(বাস্তব নয়, তবে সত্য হতে পারে)
[মিমেসিস (Mimesis) কে বলা যেতে পারে ‘প্রকৃতির আয়না’। প্রাচীন এই গ্রীক শব্দটির গ্রহণযোগ্য বাংলা প্রতিশব্দ হতে পারে ‘অনুকরণ’। অনুকরণ বললে আবার নিন্দাসূচক অর্থে কোন কিছুর ‘শুধু মাত্র কপি’ করার ব্যাপারটাও চলে আসে। ‘রূপায়ণ’ বললেও যথেষ্ট বলে মনে হয় না। মিমেসিস প্রকৃতপক্ষে আরো বেশী অর্থ বহন করে। Stephen Halliwell তাঁর The Aesthetics of Mimesis: Ancient Texts and Modern Problems (২০০২) পুস্তকে বলেন, ‘The concept of Mimesis lies at the core of the entire history of Western attempts to make sense of representational art and its values.’ বাস্তবধর্ম্মী শিল্প ও শিল্পের মান নিরূপণ অনুধাবন প্রয়াসের পুরো পাশ্চাত্ত্যের ইতিহাসের কেন্দ্রে মিমেসিসের ধারণাটি নিহিত। ধারণাটি একই সাথে সাথে বুনিয়াদী এবং ভয়ংকররকম পিচ্ছিল।]
সাহিত্য দরজার চাবী
মিমেসিস (Mimesis) থেকে উদ্ভূত সমস্যাটি স্থায়ী, চিত্তাকর্ষক, এবং সবশেষে বলা যায় অমীমাংসিত। সাহিত্য কি ‘সত্য’ না ‘মিথ্যা’? সাহিত্য, অবশ্যই, উভয়ই। অথবা সত্য বা মিথ্যার একটিও না— কেউ কেউ তর্ক জুড়ে দেবেন প্রশ্নটিই আসলে ভুল, ক্যাটেগরি এরর (যেমন, ‘উত্তর মেরুর উত্তরে কি আছে?’ টাইপ প্রশ্ন)। সাহিত্য সমালোচনায় মিমেসিসের ধারণা প্রথম তোলেন এরিস্টোটল তাঁর অসম্পূর্ণ গ্রন্থ পোয়েটিক্সে। পুস্তকের নাম পোয়েটিক্স (Poetics) মানে এই না যে বিশেষভাবে এখানে শুধু কবিতার কথাই বলা হয়েছে, বরং সব ধরনের সৃষ্ট সাহিত্যের কথা বলে। শাদা কাগজের ওপর কালো কালো চিহ্নেরা অথবা কর্ণকুহরে শব্দেরা কীভাবে মহাকাব্য (যেমন ওডিসি) হয়ে যায় সেই রহস্যময় প্রক্রিয়া এরিস্টোটলকে বিমোহিত করেছিল।
মিমেসিসের সবিস্তার সমর্থনে যে ভাবে (মিমেসিস) এর মধ্যে কৌশলটিকে কাজে পরিণত করা হয়, এরিস্টোটল এমনকি তাঁর চেয়ে ভারিক্কি দার্শনিকের সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করছিলেন। সর্ব্বজনবিদিত যে, মহামতী প্লেটো তাঁর রিপাবলিক গ্রন্থে আদর্শ রাষ্ট্র গঠনতন্ত্রে কবিদের নির্ব্বাসিত করেছিলেন। তিনি তাঁদের ‘অনুকরণ’ এর নান্দনিক গুণের প্রশংসা করেন, কিন্তু তাঁদের সৃষ্টকর্ম্মকে সহজাতভাবে অগভীর, অসত্য, এবং আত্মগত বলে উড়িয়ে দেন (তিনি ঘোষণা দেন, গলায় মালা পরিয়ে শহরের গেটের বাইরে কবিদের বের করে দেওয়া উচিৎ। তাঁদের উচিৎ জনগণের কাছ থেকে দূরে চলে যাওয়া)। এই প্রসঙ্গে সাহিত্য সমালোচক মার্ক এন্ডমুন্ডসনের Literature against Philosophy, Plato to Derrida (১৯৯৫) গ্রন্থে সরস উক্তি, ‘Literary criticism in the West begins with the wish that literature disappears.’
প্লেটোর মতে, সাহিত্য হচ্ছে নিছক বাস্তবতার ছায়া ছাড়া আর কিছু নয়। সত্য দার্শনিক-রাজার জানার বিষয়, শিল্পী-সাহিত্যিকদের নয়। তার চেয়েও জঘন্য হল, কবিতা শুধুমাত্র আবেগীয় প্রতিক্রিয়া অনুপ্রাণিত করে, যুক্তিসঙ্গত কোন কিছুতে নয়। মিমেসিস ‘মনোহর মিথ্যা’ সৃষ্টি করে। মিমেসিস বদ সিধান্ত ও নিকৃষ্ট জীবনযাপনের দিকে ধাবিত করে। জীবনের জন্য প্রয়োজন ঠান্ডা মাথা আর স্বচ্ছ দৃষ্টির। (অতএব শিল্প সাহিত্য ধুয়ে পানি খেয়ে কোন ফায়দা নেই।)
প্লেটোর যুক্তি নিরসন
এরিস্টোটল সাহিত্য ও সত্য বিষয়ক প্লেটোর প্রথম আপত্তি চমকপ্রদভাবে নিরসন করেন। মূলত, যিনি ছুরী তুলেছিলেন ফলা তাঁর দিকেই ঘুরিয়ে দেন। তিনি তুলে ধরেন, সাহিত্যিক কলা (মহাকাব্য, ট্রাজেডি, কমেডি, গীতিকবিতা) অপ্রত্যাশিত কোন ঘটনা এবং নিছক এলোমেলো ইতিহাস দিয়ে শৃঙ্খলিত নয়; অতএব, সৃষ্টির স্বাধীনতা নিয়ে সাহিত্যকর্ম্ম অপরিহার্য্য, চিরন্তন অথবা উচ্চতর সত্য প্রকাশ করতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, আনা কারেনিনা নামে কোন নারী ছিল না যিনি পরকীয়া করেছিলেন, পরিবার ফেলে এসেছিলেন, এবং একটি রেলস্টেশনে এসে আত্মহত্যা করেন। তিনি কাল্পনিক। কিন্তু যে বিবৃতি দিয়ে তল্স্তোয়ের উপন্যাসটি শুরু হয়— “প্রতিটি সুখী পরিবার একই রকম; প্রতিটি অসুখী পরিবার তাদের মতো করে অসুখী” বাক্যটির আরেকজন উপন্যাসিক তাঁর গল্পের শুরুতে বলা ‘একটি সার্ব্বজনীন স্বীকৃত সত্য’-এর মর্য্যাদা পায়। গল্প/উপন্যাস, এই যুক্তিতে বলা যায়, বাস্তবের চেয়েও সত্য। গল্প/উপন্যাস/কবিতা আমাদের বাস্তবতার গভীরে নিয়ে যায়। (অতএব,) সমাজের (উত্তম সাহিত্য প্রয়োজন), সাহিত্যের সত্য প্রয়োজন।
প্লেটোর দ্বিতীয় আপত্তির বিষয়ে এরিস্টোটলের যুক্তি হল— অনুকরণমূলক শিল্প ও সাহিত্য অতিরিক্ত আবেগ জাগায় (যেমন, টাইটানিক সিনেমায় লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিওর মৃত্যু দৃশ্য দেখে বুক ফেটে যায়, চোখে জল আসে, কিন্তু সিনেমা হলের বাইরে কানা-খোড়া ভিক্ষুক দেখে করুণা হয়না)— এটা অতোটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এরিস্টোটল মেনে নেন, শিল্প সাহিত্য আমাদের আলোড়িত করে যা শিল্প সাহিত্যের অস্তিত্বের অন্যতম একটা মুখ্য কারণ। এরিস্টোটল লিপিবদ্ধ করেন, ট্রাজেডি দেখতে দেখতে এথেন্সের মহিলাদের গর্ভপাত হত, ছেলেরা মুর্ছা যেত। কিন্তু যে আবেগ ট্রাজেডি জন্ম দেয়, তিনি যুক্তি দেখান, তা ‘বিশুদ্ধিকারক’ (cathartic), (দর্শকের আবেগকে বিশুদ্ধ করে এমন) আবেগ।
মিমেসিসের মতো ক্যাথারসিস (Catharsis) শব্দটিরও সহজে অনুবাদ করা দুঃসাধ্য। শব্দটির অর্থ ‘বিশোধন’ হতে পারে অথবা ‘পরিষ্কারক’। অথবা আরো প্রাসঙ্গিকভাবে বললে, আমাদের আবেগসমূহের ভেষজ নিরাময়। এই প্রসঙ্গে প্রায়শই জন মিল্টনের Samson Agonistes থেকে এই কথাটি স্মরণ করা হয় : ‘calm of mind, all passion spent’। আপাতবিরোধী মনে হলেও, শিল্প আমাদেরকে জাগিয়ে তোলে, কিন্তু রেখে যায় কম, বেশী নয়, আবেগী এবং অপেক্ষাকৃত ভাল, আর যৌক্তিক সিধান্ত নিতে সক্ষম করে। অন্যকথায়, প্লেটোর উচিৎ মন পরিষ্কার করার উপায় হিসেবে শিল্প-সাহিত্যকে স্বাগত জানানো।
ক্যাথারসিস তত্ত্বের সমস্যা
ক্যাথারসিস একটা দারুণ ব্যাপার কিন্তু এর মধ্যেই কিছু হাতের মারপ্যাচ আছে। সাহিত্যের সমর্থনে ক্যাথারসিসের বিরুদ্ধে একটা আপত্তি হল, অপরিহার্য্যভাবে ক্যাথারসিস সাহিত্যের অনুভূতিসম্পন্ন গুণকে (যেভাবে আমরা সাহিত্য পাঠে সাড়া দিই) অতিমূল্যায়িত করে। যৌক্তিকভাবে বললে, ক্যাথারসিস মূলত যে সাহিত্য আমাদেরকে সবচেয়ে বেশী আন্দোলিত করে তা-ই সর্ব্বোৎকৃষ্ট সাহিত্য এরকম ইঙ্গিত দেয়।
এরিস্টোটলের মিমেসিস তত্ত্ব এবং সমাজ সাহিত্যের জন্য এটি আসলে কি অর্থ প্রকাশ করে তা নিয়ে বহু শতাব্দী ধরে মতান্তর চলছে। প্লেটো তাঁর রিপাবলিকে কবিদের নির্ব্বাসন দিয়েছিলেন; এদিকে এরিস্টোটল কবিদের সম্মানিত নাগরিক হিসেবে শহরেই রাখতে চান। জর্জ অরওয়েল তাঁর ‘Outside the Whale’ প্রবন্ধে ভিন্নমত পোষণ করেন। অরওয়েলের মতে, লেখকদের আসলে (মনে মনে) নির্ব্বাসনেই থাকা উচিৎ। সমাজ (বিশেষ করে সমগ্রতাবাদী সমাজ) ঘরোয়া লেখকদের গিলে খায়, যেমনটা লেভিয়াথান করে জোনাহকে। আলেকজান্ডার সলঝেনিতসিনের জন্য ১৯৭৩ সালে নির্ব্বাসিত হওয়া দেশে থেকে সুবিধাভোগী সোভিয়েত লেখক ইউনিয়নের সদস্য হওয়া অপেক্ষা উত্তম ছিল।
অরওয়েলের বিবেচনা হলো, কৌশলগত কারণে, বুকে বুলেট খাওয়ার চেয়ে বাইরে (নির্ব্বাসনে) বন্ধুক হাতে নিয়ে থাকা ভাল। আরো আধুনিক ভাবধারায়, জেমস জয়েস মনে করেন, লেখকের একটি ‘নিরব, নির্ব্বাসনের মত, এবং ধূর্ত’ পরিস্থিতি তৈরি করা উচিৎ।
মার্ক্সবাদী লেখক বের্টোল্ড ব্রেশট এরিস্টোটলের মিমেসিসের বিপরীতে গিয়ে এমন নন্দনতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করেন যে তাঁর সাহিত্য বা নাটক এতো সম্মোহনীয়ভাবে বাস্তব যে আমরা তাঁর ভেতর ঢুকে অন্য জগতে হারিয়ে যাই। ব্রেশট জোর দিয়ে বলেন, আমাদের কঠোরভাবে মিমেসিসের প্রলোভন প্রতিহত করা উচিত। মিমেসিস সাহিত্যের মাদক। (মাদক থেকে দূরে থাকা কর্ত্তব্য।) এই তর্ক চলতেই থাকে এবং যতোদিন শিল্প-সাহিত্য আছে মতবিরোধ চলবে।
[ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের লর্ড নর্থক্লিফ ইমেরিটাস প্রফেসর, লেখক, এবং কলামিস্ট জন এন্ড্রু সাদার্ল্যাণ্ডের 50 Literature Ideas You Really Need to Know অবলম্বনে লিখিত।]
হাসিব উল ইসলাম
জন্ম: ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে, কুষ্টিয়ায়।
ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক
(বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা সেনানিবাস।)
কবিতা, অনুবাদ ও শিল্পসাহিত্য বিষয়ক লেখালেখিতে বিশেষ আগ্রহী।
প্রকাশনা:
কবিতা, বাংলা থেকে ইংরেজি কবিতা, চিত্রকলা সম্পর্কিত লেখার অনুবাদ, বিদেশী গল্প-কবিতার অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও পত্রিকায়।