুর বাজো তার ঠোঁটে।
স্বপ্নের গভীরে এক স্বপ্ন
Is all that we see or seem
But a dream within a dream?
– Edgar Allan Poeতবু তুমি এসেছিলে
স্বপ্নের গভীরে আরও এক স্বপ্ন হয়ে
গাঢ় নীল অন্ধকারে ময়ূরের ডানা
তুমি তার অপর ঠিকানা।অলস রোদের থেকে ধীরে-
পৃথিবীকে গ্রাস করে নিল কেউ,
জানি, সে-ও এক ব্যথাতুর দৈন্যের সংঘাত,
তারই অমোঘ ইশারা জেনে তবে দুপুরবারান্দাজুড়ে
শুকাতে দিয়েছ তুমি পাখিদের দৃষ্টিভ্রম- অবারিত,তবু তুমি এসেছিলে, আরও একবার
স্বপ্নের গভীরে আরও এক সুগভীর স্বপ্ন হয়ে।
প্রেম
জেগে আছি
শুধু এইটুকু জেনে।
মৃত্যুকে ছুঁয়ে দেখে অলীক পরশে,
হা হা শূন্যতায়!যে মুখে দেখেছি আমি নিজেরই মুখের ছায়া,
তাতেও ভ্রান্তি ছিল যতটুকু,
কতটুকু ছিল নীড়-নির্জনতা?ছুটছে সমস্ত কিছু, ছুটে যাচ্ছে ঢেউ
জল- বাষ্পফেনা, মেঘ আর মেঘের সকাশে এসে
পাখিগুলি! এমন সহাস্য বেদনায় তুমিও আমার দিকে
ছুটে এসেছিলে। কাল-কর্ত্তব্য বিস্মৃত,
চোখের ওপরে শুধু চোখ পড়েছিল,
বেজেছিল আলস্য সংগীত!শুধু এইটুকু জেনে
জেগে আছি,
মৃত্যুকে ছুঁয়ে দেখে অলীক পরশে,
হা হা শূন্যতায়!
তমসাপ্রবঞ্চনা
যতগুলো দুর্গ আছে নারীর হৃদয়ে, তুমি আছ-
ঈর্ষা ও প্রণয়ের ছুরী;
বাসনার ব্যূহ ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে যারা,
যারা আজ বুদ্ধের মত পথ থেকে পথে, ঘড়ীর কাঁটার ন্যায়
ঘুরে ফিরে, গান গায়- নির্বেদ-নির্ব্বাণ,
সেইসব ব্যর্থ প্রণয় আমি, আমারই দেহের ভারে নত
কফিনের কাঠে লিখে দিয়ে যাব,
সেইসব রূপকথা- তোমাকে শোনাব!
তুমি এক মন্দ্র গোলাপ, কাঁটার বর্মে ঘেরা-অবিনাশী ফুল।এইসব বিক্রম তবু পরার্ধ কীটের মত
আত্মহননের পথে চিরকাল,
তোমারই জন্য যারা- যত প্রাণ- যতগুলো প্রশ্বাসে আছে
সমাপ্তির কঠোর নিয়তি,
যতটা উদ্যমে বাজে রণহুঙ্কার- তরবারি- যতগুলো অশ্বক্ষুরের ধ্বনি, এই প্রান্তরে-
কেউ জানলো না কেমন গোপনে তুমি চলে গেলে,
এইসব যুদ্ধ ও প্রলয় পেরিয়ে।আমিতো সামান্য হৃদয় নিজের ছায়ার মত
নিজেকেই করে গেছি চিরকাল তমসাপ্রবঞ্চনা।
নস্টালজিয়া
গোলাপের নির্জনতা বুকে টেনে নাও,
পাহাড়ী ঝর্ণার সুরে, সিক্ত হাওয়ায়
ভুলে যাওয়া গানে আর অশ্রুজলে
বিশ্রুত জীবনের কথকতা …যে রাতে স্বপ্ন দেখ তুমি,
সেইসব অরণ্য আর পথের ইশারা
ডেকে ডেকে চলে যায় দূরে,
ফিরে আসে পিঁপড়ের ঢিবি আর
বাতাসে দুলতে থাকা আঙুর লতায়
মিশে থাকা প্রণয়ের সমস্ত নির্য্যাস,আকাশের পেয়ালায় প্রজাপতি তার
রঙীন পাখনা ডুবিয়ে তৈরি করছে মদ,আর শুধু বাতাসের ক্রন্দন বাজে
গাছে গাছে, পাতায় পাতায়
তুমি লিখে রাখ সেইসব নাম,
বহুদিন পরে অবসরে কেবলই যাদের
মনে পড়ে যায়।
নদী
নদী পেরোলেই স্মৃতিগন্ধময় জমাট আঁধার,
সৌরকরোজ্জ্বল এই হাতছানি,
পাঁচটি আঙুল শুধু কার কথা বলে?
ক্ষুধার্ত্ত চিৎকারে মিশে যায় আমাদের স্পর্শের মর্ম্মর ধ্বনি-
বায়ু আর বায়ুহীনতার কূটাভাস, তরঙ্গমথিত দেহে ফিরে আসে।এই ঘুম, কবে আর চেনা হল সময়ের উদ্ভ্রান্ত চোখের!
ভ্রান্তির আজন্ম পরবাসে তাই গুম হয়ে থাকি,
তবু কেউ কেউ নদী মানে স্রোতের গিমিক শুধু মনে ধরে রাখে!
আহ্নিক জীবনের গতি
এই ধাবমান তারকার পিছে যতগুলো প্রার্থনা জুটে
তুমি তার অধিক ঈর্ষা নিয়ে ছুটে এলে,
জন্মবিন্দু হতে জীবনের অসীম পরিধি ঘুরে, অবশেষে
কাকে তুমি কেন্দ্র বলে মেনে নিলে …হে আহ্নিক জীবনের গতি, কোথায় রেখেছ তবে
তোমার সে একান্ত কৌণিক পরিসর?
গমন
কী গভীর মন্থর এই চলা- বেড়ালের মত অলস ও দাম্ভিক,
যতটা নৈঃশব্দ্য ধরে এই পদচারণায়, তার চেয়ে বেশী
স্থিতির গিমিক, অবলা-অচল অহঙ্কারে ভেঙে পড়তে চায়;সাবধানে প্রসারিত হয় পথ, যেন প্রতিটি পায়ের আঘাতে
মেপে দেখে, কতদূর স্পর্ধা পৃথিবীর নির্জন আহত বুকের ওপর
নির্দ্বিধায় বয়ে যেতে পারে, শুধু ক্ষত ধরে, ব্যথাহীন,
আমাদের দেহের ভেতরে চলে সীমাহীন নির্ব্বাক স্পন্দন।
অনুভয়
আমাকেও লুকিয়ে রাখ, সময়ের ক্ষুব্ধ পরম্পরায়,
তারই ঘূর্ণন পথে কেন্দ্রগামী ত্বরণের টানে যেই ব্যাসার্দ্ধ
ধরে রাখে বৃত্তের প্রকৃত চারণভূমি-
তারই মাঝে আরও কিছু অনর্থক নৃত্য দেখি,
দেখি চক্রাকারে ফিরে আসে রাত্রি ও দিন,
অথবা ঘড়ীর ডায়ালে কেউ রেখে দেয় বিভাজন!তবু তারওতো আবর্ত্তন আছে, আছে ঘুরবার সুখ
অবিরাম অবিরাম ঘুমের মন্থরতা।
নীরবতার সঙ্গীত
জলের নিপুণ থৈ থৈ হতে তুমি হে জলের দেবতা
কোন্ সে নবীন সঙ্গীত বাজালে সমুদ্রবেহালায়?
আমি তারই অন্ধ অনুচর, রাতভর তাই এই
নক্ষত্রবিভূতি?
এককোটি আলোকবর্ষ দূরে
অবশেষে নিঃশেষ হয়ে যেই তারা
নিজের আকর্ষণে কেবল নিজেরই ভেতর
গুটিয়ে যাবার ভান করে,
তার কাছে আরও কিছু অনর্থক গল্প শোনার বাকী ছিল,
আর ছিল সুগন্ধী মদ- সুরের পেয়ালা,
রেখে গেছে তারা শুধু শূন্য পয়ার, দ্বিধাহীন ছিন্ন মেঘের কাছে।
দেখি বাতাসে ভাসতে থাকা জলের কম্পন রেখা
ক্রমশ ভুলতে থাকে আমাদের
নিজস্ব বাতিঘরগুলো,
পথ ভুল করে চলে যেতে থাকে আরও দূরে,
গভীর সাগরে,
মৃত্যু যেখানে বসে আছে নীরবতার সমগ্র যুক্তী নিয়ে।
অনর্থযাপন
ঘরের ভেতরে আমি অন্য এক আকাশের ছবি দেখি,
জানালার পর্দ্দাগুলি চিরকাল গোপনতা খুঁজে।জানি, সমুদ্রশৈবাল কোনোদিন নিজের দেহের ভাঁজে
সমুদ্র খুঁজে না, তবু ধ্বসে পড়ে বালিয়াড়ি,
চকমকি ঠুকে কেউ আগুন জ্বেলেছে তবে?কারা আজ জলের গভীরে দিল ডুব,
তুলে আনে শঙ্খের গুঞ্জন, তবু দিগন্ত প্রাসারিত হলে চিরকাল-
দেখি রাত, প্রতিটি তারার ইশারা সরে যায় মৃত্যুর থেকে বহুদূরে…
তানভীর আকন্দ
জন্ম: ১৯৯৪, গফরগাঁও, মৈমনসিংহ।
আগ্রহের বিষয়: সাহিত্য, অনুবাদ, দর্শন, ঔপনিবেশিক ইতিহাস ও উপনিবেশায়ন।ই-মেইল:
tanvirakanda09@gmail.com