(ঁ, ং, ঙ, ণ, ন, ম)
“রুমাল বলতে পার, বিড়াল বলতে পার, চন্দ্রবিন্দুও বলতে পার।”
— হযবরল, সুকুমার রায়।
সংস্কৃতে বিন্দুরূপে ছিলেন অণুক্ষণ,
বাঙলাভাষায় হইল তাঁহার দ্বৈত বিভাজন।
অনুস্বর আর চন্দ্রবিন্দু হলেন লীলাময়;
বিন্দু থেকে সিন্ধু পাবে, শাস্ত্রে ইহা কয়। ।১।
বিন্দু আছেন অনুস্বরে, নন তিনি অংবং;
অনুরূপা তিনি, বিন্দুরূপিণী, বড় তেজোময় অম্!
চন্দ্রবিন্দু বিন্দুসিন্ধু, কী অসীম লীলা তাঁর—
সকল ধ্বনির সকল সুরের, জগতের মূলাধার ।২।
“ব্যঙ্গে রঙ্গে ভ্রুকুটি ভঙ্গে সঙ্গীত কলরবে
রণহুঙ্কারে ধনু টঙ্কারে শঙ্কিত কর সবে।
বিকল অঙ্গ, ভগ্নজঙ্ঘ, এ কোন্ পঙ্গু মুনি?
কেন ভাঙা ঠ্যাঙে ডাঙায় নামিল বাঙালা মুলুকে শুনি।” ।৩।
ও হে সুকুমার, প্রশ্ন তোমার মন্দ মোটেই নয়—
বাঙলা ভাষার ঙ বর্ণটি বড় রহস্যময়।
ক-খ-গ-ঘ-দের সঙ্গে থাকিয়া করে অদ্ভুত ক্রিয়া;
শুধু ঙ নয়, ঞ-ণ-ম-য়ে বাস করে যোগমায়া। ।৪।
প্রতি বর্গের পঞ্চমে হয় অঙরূপিণীর ক্রিয়া;
তাঁরা কী করেন, কী রূপ ধরেন, ভাব তুমি ধ্যান দিয়া।
ঙ তবু ধ্যানে ধরা নাহি দেয়, তাঁকে বোঝা নয় সোজা;
ঞ-টাকে চেনা তার চেয়ে সোজা, পিঠে বয় কার বোঝা। ।৫।
ট,ঠ,ড,ঢ-দের সঙ্গে আসিলে একটু প্রকট হন—
মূর্ধণ্য-র মাথাকাটা, তবু করিছে টঙ্কারণ।
ন হইয়া গেলে সে যোগমায়ার ঘুম ভাঙে সেই ক্ষণ;
ন-এ সূচনা ও সমাপন হয়, ম-এ হয় সীমায়ন। ।৬।
খাই-এ জুড়ে দিই চন্দ্রবিন্দু, খাঁই শব্দটি পাই;
অসীম ক্ষুধার আধার হইয়া ক’রে ওঠে ‘খাঁই খাঁই’।
রাক্ষসদের ক্ষুধা তো অসীম, ওরা বলে ‘হাঁউ মাঁউ’;
মানুষ মরিয়া অসীমে যাইলে চন্দ্রবিন্দু তাও ।৭।
বিসর্গতে বিসর্জ্জন হয়, বর্ণমালার শেষ;
বিন্দু দিয়ে সে হয়েছিল শুরু, বিসর্গে নিঃশেষ;
সর্গ মানে সৃষ্টি বুঝ, বিসর্গে তার ক্ষয়;
নির্য্যাস ত্যাগ করে পরে বিসর্গ পায় লয়। ।৮।
টীকা—
১। সংস্কৃতের বিন্দু বাঙলায় অনুস্বর ও চন্দ্রবিন্দুতে বিভাজিত। সংস্কৃতে অনুস্বর ও চন্দ্রবিন্দু নাই, শুধু বিন্দু আছে।
২। সমস্ত বর্ণ ও শব্দের মূলে আছে অঙরূপিণী বা বিন্দুরূপিণী। একে বোঝা শক্ত হলেও অনুস্বর, চন্দ্রবিন্দু, ঙ, ঞ, ণ, ন, ম প্রভৃতি বর্ণে (প্রতি বর্গের পঞ্চমে) অঙরূপিণী নিজেকে কিছুটা প্রকাশ করে। বঙ্গীয় শব্দকোষ ও সরল শব্দকোষ থেকে অঙরূপিণী শব্দের অর্থ উদ্ধৃত করা হচ্ছে।
অঙরূপিণী [অংরূপ+ইন্ (ইনি) অস্ত্যর্থে+ঈ] অম্ (সূক্ষ্ম)-রূপযুক্তা, অনুরূপা, বিন্দুরূপা (যোগমায়া)।
— “বঙীয় শব্দকোষ”।
অংরূপিণী= যে সক্রিয় আধার অং-এর রূপ লাভ করিয়া চলমান থাকে; অথবা, (সিন্ধুর বিন্দুরূপের ন্যায়) ং-রূপ (বা বিন্দুরূপ) যে অখণ্ড প্রকৃতির; অথবা, অং উচ্চারণ করিয়া মনে মনে তাহা হইতে অ বাদ দিলে যে ধ্বনি বা শব্দকণা (শব্দবিন্দু) থাকিয়া যায়; কিংবা, যাহা (যে রূপবিন্দু) পর পর যোগ করিলে রেখা, রেখা যোগে তল, তল যোগে জগতের সকল ঘনবস্তুসমূহের জন্ম হইতে পারে বা হইয়া থাকে …; কিংবা এইভাবে যে শব্দ-স্পর্শ-রূপ-রস-গন্ধ-এর সারস্বত রূপ বিন্দু হইতে পঞ্চভূতময় এই অখণ্ড জগৎ উদ্ভূত হইয়াছে। অনুরূপা, বিন্দুরূপিণী, অখণ্ড তেজরূপিণী। — “সরল শব্দার্থকোষ”।
৩। এই স্তবকের চারটি চরণ সুকুমারের “শ্রীশ্রীবর্ণমালাতত্ত্ব” থেকে উদ্ধৃত। কবি এখানে ঙ বর্ণটির অর্থ বুঝতে চেষ্টা করছেন কিন্তু খেই পাচ্ছেন না।
৪। অঙরূপিণী ক-বর্গে ঙ-রূপে যুক্ত হয়। ঙ ও ক এবং ঙ ও গ বর্ণের মিলনে যুক্তাক্ষর হয়। চ-বর্গের বর্ণগুলির সঙ্গে অঙরূপিণী সর্ব্বদা ঞ-রূপে যুক্ত হয় (ঞ্চ, ঞ্জ)। মায়া মানে প্রযুক্তি, (টেকনোলজি), যোগমায়া মানে কর্ম্মরত প্রযুক্তি বুঝতে হবে। এই বইয়ের ‘যুক্তি’ কবিতায় যোগমায়া শব্দের বিস্তারিত অর্থ বলা হয়েছে। ভাষা-প্রযুক্তিতে ঙ, ঞ ইত্যাদি বর্ণগুলি যে যেমন ভাবে কাজ করে চলে তা বুঝে ওঠা এবং ভাষায় ব্যক্ত করা খুব শক্ত। পাঠক সঙ্গে থাকুন।
৫। ঙ ও ঞ বর্ণে অঙরূপিণীকে সহজে বুঝা না গেলেও ণ, ন, ম-এর অর্থ ধীরে ধীরে আরও পরিস্কার হয়। ণ-এ সে কিছুটা ব্যক্ত। ন ও ম-এর অর্থ তো বেশ পরিস্কার করে বুঝা সম্ভব। ঙ, ঞ, ণ দিয়ে শব্দ শুরু হয় না। ন ও ম-এর অর্থ তো বেশ পরিস্কার ক’রে বুঝা সম্ভব। ঙ, ঞ, ণ দিয়ে শব্দ শুরু হয় না। ন ও ম দিয়ে বহু শব্দ শুরু হয়।
৬। ট-বর্ণে টঙ্কারণ ক্রিয়া হয়। ট-বর্গের শেষে আছে অঙরূপিণী-ণ। ণ-বর্ণের অর্থ “টঙ্কার রহস্য।” ন-বর্ণে না-করণ বা অন-করণ হয়। ম-বর্ণে মিতকরণ বা সীমায়ন ক্রিয়া হয়। এইসব বর্ণগুলির অর্থ আমরা ধীরে ধীরে পরিস্কার করে বলব।
৭। চন্দ্রবিন্দু বর্ণটি অসীমতা ও রহস্যময়তার দ্যোতক। সুকুমারের হযবরল-এর রহস্যময় বিড়ালটা বলেছিল যে তাঁকে চন্দ্রবিন্দুও বলা যেতে পারে।
৮। হরিচরণবাবুর অভিধানে বিসর্গ, (বি + সৃজ্ + অ) শব্দটির অর্থ বিসর্জ্জন, মোচন, ত্যাগ, দান, মোক্ষ, মলত্যাগ মুক্তি ইত্যাদি। সংস্কৃত বর্ণমালা বিসর্গে শেষ হয়। বিসর্গ্ বর্ণের অর্থ বিসর্জ্জন।
শ্রী শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র
(বাঁকুড়া জেলার পাঁচাল গ্রামে আমার বাড়ী। আমি আকাশের তারা দেখতে ও ব্যাকরণ পড়তে ভালবাসি।)