স্বস্তিকা চিহ্নের আদ্যোপান্ত || চলন্ত সরকার

0

মানুষ স্বভাবগতভাবেই প্রতীক বা চিহ্ন ভালবাসে। এই চিহ্ন ব্যবহার কবে থেকে মানুষ শুরু করেছে তার কোন নির্দ্দিষ্ট সময়সীমা নির্দ্ধারণ করা সম্ভব নয়, মানুষ নানা কারণে নানা ধরণের প্রতীক বা চিহ্ন ব্যবহার করে আসছে সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে। মানুষের কাছে চিহ্ন বা প্রতীক বিশেষ গুরুত্ব বহন করে প্রাচীন কাল থেকেই। কোন্টা মঙ্গল, কোন্টা অমঙ্গল, কোন্টা করণীয়, কোন্টা করণীয় নয়, কোন্ জায়গায় যাওয়া যাবে বা কোথাও যেতে মানা, শিকারে নিষেধাজ্ঞা বা শিকার করা যাবে ইত্যাদি নানা কাজেই মানুষ চিহ্ন বা প্রতীক ব্যবহার করে সুপ্রাচীন কাল হতে। এইসব প্রতীক মানুষ কালক্রমে জীবনের সাথে অঙ্গীভূত করে নেয়। গৃহে, আসবাবপত্রে, গয়নায়, অস্ত্রে, এমনকি আধ্যাত্মিকতা ও পবিত্রতার সাথে একীভূত হয় যায় এসব প্রতীক।

মানুষের ইতিহাসে অসংখ্য চিহ্ন বা প্রতীক ব্যবহারের প্রমাণ নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও সাহিত্য থেকে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ও বহুল প্রচলিত প্রতীকের অন্যতম হল স্বস্তিকা। মানুষ বসবাস করেছে এমন অনেক জায়গায় স্বস্তিকা চিহ্নের কোন-না-কোন ব্যবহার রয়েছে এমন প্রমাণ মিলেছে। স্বভাবতই আগ্রহ জাগে এই চিহ্ন পৃথিবীব্যাপী এত ছড়িয়ে থাকার কারণ কি? কোথা থেকে এই চিহ্নের উৎপত্তি? পৃথিবীর নানা প্রান্তে এই চিহ্ন কি একই মানে বহন করে নাকি ভিন্নতা রয়েছে? সব প্রশ্নের উত্তর এখন পর্য্যন্ত গবেষকেরা সুনির্দ্দিষ্টভাবে দিতে সক্ষম হননি, ভবিষ্যতে পারবেন এটা আশা করা যায়।

স্বস্তিকা শব্দটি সংস্কৃত ভাষার, সাধারণ অর্থে কল্যাণ, শুভ, মঙ্গল ইত্যাদি অর্থ বহন করে শব্দটি। শব্দটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সু অর্থ শুভ বা ভাল, অস্তি হল অস্তিত্ব এবং অনুসর্গ কা যোগে গঠিত। এই শব্দের প্রথম উল্লেখ মেলে ঋগ্বেদে, তারপর পাণিনি তার অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণে এই শব্দের উল্লেখ করেন। সংস্কৃতে এর ব্যবহার অস্তিবাচক চিহ্ন ও কল্যাণ রূপে। জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্স মুল্যার স্বস্তিকা শব্দ ব্যবহারে আপত্তি জানিয়েছিলেন হেনরিখ শ্লিম্যানকে লেখা পত্রে, তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে তাতে এই চিহ্নকে ভারতে উদ্ভব বলে ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। স্বস্তিকা চিহ্নকে বিশ্বে বিভিন্ন অঞ্চলে ও বিভিন্ন ভাষায় নানা নামে ডাকা হয়, যেমন, ফিলফট, গ্যামাডিওন, টেট্রাসকেলিওন, ক্রস ক্রাম্পোন, খাস, ওয়াঞ্জি, মানজা, হাকেন ক্রুজ ইত্যাদি।

স্বস্তিকা চিহ্নকে প্রথম পবিত্রতা ও আধ্যাত্মিকতার সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে সম্ভবত ভারতে। ভারতে দুই ধরণের স্বস্তিকা চিহ্নের ব্যবহার রয়েছে, ঘড়ীর কাটার দিক মুখ করে থাকা স্বস্তিকা ইতিবাচক তথা কল্যাণের প্রতীক, ঘড়ীর কাটার বিপরীতে থাকা স্বস্তিকা তান্ত্রিক ও রণচণ্ডী কালীর প্রতীক। স্বস্তিকা চিহ্নকে ভারতীয় পুরাণে ব্রহ্মার চার মুখের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এর চারটি বাহুকে মনে করা হয় ব্রহ্মার চার মুখ, যা চারদিক ব্যাপ্ত করে আছে, অর্থাৎ যা সর্ব্বদিকে পরিব্যাপ্ত করে আছে। এটি জিউস, বালদেব, সূর্য্যদেব, অগ্নিদেব, ইন্দ্র, আকাশের দেবতা, এমনকি সকল দেবতার দেবতা মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও নিয়ন্তার প্রতীক হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। স্বস্তিকা চিহ্নকে হিন্দুদের ত্রিদেব— ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিবের প্রতীক হিসেবেও দেখানো হয়েছে, অর্থাৎ সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের প্রতীক এই স্বস্তিকা। বৌদ্ধধর্ম্মে ও জৈনধর্ম্মেও স্বস্তিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন। গৌতম বুদ্ধের বুকে ও পায়ে ও বিভিন্ন বৌদ্ধ পান্ডুলিপিতে এই চিহ্ন চিহ্নিত রয়েছে। জৈন তীর্থঙ্ককরদের সাতজন এই চিহ্ন বহন করেন। প্রাচীন পারসিক ধর্ম্ম জরোথুস্ত্র ধর্ম্মেও স্বস্তিকার ব্যবহার রয়েছে সূর্য্য, প্রাণ ও অসীমের প্রতীক হিসেবে। প্রাচীন তিব্বতের ধর্ম্মমত বন ধর্ম্মেও অত্যন্ত পবিত্র চিহ্ন হিসেবে সম্মান করা হয় স্বস্তিকা চিহ্নকে।

স্বস্তিকা চিহ্নের বিষয়ে বলা যায় যে, প্যালেওলিথিক ও নিওলিথিক যুগে কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া গেলেও এর ছড়িয়ে পড়া বা বহুল ব্যবহার শুরু হয় ব্রোঞ্জ যুগ ও তার পরবর্ত্তী সময়কাল থেকে। এখন পর্য্যন্ত পাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায়, সবচেয়ে প্রাচীনতম স্বস্তিকা চিহ্ন হচ্ছে ইউক্রেনের মেইনে পাওয়া ম্যামথ হাতির দাঁতে খোদিত স্বস্তিকা, যার বয়স মোটামুটিভাবে ১২০০০ বছরের মতো! অর্থাৎ ১২০০০ বছর আগে মানুষ এই চিহ্ন ব্যবহার করত।

ইরানে এই চিহ্ন পাওয়া যায় ৭০০০ খ্রিস্ট পূর্ব্বাব্দে পাথরের গায়ে অঙ্কিত অবস্থায়। বুলগেরিয়ার একটা গুহায় চিত্রিত হয় ৬০০০ খ্রিস্ট পূর্ব্বাব্দে। সামারা ও সিন্ধু সভ্যতায় দেখা মেলে ৩০০০ খ্রিস্ট পূর্ব্বাব্দে। হিসারলিকে পাথরের টুকরোতে, গ্রিস সাইপ্রাসে মাটির পাত্রে, ইতালিতে মার্বেল পাথরে ও সিরামিক পাত্রে, জার্মানিতে ব্রোঞ্জ পাতে, স্ক্যান্ডিনেভিয়াতে বিভিন্ন অস্ত্রে, গহনায়, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ডে পাথর কেটে ইংল্যান্ড, ফ্রান্সে ব্রোঞ্জের গহনায় স্বস্তিকা চিহ্নের দেখা মেলে।

পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে স্বস্তিকা চিহ্নের ব্যবহার দেখা গেলেও এই চিহ্নটি বিশেষভাবে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ব্যবহার করেন ভারতীয়রাই। স্বস্তিকা চিহ্ন নিয়ে নতুনভাবে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদ হেনরিখ শ্লিম্যান, এর সাথে মহাকবি হোমারের একটা যোগ আছে। তিনি হোমারের ‘ইলিয়াড’ কাব্যকে গবেষণার উপকরণ হিসেবে ধরে নিয়ে এই কাব্যে বর্ণিত স্থান সন্ধানে ব্রতী হন। তিনি এই কাজে ব্রতী হবার পর অনেকেই তাকে পাগল ভেবেছেন একারণে যে প্রাচীন মহাকাব্যে বর্ণিত বিষয়কে তিনি বাস্তব বলে ভেবেছেন। কিন্তু ১৮৭১ সালে ইজিয়ান সাগর তীরবর্ত্তী তুরস্কে তিনি তার কাঙ্ক্ষিত শহরের সন্ধান পেয়ে যান! হোমার বর্ণিত শহর ট্রয় বাস্তবে ছিল তা তিনি পৃথিবীকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন! এই শহরে অনেককিছুর সাথে তিনি পেয়ে যান স্বস্তিকা চিহ্ন, যা জার্মান প্রত্নতত্ত্ববিদদের অবাক করে। তারা জার্মানিতে প্রাপ্ত স্বস্তিকার সাথে এই স্বস্তিকার মিল লক্ষ্য করেন। তারা শুরু করেন প্রাচীন ইতিহাসের সন্ধান, নতুনভাবে। আর্য্য নামে পরিচিত গোষ্ঠীর সাথে তারা নিজেদের একাত্ম করে নেন,তারা নিজেদের প্রাচীন আর্য্যদের উত্তরপুরুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। এই পালে হাওয়া লাগায় ১৯ শতকের ফরাসী অভিজাত ও ঔপন্যাসিক আর্থার ডি গ্যোবিন্যুর আর্য্য শ্রেষ্ঠত্বের তত্ত্ব, তিনি জার্মানদের রক্তে প্রাচীন আর্য্যদের রক্ত বহমান বলে জানান। এরই ধারাবাহিকতায় জার্মান জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে জার্মান জাতির অহমে খুব চোট লাগে। তারা নিজেদের ভাবত শ্রেষ্ঠ মানুষের বংশধর হিসেবে আর তারাই কিনা এমনভাবে পরাজিত হল!

এর পরের ইতিহাস মোটামুটি সবারই জানা। স্বস্তিকা চিহ্নকে জার্মানদের একান্ত করে নেবার পালা এবার জার্মানদের। তাদের সেই যাত্রা শুরু ইতিহাসের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি এডলফ হিটলারের হাত ধরে। হিটলার প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই স্বস্তিকা চিহ্নকে পতাকায় স্থান দেবার কথা তার আত্মজীবনী ‘মাইন কেম্ফ’-এ উল্লেখ করেন। হিটলার জার্মান জাতীয়তাবাদ ও দেশের দুরবস্থার সুযোগ কাজে লাগিয়ে জার্মানির শাসনক্ষমতায় বসেন ১৯৩৩ সালে। ১৯৩৫ সালে জার্মানির নতুন পতাকার ডিজাইন অনুমোদন করেন, তার সেই লাল কাপড়ে সাদা গোল অংশে স্বস্তিকা চিহ্নিত পতাকা! এবার যেন হিটলার স্বস্তি পেলেন। ধীরে ধীরে স্বস্তিকা চিহ্ন হয়ে ওঠে নতুন জার্মানির প্রতীক, পার্টি অফিস, কুচকাওয়াজ, সামরিক বাহিনির পোশাকে যানবাহনে, নৌযানে এই চিহ্ন চিত্রিত হতে থাকে। নাৎসি জার্মানি বললেই যে প্রতীক চোখে ভেসে ওঠে সেটা স্বস্তিকা চিহ্ন! যে চিহ্ন আবহমান কাল ধরে বিবেচিত হয়েছে সত্য-ন্যায়ের প্রতীক হিসেবে সেই প্রতীক নাৎসী জার্মানির দ্বারা হয়ে গেল নৃশংসতা, অত্যাচার, বিভীষিকার প্রতীক। তাই বিশ্বযুদ্ধ পরবর্ত্তী সময়ে জার্মানিতে নিষিদ্ধ করা হয় স্বস্তিকা চিহ্ন।

ভারত, নেপাল, মঙ্গোলিয়া, তিব্বত, ইন্দোনেশিয়া, জাপান, চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ডে, ইউক্রেনে আজও স্বস্তিকা চিহ্ন বহন করে তার প্রাচীন বৈশিষ্ট্য; সত্য, ন্যায়, শুভ, পবিত্রতা, মঙ্গলের প্রতীক হিসেবে আজও এইসব দেশের লোকেরা তাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণে ও ধর্ম্মাচারণে স্বস্তিকা চিহ্ন ব্যবহার করে।

 

সহায়ক গ্রন্থ ও উৎস :
১. The Swastika, The Earliest Known Symbol, And Its Migration, with Observation of Tje Migration of Certain Industries in Prehistoric Times — Thomas Wilson.
২. Exploreing the pattern and ideogram of Swastika : A universal principle of sustainablity — SanDHI The Science and Heritage Institute, Indian Institute of Technology, Kharagpur.
৩. The Swastika : Constricting the Symbol — Malcolm Quinn.
৪. The Science of Swastika — Bernard Mess.
৫. Indian Mythology : Tales, Symbols, and Rituals from the Heart of the Subcontinent — Devdutt Pattanaik.
৬. The Ancient symbol of Swastika, its Distortion, uses and Missuses — Sekhar Chakrabarti.
৭. Wikipedia

ছবি: Exploring the pattern and ideogram of Swastika: A universal principle of sustainability — SanDHI The Science and Heritage Institute, Indian Institute of Technology, Kharagpur

 

 

 


চলন্ত সরকার
জন্ম : ১ এপ্রিল ১৯৯২, মৈমনসিনংহ।
আগ্রহের বিষয় : মিথলজি, তুলনামূলক সাহিত্য, পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব।
পড়াশোনা : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল। বাংলা ভাষা সাহিত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর।

শেয়ার করুন

মন্তব্য

টি মন্তব্য করা হয়েছে

Leave A Reply

শেয়ার